Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

চিড়িয়াখানায় বন্দিদশা এবং প্রাণীকূলের সংকট

চিড়িয়াখানা বলতেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে শক্ত শিকের ফ্রেমের পেছনে ঘুরে বেড়ানো পশু-পাখি, সাপ-খোপ, নানা ধরনের সরীসৃপ ও নাম না জানা আরো অনেক প্রাণী। ছেলে থেকে শুরু করে বুড়ো, সবাই সময় পেলে ছুটির দিনে কিছুটা সময় কাটানো এবং প্রাণিজগত সম্পর্কে জানার উদ্দেশ্য চিড়িয়াখানায় গিয়ে থাকে। বাদামের ঠোঙা হাতে অলস পায়ে এক খাঁচা থেকে অন্য খাঁচার সামনে দিয়ে প্রদক্ষিণ করা- এমন দৃশ্য চিড়িয়াখানায় হরহামেশাই দেখা যায়।

Source: onegreenplanet.org

বনের ছত্রছায়ায় স্বাধীনভাবে ঘুরে বেড়ানো প্রাণীগুলোকে খাঁচায় বন্দী করে জনসম্মুখে প্রদর্শন করার মাধ্যমে মানুষের বিনোদন ব্যবস্থার প্রচলনটা শুরু হয়েছিল বেশ কয়েক শতক আগে থেকেই। সর্বপ্রথম জাগুয়ার এবং বানর- এই দুই প্রাণীকে খাঁচাবন্দী করার মাধ্যমে চিড়িয়াখানার পথচলা শুরু হয়।

শুরুতেই কিছু বাস্তব ঘটনার উল্লেখ করা হচ্ছে, যা থেকে স্পষ্ট প্রমাণ হয় যে বন্দিদশা প্রাণীদের মাঝে তৈরি করেছে নানা ধরনের মানসিক বৈকল্য, ঠেলে দিয়েছে অস্বাভাবিক জীবনযাপনের দিকে।

গরিলা

গরিলা; Source: onegreenplanet.org

গহীন অরণ্যে বসবাসকারী প্রচন্ড শক্তিধর এক বন্য প্রাণীর নাম গরিলা। অনেকে গরিলাকে সামাজিক জীব বলে থাকেন, কারণ এরা একে অন্যের প্রতি ভালোবাসা প্রদর্শন করে, সুখ-দুঃখের অনুভূতি প্রকাশ করে এবং খেলাধুলায় মেতে থাকে। গরিলা যথেষ্ট লাজুক এবং ভদ্র স্বভাবের একটি প্রাণী।

এই প্রাণীকে বিভিন্ন সময়ে যখন খাঁচায় আবদ্ধ করে চিড়িয়াখানাকে আবাসস্থল হিসেবে নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে, তখন তাদের মাঝে বিষণ্ণতা এবং পালিয়ে যাওয়ার প্রবণতা ব্যাপকভাবে লক্ষ্য করা গেছে। প্রায় ১৪টি চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষ থেকে জানা গেছে যে, বন্দিদশার কারণে বেশ কিছু গরিলা বিষণ্ণতায় ভুগছিল এবং এর মাত্রা এতটাই বেড়ে গিয়েছিল যে হ্যালডল, প্রোযাক এর মতো ঔষধ দিয়ে তাদের পাগলামিকে নিয়ন্ত্রণে আনতে হয়েছিল।

হাতি

খাঁচায় আবদ্ধ হাতি; Source: onegreenplanet.org

স্থলভাগের সর্বাপেক্ষা বড় প্রাণী হাতি। দিনের প্রায় ১৮ ঘন্টা হেঁটে চলা এই প্রাণীটি দলবদ্ধভাবে ঘুরে বেড়ায় এবং একজন মেয়ে হাতির নেতৃত্বে পথ পরিক্রম করে থাকে। হাতির দৈনন্দিন জীবনযাপনের দিকে আলোকপাত করলে দেখা যায়- খাওয়া, সাঁতার কাটা, এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় ঘুরে বেড়ানো, শূড় দিয়ে কাঁদা গায়ে ছুঁড়ে গোসল করা এবং ঘাস অথবা বালু বিস্তৃত এলাকায় বসে বিশ্রাম করা, এসব যেন হাতির রুটিন।

এই বিশালাকৃতির প্রাণীটিকে যখন চিড়িয়াখানায় নিয়ে আসা হয়, তখন তার জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণ বিস্তৃত জায়গা বা প্রাকৃতিক পরিবেশ দেয়া সম্ভব হয়ে ওঠে না। ফলে ধীরে ধীরে সে স্বাভাবিক জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন হতে থাকে। বেশিরভাগ সময় এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকতে হয়, তাই আর্থ্রাইটিসের মতো রোগের প্রকোপ দেখা যায় এবং যেহেতু সবসময় কংক্রিটের উপর দাঁড়িয়ে থাকতে হয়, তাই পায়ে নানা ধরনের ঘা বা ইনফেকশনের সংক্রমণ ঘটে থাকে। এই ঘটনাগুলো একসময় বন্দী হাতিকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়।

ভালুক

বিষণ্ণ ভালুক; Source: onegreenplanet.org

পৃথিবীতে অনেক ধরনের ভালুক আছে এবং ভালুকের বিচরণ ক্ষেত্রটাও বিস্তৃত। ভালুকেরা ঘুরে ঘুরে তাদের খাবার সংগ্রহ করে থাকে এবং মজার মজার খাবারের প্রতি এদের রয়েছে বিশেষ দুর্বলতা। ভালুকের গড় জীবনকাল ১৫ থেকে ৩০ বছর হয়ে থাকে।

কিন্তু খাঁচায় বন্দী ভালুকেরা অধিকাংশই বিষণ্ণতায় ভুগতে ভুগতে একসময় পাগলামি আরম্ভ করে। প্রকৃতির দস্যি সন্তান চার দেয়ালের বন্দিদশাটাকে ঠিক মেনে নিতে পারে না।

২০১২ সালে বাফেলো জু নামক চিড়িয়াখানা থেকে প্রায় ৪০০ পাউন্ডের একটি গরিলা সুযোগ বুঝে খাঁচা থেকে পালিয়ে যায় এবং একজন চিড়িয়াখানা কর্তব্যরত ব্যক্তিকে কামড়ে দেয়।

Source: onegreenplanet.org

প্রকৃতির বুকে দুরন্ত গতিতে ছুটে চলা প্রাণীগুলোকে যখন কৃত্রিম পরিবেশে আবদ্ধ করা হয় তখন নিয়মানুযায়ী সাধ্যমতো কিছুটা প্রাকৃতিক পরিবেশ সৃষ্টি করার কথা উল্লেখ রয়েছে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার বিবৃতি বা আইন অনুযায়ী। আবার এমনও অনেক দেশ রয়েছে যেখানে প্রাণী বন্দী এবং সুরক্ষার ব্যাপারে নেই কোনো আইন।

Source: onegreenplanet.org

যুক্তরাষ্ট্রে যদি কেউ চিড়িয়াখানা স্থাপন করতে চায়, তবে তাকে ডিপার্টমেন্ট অফ অ্যাগ্রিকালচার থেকে সনদপ্রাপ্ত হতে হবে এবং অ্যানিম্যাল ওয়েলফেয়ার অ্যাক্ট এর সব নিয়মকানুন মেনে চলতে হবে। এই আইন অনুযায়ী-

  • খাঁচায় আবদ্ধ প্রাণীদেরকে সঠিকভাবে ও পরিমাণ মতো খাবার প্রদান করতে হবে
  • পর্যাপ্ত পরিমাণে সুপেয় পানির সরবরাহ থাকতে হবে
  • বসবাস উপযোগী স্থানের ব্যবস্থা করতে হবে
  • খাঁচার মেঝে ঘাসে আবৃত না হলেও চলবে, কংক্রিটের মেঝের ব্যবস্থা করলেই হবে এবং
  • খাঁচায় পর্যাপ্ত স্থান থাকতে হবে যাতে করে প্রাণীরা সহজেই দাঁড়াতে, ঘোরাফেরা করতে ও ঘুমাতে পারে।

Source: onegreenplanet.org

দুর্ভাগ্যবশত বেশিরভাগ চিড়িয়াখানাতেই এসব নিয়মের খুব একটা পালন করার দৃশ্য চোখে পড়ে না। এমন একটা অবস্থায় প্রাণীদের রাখা হয়, যেখানে তারা তাদের স্বাভাবিক জীবনযাপন থেকে দূরে সরতে থাকে, তাদের নিজেদের জীবনযাপনের উপর থেকে নিয়ন্ত্রণ হারাতে থাকে। এমনকি তাদের চিরাচরিত খাদ্যাভ্যাস থেকেও চ্যুতি ঘটে।

Source: onegreenplanet.org

এমন কিছু প্রাণী আছে যাদের সঠিকভাবে পরিচর্যার আবশ্যকতা রয়েছে, আবার কিছু প্রাণী রয়েছে, যারা তাদের প্রজাতির অন্য প্রাণীদের সাথে আজীবন একটি বন্ধন তৈরি করে থাকে, যা স্থানান্তরের ফলে নষ্ট হয়ে থাকে (এই কারণে অনেকসময় অনেক প্রাণী বিষণ্নতায় ভুগতে থাকে)। অনেকসময় প্রাণীদের বংশবৃদ্ধির জন্য সঠিক পরিবেশ প্রদান করা হয় না। একেক প্রাণীর জীবনযাপনের ধরন একেক রকম, তাই না জেনে অনেক সময় চিড়িয়াখানায় দায়িত্বরত ব্যক্তিরা বিরূপ পরিবেশ সৃষ্টি করে থাকেন, যা প্রাণীদের প্রাণনাশের কারণ হয়ে দাঁড়ায় মাঝে মাঝে।

Source: onegreenplanet.org

চিড়িয়াখানা একদিকে যেমন বহু প্রাণীর সম্মেলনস্থল, ঠিক তেমনি এটি একটা ব্যবসাও বটে। ব্যবসায় যেমন মালামাল হাত বদল হতে থাকে, ঠিক তেমনি চিড়িয়াখানায়ও প্রাণী হাত বদল হয়। অর্থের বিনিময়ে এক চিড়িয়াখানার মালিক হতে অন্য চিড়িয়াখানার মালিকের কাছে প্রাণী হস্তান্তর হয়। এক কৃত্রিম পরিবেশে থাকতে থাকতে হঠাৎ করে নতুন এক পরিবেশ, নতুন জায়গা, নতুন দেখাশোনার লোক এবং সর্বোপরি নতুন রুটিনের সাথে মানিয়ে নিতে প্রাণীদেরকে বেশ হিমশিম খেতে হয়। একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটতে থাকলে তা তাদের জন্য অহিতকর হয়ে উঠে।

নিত্যনতুন রুটিনের সাথে মানিয়ে নিতে নিতে তারা ত্যক্ত-বিরক্ত হয়ে উঠে, পথ খুঁজে খাঁচা ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার। পথ খুঁজে না পেয়ে একসময় কিছু কিছু প্রাণী বিকারগ্রস্ত ও আত্মঘাতী হয়ে উঠে। প্রাণীদের কিছু কিছু আচরণ দেখে বোঝা যায় যে তারা এই বদ্ধ পরিবেশে হাঁপিয়ে উঠেছে এবং নিজেদের স্বাভাবিক মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছে। এমন কিছু লক্ষণ এবার জেনে নেয়া যাক-

  • বানর জাতীয় প্রাণীরা তাদের মল একে অন্যের গায়ে ছোঁড়াছুড়ি করতে থাকে এবং নিজেদের উদগিরিত বমন আবার নিজেরাই ভক্ষণ করে
  • পাখিদের ক্ষেত্রে অনেকসময় এরা নিজেদের শরীরের পালক নিজেরাই টেনে টেনে তুলে ফেলে
  • ত্যক্ত-বিরক্ত হাতিদের দেখা যায় এরা অকারণেই ক্রমাগত সামনে পিছনে দুলতে থাকে
  • পরাক্রমশালী বাঘও একসময় অসন্তোষের ফলে নেতিয়ে পড়ে, ক্রমাগত মাটিতে পদাঘাত করে নিজের বন্দীদশার জন্য বিকারগ্রস্ততা প্রকাশ করে থাকে
  • মেরুভালুককে দেখা যায় ভাবলেশহীনভাবে অনেকটা সময় ধরে পানিতে সাঁতার কাটছে তো কাটছেই
  • মাছেরাও বাদ যায় না এই তালিকা থেকে। ঘন ঘন পানির উপরিভাগে এসে মুখ বের করা অথবা যে জায়গায় মাছগুলোকে কৃত্রিমভাবে রাখা হয়েছে সেখানকার দেয়ালে অনবরত ঘা ঘষার মতো লক্ষণগুলো প্রকাশ করে নিজেদের বন্দিদশার প্রতি আক্ষেপ প্রকাশ করে থাকে।

Source: onegreenplanet.org

চিড়িখানায় ঘুরতে আসা মানুষদের কাছ থেকেও প্রাণীরা অনেকভাবে হেনস্তার শিকার হয়ে থাকে। মানুষের স্বভাবসুলভ কারণে অনেকেই অনেকসময় নিয়ম এবং সুরক্ষার কথা তোয়াক্কা না করে হাতে থাকা বাদামের ঠোঙাটা থেকে হয়ত দুই একটা বাদাম ছুঁড়ে দেয় অথবা খালি ঠোঙা, বোতল, প্লাস্টিক ব্যাগ ছুঁড়ে মারে প্রাণীগুলোকে তাক করে। কখনো কি কেউ সচেতনভাবে ভেবে দেখেছে যে, আনন্দের বশে ছুঁড়ে ফেলা এই জিনিসগুলো খাঁচার প্রাণীগুলো যদি খেয়ে ফেলে তাহলে সেটা প্রাণীদের জন্য কতটুকু স্বাস্থ্যসম্মত হবে, কিংবা এতে প্রাণনাশের আশঙ্কা নেই তো?

এবার আলোকপাত করা যাক চিড়িয়াখানায় কর্মরত ব্যক্তিদের অবহেলার দরুন হেনস্তার কিছু তথ্য সম্পর্কে। যদিও তাদের প্রধান দায়িত্ব খাঁচায় আবদ্ধ প্রাণীগুলোর সঠিক পরিচর্যা করা, কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত এই জায়গাটায়ই রয়েছে তাদের চরম অনীহা। তাদের কাজে অবহেলার কারণে প্রাণীদের প্রায়শ অভুক্ত থাকতে হয় এবং সঠিকভাবে চিকিৎসা প্রদান করা হয় না। অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে দিনের পর দিন থাকতে থাকতে একসময় অনেক প্রাণীই মৃত্যুমুখে পতিত হয়। এমনকি বন্যা বা দাবানলের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় প্রাণীগুলোকে স্থানান্তরের কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয় না। ফলশ্রুতিতে বন্যায় ডুবে বা আগুনে পুড়ে বিশ্বে প্রতি বছর বহু প্রাণী অকালে প্রাণ হারায়।

বন্দিদশা কোনো প্রাণীই ঠিক স্বাভাবিকভাবে মেনে নিতে পারে না। হোক সে অবলা বন্য প্রাণী। চার দেয়ালের শক্ত শিকের খাঁচা দিনে দিনে শুধু তাদের জীবনে হতাশা এবং দুর্ভোগ বয়ে আনে। স্বাভাবিক বিকাশকে ব্যহত করে এবং ধীরে ধীরে তাদের জীবনের উপর থেকে নিয়ন্ত্রণটা হারিয়ে যায়। আমরা যদি টিকিট কেটে চিড়িয়াখানা ভ্রমণ করা থেকে বিরত থাকি, তাহলে হয়ত  বন্যপ্রাণী সংগ্রহ এবং তাদের খাঁচায় পুরে প্রদর্শন অনেকাংশে কমে যাবে। কিছুটা সচেতনতা হয়ত বন্যপ্রাণীদের বন্দিত্বের বদলে মুক্ত আকাশের নিচে গহীন অরণ্যে ঘুরে বেড়াতে সহায়তা করবে।

ফিচার ইমেজ: digitalspy.com

Related Articles