“কোথায় যাচ্ছ যদি না জান, তবে সব পথই তোমাকে সেখানে নিয়ে যাবে।”
– লুইস ক্যারল
শিশু সাহিত্যের এক জনপ্রিয় লেখক ছিলেন লুইস ক্যারল। ছোটদের স্বপ্নবিলাসী করে তুলতে, তাদেরকে নিয়ে কল্পনার রাজ্যে ভ্রমণ করতে তার জুড়ি মেলা ভার। তার গল্পে থাকতো না নীতিবাক্যের ঘেরাটোপ, নেই ছোটদের ভয় পাওয়ানো শাস্তির জুজু। গল্প জুড়ে শিশুদেরকে নানা ফ্যান্টাসির জগতে ভ্রমণ করিয়ে আনার এক অসাধারণ প্রতিভা ছিল লুইসের।
তিনি ছিলেন একাধারে গণিতজ্ঞ, কবি, আবিষ্কারক, প্রাবন্ধিক, যাজক এবং শখের আলোকচিত্র শিল্পী। তাকে সেই সময়ের অন্যতম শ্রেষ্ঠ আলোকচিত্রগ্রাহক বলেও মনে করা হয়। অবসর সময়ে তিনি ব্যাডমিন্টন, দাবা, বিলিয়ার্ড, তাস ইত্যাদি খেলতে খুব ভালবাসতেন। ছোটোখাট যন্ত্রপাতি, যেমন অন্ধকারে লেখার একধরনের যন্ত্র লুইস নিজেই তৈরি করেছিলেন।
লিনিয়ার ও ম্যাট্রিক্স অ্যালজেব্রা, ম্যাথমেটিক্যাল আর সিম্বলিক লজিকের বিষয় নিয়ে ‘অ্যা সিলেবাস অব প্লেন অ্যালজেব্রাইক জিয়োমেট্রি’ নামে কাঠখোট্টা বই লেখেন যে লেখক তার হাত দিয়েই কিনা সৃষ্টি হয় অদ্ভুতুড়ে বিষয়ের ফোয়ারা ছোটানো, হাসির খই ফোটানো, আলো ঝলমলে, কল্পনার রাজ্যে নিয়ে যাওয়া ছোটদের বই ‘অ্যালিস ইন ওয়ান্ডারল্যান্ড’!
পারিবারিক জীবন
লুইস ক্যারলের জন্ম ১৮৩২ সালের ২৭ জানুয়ারি, ইংল্যান্ডের চেশায়ার কাউন্টির ডেরসবেরিতে। পিতৃ প্রদত্ত নাম চার্লস লুডউইগ ডজসন। মা-বাবার তৃতীয় সন্তান ছিলেন লুইস। ছোটবেলা থেকেই ভাইবোন, বিশেষত দিদি ও ছোট বোনের সঙ্গে তার নিবিড় বন্ধুত্ব ছিল। অভিজাত পরিবারের সন্তান লুইসের পূর্ব পুরুষদের অধিকাংশই হয় আর্মি অফিসার, নয়তো চার্চের বিশপ ছিলেন। ছোট থেকেই কঠোর নিয়মের মধ্যে বড় হয়েছিলেন বলেই তার মধ্যে নীতিবোধ ছিল প্রখর।
শিক্ষাজীবন
চার্লসের বাবা চার্লস ডজসন অল সেন্ট’স চার্চের কিউরেটর ছিলেন। অঙ্কে তার ছিল তুখোড় জ্ঞান। উত্তরাধিকার সূত্রে লুইস বাবার কাছ থেকেই অঙ্কের প্রতি গভীর অনুরাগ পেয়েছিলেন। বাড়ির প্রাথমিক পড়াশোনা শেষে লুইসকে ভর্তি করানো হয় রিচমন্ড পাবলিক স্কুলে। ১১ বছর বয়সে বাবার কর্মসূত্রে গোটা পরিবার নর্থ ইয়র্কশায়ারে চলে আসে।
১৪ বছর বয়সে উইকশায়ারের রাগবি স্কুলে চার্লস ভর্তি হন। কিন্তু স্কুলের পরিবেশ তার খুব একটা পছন্দ হয়নি। কিন্তু পড়াশোনায় তিনি বরাবরই কৃতী ছাত্র ছিলেন। অঙ্কে তার সহজাত প্রতিভা দেখে স্কুলের সব শিক্ষকই মুগ্ধ হতেন। এসময় সাহিত্যের প্রতি তার অগাধ ভালবাসা জন্মায়।
ছেলেবেলায় তিনি ভাইবোনদের আনন্দ দেওয়ার জন্য অনেক ছোট গল্প ও কবিতা লিখেছিলেন। ছোটবেলা থেকেই নানা অসুখে ভুগতে থাকেন তিনি। অল্প বয়স থেকে কানে কম শোনা এবং তোতলামির সমস্যায় ভুগতে থাকেন। এর মাঝেই জীবনকে তিনি উপভোগ করে গেছেন আপন মহিমায়। ছোটদের সাথে সহজেই মিশে যেতে পারতেন, সকলকে গান শোনাতে, গল্প বলতে ও অন্যকে নকল করে দেখাতে খুব পছন্দ করতেন। ভাই-বোনদের সঙ্গে মিলে বের করতেন হাতে লেখা একাধিক পারিবারিক পত্রিকা। পত্রিকাগুলোতে উঁকি দিত তার নানারকম অদ্ভুত চিন্তা-ভাবনা, শব্দের জাদু, প্যারডির উচ্ছল প্রবণতা।
১৮৫১ সালে লুইস জুনিয়র স্কুল সমাপ্ত করে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রাইস্ট চার্চ কলেজে ভর্তি হন। সেই বছরই তার মা মারা যান। ১৮৫৪ সালে অঙ্কে ফার্স্ট ক্লাস পেয়ে লুইস গ্র্যাজুয়েট হন।
কর্মময় জীবন
ভাল ফলাফলের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রাইস্ট চার্চ কলেজে লেকচারার হিসেবে যোগ দেন লুইস। দীর্ঘ ২৬ বছর সেই কলেজেই তিনি পড়িয়েছিলেন। ১৮৮১ সালে চাকরি থেকে অবসর নেন। অবসর নেয়ার পর হেনরি লিডেল ক্রাইস্ট চার্চ কলেজের কিউরেটর নিযুক্ত হন। ১৮৮২-৯২ সাল পর্যন্ত লুইস এই কলেজে তার কর্মময় জীবন অতিবাহিত করেন। এর মধ্যে তিনি ১৮৬১ সালে অক্সফোর্ডের এক চার্চের যাজক নিযুক্ত হয়েছিলেন।
‘অ্যালিস ইন ওয়ান্ডারল্যান্ড’ সৃষ্টির ইতিহাস
১৮৬৫ সালে প্রকাশিত হওয়া এই উপন্যাসটি তৈরির পিছনে রয়েছে এক চমকপ্রদ ইতিহাস। গল্পের শুরু এর কয়েক বছর আগে। জুলাই মাসের এক ঝলমলে সকালে অক্সফোর্ডের ক্রাইস্ট চার্চ কলেজের ডিনের তিন মেয়ে লোরিনা, অ্যালিস আর এডিথ লিডল অনুমতি পায় তাদের প্রিয় খেলার সঙ্গী ও গল্প বলার বন্ধু ক্রাইস্ট চার্চ কলেজেরই প্রফেসর চার্লস লুডউইগ ডজসনের সঙ্গে পিকনিকে যাওয়ার।
কলেজের ছাত্রদের অঙ্ক আর লজিকের মতো শক্ত বিষয় পড়াতে এই প্রফেসরের ভাল লাগলেও তার প্রকৃত ভালবাসার পৃথিবীটা ছিল একদম ভিন্ন। ছোটদের সাথে সময় কাটাতে খুব পছন্দ করতেন তিনি। ভালবাসতেন ছোটদের জন্য মজার ছড়া, গল্প বানাতে আর সেসব সুন্দর মুহূর্ত ক্যামেরায় ধরে রাখতে।
আইসিস নদীর ওপর দিয়ে সেই ছোট্ট বন্ধুদের নিয়ে প্রফেসর যখন নৌকা চালাচ্ছিলেন, তখন ছোট্ট বন্ধুরা প্রফেসরের কাছে আবদার করলো তাদের গল্প শোনাতে হবে। এর মধ্যে প্রফেসরের সবচেয়ে ন্যাওটা ডিনের মেজো মেয়ে অ্যালিসের বায়না তাকে নিয়ে মজার গল্পটি বলতে হবে। সেদিনের সেই পিকনিকে প্রফেসর মুখে মুখেই তার ছোট্ট বন্ধুদের আবদার রাখতে বুনতে থাকেন গল্পের জাল। যখন তার গল্প বলা শেষ হলো, তখনও ছোট্ট বন্ধুদের ভাল লাগার আবেশ কিছুতেই শেষ হতে চায় না। তাই দশ বছরের অ্যালিস বায়না জুড়ে দিলো, তাকে পুরো গল্পটা লিখে দিতে হবে।
ছোট্ট বন্ধুর অনুরোধে প্রফেসর একটু সাজিয়ে-গুছিয়ে লিখে ফেলেন সে দিনের বানিয়ে বলা গল্পটি। পাতায় পাতায় জুড়ে দেন নিজের হাতে আঁকা ছবি। শেষে জুড়ে দেন তার তোলা অ্যালিসের একটি ছবি। ১৮৬৪ সালে বড়দিনের উপহার হিসেবে চার্লস তার ছোট্ট বন্ধু অ্যালিসকে উপহার দেন সবুজ চামড়ায় বাঁধানো, ছবিতে ভরা, হাতে লেখা এক আশ্চর্য সুন্দর বই- ‘অ্যালিস’স অ্যাডভেঞ্চারস আন্ডারগ্রাউন্ড’।
বইটি মুদ্রিত আকারে প্রকাশের সময় লেখক গল্পে কিছুটা পরিবর্তন আনেন। বইয়ের প্রচ্ছদ আঁকেন বিখ্যাত কার্টুনিস্ট-ইলাস্ট্রেটর জন টেনিয়েল। বইয়ের নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় ‘অ্যালিস’স অ্যাডভেঞ্চারস ইন ওয়ান্ডারল্যান্ড’। বইটি প্রকাশনার দায়িত্বে ছিল লন্ডনের নামকরা পাবলিশিং হাউস ম্যাকমিলান। লেখকের নাম হিসেবে চার্লস ‘লুইস ক্যারল’ ছদ্মনামটি ব্যবহার করেন। এই বইয়ের জনপ্রিয়তায় পরবর্তীতে চার্লস লুডউইগ ডজসন নামটি হারিয়ে যায়। পরিচিতি পেতে থাকেন তিনি লুইস ক্যারল ছদ্মনামে।
অদ্ভুত স্বভাবের কল্পনাবিলাসী লেখকের শেষ জীবন
লুইসের বন্ধু-বান্ধবদের অধিকাংশই ছিল বাচ্চা ছেলে-মেয়ে। তার ছোট্ট বন্ধুদের প্রায়শই তিনি মিষ্টি-মিষ্টি মজার চিঠি লিখতেন। ট্রেনে করে অনেক দূরে বা সমুদ্রের ধারে বেড়াতে যাওয়ার সময় লুইস সঙ্গে একরাশ খেলনা, পাজল ইত্যাদি নিয়ে যেতেন। যদি কোনো বাচ্চার সঙ্গে রাস্তায় দেখা হয়ে যেত, তাহলে তার সঙ্গে এগুলো নিয়ে নিমিষে বন্ধুত্ব পাতিয়ে ফেলতেন।
তার অনেক অদ্ভুত স্বভাব ছিল। তিনি নাকি দিনে একবার খেতেন; ডায়েরিতে প্রতিদিনের সমস্ত খুঁটিনাটি বিবরণ, এমনকি খাবারের মেন্যু পর্যন্ত লিখে রাখতেন, পাছে কেউ তাকে পরপর দু’দিন একই খাবার না খেতে দেয়! তার ডায়েরির ১৩টি খন্ড পাওয়া যায়। মৃত্যুর ৩৭ বছর আগে থেকে তিনি যত চিঠি লেখেছেন, সব নথিভুক্ত করে রেখেছিলেন। সেই রেজিস্টারের ২৪টি খন্ড ছিল এবং সেখানে ৯৮,৭২১টি চিঠির হিসেব পাওয়া যায়।
অজস্র ভাষায় তার লেখা অনুদিত হয়েছে। এতদিন পরেও তার লেখা ছোটদের অনবদ্য সব উপন্যাস, গল্প ও কবিতাগুলোর জনপ্রিয়তা আকাশছোঁয়া । শব্দ নিয়ে বুদ্ধিদীপ্ত ভাঙচুর, ছত্রে-ছত্রে মজা, হাস্যরস এবং লাগামহীন কল্পনার সৃষ্টিশীলতার জন্য তার রচনা এখনও সব বয়সী পাঠকদের কাছে পছন্দের তালিকার প্রথম সারিতেই অবস্থান করছে।
১৮৬৫ সালের প্রথম সংস্করণের পর থেকে এখন পর্যন্ত ‘অ্যালিস ইন ওয়ান্ডারল্যান্ড’ বেস্টসেলার বইটি একবারের জন্যও আউট অব প্রিন্ট হয়নি। অ্যালিস ইন ওয়ান্ডারল্যান্ড এর পরে ক্যারল লিখেছেন, ‘থ্রু দ্য লুকিং গ্লাস’, ‘দ্য হান্টিং অব দ্য স্নার্ক’ ও ‘সিলভি অ্যান্ড ব্রুনো’র মতো বই। ছোটদের জন্য তৈরি করেছেন অঙ্কের টেক্সট বই, বহু মজার খেলা, নানা ধরনের ধাঁধা, লজিক গেম ও শব্দ দিয়ে তৈরি নানা মজার খেলা।
১৮৯৮ সালে বোনের বাড়ি ‘দ্য চেস্টনাট’ এ ‘চিরকিশোর’ মানুষটি শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। ইংল্যান্ডের গিল্ডফোর্ডে ‘দ্য মাউন্ট’ সমাধিস্থানে অন্য ভাই-বোনদের পাশাপাশি চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন এই স্বপ্নবিলাসী লেখক।
ফিচার ইমেজ: Thomas Kinkade