Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

উদ্ভিদকূলের বৈচিত্র্যময় প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা

শিকারী আক্রমণ করলে শিকার ছাড়া পাওয়ার চেষ্টা করছে, পাল্টা আক্রমণ করছে, কিংবা দৌড়ে পালিয়ে যাচ্ছে- প্রাণিকুলে এমন ঘটনা হরহামেশাই ঘটে থাকে। কিন্তু কোনো তৃণভোজী প্রাণী যখন কোনো উদ্ভিদকে খেতে আসে বা ক্ষতিকর পোকামাকড় যখন উদ্ভিদের গায়ে নিজের বসতি গড়ে তোলে, তখন উদ্ভিদ কি নিজেকে রক্ষা করতে পারে? কীভাবে আক্রমণের হাত থেকে সে বাঁচায় নিজেকে? উদ্ভিদকুলের বৈচিত্র্যময় কিছু প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার কথা জানাতেই এই আয়োজন।

প্রতিকূল অবস্থা মোকাবেলা করার জন্যে প্রাণীদের মতো উদ্ভিদের হাত, পা বা মস্তিষ্ক না থাকলেও, প্রতিরক্ষার জন্যে তার গায়েই রয়েছে বিভিন্ন অস্ত্রশস্ত্র।

কাঁটা

উদ্ভিদের কোনো শাখা যখন পূর্ণাঙ্গভাবে শাখার মতো বেড়ে না উঠে সূঁচালো একটি ছোট অংশ হিসেবে থেকে যায়, তাকেই বলা হয় কাঁটা। লেবু, ডালিম বা বেল গাছের গায়ে যে কাঁটা আমরা দেখতে পাই, প্রকৃতপক্ষে তা হচ্ছে ঐ গাছের শাখারই পরিবর্তিত একটি রূপ।

 স্পাইন

এরা কাঁটার মতোই সূঁচালো, তবে এরা হচ্ছে গাছের পাতার পরিবর্তিত রূপ। ক্যাকটাসের গায়ে আমরা স্পাইন দেখতে পাই, যা মরু অঞ্চলের তৃষ্ণার্ত প্রাণীদের হাত থেকে তাদেরকে রক্ষা করে।

ক্যাকটাস; Source: pinterest.com

প্রিকল

এটি উদ্ভিদের ছাল বা এপিডার্মিসেরই একটি বর্ধিত অংশ, যা প্রতিরক্ষার কাজে ব্যবহৃত হয়। গোলাপ গাছে এ ধরনের প্রিকল থাকতে দেখা যায়।

ট্রাইকোম

সাধারণত বিছুটি (Urtica dioica) নামে যে গাছটিকে আমরা চিনি, তার প্রতিরক্ষার অস্ত্রটির নাম হচ্ছে ট্রাইকোম। গাছটির কাণ্ড জুড়ে অতি সূক্ষ্ম লোমের মত ট্রাইকোম বিস্তৃত থাকে। গাছের গায়ে স্পর্শ করলে ট্রাইকোমের অগ্রভাগ ভেঙে যায় এবং এর ভেতর থেকে হিস্টামিন, অ্যাসিটাইলকোলিন, সেরোটোনিন সহ অন্যান্য রাসায়নিক পদার্থ নির্গত হয়। বিছুটি গাছ স্পর্শ করলেই যে হুল ফোঁটার মতো যন্ত্রণা অনুভূত হয়, তার জন্য এই রাসায়নিক পদার্থগুলোই দায়ী।

বিছুটি; Source: Wikimedia Commons

ফলের শক্ত খোসা

ডাব ও রাবার গাছের ফলের খোসা এত বেশি শক্ত হয় যে, কোনো প্রাণী সহজে একে ভাঙতে বা চিবিয়ে খেতে পারে না। এভাবে শক্ত খোসা এসব গাছের ফলকে সুরক্ষিত রাখে।

দুর্গন্ধ তেতো স্বাদ

লজ্জাবতী গাছের গোড়ায় নাড়াচাড়া করার চেষ্টা করলে এটি বিশেষ ধরনের দুর্গন্ধ ছড়িয়ে নিজেকে রক্ষা করে থাকে। তুলসী ও পুদিনা গাছের বিশেষ গন্ধ এবং তেতো স্বাদের কারণে পোকামাকড় এসব গাছে আক্রমণ করা থেকে সাধারণত বিরত থাকে। নিম এবং করলাও তাদের তেতো স্বাদের ফলে প্রাণীদের আক্রমণ থেকে বেঁচে যায়। টমেটো পাতার বাজে স্বাদের কারণে পশুপাখিরা এটি খেতে অপছন্দ করে।

মাটির নিচে অবস্থান করা

আদা, হলুদ, কচু, পেঁয়াজ প্রভৃতি মাটির নিচে জন্মানোর কারণে সম্ভাব্য বিভিন্ন ধরনের আক্রমণ থেকে নিরাপদ থাকে।

বাহ্যিক অনাকর্ষণীয় রূপ

কিছু কিছু উদ্ভিদ নিজের প্রকৃতিপ্রদত্ত বাহ্যিক রূপের কারণেই প্রাণীকুলের কাছে ভয়ঙ্কর বা অনাকর্ষণীয় হিসেবে বিবেচিত হয়। যেমন, Arisaema গোত্রভুক্ত উদ্ভিদগুলো দেখতে অনেকটা সাপের ফণার মতো দেখায় বলে, এসব উদ্ভিদকে প্রাণীরা এড়িয়ে চলে।

কোনো উদ্ভিদ আবার সাময়িকভাবে একটি ভিন্ন, অনাকর্ষণীয় রূপ ধারণের মাধ্যমে নিজেকে নিরাপদ রাখে। এই বৈশিষ্ট্যটি আমরা দেখতে পাই আমাদের অতি পরিচিত লজ্জাবতী গাছের মধ্যেই। লজ্জাবতী গাছ (Mimosa pudica) এর স্পর্শকাতরতার কথা তো আমরা সবাই জানি। আঙুল দিয়ে হালকা করে ছুঁয়ে দিলেই এর পাতাগুলো নুয়ে পড়ে, ভেতরের দিকে গুটিয়ে যায়। আবার মিনিটখানেক পর তাকে দেখা যায় পাতাগুলো মেলে ধরতে। পাতার এ ধরনের আচরণকে বলা হয় সিসমোনাস্টিক মুভমেন্ট। মূলত নিজেকে রক্ষা করার জন্যেই এটি এমন আচরণ করে, যাতে তাকে দেখতে মৃত বা অনাকর্ষণীয় মনে হয় এবং কোনো প্রাণী তাকে উপড়ে খেয়ে না ফেলে।

লজ্জাবতী গাছের সিসমোনাস্টিক মুভমেন্ট; Source: nationalgeographic.com

সিসমোনাস্টিক মুভমেন্টের কারণ তো জানা হলো, কিন্তু এমন তরতাজা গাছটি কীভাবে এত দ্রুত নিজের রূপ বদলে ফেলতে পারে? আসলে পুরো ব্যাপারটিই ঘটে উদ্ভিদকোষের টারগার প্রেসারের পরিবর্তনের মাধ্যমে। কোষগহ্বরের ভেতরে থাকা তরল পদার্থ কোষপ্রাচীরের গায়ে যে চাপ প্রয়োগ করে, সেটিই হচ্ছে টারগার প্রেসার। বাইরের পরিবেশ থেকে কোনো ধরনের স্পর্শ বা আঘাত পেলে লজ্জাবতী গাছের কাণ্ড এক প্রকার রাসায়নিক পদার্থের নিঃসরণ ঘটায়, যা কোষ গহ্বরের ভেতরে থাকা তরলকে বের করে ফেলে। ফলে টারগার প্রেসার কমে গিয়ে কোষগুলো চুপসে যায় এবং পাতাগুলো নুয়ে পড়ে। বিজ্ঞানীদের মতে, তৃণভোজী প্রাণী ও ক্ষতিকর পোকামাকড় থেকে নিজেকে বাঁচাতেই লজ্জাবতী গাছ এই কৌশল ব্যবহার করে।

কোনো কোনো উদ্ভিদ আবার শত্রুর আক্রমণ থেকে বাঁচতে অন্যান্য প্রাণীরও সাহায্য নিয়ে থাকে। এই প্রক্রিয়ায়, আক্রান্ত উদ্ভিদ তো বটেই, সাহায্যকারী প্রাণীটিও কোনো না কোনোভাবে উপকৃত হয়। আর এভাবেই তাদের পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমে উদ্ভিদকুল ও প্রাণিকুলের প্রকৃতির বুকে নিরাপদে সহাবস্থান করা সম্ভব হয়।

খাদ্য আশ্রয়ের বিনিময়ে প্রতিরক্ষা

বুলহর্ন অ্যাকাসিয়া (Vachellia cornigera) নামক উদ্ভিদটির প্রতিরক্ষার জন্য নিয়োজিত রয়েছে এক দল ভাড়াটে পিঁপড়া সৈন্য! এই পিঁপড়ারা গাছটির কাঁটার ভেতরে বাস করে এবং তাদের জন্যে গাছের তৈরি করা বিশেষ খাবার খেয়ে বেঁচে থাকে। বিনিময়ে তারা গাছটির কাছে ঘেঁষতে চাওয়া সব ধরনের পশুপাখি, কীটপতঙ্গ এবং ছত্রাক থেকে গাছকে রক্ষা করে। এমনকি বুলহর্ন অ্যাকাসিয়ার খুব কাছে অন্য কোনো গাছ বেড়ে উঠতে থাকলে এরা ঐ গাছের পাতা উপড়ে ফেলে, যাতে ঐ গাছের ছায়া পড়ার ফলে অ্যাকাসিয়া সূর্যের আলো থেকে বঞ্চিত না হয়।

বুলহর্ন অ্যাকাসিয়া গাছের কাঁটার ভেতরেই তার পিঁপড়া সৈন্যদলের আবাস; Source: thehigherlearning.com

পিঁপড়া সৈন্যরা যেন তাকে ত্যাগ করে যেতে না পারে, সেজন্যে অ্যাকাসিয়া এক বিশেষ কৌশল ব্যবহার করে। পিঁপড়ারা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সুক্রোজ নামক চিনিজাতীয় দ্রব্য খেয়ে থাকে, যা তাদের পরিপাকতন্ত্রে ইনভার্টেজ এনজাইমের প্রভাবে ভেঙে হজম হয়। কিন্তু অ্যাকাসিয়া গাছ কাইটিনেজ নামক এক এনজাইম নিঃসরণ করে, যার প্রভাবে পিঁপড়ার নিজস্ব ইনভার্টেজ এনজাইম নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে। আবার এই এনজাইমের ঘাটতি পূরণের ব্যবস্থাও রয়েছে অ্যাকাসিয়া গাছের নির্যাসের মধ্যেই। কারণ এর নির্যাসে আছে ইনভার্টেজ। যেহেতু নিজস্ব ইনভার্টেজ এনজাইম নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়া পিঁপড়ারা অন্য কোনো গাছের নির্যাস গ্রহণ করলে তা হজম করতে পারে না, তাই তারা তখন শুধুমাত্র অ্যাকাসিয়ার নির্যাসের ওপরই সম্পূর্ণরূপে নির্ভরশীল হয়ে পড়ে।

শত্রুকেই তার শিকারীর হাতে ধরিয়ে দেওয়া

যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে একপ্রকার বন্য তামাক গাছ পাওয়া যায়, যারা শত্রুর হাত থেকে বাঁচার জন্যে শত্রুর শিকারীর সাহায্য নেয়। কোনো তৃণভোজী পতঙ্গ যদি তামাক গাছে আক্রমণ করে, তখন গাছটি এক ধরনের উদ্বায়ী রাসায়নিক যৌগের নিঃসরণ ঘটায়। উক্ত যৌগ ঐ তৃণভোজী পতঙ্গের শিকারীর কাছে পৌঁছলে শিকারী সংকেত পায় যে, এখানে তার শিকার অবস্থান করছে। শিকারী তখন তামাক গাছের কাছে গিয়ে তার শিকারকে বধ করে। আর তামাক গাছটিও পতঙ্গের ক্ষতির হাত থেকে বেঁচে যায়।

কোনো কোনো উদ্ভিদে আবার বিশেষ কিছু রাসায়নিক পদার্থ বিদ্যমান থাকে, যার মাধ্যমে উদ্ভিদ পাল্টা আক্রমণ করে প্রাণিকুলের ক্ষতির হাত থেকে নিজেকে রক্ষা করে।

ইডিওব্লাস্ট

ডাম্ব কেইন (Dieffenbachia) উদ্ভিদে রয়েছে ইডিওব্লাস্ট নামক বিশেষায়িত এক প্রকার কোষ, যা উদ্ভিদটির প্রতিরক্ষায় সাহায্যকারী কিছু রাসায়নিক পদার্থ ধারণ করে। ইডিওব্লাস্ট প্রথমে শিকারীর মুখে ক্যালসিয়াম অক্সালেট স্ফটিক ছুঁড়ে দেয়। এরপর এটি Raphide নামক বিশেষ এক ধরনের এনজাইম নির্গত করে, যা সরীসৃপ প্রাণীর বিষের মতোই বিপজ্জনক। এটি আক্রান্ত ব্যক্তিকে পক্ষাঘাতগ্রস্ত করে তুলতে পারে এবং কথা বলার ক্ষমতা নষ্ট করে দিতে পারে।

উপক্ষার

আফিম, তামাক, ধুতুরা গাছে বিদ্যমান বিষাক্ত উপক্ষার বা অ্যালকালয়েড এসব গাছকে নিরাপত্তা দিয়ে থাকে

ল্যাটেক্স নিঃসরণ

রাবার, কাঁঠাল, পেঁপে প্রভৃতি গাছের কাণ্ড, পাতা বা ফল থেকে ল্যাটেক্স নামক সাদা বা হলুদাভ, আঠালো এক প্রকার নির্যাস উৎপন্ন হয়। এই নির্যাস চামড়ায় লাগলে চুলকানি হতে পারে। তাই পশুপাখিরা এসব গাছ থেকে দূরত্ব বজায় রেখে চলে।

রাবার গাছ থেকে ল্যাটেক্স এর ক্ষরণ; Source: bouncerubberbands.com.au

বিষাক্ত তরল পদার্থ নিঃসরণ

পশুপাখি ও কীটপতঙ্গের হাত থেকে রক্ষার জন্যে অনেক উদ্ভিদেরই পাতা ও কাণ্ডে বিষাক্ত তরল পদার্থ থাকে। কোনো গাছ আক্রমণের শিকার হলে আক্রমণকারীর ওপর এ বিষ প্রয়োগ করে নিজেকে রক্ষা করে, আবার কোনো কোনো গাছ আক্রান্ত হলে নিজেকেই এই তরলে আবৃত করে ফেলে। ঘৃতকুমারী, আখ, পয়জন আইভি, উইলো প্রভৃতি গাছে এই বৈশিষ্ট্য দেখা যায়।

সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে, উদ্ভিদকে এক জায়গায় স্থির হয়ে থাকতে হলেও, নিজেকে বিপদের হাত থেকে বাঁচানোর জন্য তার প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা কম শক্তিশালী নয়। নিজের নিরাপত্তার প্রয়োজনে সে শত্রুর বড় ধরনের চিরস্থায়ী ক্ষতি করতেও সক্ষম।

ফিচার ইমেজ- YouTube

Related Articles