সত্তর ও আশির দশককে বাংলাদেশের ফুটবলের ইতিহাসে স্বর্ণযুগ বলা চলে। সেসময়ের বাংলাদেশ ফুটবল লীগের দুই প্রতিদ্বন্দ্বী দল আবাহনী ও মোহামেডানের দ্বৈরথ দেখার জন্য খেলার মাঠের গ্যালারিগুলো যেমন ছিল দর্শকদের ভিড়ে পরিপূর্ণ, ঠিক তেমনি এই খেলার রেডিও ধারাবিবরণী এবং পরবর্তীতে টিভি পর্দায় সেই খেলার সরাসরি সম্প্রচার দেখার জন্য গ্রামে-গঞ্জে, পাড়া-মহল্লায় মানুষের ঔৎসুক্য ছিল চোখে পড়ার মতো। ৯০ মিনিটের সেই খেলার জন্য সারা বাংলাদেশ তখন থমকে যেতো। বাংলাদেশের মানুষ আবাহনী ও মোহামেডান এই দুই দলে বিভক্ত হয়ে পড়তো।
এই খেলার জন্য দেশের মানুষ এতটাই আবেগতাড়িত হয়ে পড়তো যে, পছন্দের দল না জিতলে বিপক্ষ দলের সমর্কদের সাথে হাতাহাতি থেকে শুরু করে অনেক সময় রীতিমতো ভয়ঙ্কর ধরনের সংঘাতে রূপ নিতো। মানুষ এতটাই ফুটবল অনুরাগী ছিল যে কথিত রয়েছে, সেসময় নাকি কোনো কট্টর আবাহনী সমর্থকের মেয়ের সাথে কোনো কট্টর মোহামেডান সমর্থকের ছেলের বিয়ে কল্পনাই করা যেত না।
তখনকার ফুটবল মাঠে একটা গল্প বেশ প্রচলিত ছিল। এক ফুটবল পাগল ভক্ত প্রথম ঢাকায় এসে প্রিয় দলের খেলা আছে জেনে কষ্টেসৃষ্টে একটি টিকিট জোগাড় করে ঢুকে পড়লেন গ্যালারিতে। কিন্ত তিনি জানতেন না যে, তিনি যে গ্যালারিতে বসেছেন সেটি ছিল বিপক্ষ দলের সমর্থকে পরিপূর্ণ। খেলা শুরু হওয়ার পর খেলা এগিয়ে চলছে। এর মধ্যেই তার পছন্দের দলটি গোল করে বসেছে। প্রিয় দলের গোলে তিনি খুশি চেপে রাখতে না পেরে চিৎকার করে উঠলেন। ব্যস! শুরু হয়ে গেলো ধুন্ধুমার কান্ড। সেসময়ে ফুটবল নিয়ে বাংলাদেশের মানুষের পাগলামি এমনই তীব্র ছিল।
হবেই না বা কেন? সেসময় বাংলাদেশের ফুটবলে সালাউদ্দিন, চুন্নু, বাদল রায়, সাব্বির, কায়সার, কানন, ওয়াসিম, রুমি, আসলাম, মহসিনদের মতো কত অসাধারণ সব ফুটবল প্রতিভার জন্ম হয়েছিল, তার ইয়ত্তা নেই। বাংলাদেশের এমনই এক ফুটবল প্রতিভার গল্প শোনাবো আজ, যার খেলা দেখে একসময়ের বাংলাদেশ জাতীয় ফুটবল দলের জার্মান কোচ অটো ফিস্টার বলেছিলেন, “He was mistakenly born in Bangladesh”। বাংলাদেশে জন্ম হওয়ায় বহির্বিশ্ব যার প্রতিভার স্ফূরণ দেখতে পারলো না বলে কোচের আক্ষেপ যে ফুটবলারকে নিয়ে, তিনি একসময় বাংলাদেশের ফুটবলের রক্ষণসেনা হয়ে মাঠকাঁপানো এক অনন্য দৃঢ় চরিত্রের ফুটবলার মোনেম মুন্না। বাংলাদেশের ফুটবল ইতিহাসে সেরা ডিফেন্ডারদের একজন বলে গণ্য করা হয় তাকে। তার হাত ধরে ফুটবলের আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশ পেয়েছিল একাধিক সাফল্য।
১৯৬৮ সালের ৯ জুন নারায়ণগঞ্জে তার জন্ম। ছোটবেলা থেকে ফুটবলের প্রতি ছিল তার ভীষণ ঝোঁক। খেলতেনও বেশ ভাল। ১৯৮০-৮১ সালে পায়োনিয়ার ডিভিশনে গুলশান ক্লাবের হয়ে নাম লেখান, আর এর মধ্য দিয়ে প্রতিযোগিতামূল ফুটবলে মুন্নার অভিষেক ঘটে। পরের বছর যোগ দেন দ্বিতীয় বিভাগের দল শান্তিনগরে।
মুন্না প্রথম নজর কাড়েন বাংলাদেশের জাতীয় দলের বিরুদ্ধে এক প্রীতি ম্যাচে অংশ নিয়ে। নারায়ণগঞ্জের জেলা দলের হয়ে সেই ম্যাচে মুন্না নজরকাড়া নৈপুণ্য প্রদর্শন করেন। তার খেলা দেখে জাতীয় দলের সিনিয়র ফুটবলাররা মুগ্ধ হয়ে যান। সেসময় মুন্নার বয়স ছিল মাত্র ১৪। খেলা শেষে সেসময়ের বাফুফের উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা স্বীকার করেন যে, এই বয়সেই এই ছেলে জাতীয় দলে খেলার যোগ্যতা রাখে।
১৯৮৩ সালে দ্বিতীয় বিভাগের দল মুক্তিযোদ্ধা সংসদ মুন্নাকে দলে নেয়। এ বছরই মুক্তিযোদ্ধা সংসদ দ্বিতীয় বিভাগ চ্যাম্পিয়ন হয়ে প্রথম বিভাগে উঠে আসে। ১৯৮৪-৮৫ এই দুই মৌসুম মুন্না প্রথম বিভাগে মুক্তিযোদ্ধা সংসদের হয়ে অসাধারণ নৈপুণ্য প্রদর্শন করেন। ১৯৮৬ সালে এক মৌসুমের জন্য চলে যান ব্রাদার্স ইউনিয়নে। সে সময়ে ব্রাদার্সের হয়ে তার দুরন্ত পারফরম্যান্সের কারণে নজরে পড়ে যান আবাহনীর কর্মকর্তাদের। ফলে ১৯৮৭ সালে যোগ দেন ঢাকার ফুটবল ক্লাবের অন্যতম এক পরাশক্তি আবাহনী ক্রীড়া চক্রে।
এ সময় আবাহনীর হয়ে মাঠ কাঁপাচ্ছিলেন আশরাফ উদ্দিন চুন্নু, গোলাম রাব্বানী হেলাল, আসলামের মতো তুখোড় সব ফুটবলাররা। সেসব অভিজ্ঞ ফুটবলারের পাশে তরুণ মুন্না তার পারফরম্যান্সের মাধ্যমে নিজের জায়গা করে নিতে সক্ষম হন। এরপর তিনি আর কখনো দল পরিবর্তন করেননি। আবাহনীই ছিল তার ধ্যান-জ্ঞান। এই দলের হয়ে পার করে দেন তার পুরো ফুটবল ক্যারিয়ার। আমৃত্যু জড়িয়ে ছিলেন এই দলের সাথেই। আবাহনীর ভরসার প্রতীক হয়ে উঠেছিলেন তিনি।
১৯৯১ সালে দলবদলে মুন্না আবাহনীর হয়ে রেকর্ড পরিমাণ পারিশ্রমিক পান, যা ছিল সেসময়ে পুরো দক্ষিণ এশিয়ার জন্য এক অনন্য রেকর্ড। আবাহনীর হয়ে তার ফুটবল ক্যারিয়ারে দলকে পাঁচবার ঢাকা লীগ এবং তিনবার ফেডারেশন কাপের শিরোপা জেতাতে সক্ষম হন। ১৯৯০ সালে যখন আবাহনীর সব ফুটবলার চড়া দামে মুক্তিযোদ্ধা ক্লাবে নাম লেখায়, তখন দলের প্রতি ভালোবাসায় একাই আবাহনীতে থেকে যান মুন্না। সে বছরেই একদল তরুণ ফুটবলারদের সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়ে দলকে লীগ শিরোপা জেতাতে সাহায্য করেন।
আবাহনীর হয়ে বাংলাদেশের ফুটবল লীগে দাপটের সাথে খেলতে খেলতে মুন্না নাম লেখান ভারতের অন্যতম স্বনামধন্য ফুটবল ক্লাব ইস্টবেঙ্গলে। ১৯৯১ ও ১৯৯৩ সালে কলকাতার অন্যতম জনপ্রিয় ক্লাব ইস্ট বেঙ্গল বিদেশী কোটায় তাকে দলে অন্তর্ভুক্ত করে। শুধুমাত্র দুই মৌসুম এই দলের হয়ে খেলেছিলেন এবং এই সময়ে দলকে লীগ শিরোপা ও ফেডারেশন কাপ জেতাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন মুন্না। এই সময় ইস্টবেঙ্গল সমর্থক এবং ফুটবলপ্রিয় বাঙালিদের মন জয় করে নিতে সক্ষম হন। তার অসাধারণ নৈপুণ্যের জন্য ইস্টবেঙ্গলের তখনকার কর্মকর্তারা স্বীকার করেছিলেন, “মুন্না একজন শক্তিশালী ডিফেন্ডার, যিনি একজন দারুণ ট্যাকলার এবং হেডার”। তার সম্পর্কে বলতে গিয়ে ইস্টবেঙ্গলের একসময়ের ক্লাব অফিশিয়াল দেবব্রত সরকার বলেছিলেন, “এই উপমহাদেশে মুন্নার মতো দ্বিতীয় আর একজন জন্মাবে না”। কলকাতায় মাত্র দুই মৌসুম খেলেই নিজের প্রতিভার স্বাক্ষর রেখে গেছেন এই কিংবদন্তী। ভারতে বাংলাদেশের ফুটবলের এক অনবদ্য বিজ্ঞাপন হয়ে উঠেছিলেন মোনেম মুন্না। তাই তো, ইস্ট বেঙ্গল ক্লাবের ‘হল অব ফেম’-এ মোনেম মুন্নাকে জায়গা দিতে দুবার চিন্তা করতে হয়নি ক্লাবটিকে।
মুন্না বিভিন্ন দলের হয়ে খেলার সময় ডিফেন্ডার হিসেবে স্টপার পজিশনই ছিল তার পছন্দের জায়গা। কিন্তু ইস্টবেঙ্গলে যোগ দিয়ে তৎকালীন ইস্টবেঙ্গল কোচ নাইমুদ্দিন তাকে খেলান লিবেরো বা সুইপার পজিশনে। এই পজিশনে খেলতে হলে একজন ফুটবলারকে শক্তিশালী, দারুণ ট্যাকলারে এবং লং পাসে দক্ষ হতে হয়। মুন্নার প্রতি কোচের প্রচন্ড আস্থা থাকায় তিনি মুন্নাকে ডিফেন্স লাইনের নিচে অনেকটা ফ্রি রোলে খেলার সুযোগ করে দেন। এর ফলে প্রতিপক্ষের আক্রমণকে প্রতিহত করা, ডিফেন্স লাইনের ভুলে বিপক্ষ দলের কাছে চলে যাওয়া বলকে ত্বরিত গতিতে ‘ক্লিয়ার’ করা এবং সুযোগ পেলে লং পাসে সতীর্থদের প্রতি আক্রমণে সাহায্য করার মতো গুরুদায়িত্বের ভার কোচ মুন্নার ওপর অর্পন করেন। মুন্না তার কোচের সেই আস্থার মর্যাদা দিয়েছিলেন। এই পজিশনেও মুন্না ছিলেন বেশ সাবলীল।
১৯৮৬ সালে সিউল এশিয়ান গেমসে অংশ গ্রহণের জন্য প্রথমবারের মতো জাতীয় দলে ডাক পান। তখন তার বয়স ছিল মাত্র ১৮ বছর। দুয়েকবার ইনজুরির কারণে দল থেকে বাদ পড়ার ঘটনা সরিয়ে রাখলে অবসর নেয়ার আগ পর্যন্ত টানা এগারো বছর তিনি ছিলেন জাতীয় দলের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও নির্ভরযোগ্য সদস্য।
১৯৯০ সালে বেইজিং এশিয়ান গেমসে প্রথমবারের মতো জাতীয় দলের অধিনায়ক নির্বাচিত হন মুন্না। ১৯৯৫ সালে বাংলাদেশ মিয়ানমারে চার জাতি প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়। সেই প্রতিযোগিতায় মুন্নার নেতৃত্বেই প্রথমবারের মতো আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশ কোনো শিরোপা জয় করে। টুর্নামেন্টে দলনেতা এবং ফুটবলার হিসেবে মুন্নার পারফরম্যান্স ছিল প্রশংসার দাবিদার। সে বছর তার নেতৃত্বে সাফ ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপে বাংলাদেশ দল রানার আপ হয়।
জনপ্রিয়তা এবং পারফরম্যান্সের জন্য নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি সময় কর্পোরেট বাণিজ্যের প্রধান আইকন হয়ে ওঠেন মোনেম মুন্না। বিশ্বখ্যাত প্রসাধনী প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান ইউনিলিভার ১৯৯৬ সালে মুন্নাকে বাংলাদেশের ব্র্যান্ড প্রতিনিধি হিসেবে সম্মানিত করে।
১৯৯৭ সালে ফুটবল থেকে অবসর নেয়ার পর ম্যানেজার হিসেবে প্রিয় ক্লাব আবাহনীর ফুটবল দলের দায়িত্ব নিয়েছিলেন। কিন্তু ১৯৯৯ সালে তিনি কিডনী রোগে আক্রান্ত হন। ২০০০ সালে কিডনী প্রতিস্থাপনের পর বেশ কিছুদিন বেঁচে ছিলেন। কিন্তু ২০০৪ সালে তার দেহে ক্ষতিকর ভাইরাস ধরা পড়ে। ২০০৫ সালের ২৬ জানুয়ারি গুরুতর অসুস্থ হয়ে ঢাকার একটি হাসপাতালে মাত্র ৩৯ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন বাংলাদেশ ফুটবলের আইকন মোনেম মুন্না। তখনও পর্যন্ত তিনি ম্যানেজার হিসেবে আবাহনী দলের দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছিলেন।
মোনেম মুন্না আজও বাংলাদেশের ফুটবল ইতিহাসে উজ্জ্বল এক নাম। পরিশ্রমী এবং আত্মপ্রত্যয়ী ফুটবলার হিসেবে ছিলেন অন্য সবার চেয়ে এগিয়ে। নিজের প্রতি তার এমনই বিশ্বাস ছিল যে, তিনি বিশ্বাস করতেন, তাকে ড্রিবল করে কিংবা পরাস্ত করে কোনো স্ট্রাইকার পার হতে পারবে না। তার শক্তিশালী ট্যাকলের স্বাদ পায়নি, এমন ফরোয়ার্ড পাওয়া ঢাকার মাঠে খুবই দুষ্কর। নৈপুণ্য দিয়ে শুধু মাঠ মাতিয়ে রাখাই নয়, একইসাথে দক্ষ নেতৃত্ব এবং দুর্দান্ত পেশাদারিত্বের এক জ্বলন্ত উদাহরণ ছিলেন মোনেম মুন্না। আর তাই এই উপমহাদেশের জনপ্রিয় ফুটবল আইকনে পরিণত হয়েছিলেন। ক্রীড়ামোদীরা তাই ভালবেসে তাকে ‘কিং ব্যাক’ হিসেবে সম্মানিত করেছিল।
এই উপমহাদেশের ফুটবল ইতিহাসে ডিফেন্ডার হিসেবে মুন্না যে উচ্চতায় নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন, তেমনটি আর কেউ পারেননি। মাঠের মধ্যে নিজের ওপর কত বিশ্বাস এবং প্রভাব থাকলে একজন ফুটবলার এতটাই জনপ্রিয় হয়ে উঠতে পারেন, তা বোঝার জন্য কোনো জ্যোতিষীর দরকার পড়ে না।
ফিচার ছবি: prothomalo.com