সাবমেরিন বা ডুবোজাহাজ- আধুনিক বিশ্বের অন্যতম এক বিশেষ নৌযান। একই সাথে নানান কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে ডুবোজাহাজ। শত্রুর নৌ ঘাঁটি থেকে শুরু করে বিমান কিংবা যেকোনো ধরনের নৌযান বিধ্বস্ত করায় এর জুড়ি নেই। পাশাপাশি গভীর সমুদ্রের তলদেশে গবেষণা কাজ কিংবা উদ্ধার অভিযানেও এটি সমান পারদর্শী। বর্তমানে এটি জাতীয় শক্তির অন্যতম প্রতীক হিসেবেও বিবেচিত হচ্ছে। তাই বর্তমান বিশ্বের প্রতিটি দেশই তাদের শক্তিমত্তা বৃদ্ধির জন্যে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের সাথে সাথে এক বা একের অধিক ডুবোজাহাজ কেনার আগ্রহ দেখাচ্ছে এবং কিনছে।
কিন্তু শুরুর দিকটায় কেমন ছিল এই ডুবোজাহাজ?
১৫৭৮ সালে ইংরেজ গণিতবিদ উইলিয়াম বোর্ন তার বই Inventions or Devises এ সর্বপ্রথম ডুবোজাহাজের ধারণা দেন। তবে নৌযানের প্রেক্ষিতে ডুবোজাহাজের আবিষ্কারক হিসেবে কর্নেলিয়াস জ্যাকবসজুন ড্রেবেল নামে একজন ডাচকেই ধরা হয়। তার আবিষ্কৃত ডুবোজাহাজ বর্তমানে ড্রেবেলীয় ডুবোজাহাজ নামে পরিচিত। ইংল্যান্ডের রাজা প্রথম জেমসের অধীনে রাজকীয় নৌবাহিনীতে কর্মরত ছিলেন ড্রেবেল। ইংরেজ গণিতবিদ উইলিয়াম বোর্নের বইতে উল্লিখিত ধারণা ও কাঠামো অনুসারে ১৬২০ সালে ডুবোজাহাজটি তৈরি করেন তিনি। এটা ছিল কাঠের তৈরি, আর এর সম্পূর্ণ দেহ চামড়া দিয়ে মুড়ে দেয়া হয়েছিল। এ ডুবোজাহাজটিকে দাঁড় টেনে সামনের দিকে নিয়ে যেতে হতো।
এ নিয়ে বিতর্কিত মন্তব্যও রয়েছে। অনেকে মনে করেন অন্য একটি নৌকা দিয়ে এটিকে সামনের দিকে টেনে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। পরবর্তী ৪ বছরের মধ্যেই লন্ডনের টেমস নদীতে আরও নানান পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে আরও দু’বার সংস্করণ করা হয়। প্রত্যেকটিই ছিল আগেরটির চেয়ে তুলনামূলক বড়।
ডুবোজাহাজটির তৃতীয় সংস্করণ এতে কিছুটা ভিন্ন মাত্রা যোগ করে। এর প্রধান আকর্ষণ ছিলেন রাজা প্রথম জেমস। ডুবোজাহাজের আবিষ্কারক ড্রেবেলের অনুরোধে রাজা জেমস এ ডুবোজাহাজে পরীক্ষামূলকভাবে চলাচল করতে সম্মতি জানান। প্রথম ভ্রমণকারী রাজা হিসেবে ডুবোজাহাজে আরোহণের মাধ্যমে টেমসের পানির নিচে অবস্থান করে ইতিহাসের পাতায় নিজের নামকে চিরস্মরণীয় করেন তিনি। এরচেয়েও মজার ব্যাপার হলো তারই নির্দেশনায় এই মডেলটি প্রস্তুত করা হয়েছিল। এতে ৬টি দাঁড় ছিল এবং এটি একই সাথে ১৬ জন যাত্রী বহন করতে পারত। ডুবোজাহাজটি কয়েক হাজার লন্ডনবাসীর সামনে প্রায় তিন ঘন্টাব্যাপী পানিতে সম্পূর্ণরুপে ডুবে ছিল। পানির নিচে প্রায় ১২-১৫ ফুট পর্যন্ত অবস্থানসহ ওয়েস্টমিনিস্টার থেকে গ্রীনিচ পর্যন্ত যেতে-আসতে সক্ষম হয়েছিল ডুবোজাহাজটি। পরবর্তীতে আরো অনেকবার পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালানো হলেও নৌ কর্মকর্তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে ব্যর্থ হয় এটি।
এরপর আঠারো শতকের মাঝামাঝির দিকে নাথানিয়েল সাইমনস নামক এক ইংরেজ সর্বপ্রথম ব্যালাস্ট ট্যাঙ্ক ব্যবহার করে একধরনের ডুবোজাহাজ নির্মাণ করেন। এতে করে ডুবোজাহাজে নতুন এক দিগন্তের উন্মোচন হয়। এ শতকেই প্রথম সামরিক ডুবোজাহাজ ‘টারটেল’ (Turtle) ব্যবহার করা হয়।
উনিশ শতকের ডুবোজাহাজগুলো ক্রমান্বয়ে আরও শক্তিশালী হতে শুরু করে। এরই ফলে এ শতকেই কোনো এক সামরিক ডুবোজাহাজ প্রথমবারের মতো শত্রুর জলযান ডুবিয়ে দিতে সক্ষম হয়। এসময়ে প্রথম কোনো ডুবোজাহাজ নিজ শক্তিতে পানিতে ডুবে থাকতে এবং আবার ভেসে উঠতে সক্ষম হয়। এছাড়াও উনিশ শতকে অনেক নতুন প্রযুক্তি যুক্ত করা হয় যা এখনও পর্যন্ত আধুনিক ডুবোজাহাজের ক্ষেত্রে অপরিহার্য।
তবে বিংশ শতকের পূর্ব পর্যন্ত কোনো দেশের নৌ বাহিনীই ডুবোজাহাজকে তাদের নিয়মিত ব্যবহার্য যান হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করেনি। বিংশ শতকে এসেই এটি পরিপূর্ণভাবে বিস্তার লাভ করে এবং বহু দেশের নৌ বাহিনীর অন্যতম অপরিহার্য নৌযান হিসেবে জায়গা করে নেয়। বর্তমানে বেশ কয়েক ধরনের ডুবোজাহাজ দেখা যায়। এর মধ্যে অ্যাটাক সাবমেরিন (Attack submarine), ব্যালাস্টিক মিসাইল সাবমেরিন (Ballistic missile submarine), ক্রুজ মিসাইল সাবমেরিন (Cruise missile submarine), নিউক্লিয়ার সাবমেরিন (Nuclear submarine) এর ব্যবহার বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
যে কারণে সাবমেরিন অন্যান্য জলযান থেকে আলাদা
ডুবোজাহাজের সবচেয়ে বৈচিত্র্যময় বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এটি একই সঙ্গে পানিতে ভাসতে পারে এবং প্রয়োজন হলে পানির নিচেও অবস্থান করতে পারে। কিন্তু কিভাবে তা সম্ভব হয়?
একটি খালি বোতল খুব সহজেই পানিতে ভেসে থাকতে পারে। আবার বোতলটি পানি দিয়ে ভর্তি করে দিলে তা পানির নিচে ডুবে যায়। ঠিক একইভাবে ডুবোজাহাজ পানিতে ভাসে ও ডুবে থাকে। ডুবোজাহাজে একটি ব্যালাস্ট ট্যাঙ্ক থাকে। এই ট্যাঙ্কের সাহায্যেই মূলত সাবমেরিনটি পানিতে ডুবে ও ভেসে থাকে। সাধারণত ব্যালাস্ট ট্যাঙ্ক যখন বায়ুপূর্ণ থাকে, তখন ডুবোজাহাজ পানিতে ভাসমান থাকে। এর নিচে এবং উপরের দিকে দুটি ভালভ থাকে। যখন এটির পানির নিচে যাবার প্রয়োজন হয়, তখন নিচের ভালভটি খুলে দেয়া হয় এবং সেখান দিয়ে পানি ঢুকে এর ওজন বাড়িয়ে দেয়, আর ওপরের ভালভ দিয়ে বাতাস বের হয়ে যায়। ফলে ডুবোজাহাজটি আস্তে আস্তে পানির নিচে চলে যায়।
এর পাশাপাশি অন্য একটি ট্যাঙ্কে বাতাসের মজুৎ রাখা হয় এবং ওপরে ওঠার প্রয়োজন হলে পাম্পের মাধ্যমে ব্যালাস্ট ট্যাঙ্কের পানি বের করে ফেলা হয় এবং মজুতকৃত বাতাস দিয়ে ট্যাঙ্কটি ভর্তি করে ফেলা হয়। এভাবে সহজেই এর ওজন হ্রাস পায় এবং এটি আবার ভেসে ওঠে। ডুবোজাহাজের ভেতরের চাপ নিয়ন্ত্রণ করার জন্য এতে উন্নতমানের স্টিল ও টাইটেনিয়াম ব্যবহার করে তৈরি করা হয়। এর ফলে ভিতরে চাপের কোনো পরিবর্তন হয় না।
বাংলাদেশ এবং সাবমেরিন
অনেক বছর ধরেই যুদ্ধক্ষেত্রের পাশাপাশি নানান কাজে বিভিন্ন দেশে ডুবোজাহাজ ব্যবহৃত হয়ে আসছে। কালের পরিক্রমায় আধুনিকতার ছোঁয়া লেগেছে আমাদের দেশেও। এরই প্রতিফলন হিসেবে সম্প্রতি বাংলাদেশ নৌবাহিনীতে যুক্ত হয়েছে নতুন দুটি ডুবোজাহাজ। ‘নবযাত্রা’ ও ‘জয়যাত্রা’ নামের এ দু’টি ডুবোজাহাজ আমাদের নৌবাহিনীর শক্তিকে আরও ত্বরান্বিত করেছে। আকাশ ও স্থলপথের পাশাপাশি জলপথেও যে বাংলাদেশ এখন বেশ শক্তিশালী তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
‘সবার সাথে বন্ধুত্ব, কারো সাথে শত্রুতা নয়’ এটিই আমাদের পররাষ্ট্রনীতি। তাই বলা যায় অনেকটা আত্মরক্ষার্থেই ডুবোজাহাজ দুটি ব্যবহৃত হবে। সমুদ্রে গ্যাস ও তেল অনুসন্ধানসহ বাংলাদেশের বৈদেশিক বাণিজ্যের অধিকাংশই চলে জল পথে। এ সকল কাজে ডুবোজাহাজ দুটি আমাদের নিরাপত্তার ক্ষেত্রে নতুন মাত্রা যোগ করবে। এছাড়াও বঙ্গোপসাগরের ১ লাখ ১১ হাজার ৬৩১ বর্গকিলোমিটার অঞ্চলে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব আরও সমৃদ্ধ হবে।
বাংলাদেশে আমদানিকৃত ডুবোজাহাজ দুটি ‘০৩৫জি’ মডেলের। অনুসন্ধান করে জানা যায়, এ ধরনের ডুবোজাহাজ প্রথম ১৯৮৫ সালের দিকে তৈরি হয় এবং ১৯৯০ এর দিকে আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু হয়। বিগত ২৪ বছর এ ডুবোজাহাজ দুটি চীন ব্যবহার করেছে। পুরোনো এই ডুবোজাহাজ দুটি ক্রয় করতে বাংলাদেশের গুণতে হয়েছে ২০ কোটি ৩৩ লাখ ডলার বা এক হাজার ৫৬৯ কোটি টাকা। এ ধরনের নতুন একটি ডুবোজাহাজ কিনতে গেলে ১০০ কোটি ডলারের মতো গুণতে হয়।
এ ধরনের নতুন একটি ডুবোজাহাজের গড় আয়ু ধরা হয় ২৫ বছর। তবে পুনঃসজ্জিত করে এর আয়ু বাড়ানো যায়। ‘নবযাত্রা’ ও ‘জয়যাত্রা’র দৈর্ঘ্য ৭৬ মিটার এবং প্রস্থ ৭ দশমিক ৬ মিটার। ৫ হাজার ২০০ অশ্বশক্তির এ দুটি ডুবোজাহাজ ডিজেল-ইলেকট্রিক ইঞ্জিনে চলাচল করে। এ দুটি ডুবোজাহাজে টর্পেডো ও মাইন প্রযুক্তি থাকার ফলে এটি দিয়ে শত্রু জাহাজ ও ডুবোজাহাজে আক্রমণ করে ধ্বংস করা সম্ভব। এর পাশাপাশি ফ্রান্সে তৈরি পানির তলদেশে শব্দ প্রযুক্তি ব্যবহার করে তল্লাশি চালানোর ব্যবস্থাও রয়েছে। ডুবোজাহাজ দুটির প্রত্যেকটিতে ৫৭ জন কর্মকর্তা ও কর্মচারীর আবাসন সুবিধা আছে। এগুলো ৩০০ মিটার পর্যন্ত পানির গভীরে যেতে পারে। এগুলোর সর্বোচ্চ গতি ঘন্টায় ১৭ নটিক্যাল মাইল। এর ডিসপ্লেসমেন্ট ১,৬০৯ টন।
ডুবোজাহাজ ক্রয় প্রসঙ্গে নৌবাহিনীর বিভিন্ন ব্যক্তিবর্গের মন্তব্য ঘেঁটে দেখা যায় বাংলাদেশে এই দুটি ডুবোজাহাজ যুক্ত হওয়ায় অনেকেই বেশ গর্বিতবোধ করছেন। আবার একই সাথে দেশের অনেক ব্যক্তিবর্গ এই মুহূর্তে ডুবোজাহাজের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। অনেকে এর মেয়াদকাল নিয়েও শঙ্কা প্রকাশ করেছেন। তবে জনমত নির্বিশেষে সকলের একটাই আশা ‘জয়যাত্রা’ ও ‘নবযাত্রা’ কাজ করুক দেশ ও জনগণের কল্যাণে। যুদ্ধ নয়, সম্প্রীতির পথে নবযাত্রা শুরু হোক এবং তা পূর্ণতা পাক জয়যাত্রায়।
ডুবোজাহাজ সম্পর্কিত আরও কিছু তথ্য
- প্রথম দিকের ডুবোজাহাজে এক থেকে দুই জন যাত্রী অবস্থান করতে পারলেও বর্তমানে কিছু ডুবোজাহাজ একই সময়ে ১০০ জনেরও অধিক ক্রু বহন করতে পারে।
- কিছু কিছু ডুবোজাহাজ টানা ২০-২৫ বছর সমুদ্রের তলদেশে অবস্থান করতে পারে।
- আধুনিক ডুবোজাহাজগুলোতে টাইটানিয়াম দিয়ে তৈরি কিছু হাল (Hulls) থাকে, যার দরুণ এগুলো পানির অনেক গভীরের চাপ নিতে সক্ষম হয়।
- ১ম ও ২য় বিশ্বযুদ্ধে শত্রুদের আক্রমণ করার জন্য জার্মানি ইউ-বোট নামে এক ধরনের ডুবোজাহাজ ব্যবহার করেছিলো।
- প্রথম দিকের ডুবোজাহাজগুলোতে গ্যাস, বাষ্প এমনকি মানব শক্তিও প্রধান শক্তির উৎস হিসেবে ব্যবহার করা হতো।
- বর্তমান সময়ের ডুবোজাহাজে শক্তির উৎস হিসেবে ব্যাটারি, ইঞ্জিন এবং পারমাণবিক শক্তি ব্যবহার করা হয়।
- বিভিন্ন বেসামরিক কাজেও ডুবোজাহাজ ব্যবহার করা হয়ে থাকে। যেমন উদ্ধার অভিযান, গভীর সমুদ্রে অনুসন্ধান ইত্যাদি।
- ‘দ্য ক্রুস্ক’ নামক এক রাশিয়ান ডুবোজাহাজ অভ্যন্তরীণ বিস্ফোরণে ২০০০ সালে বিধ্বস্ত হয় এবং এতে কর্মরত ১১৮ জন ক্রুর সকলেই নিহত হয়।
তথ্যসূত্র
১) en.wikipedia.org/wiki/Submarine
২) science.howstuffworks.com/transport/engines-equipment/submarine1.htm
৩) dhakatribune.com/bangladesh/2017/03/12/bangladeshs-first-submarines-commissioned/
৪) prothom-alo.com/bangladesh/article/324946
৫) softschools.com/facts/transportation/submarine_facts/1190/