ভূ-রাজনীতিতে কোনো স্থায়ী বন্ধু বা শত্রু নেই, কেবল আছে স্বার্থ। আজ এক দেশের সাথে স্বার্থ আছে, সুতরাং তার সাথে হবে মিত্রতা। কাল স্বার্থ বদলে গেলে বদলে যাবে সম্পর্ক। এই প্রায় নির্মম নিয়মেই চলে বিশ্ব রাজনীতি। এবং এরই অংশ হিসেবে বর্তমান বিশ্বে দেখা যাচ্ছে ইজরাইল ও সৌদি আরবের মধ্যে সুসম্পর্ক।
এই দুই দেশের সুসম্পর্ক নিয়ে বেশী সরব ইজরাইল। তাদের রাজনীতির ধরনই এই। তারা নানা বিবৃতি দিচ্ছে এবং জানিয়ে দিচ্ছে আরব বিশ্বের সাথে তাদের শত্রুতার দিনগুলো শেষ।
কিন্তু ইজরাইলকে শুরু থেকেই বিরোধীতা করে আসছে আরব বিশ্ব। তাদের বিচারে ইজরাইল অবৈধ রাষ্ট্র। নিরীহ ফিলিস্তিনি লোকদের উপর ইজরাইলের নির্মম নির্যাতন ও অন্যায় দখলদারী মনোভাব সেই বিরোধীতার বারুদে ঢেলেছে ঘৃত।
আরব-ইজরাইল যুদ্ধও হয়েছে একসময়। কিন্তু এখন সব ভিন্ন চিত্র। এর কারণ কী?
প্রথম কারণ ইরাক যুদ্ধ। আমেরিকার নেতৃত্বে ইরাকে যে আগ্রাসন চালানো হয়েছিল মানববিধ্বংসী অস্ত্রের মিথ্যা অভিযোগে, তাতে সেখানকার সুন্নীরা ক্ষমতা থেকে হটে গেছে। শিয়া-সুন্নী বিদ্বেষ বেড়েছে আর বর্তমানে ক্ষমতায় শিয়া নেতৃত্ব। এই শিয়া নেতৃত্বের আবার গভীর সম্পর্ক শিয়া ইরানের সাথে।
ইরান শিয়া ইসলামী বিপ্লবের মাধ্যমে ইসলামিক রিপাবলিকে পরিণত হবার পর থেকেই সমস্ত আরব রাজাদের জন্য একরকম হুমকি হয়ে রয়েছে। সিরিয়ায় আসাদ বিরোধী জোটে আমেরিকা-সৌদিরা মিলিত হয়েও আসাদকে ক্ষমতা থেকে সরাতে পারে নি। ইরান-রাশিয়া জোটের কাছে পরাজিতই হয়েছে আমেরিকা এখানে। আসাদ ক্ষমতায় রয়েছেন বহাল তবিয়তে।
এদিকে ইয়েমেনে হুথি বিদ্রোহীদের সাথে যুদ্ধে জড়ায় সৌদি। কিন্তু সেখানেও জয়ের দেখা মেলে নি। ইরান রাশিয়ার সমর্থনে হুথিরা এখনো ভালোই লড়ে যাচ্ছে। মানবাধিকার লংঘনের অভিযোগ উঠেছে সৌদি নেতৃত্বাধীন জোটের প্রতি।
আমেরিকার প্রভাব মধ্যপ্রাচ্যে কমতে শুরু করেছে। নতুন শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হচ্ছে রাশিয়া এ অঞ্চলে। এই অবস্থায় সৌদির জন্য মারাত্মক কিছু দুশ্চিন্তার বিষয় রয়েছে। যেমন, বাদশাহ সালমান তার ছেলে মুহাম্মদ বিন সালমানকে রীতি ভেঙ্গে ক্রাউন প্রিন্স নিযুক্ত করেছেন। রাজা হবার দাবীদার কিন্তু আরো অনেকে, কারণ রাজপরিবার অনেক বড়। সুতরাং মুহাম্মদ বিন সালমান রাজা হবার সময় ঝামেলা হতে পারে। আরব বসন্ত নামক বিপ্লবী ব্যাপারটিকেও ভুলে যায় নি আরব বিশ্ব। এমন একটা কিছু সৌদিতেও শুরু হয়ে যেতে পারে। এদিকে সৌদির অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো না, কারণ বিশ্ববাজারে তেলের দাম কমছেই।
এই অবস্থায় মুহাম্মদ বিন সালমানের সামনে নিজের ক্ষমতায় যাওয়া ও দেশের অর্থনীতিকে তেল নির্ভরতা থেকে বের করে শিল্প নির্ভর করা- এই দুটিই সবচেয়ে বড় কাজ। এই দুই কাজ তার একা করা সম্ভব নয়। বাইরের সাহায্য দরকার। আগে ছিল মধ্যপ্রাচ্যের চালক শক্তি আমেরিকা। কিন্তু আমেরিকা আগের অবস্থায় নেই অথবা তাদের নীতিও বদলে গেছে। সুতরাং নতুন শক্তি তৈরী করতে নতুন বন্ধু দরকার সৌদি আরবের। কিন্তু বন্ধু হবে কে? শত্রুর শত্রু যে! এ অঞ্চলে ইরানকে নিজেদের জন্য হুমকি মনে করে ইজরাইল। দুজনেরই শত্রু মিলে গেল, তাই সৌদি-ইজরাইল তারা এখন পরস্পর মিত্র।
ইজরাইল চায় না কোনো বৈপ্লবিক চরিত্রের ইসলামি শক্তির হাতে মধ্যপ্রাচ্যের নিয়ন্ত্রণ চলে যাক। যেমন শিয়া ইরান বা আরব বসন্তওয়ালারা। কারণ তাদের হাতে মধ্যপ্রাচ্যের নিয়ন্ত্রণ চলে গেলে তারা ইজরাইলকে বিব্রত করতে থাকবে, ফিলিস্তিনিদের অধিকার নিয়ে সরাসরি কথা বলবে, যা হবে ইজরাইলের অস্তিত্বের জন্য হুমকিস্বরূপ। কারণ ফিলিস্তিনের হামাসকে এরা সহযোগীতা করবে অস্ত্র এবং অর্থ দিয়ে, ফলশ্রুতিতে বিপদজনক হয়ে উঠবে ইজরাইল-ফিলিস্তিন।
ইজরাইল এবং সৌদি দুই দেশকেই একদিক দিয়ে হতাশ করেছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প, আমেরিকান প্রেসিডেন্ট। আমেরিকা মধ্যপ্রাচ্যের নিয়ন্ত্রণে থাকলে, বা ইরানের বিরুদ্ধে জোরেসোরে কোন ব্যবস্থা নিলে সৌদি-ইজরাইল এত প্রকাশ্য মিত্রতা দেখাত না।
সৌদি ও ইজরাইল দুই দেশই চাইছিল আমেরিকা যেন ইরানের বিরুদ্ধে বড় কোনো পদক্ষেপ নেয়। ডোনাল্ড ট্রাম্প ইরানকে সন্ত্রাসবাদী ইত্যাদি বলে হুমকি ধামকিও দিয়েছেন অনেক। কিন্তু কাগজে-কলমে ইরানের সাথে ওবামা প্রশাসনের করা নিউক্লিয়ার চুক্তি থেকে সরে আসেন নি।
উল্লেখ্য, শিয়া ইসলামিক ইরান অর্থনৈতিক অবরোধে এবং নিজেদের রক্ষণশীল অর্থনৈতিক নীতির কারণে অর্থনৈতিকভাবে অনেক পিছিয়ে পড়েছিল। বেকারত্বের হার বেড়েছে। ফলে দেশের ভেতরে নানা পরিবর্তনের দাবী উঠে। এর মধ্যে প্রধান ছিল অর্থনৈতিক পরিবর্তন ও সামাজিক পরিবর্তন। সামাজিক পরিবর্তন ধীরে হলেও অর্থনৈতিক পরিবর্তন হয়েছে দ্রুত, তুলনামূলক মডারেট রৌহানি সরকার এই কারণেই নির্বাচিত হয়েছে বিপুল ব্যবধানে। আমেরিকার সাথে নিউক্লিয়ার চুক্তি পরবর্তী অবস্থা উন্নতির পথে। কিন্তু এতে মারাত্মক নাখোশ ইজরাইল ও সৌদি আরব। অতএব সৌদি ও ইজরাইল প্রকাশ্যে তাদের এই মিত্রতা বন্ধনে আবদ্ধ।
সৌদির দিক থেকে আরেকটা কারণ হলো লেবাননের শিয়া গোষ্ঠী হেজবুল্লাহ। হেজবুল্লাহর সমর্থক ইরান। হেজবুল্লাহ লেবাননে প্রচুর শক্তিশালী, বর্তমান শাসকদলের জোটে আছে। সৌদি আরব লেবাননের হেজবুল্লাহকে বিপদে ফেলতে প্রধানমন্ত্রী সাদ হারিরিকে ডেকে নিয়ে গিয়ে পদত্যাগ করায়। অন্য দেশের প্রধানমন্ত্রীকে এভাবে চাপ দিয়ে পদত্যাগ করানো সমস্ত কূটনৈতিক শিষ্টাচার বহির্ভূত ও বিরল ঘটনা। কিন্তু তাদের এই প্রচেষ্টাও ব্যর্থ হয়। ইউরোপের, বিশেষত ফ্রান্সের চাপে হারিরিকে আটকে রাখতে পারে নি সৌদি আরব। লেবাননে শিয়া-সুন্নী মিলিত সরকারে সুন্নীরা সাধারণত সৌদি পন্থী আর শিয়া হেজবুল্লাহ সমর্থকরা ইরানপন্থী। কিন্তু সাদ হারিরিকে পদত্যাগ করিয়ে সৌদি যে পদক্ষেপ নেয় তা লেবাননে শিয়া-সুন্নী সম্পর্কে ভাঙন ধরাতে পারে নি, বরং উভয় দলের সাধারণ সমর্থকরা এতে সৌদির উপর ক্ষুব্ধ হয়। হারিরি দেশে ফিরে গিয়ে আবার পদত্যাগ বাতিল করেছেন।
সুতরাং লেবাননে সৌদি হেজবুল্লাহর বিরুদ্ধে কিছু করতে পারবে না ইজরাইলের মিলিটারী সাহায্য ছাড়া। হেজবুল্লাহও এখানে ইজরাইল-সৌদির কমন শত্রু। কিন্তু দুই দেশের এই মিত্রতার ভবিষ্যত কী? টিকবে কি এই সম্পর্ক? তা নির্ভর করবে মুহাম্মদ বিন সালমান নিজের দেশের অর্থনৈতিক সংস্কার, সামাজিক সংস্কার, নিজের পুরোদমে ক্ষমতায় বসা ইত্যাদি কাজ সুচারুরূপে করতে পারেন কি না, তার উপর। এদের মধ্যে একটা বিশৃঙ্খলা লেগে গেলে কী হবে তা বলা মুশকিল। তবে এখানে, ফিলিস্তিনিদের জন্য সুখবর হালকা রয়েছে বলে মনে করতে পারেন কোনো আশাবাদী।
সৌদির সাথে মিত্রতার জের ধরে ইজরাইল ফিলিস্তিন নীতির ব্যাপারে আরো শিথিল অবস্থানে যেতে পারে। পশ্চিম তীরে ফিলিস্তিনি জায়গাতে ইজরাইল তাদের বসতি নির্মাণ অব্যাহত রেখেছে প্রায় চল্লিশ বছর ধরে। আন্তর্জাতিক আইনকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে, জাতিসংঘ সহ সারা বিশ্বের নিষেধ সত্ত্বেও তারা এই অবৈধ বসতি নির্মাণ চালিয়ে যাচ্ছে। তাদের এই দখলদারী মনোভাব এখনো জোরেসোরেই বর্তমান রয়েছে। তাই ইজরাইল ও ফিলিস্তিনকে দুই দেশ করে দেয়ার সমাধানটি বাস্তব রূপ নিতে পারছে না। এসব থেকে ইজরাইল সরে আসতে পারে সৌদির সাথে মিত্রতার জন্য, এটা আশাবাদী চিন্তা।
যদি ইজরাইল ফিলিস্তিনিদের জায়গায় নিজেদের এই অবৈধ বসতি নির্মাণ চালিয়ে যায় এবং সৌদির সাথে মিত্রতার সম্পর্কও গড়ে তোলে, তখন ইসলামি বিশ্বে সৌদির এই মিত্রতা যে খুব ভালো চোখে দেখা হবে না তা বলাই বাহুল্য। এদিকে তেলের দাম যেভাবে পড়ছে, তাতে সৌদির শক্তিশালী অর্থনীতিও দুর্বল হয়ে উঠবে। মুসলিম বিশ্বের নেতৃত্ব নিয়ে তুরস্কের উচ্চাকাঙ্খাও এখানে বিবেচনায় নিতে হবে। ফলে ইসলামি বিশ্বে এই ইজরাইলের সাথে বন্ধুত্বের জন্য আরো বিতর্কিত হয়ে উঠবে সৌদি নেতৃত্ব। সমস্যাকে আরো ঘোলাটে করেছে সাম্প্রতিক কালে ডোনাল্ড ট্রাম্পের ইজরাইলের রাজধানী হিসেবে জেরুজালেমকে স্বীকৃতি।
ফিচার ইমেজ- humansarefree.com