বিশ্বে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হিসাবে দেশ পরিচালনা করার জন্য খ্যাতি যেমন তার আছে, তেমনি রাজনৈতিকভাবে অনভিজ্ঞ এবং দুর্নীতিগ্রস্ত হওয়ার দায়ে ক্ষমতাচ্যুতও হয়েছেন বারবার। ধর্মনিরপেক্ষতা এবং পাকিস্তানকে আধুনিকীকরণের যে কর্মসূচী তার ছিল, সেজন্য অবিরত সমালোচিত হয়েছেন পাকিস্তানের ইসলামবাদী রক্ষণশীল সমাজ দ্বারা। পাকিস্তান পিপলস পার্টির প্রতিষ্ঠাতা জুলফিকার আলী ভুট্টো কন্যা, বেনজির ভুট্টো ছিলেন একজন বিতর্কিত ব্যক্তিত্ব।
পুরুষ শাসিত গৎবাঁধা রাজনৈতিক পত্তনের বিপরীতে গিয়ে তারুণ্যের প্রতীক ও নতুন পাকিস্তানের স্বপ্ন দেখা ভুট্টো সামাজিক সংস্কারের ক্ষেত্রে কতখানি সফল হয়েছেন তা নিয়ে যথেষ্ঠ তর্ক রয়েছে। দুর্বল নেতৃত্ব ও ত্রুটিপূর্ণ শাসনকার্যের দুর্নাম থাকা সত্ত্বেও তিনি ঘরোয়াভাবে বেশ জনপ্রিয় ছিলেন। পশ্চিমা দেশগুলোর কাছ থেকে সমর্থনও পেয়েছেন, কারণ তাদের চোখে ভুট্টো ছিলেন গণতন্ত্র ও নারী অধিকার রক্ষায় পাকিস্তানের মতো রক্ষণশীল দেশের চ্যাম্পিয়ন।
২০০৭ সালে খুন হওয়া বেনজির ভুট্টোর হত্যার পেছনে কে দায়ী তা এখনো প্রকাশিত না হলেও তার মৃত্যুর মধ্য দিয়ে পাকিস্তানের রাজনৈতিক কর্মপন্থা সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায়।
পাকিস্তানের করাচিতে ১৯৫৩ সালের ২১ জুন তিনি জন্মগ্রহণ করেন। ভুট্টো স্বনামধন্য হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় এবং অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছেন, যেখানে তিনি অক্সফোর্ড ইউনিয়নের সভাপতি ছিলেন। ১৯৭৭ সালে তার বাবা জুলফিকার আলী ভুট্টোর সরকার, জেনারেল জিয়া উল হক পরিচালিত সামরিক অভ্যুত্থানের ফলে ক্ষমতাচ্যুত হলে বেনজির ভুট্টো দেশে ফিরে আসেন। ১৯৭৮ সালে প্রতিপক্ষের নেতাকে খুন করার আভিযোগ প্রমাণিত হলে জুলফিকার আলী ভুট্টোকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। তার ফলশ্রুতিতে উত্তরাধিকার সূত্রে পাকিস্তান পিপলস পার্টির নেতৃত্ব পেয়েছিলেন বেনজির।
১৯৮৮ সালে বিমান দুর্ঘটনায় নিহত হওয়ার পর জিয়া উল-হকের একনায়কত্ব শেষ হয়। ভুট্টো তার প্রথম সন্তান জন্ম দেওয়ার তিন মাস পর প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন ১ ডিসেম্বর, ১৯৮৮ সালে। কিন্তু ক্ষমতা গ্রহণের মাত্র ২০ মাস পরেই দেশটির রাষ্ট্রপতি তাকে ক্ষমতা থেকে উৎখাত করেন সংবিধান লঙ্ঘন, দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির অভিযোগে।
ক্ষমতাচ্যুত হয়ে বিরোধী দলে গেলেও ভুট্টোবিরোধী অসন্তোষ অব্যাহত থাকে। ১৯৯৩ সালে পুনরায় নির্বাচনে জয়লাভ করে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বে থাকাকালে আবারো একই অভিযোগে তার সরকারকে ১৯৯৬ সালে ভেঙে দেন রাষ্ট্রপতি। ব্রিটেন ও দুবাইতে নির্বাসনে থাকলেও ১৯৯৯ সালে দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত হন এবং ৩ বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন।
দীর্ঘদিন দেশের বাইরে থাকার পর ২০০৭ সালে তৃতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী হয়ে নির্বাচনে অংশগ্রহণের জন্য পাকিস্তানে ফিরে আসেন। আর এই ফিরে আসাটাই কাল হয়ে দাঁড়ায় তার জন্য।
২৭ ডিসেম্বর, ২০০৭ সাল। ভুট্টো রাওয়ালপিন্ডিতে একটি নির্বাচনী সমাবেশে শেষ করে ফিরছিলেন। তখনই ১৫ বছর বয়সী বিলাল নামক আত্মঘাতী বোমারু বেনজিরকে লক্ষ্য করে গুলি ছোঁড়ে এবং তারপর নিজের সাথে বহন করা বোমায় নিজে সহ আরো ২৪ জনকে হত্যা করে। পাকিস্তানের তালেবান গোষ্ঠী এই হত্যার দায় স্বীকার করলেও হত্যাকাণ্ডটি আসলে কার নির্দেশে হয়েছে তা নিয়ে রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন মতামত।
পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় তত্ত্ব
তৎকালীন প্রেসিডেন্ট পারভেজ মোশাররফের সরকার পাকিস্তান তালেবানের প্রধান বায়তুল্লাহ মেহসুদকে হত্যার জন্য দায়ী করলেও মেহসুদ তা স্বীকার করেননি। ২০০৯ সালে মার্কিন ড্রোন হামলায় তিনি নিহত হন। ভুট্টো দেশে ইসলামী চরমপন্থীদের জন্য ভীতিকর ও বেশ প্রভাবশালী প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন। তিনি আল কায়েদা, তালেবান, স্থানীয় জিহাদি গোষ্ঠী এবং পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠার পেছনে অবদান রাখা বিভিন্ন সংস্থা দ্বারা নানান সময়ে হুমকির সম্মুখীন হন। হত্যার পরিকল্পনা, অর্থায়ন এবং হত্যাকাণ্ডের পেছনে তদন্তকারীরা মূলত এসব সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর নিম্ন পর্যায়ের কর্মীদের দোষী হিসেবে সাব্যস্ত করে। এমনকি জেনারেল মোশাররফের বিরুদ্ধেও নির্বাচনের আগে প্রতিদ্বন্দ্বী ভুট্টোকে হত্যার বৃহত্তর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত থাকার অভিযোগ আনা হয়েছে।
টেলিফোনে জেনারেল মোশাররফের হুমকি
মোশাররফকে যখন বেনজির ভুট্টো হত্যাকাণ্ডে রাষ্ট্রের জড়িত থাকা নিয়ে প্রশ্ন করা হয় তখন তিনি বলেন,
আমার কাছে তেমন কোনো তথ্য নেই। যদিও আমি মনে করি আমার ভাবনা সঠিক, কারণ তিনি এমন একজন নারী ছিলেন যিনি পশ্চিমা দেশগুলো দ্বারা বেশি প্রভাবিত হতেন এবং স্বাভাবিকভাবেই তাকে পাকিস্তানের জন্য হুমকি হিসেবেই দেখা হতো।
তদন্তকারীর প্রকাশিত তথ্যানুযায়ী, তিনি ওয়াশিংটনে বেনজির ভুট্টোকে টেলিফোন করেছিলেন। ভুট্টোর দীর্ঘদিনের সহযোগী মার্ক সেইগাল এবং সাংবাদিক রস সাসকিন্ড সেসময় তার সাথে উপস্থিত ছিলেন। মোশাররফ তাকে হুমকি দিয়েছিলেন পাকিস্তানে কখনো ফিরে না যেতে, সাথে এটাও বলেছিলেন ভুট্টো যদি ফিরে আসে তাহলে এর পরিণামে যা ঘটতে পারে তার জন্য জেনারেল দায়ী থাকবেন না।
২০১৩ সালে বেনজির ভুট্টো হত্যার দায়ে পারভেজ মোশাররফকে অভিযুক্ত করে পাকিস্তান আদালত। গত বছরের শুরুতে তাকে ভুট্টো হত্যা মামলায় পলাতক আসামি হিসেবে ঘোষণা করা হয়।
ভুট্টো মামলায় ধরা পড়া আসামিরা
মোশাররফের বিরুদ্ধে আইনি প্রক্রিয়া স্থগিত করা হয়েছে, কারণ তিনি দুবাইয়ে নির্বাসনে আছেন। বেনজির ভুট্টোর পুত্র ও রাজনৈতিক উত্তরাধিকারী বিলাওয়াল ভুট্টো জারদারি বলেন,
আমার মাকে হত্যা করার পুরো ঘটনাটাই মোশাররফের সাজানো। তিনি ইচ্ছাকৃতভাবেই সেদিন নিরাপত্তা পরিস্থিতির বিঘ্ন ঘটান যাতে তাকে হত্যা করা যায়।
হত্যার কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই ৫ জন সন্দেহভাজন ব্যক্তি বিলালকে এই হত্যাযজ্ঞে সাহায্য করে বলে স্বীকার করে। গ্রেপ্তারকৃত প্রথম ব্যক্তি আইজাজ শাহ বলেন, তিনিই তালেবান কর্তৃক প্রথমে নির্বাচিত হন ভুট্টোকে হত্যা করার জন্য। বিলাল যদি কোনো কারণে ব্যর্থ হয়, মিশনটি সম্পূর্ণ করার জন্য তাকে বিকল্প হিসাবে রাখা হয়।
রাশেদ আহমেদ ও শের জামান স্বীকার করেন যে, তারা ষড়যন্ত্রের মধ্যবর্তী আয়োজক ছিলেন এবং রাওয়ালপিন্ডির দুই চাচাত ভাই হাসনাইন গুল ও রাফাকাত হুসেন কর্তৃপক্ষকে জানান, হত্যার আগের রাতে বিলাল তাদের বাসায় অবস্থান করেছিল।
২০১৭ সালে পাকিস্তান আদালত এই ৫ ব্যক্তির বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ মিথ্যা বলে প্রমাণিত হলে তাদের বেকসুর খালাস দেওয়া হয়। পরবর্তীতে দুই জন পুলিশ কর্মকর্তাকে এই মামলায় দোষী সাব্যস্ত করা হয় অপরাধস্থল অবমাননার অভিযোগে। বিগত ১০ বছরে এই হত্যা মামলায় তারাই একমাত্র ধরা পড়া আসামি।
জাতিসংঘের দেওয়া রিপোর্ট
পাকিস্তান পিপলস পার্টি (পিপিপি) সরকারের অনুরোধে ভুট্টোর হত্যার পর ৩ সদস্যের জাতিসংঘের একটি দলকে হত্যার তদন্তের জন্য পাঠানো হয়েছিল। ২০১০ সালে প্রকাশ হওয়া ৭০ পৃষ্ঠার প্রতিবেদনটিতে জাতিসংঘ ভুট্টোকে প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা প্রদানের ব্যর্থতার জন্য মোশাররফের প্রশাসনকে দায়ী করে।
ঘটনার পর পুলিশের উদাসীনতার কারণে বেশ কিছু প্রমাণ ঘটনাস্থল থেকে হারিয়ে গেছে বলে তারা মনে করেন। দুজন অভিযুক্ত পুলিশ কর্মকর্তার মধ্যে রয়েছেন সিনিয়র পুলিশ অফিসার খুররাম শাহজাদ। দ্বিতীয় পুলিশ কর্মকর্তা রাওয়ালপিন্ডির পুলিশ প্রধান সৌদ আজিজকেও এই মামলায় দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছে, কারণ তিনি বেনজির ভুট্টোর মৃতদেহের ময়নাতদন্ত করতে বারবার তার কাছে দরখাস্ত করা হলেও অনুমতি দেননি।
অন্যদিকে পরবর্তীতে উদ্ধারকৃত ভিডিও ক্লিপ থেকে দেখা যায়, বেনজির ভুট্টোর বিশ্বস্ত দেহরক্ষী খালিদ শাহেনশাহ ঘটনার দিন মঞ্চে দাঁড়িয়ে উদ্ভট অঙ্গভঙ্গি করছেন। কিন্তু তাকে আটক করার আগেই করাচীতে শাহেনশাহ রহস্যজনকভাবে গুলিবিদ্ধ হন। কেউ কেউ আবার সন্দেহের তীর তার স্বামী আসিফ আলী জারদারির দিকেও তাক করে।
পাকিস্তানের বেসামরিক সরকার প্রায়ই বিচার বিভাগ ও সামরিক বাহিনীর সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়, যেখানে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সামরিক বাহিনী সেনা অভ্যুত্থানের নামে সরকার প্রধানকে ক্ষমতাচ্যুত করে থাকে। বেনজির হত্যা মামলার সুরাহা না হলেও দেশটি ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে। গেম অফ থ্রোন্স এর মতো ক্ষমতার এই নোংরা খেলায় কে জয়ী হবেন তা জানা যাবে এই বছরের জুলাই মাসে পাকিস্তানে অনুষ্ঠিত ১৩ তম নির্বাচনে।
ফিচার ইমেজ : stuff.co.nz