Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

রক্ত শুধু লাল নয়, হতে পারে বিভিন্ন বর্ণের!

মানুষের রক্ত লাল বর্ণের হয়ে থাকে। আর আমরা সচরাচর এই লাল বর্ণের রক্ত দেখতেই অভ্যস্ত। কিন্তু কিছু কিছু প্রাণীর এবং মানুষের রক্তও নানা কারণে অথবা কোনো কারণ ছাড়াই ভিন্ন বর্ণের হতে পারে। রক্ত সমগ্র শরীরে অনেক গুরুত্বপূর্ণ পদার্থ বহন করে। মানুষ ছাড়াও অন্যান্য প্রাণীদেহেও রক্ত প্রায় মোটামুটি একই ধরনের কাজ করে।

হিমোগ্লোবিনযুক্ত লোহিত কণিকা; Source: healthjade.com

রক্তের লোহিত কণিকায় হিমোগ্লোবিনের উপস্থিতির জন্য তা লাল দেখায়। হিমোগ্লোবিন হচ্ছে শ্বাস-প্রশ্বাস সম্বন্ধীয় একধরনের লৌহসমৃদ্ধ রঞ্জক প্রোটিন। এই রঞ্জক প্রোটিন কোষ-কলায় অক্সিজেন পরিবহন করে। মানুষের শরীরে অক্সিজেনযুক্ত রক্ত দেখতে উজ্জ্বল লাল এবং অক্সিজেন বিহীন রক্ত গাঢ় লাল অথবা গাঢ় তামাটে বর্ণের হয়ে থাকে। মানুষের রক্ত যদি লাল না হয়, তবে ধরে নেয়া যায় তার স্বাস্থ্যগত সমস্যা রয়েছে। যদি মানব রক্তের হিমোগ্লোবিনের কোনো প্রকার অস্বাভাবিক গঠন দেখা যায়, তবে রক্ত বাদামী অথবা সবুজ হতে পারে।

মিথহিমোগ্লোবিনেমিয়ার ফলে হওয়া ব্লু বেবি সিন্ড্রোম; Source: pinterest.com

অনেক সময় মানুষের ত্বক, বিশেষ করে ঠোঁট ও আঙুলে নীলাভ বর্ণ দেখা যায় এবং রক্ত চকলেট-বাদামী রঙের হয়ে থাকে। এই অবস্থাকে বলা হয় মিথহিমোগ্লোবিনেমিয়া। মানব শরীরে এক বিশেষ ধরনের হিমোগ্লোবিন পাওয়া যায়, যাকে মিথহিমোগ্লোবিন বলা হয়। এই মিথহিমোগ্লোবিনও রক্তের মাধ্যমে অক্সিজেন বহন করে। কিন্তু এই অক্সিজেন শরীরের কোষে প্রদান করে না। যদি শরীর অতিরিক্ত মিথহিমোগ্লোবিন উৎপন্ন করে, তবে তা স্বাভাবিক হিমোগ্লোবিনকে সরিয়ে দিতে থাকে। ফলে কোষ পর্যাপ্ত অক্সিজেন পেতে ব্যর্থ হয়। এভাবে ত্বক নীলাভ বর্ণ ও রক্ত চকলেট-বাদামী বর্ণের হয়ে থাকে। এসব ক্ষেত্রে মানবদেহে নানা ধরনের জটিলতা দেখা দিতে পারে। এমনই একটি জটিলতা হচ্ছে ‘ব্লু বেবি সিনড্রোম’। ‘ব্লু বেবি সিনড্রোম’ একইভাবে নাইট্রেট এর বিষক্রিয়ার মাধ্যমেও ঘটতে পারে। ছোট বাচ্চায় ত্বক নীল হলে কুসংস্কারবশত অনেকেই মনে করেন বাচ্চাকে ভূতে ধরেছে। ফলে তারা তাবিজ-কবজের জন্য ছুটতে থাকেন। আর এভাবেই করুণ মৃত্যুর দিকে চলে যেতে পারে প্রিয় সন্তানটি।

সালফো-হিমোগ্লোবিনেমিয়ার ফলে পাওয়া যায় সবুজ রক্ত; Source: feedrum.club

মানব শরীরে কালেভদ্রে সবুজ বর্ণের রক্তের দেখা মিলতে পারে। দীর্ঘদিন ধরে ক্রমাগতভাবে বা অতিরিক্ত সালফারযুক্ত ওষুধ ব্যবহারের ফলে এই অবস্থার সৃষ্টি হতে পারে। এক্ষেত্রে লোহিত রক্ত কণিকায় থাকা হিমোগ্লোবিনের সাথে সালফার যোগ হয়ে সবুজ রাসায়নিক পদার্থ সালফো-হিমোগ্লোবিন তৈরি করে। এই পরিবর্তিত যৌগ আর অক্সিজেন বহন করতে পারে না।

মিথহিমোগ্লোবিনের সমস্যা চিকিৎসা দ্বারা সুস্থ হয়ে উঠলেও সালফো-হিমোগ্লোবিনের ক্ষেত্রে চিকিৎসার দ্বারা হিমোগ্লোবিনকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনা যায় না। সাধারণত লোহিত রক্ত কণিকার প্রতি ১২০ দিন পর পর ভাঙনের মাধ্যমে এ সমস্যা ঠিক হয়ে উঠতে পারে। অপরদিকে এমন সবুজ রক্ত দেখা গেলে সালফারযুক্ত যে ওষুধ দায়ী, তা সেবন বন্ধ করতে হবে।

উপরিউক্ত কথাগুলোর দ্বারা জানা গেল, মানবদেহের স্বাভাবিক রক্তের বর্ণ দেখাবে লাল। যদি লাল বর্ণ ছাড়া ভিন্ন বর্ণ দেখায়, তবে তাকে স্বাভাবিক রক্ত বলা যায় না। এমতাবস্থায় হতে পারে ভিন্ন বর্ণের রক্তধারী ব্যক্তিটি কোনো রোগে ভুগছে অথবা কোনো রোগে সে আক্রান্ত হতে যাচ্ছে। এখন যদি লাল বর্ণ ছাড়া অন্য কোনো বর্ণ যেমন– সবুজ, হলুদ, নীল ইত্যাদি বর্ণ অন্যান্য প্রাণীতে পাওয়া যায় তবে কি সেগুলোও রোগের কারণ নির্দেশ করে? আদৌ কি এমন বিচিত্র বর্ণের রক্তের অস্তিত্ব আছে? চলুন ঘুরে আসা যাক প্রাণীজগৎ থেকে।

সবুজ রক্তবিশিষ্ট প্রাণী

নিউগিনি এবং দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপপুঞ্জে প্রাপ্ত এক শ্রেণির স্কিন্কস এর রক্ত পীতাভ সবুজ বর্ণের হয়ে থাকে। স্কিন্কসের আওতায় রয়েছে বিভিন্ন প্রজাতির গিরগিটি। এরা Scincidae গোত্রের অন্তর্ভুক্ত Prasinohaema গণের প্রাণী। গ্রিক শব্দ Prasino এর অর্থ হচ্ছে সবুজ এবং haema শব্দের অর্থ হচ্ছে রক্ত। অর্থাৎ এই গণের অন্তর্ভুক্ত প্রাণীর রক্তের বর্ণ হবে সবুজ।

এই গিরগিটির হাড়, পেশী, কলা, জিহ্বা ইত্যাদি সবুজ বর্ণযুক্ত © CHRISTOPHER AUSTIN

সবুজ রক্তের এই প্রাণী ১৯৬৯ সালে প্রথম আবিষ্কৃত হলেও তেমন আলোচনায় ছিল না। তবে লুইজিয়ানা স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক ক্রিস্টোফার অস্টিনের গবেষণার পর এই প্রাণীগুলোর বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য আলোচনায় উঠে আসে। তিনি বলেন, এই গিরগিটির সবুজ বর্ণ শুধু তার রক্তের মাঝেই সীমাবদ্ধ নয়। প্রাণীগুলোর হাড়, পেশী, কলা, জিহ্বা, শ্লৈষ্মিক ঝিল্লিও সবুজ বর্ণযুক্ত হয়ে থাকে।

সবুজ রক্ত বিশিষ্ট গিরগিটির রক্তে প্রচুর পরিমাণ বিলিভারডিন থাকে। বিলিভারডিন বা সবুজ পিত্তরস সাধারণত হিমোগ্লোবিনের ভাঙনের ফলে উৎপন্ন হয়। এই রস অতিরিক্ত উৎপন্ন হলে তা বিষাক্ত হয়। মানুষের ক্ষেত্রে এরূপ হলে তাকে জন্ডিস বলা হয়। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে গিরগিটি মানুষের চেয়ে ৪০ গুণের অধিক পরিমাণ বিলিভারডিন ধারণ করেও সুস্থ রয়ে গেছে। অর্থাৎ মানুষের জন্য যা মারাত্মক বিষাক্ত, তা এই সবুজ রক্তের গিরগিটির জন্য অতি স্বাভাবিক বিষয়।

নীল রক্তবিশিষ্ট প্রাণী

ওষুধ প্রস্তুতকারকদের কাছে খুবই প্রয়োজনীয় হর্স স্যু ক্র্যাবের সবুজাভ নীল রক্ত; Source: npr.org

আশ্চর্যজনক হলেও সত্য, অনেক প্রাণীর রক্ত নীল বর্ণের হয়ে থাকে। আর্থ্রোপোডা পর্বের প্রাণী (মাকড়শা, হর্স স্যু ক্র্যাব বা কাঁকড়া, লবস্টার), কিছু ক্রাস্টেশিয়ান উপপর্বের প্রাণী, অধিকাংশ শামুকজাতীয় প্রাণী বা মলাস্কা পর্বের প্রাণীর (অক্টোপাশ, স্কুইড, কাটলফিশ, শামুক, স্লাগ, ঝিনুক ইত্যাদি) রক্তের বর্ণ নীল হয়ে থাকে।

বামে হর্স স্যু বা ঘোড়ার পায়ে পড়ানোর জন্য ধাতব জুতা এবং ডানে অনুরূপ দেখতে হর্স স্যু ক্র্যাব; Source: lapelpinplanet.com

এ সকল প্রাণীর রক্তে অনেক বেশি পরিমাণ কপার থাকে। সাধারণত মানুষের ক্ষেত্রে লৌহের সাথে অক্সিজেন যুক্ত হলেও এসব প্রাণীর ক্ষেত্রে কপার ও অক্সিজেন মিলিত হয়। কপার অক্সিজেনের সাথে যুক্ত হয়ে নীল বর্ণের রক্ত তৈরি করে। কপারযুক্ত এই প্রোটিনকে বলা হয় হিমোসায়ানিন। হিমোসায়ানিন বিশিষ্ট রক্তের প্রাণীদের বাহ্যিকভাবে সাধারণত বেগুনি দেখায়।

হলুদ বর্ণের হিমোলিম্ফের পতঙ্গ

আর্থ্রোপোডা পর্বের অন্তর্গত বিভিন্ন ধরনের কীটপতঙ্গগুলোতে ফ্যাকাসে হলুদ, ফ্যাকাসে সবুজ অথবা বর্ণহীন  হিমোলিম্ফ থাকে। হিমোলিম্ফ হচ্ছে রক্ত সমতূল্য তরল পদার্থ, যা পতঙ্গদেহের হিমোসিলে থাকে। হিমোসিল হচ্ছে কীটপতঙ্গের রক্ত সমৃদ্ধ দেহগহ্বর।

মানুষের রক্তের থেকে ভিন্ন বর্ণের রক্তবিশিষ্ট পতঙ্গ; Source: indianapublicmedia.org

কীটপতঙ্গের রক্ত বা হিমোলিম্ফ প্রবাহের পদ্ধতি মানুষ থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। কীট-পতঙ্গের দেহে কোনো প্রকার রক্তনালী থাকে না। এই রক্ত কোনো অক্সিজেনও পরিবহন করে না। এরা প্রোটিন এবং অন্যান্য পুষ্টি উপাদান বহনের কাজ করে। এই প্রোটিন বা পুষ্টি উপাদান অর্থাৎ গৃহীত খাদ্যের উপরই হিমোলিম্ফের বর্ণ বিভিন্ন রকম হয়ে থাকে। এজন্যই মশা মারার পর লাল রক্ত দেখা যায়। তবে এই রক্ত হচ্ছে অন্যান্য প্রাণীদেহ থেকে শুষে নেয়া রক্ত। অপরদিকে, মাছি মারার পর যে লালচে বর্ণ দেখা যায়, তা আসে মাছির চোখের রঞ্জক পদার্থ থেকে।

কমলা বর্ণের হিমোলিম্ফের পতঙ্গ

আমাদের সকলের পরিচিত একটি প্রাণী হচ্ছে তেলাপোকা। এদের পুরুষ ও স্ত্রী লার্ভার রক্ত বা হিমোলিম্ফ হচ্ছে বর্ণহীন। পূর্ণাঙ্গ স্ত্রী তেলাপোকার যখন ডিম উৎপাদন করার সময় আসে, তখন তার রক্ত কমলা বর্ণ ধারণ করে। ভাইটেলোজেনিন নামক একপ্রকার প্রোটিনের উপস্থিতির জন্য এই বর্ণ কমলা রংয়ের হয়। যকৃতে তৈরি হওয়া এই প্রোটিন হিমোলিম্ফে নিঃসৃত হয়ে কমলা বর্ণ প্রদান করে।

কমলা বর্ণের হিমোলিম্ফ পাওয়া যায় ডিম উৎপাদনকালে স্ত্রী তেলাপোকায়; Source: Wikimedia commons

ভাইটেলোজেনিন থেকে ডিমের কুসুমের প্রোটিন ভাইটেলিন তৈরি হয়। এই প্রোটিন মুরগির ডিমের কুসুমের মতোই কাজ করে। এরা ‍হিমোলিম্ফের মাধ্যমে বাহিত হয়ে ডিম্বাশয়ে ভিটামিনের মতো পুষ্টি অণু প্রদান করে ভ্রুণ বৃদ্ধিতে সহায়তা করে।

ফিচার ইমেজ-  npr.org

Related Articles