শিশু থেকে শুরু করে বয়োবৃদ্ধ, সকল বয়সের মানুষের নিকট অবসর যাপনের একটি আকর্ষণীয় নাম চিড়িয়াখানা। মানুষের সমাজের বাইরে অরণ্যানী, সমুদ্র, পাহাড়-পর্বত আর মরুভূমিতে বসবাসকারী পশুপাখি সচরাচর দেখার সুযোগ হয়ে ওঠে না। তবে সুযোগ করে দেয় চিড়িয়াখানা। পৃথিবীর বৃহত্তম চিড়িয়াখানাগুলো নানা রঙের, আকারের, বৈশিষ্ট্যের প্রাণীদের এমন বৈচিত্র্যময় পসরা সাজিয়ে রেখেছে যে একটি চিড়িয়াখানা ঘুরে আসলে পৃথিবীর তাবৎ জীববৈচিত্র্য সম্পর্কে মোটামুটি জ্ঞান নিয়ে ফেরা সম্ভব। এ পর্বে, প্রাণী সংখ্যার ভিত্তিতে পৃথিবীর বৃহত্তম ১০টি চিড়িয়াখানার কথাই তুলে ধরা হয়েছে।
১০. স্যান ডিয়েগো চিড়িয়াখানা
ক্যালিফোর্নিয়ার স্যান ডিয়েগোতে অবস্থিত ‘স্যান ডিয়েগো’ চিড়িয়াখানা’ আয়তনে এবং প্রাণীর সংখ্যায় পৃথিবীর অন্যতম বৃহত্তম। ১০০ একর জায়গা জুড়ে বিস্তৃত এই চিড়িয়াখানায় ৬৫০ এর অধিক প্রজাতি আর উপ-প্রজাতির পশুপাখি রয়েছে ৩৭০০ এর অধিক। পৃথিবীর হাতেগোনা কিছু চিড়িয়াখানার মধ্যে স্যান ডিয়েগো একটি, যেখানে জায়ান্ট পান্ডা আছে। প্রতিবছর লাখো মানুষ এ চিড়িয়াখানাটিতে আসে। ৫ লক্ষাধিক মানুষের রয়েছে চিড়িয়াখানার আনুষ্ঠানিক সদস্যপদ। প্রতিদিন সকাল ৯টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত খোলা থাকে এ চিড়িয়াখানা। দর্শনার্থীদের জন্য যাবতীয় সুবিধা সম্বলিত এ চিড়িয়াখানার খরচও অনেক। এন্ট্রি ফি প্রাপ্ত বয়স্কদের জন্য ৪,৫০০ টাকা ও শিশুদের জন্য ৩,৫০০ টাকা।
৯. ব্রংক্স চিড়িয়াখানা
আমেরিকার নিউ ইয়র্ক শহরের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত ব্রংক্স চিড়িয়াখানাকে বলা হয় পৃথিবীর প্রাচীনতম মেট্রোপলিটন চিড়িয়াখানা। তাছাড়া পৃথিবীর জনপ্রিয় মেট্রোপলিটন চিড়িয়াখানাগুলোর মধ্যে এটিই সর্ববৃহৎ। প্রায় ২৬৫ একর জায়গা জুড়ে বিস্তৃত এই চিড়িয়াখানাটি মূলত ৪টি পৃথক চিড়িয়াখানা এবং একটি অ্যাকুরিয়ামের সমন্বয়ে গঠিত।
এখানে মোট পশুপাখির সংখ্যা ৪ হাজারের বেশি। বেবুন, পাহাড়ি চিতা, বাইসন আর হিমালয়ান ভাল্লুক এখানকার মূল আকর্ষণ। তবে পৃথক পৃথক সময়ে দুটি পৃথক ঘটনায় দুজন মানুষের মৃত্যুর কারণে এ চিড়িয়াখানাটি দু’বার বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। পরবর্তীকালে কর্তৃপক্ষের গৃহীত নিরাপত্তা ব্যবস্থা এর জনপ্রিয়তা পুনরায় ফিরিয়ে এনেছে। প্রতি বছর ২০ লক্ষাধিক দর্শনার্থী ব্রংক্স চিড়িয়াখানায় ভ্রমণ করে। চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষের আশা, ২০১৯ সাল থেকে সংখ্যাটা আরো অনেক বাড়বে। কেননা, এ বছর আরো হাজারখানেক পশুপাখি সংযোজনের পরিকল্পনা আছে। স্যান ডিয়েগোর তুলনায় এর প্রবেশমূল্য অনেক কম। বয়স্কদের জন্য ২,০০০ হাজার টাকা আর শিশুদের জন্য ১,২০০ টাকা।
৮. টরন্টো চিড়িয়াখানা
৭১০ একর জমির উপর স্থাপিত টরন্টো চিড়িয়াখানা কানাডার তো বটেই, পৃথিবীরই অন্যতম বৃহত্তম চিড়িয়াখানা। একে পৃথিবীর সবচেয়ে কম ঘনবসতির চিড়িয়াখানাও বলা হয়। এত বিশাল জায়গা জুড়ে বিস্তৃত এ চিড়িয়াখানায় প্রাণীর সংখ্যা মাত্র ৫ হাজার। বছরে গড়ে ১৩ লক্ষ মানুষ এ চিড়িয়াখানায় ঘুরতে আসে। টরন্টো চিড়িয়াখানার মূল আকর্ষণ এর বৈচিত্র্য। পৃথিবীর সকল জীববৈচিত্র্যময় অঞ্চলের প্রাণীই রয়েছে এ চিড়িয়াখানায়। তাদেরকে রাখা হয়েছে পৃথকভাবে, তাদের নিজস্ব অঞ্চলের বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী পরিবেশ সৃষ্টি করে। বিশাল জায়াগা জুড়ে ঘুরে ঘুরে দেখবার জন্য এর ভেতরে রয়েছে চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষ পরিচালিত নিজস্ব পরিবহন ব্যবস্থা। এখানে বড়দের প্রবেশমূল্য ২ হাজার টাকা ও শিশুদের ১,৩০০ টাকা।
৭. কলম্বাস চিড়িয়াখানা
আবারো ফিরছি আমেরিকায়। যুক্তরাষ্ট্রের ওহিও অঙ্গরাজ্যে অবস্থিত কলম্বাস চিড়িয়াখানাটি আয়তনে ৫৩০ একর। ৭ হাজারের অধিক প্রাণীকে জায়গা করে দেয়া এ চিড়িয়াখানা আমেরিকার বৃহত্তম চিড়িয়াখানাও বটে। উত্তর আমেরিকা, দক্ষিণ আমেরিকা, মেরু অঞ্চল, এশিয়া, আফ্রিকা আর অস্ট্রেলিয়ার প্রধান জীববৈচিত্র্যপূর্ণ অঞ্চলগুলো থেকে আনা হয়েছে এ প্রাণীগুলো। তবে এখানকার মূল আকর্ষণ মেরুদেশীয় নেকড়ে, আর্কটিক শিয়াল, বাদামী ভাল্লুক, মেরু ভাল্লুক আর ৪০ প্রজাতির বিরল গায়কপাখি।
জীববৈচিত্র্যের পাশাপাশি যে বিষয়টি এ চিড়িয়াখানাকে অনন্য করে রেখেছে, তা হলো জীববৈচিত্র্য রক্ষায় এর অবদান। এ চিড়িয়াখানাটি মূলত অলাভজনক। দর্শনার্থীদের নিকট টিকিট বিক্রি করে করা আয় থেকে কর্মচারীদের বেতন মেটানোর পর পুরোটাই ব্যয় করা হয় জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে গৃহীত বিভিন্ন উদ্যোগে।
৬. মস্কো চিড়িয়াখানা
রাশিয়ার সর্ববৃহৎ এবং সর্বপ্রাচীন মস্কো চিড়িয়াখানা ১৮৬৪ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৯০ সালে এ চিড়িয়াখানার বড় ধরনের সংস্কার কাজ করা হয়, যুক্ত করা হয় একটি অ্যাকুরিয়াম। তথাপি ৫৪ একর আয়তনের চিড়িয়াখানাটি আয়তনে এ তালিকার অপরাপর চিড়িয়াখানাগুলোর চেয়ে বেশ ছোট। এর বিশেষত্ব হলো পুরোটা জুড়ে পদব্রজে চলার ব্রিজ, যা দিয়ে উপর থেকে প্রাণীগুলোকে দেখার সুযোগ মেলে। হাজারখানেক প্রজাতির আট হাজার প্রাণীর বাসস্থান এই মস্কো চিড়িয়াখানা। শ্লথ, ক্যাঙারু, বিরল হাতি, বাইসন, মেগাব্যাট (বড় আকৃতির ব্যাট) আর শতাধিক প্রজাতির পাখি দেখতে এ চিড়িয়াখানায় বছরে দু’লক্ষাধিক দর্শনার্থীর আগমন ঘটে থাকে।
৫. ন্যাশনাল জ্যুলজিক্যাল গার্ডেন অব সাউথ আফ্রিকা
দক্ষিণ আফ্রিকার প্রিটোরিয়ায় অবস্থিত ‘ন্যাশনাল জ্যুলজিক্যাল গার্ডেন অব সাউথ আফ্রিকা’ চিড়িয়াখানাটি আফ্রিকা মহাদেশের বৃহত্তম। ২১০ একর জমির উপর অবস্থিত এ চিড়িয়াখানাটিতে আছে ৯ হাজারের অধিক প্রাণীর আবাস। ১৮৯৯ সাল থেকে জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত এ চিড়িয়াখানা পৃথিবীর অন্যতম প্রাচীন চিড়িয়াখানাও বটে। কৃত্রিম আফ্রিকান সাবানা (একপ্রকার তৃণভূমি), বিশাল বিশাল কয়েকটি পক্ষীশালা আর ক্যাবলওয়ের ব্যবস্থাই এ চিড়িয়াখানার মূল আকর্ষণ। তাছাড়া চিড়িয়াখানার মাঝে দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে একটি ছোট নদী, যা এর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের মাত্রাবর্ধন করেছে। বিশাল এ চিড়িয়াখানাটির প্রবেশমূল্য তুলনামূলকভাবে কম, মাত্র ৭০০ টাকা। প্রতি বছর ৬০ লাখ টিকিট বিক্রি করে প্রিটোরিয়ার এই চিড়িয়াখানা।
৪. বেইজিং চিড়িয়াখানা
হাজারখানেক প্রজাতির ১৪,৫০০টি প্রাণীর বাস বেইজিং চিড়িয়াখানায়, যা একে করেছে পৃথিবীর অন্যতম বৃহত্তম চিড়িয়াখানা। বিশালাকার চীনা স্যালামান্ডার, জায়ান্ট পান্ডা আর দক্ষিণ চীনের এক বিরল প্রজাতির বাঘ রয়েছে এ চিড়িয়াখানায়, যা এর মূল আকর্ষণ। ২২০ একর জমিতে নির্মিত এ চিড়িয়াখানাটির আসল সৌন্দর্য এর পরিকল্পিত ও সুসজ্জিত পার্কগুলো। একবার ভেতরে প্রবেশ করলে দর্শনার্থীরা ক্ষণে ক্ষণে ভুলেই যাবেন যে তারা কোনো চিড়িয়াখানায় রয়েছেন। বরং একে একটি বিশাল প্রাকৃতিক বনই মনে হবে বেশি।
১৯০৬ সালে কার্যক্রম শুরু করা এ চিড়িয়াখানায় দর্শনার্থীর সংখ্যা পৃথিবীর যেকোনো চিড়িয়াখানার চেয়ে বেশি। বছর ৬০ লক্ষাধিক মানুষ একবার করে ঘুরে যায় বেইজিং চিড়িয়াখানায়। সংখ্যাটা এত বেশি হবার একমাত্র কারণ কি চীনের জনসংখ্যা মনে হচ্ছে? না, এ তালিকার সবচেয়ে সস্তা চিড়িয়াখানাও বেইজিংয়ের এই চিড়িয়াখানাটিই। বাংলাদেশি টাকায় মাত্র ৩০০ টাকা খরচ করেই আপনি দেখে আসতে পারবেন হাজার প্রজাতির পশুপাখি!
৩. হেনরি ডোরলি চিড়িয়াখানা
যুক্তরাষ্ট্রের মানুষ পশুপাখি ভালোবাসে। কোনো গবেষণালব্ধ তথ্য ছাড়াই আপনি এ কথা অনায়াসে বলে দিতে পারেন। কারণ পৃথিবীর বৃহত্তম চিড়িয়াখানার তালিকায় সবচেয়ে বেশি সংখ্যক নাম যুক্তরাষ্ট্র থেকেই। ১৮৬৪ সালে প্রতিষ্ঠিত হেনরি ডোরলি চিড়িয়াখানা এ তালিকায় ৩য় স্থানে আছে। এটি আমেরিকার সবচেয়ে প্রাচীন চিড়িয়াখানাও বটে।
নেব্রাস্কায় অবস্থিত এ চিড়িয়াখানাটি ১৭ হাজার প্রাণীর বাসস্থান। এটি পরিচিত এর বিশাল জিওডেসিক ডোম আর পৃথিবীর বৃহত্তম ইনডোর মরুভূমির জন্য (চিড়িয়াখানার ভেতরে সৃষ্ট কৃত্রিম মরুভূমি)। তাছাড়া এখানকার ৯৬২ প্রজাতির প্রাণীদের নিয়ে প্রতিনিয়ত চলছে উন্নত গবেষণা। সেসব গবেষণা আবার সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত। অন্যদিকে, প্রাণীদের স্বাস্থ্য সুরক্ষার দায়িত্বটিও চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষ নিপুণভাবে পালন করে। কর্তৃপক্ষের দাবি, পৃথিবীর সবচেয়ে কম প্রাণীমৃত্যুর হার এ চিড়িয়াখানাতেই। সামান্য নাস্তাসহ পুরো হেনরি ডোরলি চিড়িয়াখানা ঘুরে দেখতে প্রাপ্তবয়স্কদের খরচ করতে হবে ১,৬০০ টাকা, শিশুদের ১,০০০ টাকা।
২. লন্ডন চিড়িয়াখানা
পৃথিবীর দ্বিতীয় প্রাচীনতম চিড়িয়াখানা ‘লন্ডন চিড়িয়াখানা’ নির্মিত হয়েছিল ১৮২৮ সালে। প্রাথমিকভাবে কেবল বৈজ্ঞানিক গবেষণার খাতিরে নির্মিত এ চিড়িয়াখানাটি জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হয় ১৮৪৭ সালে। ১৮৪৭ সালকেও যদি এর প্রতিষ্ঠাকাল ধরা হয়, এটিই পৃথিবীর দ্বিতীয় প্রাচীনতম চিড়িয়াখানা, পৃথিবীর সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণও বটে! যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী লন্ডনের কেন্দ্রবিন্দুতে হওয়ায় পরবর্তীকালে বর্ধনের জন্য জমিই পায়নি এটি। কিন্তু তা-ই বলে কর্তৃপক্ষ কিন্তু বসে থাকেনি। মাত্র ৩৭ একর জমির উপর অবস্থিত এ চিড়িয়াখানায় প্রাণীর সংখ্যা ধীরে ধীরে বাড়তে বাড়তে ছাড়িয়েছে ২০ হাজারের মাইলফলক, যা সংখ্যার দিক দিয়েও একে করেছে পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম চিড়িয়াখানা।
বড়দিন বাদে বছরের ৩৬৪ দিনই খোলা থাকে এটি। কেবল পশুপাখি প্রদর্শন করে অর্থ উপার্জন নয়, সেগুলো নিয়ে সচেতনতা সৃষ্টিতে কাজ করার জন্যও সুনাম রয়েছে চিড়িয়াখানাটির। অনলাইনে টিকিট কাটলে ২,৫০০ টাকা, চিড়িয়াখানায় গিয়ে কাটলে কিছুটা বেশিও হতে পারে। সকল বয়সের দর্শনার্থীর জন্য টিকিটের মূল্য এখানে সমান।
১. বার্লিন জ্যুলজিক্যাল গার্ডেন
প্রাণীর সংখ্যা বলুন আর প্রাণীবৈচিত্র্য বলুন, সব দিক থেকেই ‘বার্লিন জ্যুলজিক্যাল গার্ডেন’ অতুলনীয়। এ চিড়িয়াখানায় সর্বমোট ১,৩৮০ প্রজাতির প্রাণী রয়েছে। আর প্রাণীর সংখ্যাটা ২০১৭ সালে ২০,২০০ ছাড়িয়েছে। তাছাড়া, পৃথিবীর বৃহত্তম অ্যাকুরিয়ামের মর্যাদাও বার্লিন চিড়িয়াখানারই। এর অ্যাকুরিয়ামে ৫৬২ প্রজাতির মাছ রয়েছে। জার্মানি তো বটেই, ইউরোপের সবচেয়ে জনপ্রিয় এ চিড়িয়াখানায় বছরে ৩৫-৪০ লক্ষাধিক মানুষ ঘুরতে আসে। কিছু বিরল প্রজাতির পাখি, সরীসৃপ আর আর্কটিক নেকড়ের জন্য বিখ্যাত এই চিড়িয়াখানা। এ প্রাণীগুলো দেখতে হলে খরচ করতে হবে বাংলাদেশি হিসেবে ১,৫০০ টাকা।
এই সম্পর্কে আরও জানতে পড়ুন এই বইগুলো
১) চিড়িয়াখানা, ম্যানেজমেন্ট, জ্যু এডুকেশন, বন্যপ্রাণীদের পরিচয়, খাবার ও অন্যান্য
২) এই দুনিয়ার চিড়িয়াখানা