মধ্য ইউরোপের এক অপূর্ব সুন্দর দেশ পোল্যান্ড। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে এক ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট রচিত হয়েছিল এই পোল্যান্ড থেকেই। দ্য রিপাবলিক অফ পোল্যান্ড, যাকে পোল্যান্ড নামেই সবাই চেনে। দেশটিকে ঘিরে রয়েছে সাতটি দেশ। পশ্চিমে জার্মানি, পূর্বে ইউক্রেন ও বেলারুশ, উত্তরে লিথুয়ানিয়া ও রাশিয়া এবং দক্ষিণে চেক প্রজাতন্ত্র ও স্লোভাকিয়া। বাল্টিক সাগরের নীল জলরাশি আর কার্পেথিয়ান পাহাড়ের সবুজের ছায়ায় ঘেরা নীল সবুজের দেশ পোল্যান্ড। সংস্কৃতি আর ঐতিহ্যের এক অপূর্ব মেলবন্ধন এই ভূমি।
পোল্যান্ডের রয়েছে দীর্ঘ ও সমৃদ্ধ এক ইতিহাস। কয়েক হাজার বছর ধরে দেশটি নিজেদের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য পার্শ্ববর্তী রাজ্যগুলোর সাথে প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করে নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে সক্ষম হয়েছে। পূর্ব ও পশ্চিমের মধ্যকার ভূ-রাজনৈতিক অবস্থানের কারণে পোলিশ ইতিহাসে যুদ্ধ এবং বিদ্রোহের এক সংগ্রামমুখর ইতিহাস রচিত হয়েছে, যা কালের সাক্ষী হয়ে দেশটির আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে।
ঐতিহাসিকদের মতে, স্লাভিক উপজাতিরা প্রথম দেশটিতে বসতি স্থাপন করে। দশম শতাব্দীতে, পিয়াস্ট রাজবংশের শাসনামলে, রাজ্য হিসেবে পোল্যান্ড সর্বপ্রথম আত্মপ্রকাশ করে। ৯৬৬ খ্রিস্টাব্দে ব্যাপ্টিজম মতাবলম্বীরা দেশটিতে আসে এবং এ সময়ই তাদের প্রচেষ্টায় দেশটিতে খ্রিস্টধর্মের ব্যাপক প্রসার ঘটে।
ষোড়শ শতকের শেষের দিককে পোল্যান্ডের ইতিহাসে স্বর্ণযুগ বলা চলে। এ সময়ই জাগিয়েলনীয় রাজবংশের তত্ত্বাবধানে পোল্যান্ড ইউরোপের সবচেয়ে বৃহৎ, সমৃদ্ধ ও প্রভাবশালী রাষ্ট্রে পরিণত হয়। ১৩৮৫ সালে পোলিশদের হাত ধরে পাশের রাজ্য লুথিয়ানায়ও খ্রিস্টধর্মের প্রচার ও প্রসার ঘটে। তখন পোলিশ-লিথুনিয়ান ইউনিয়ন গঠিত হয়, যা ৪০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে চলে। পরবর্তীতে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন রাজ্য পোল্যান্ড-লুথিয়ানার ওপর তাদের আধিপত্য বিস্তার করতে চেষ্টা করে।
১৭৯১ সালের দিকে প্রতিবেশী রাষ্ট্র রাশিয়া, অস্ট্রিয়া ও প্রুশিয়া পোল্যান্ডকে অধিকার করে নিজেদের মধ্যে পোল্যান্ড রাজ্যটি ভাগ-বাটোয়ারা করে নেয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর দেশটি আবার স্বাধীনতার স্বাদ পায়। এরপর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে আবার পোল্যান্ডের ওপর আঘাত আসে।
১ সেপ্টেম্বর, ১৯৩৯ সালে নাৎসি জার্মানি পোল্যান্ড আক্রমণ করে রাজ্যটি দখল করে নেয়। এর মধ্য দিয়ে সূত্রপাত ঘটে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের। ১৭ সেপ্টেম্বর সোভিয়েত ইউনিয়ন অপ্রত্যাশিত আক্রমণ করে এবং দেশটি আবার পূর্ব ও পশ্চিমে ভাগ হয়ে যায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর, পোল্যান্ড সোভিয়েত ইউনিয়নের নিয়ন্ত্রণাধীন এক রাজ্য কমিউনিস্ট পিপলস রিপাবলিক পোল্যান্ড হিসেবে পরিচিতি পেতে থাকে। ফলে পোল্যান্ড তার বহু বছরের বিভিন্ন জাতিসত্ত্বার যে সম্মিলিত ঐতিহ্য ছিল, তা থেকে বিচ্যুত হতে থাকে।
১৯৮০ সালে কমিউনিস্ট রাষ্ট্রগুলোতে প্রথম স্বাধীন ট্রেড ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠিত হয়। এই সংস্কার আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিলেন পোলিশ নেতা লেচ ওয়ালিসা। মূলত তার নেতৃত্বে পূর্ব ইউরোপে সোভিয়েত নিয়ন্ত্রণ ভেঙে পড়ে। ১৯৮৯ সালে তৃতীয় পোলিশ প্রজাতন্ত্রের প্রথম নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। পোল্যান্ড সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র থেকে পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় প্রবেশ করে, প্রতিষ্ঠিত হয় উদার সংসদীয় গণতন্ত্র। ১৯৯৭ সালে দেশটির নতুন সংবিধান রচিত হয়। ১৯৯৯ সালে ন্যাটোর সদস্য হয় দেশটি এবং ২০০৪ সালে ইউরোপীয় ইউনিয়নে যোগদান করে।
অপূর্ব সুন্দর ও ঝকঝকে এক দেশ পোল্যান্ড। পোল্যান্ডে রয়েছে বহু দর্শনীয় স্থান। সেসব দর্শনীয় স্থান সম্পর্কে এবার তাহলে জেনে নেয়া যাক।
পজনান (Poznan)
পজনান পোল্যান্ডের পুরনো রাজধানী। শহরটির অন্যতম স্থান ওল্ড টাউন স্কোয়ার। এখানকার বিভিন্ন স্থাপনাতে প্রাচীনকালের গোথিক স্থাপত্য দেখা যায়, যা পর্যটকদের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু। টাউন স্কয়ারের বিভিন্ন জায়গায় দেখতে পাবেন ছাগলের নানা স্থাপত্য। এই কারণে পজনান শহরকে বলা হয়ে থাকে, ‘দ্য সিটি অব হেড বাটিং গোটস।’ এর পেছনে এক বহুল প্রচলিত গল্প রয়েছে। একবার শহরের এক বাবুর্চি হরিণের মাংস রান্না করতে গিয়ে পুড়িয়ে ফেলেন। তখনই তিনি তাড়াতাড়ি পাশের মাঠে চড়ে বেড়ানো দুটো ছাগলকে ধরে এনে তাদের মাংস রান্না করতে যাবেন, এমন সময় ছাগল দুটি বুঝতে পেরে রান্নাঘর থেকে পালিয়ে ওল্ড টাউন হলের চার্চের মাথায় উঠে যায়। আর স্থানীয়রা তখন থেকেই বিশ্বাস করতে শুরু করে যে ছাগল দুটি কোনো শুভ প্রতীক। তাই পোলিশদের জীবনের সাথে জড়িয়ে রয়েছে হেডবাটিং গোটসের আইকনটি। চার্চের ঘড়িতে দুপুর বরোটার ঘন্টাধ্বনি হতেই দুটি যান্ত্রিক ছাগল বেলের মাথা থেকে একটি জানালা দিয়ে বাইরে এসে দাঁড়ায়। দুই ছাগলে কিছুক্ষণ শিঙে শিঙে গুঁতোগুঁতি করে আবার ভেতরে প্রবেশ করে।
রক্লো (Wroclaw)
পজনান হয়ে নতুন শহর রক্লো যাবার পথে চারদিকে চোখে পড়বে ঘন সবুজ জঙ্গল। পাশে বয়ে যাচ্ছে ওডার নদী। ওডার নদীর ধারে অবস্থিত পশ্চিম পোল্যান্ডের এক বৃহত্তম শহর রক্লো । শতাব্দী ধরে প্রিসিয়া, পোল্যান্ড, জার্মানি এবং বোহেমিয়াদের দ্বারা শাসিত হয়েছে এই শহর। কিন্তু ১৯৪৫ সালের পর থেকে শহরটি পোল্যান্ডের অংশ হয়ে গেছে। শহরটিতে রয়েছে অনন্যসাধারণ কিছু স্থাপত্য। তবে শহরের প্রধান আকর্ষণ মার্কেট স্কয়ার, ওল্ড টাউন হল ও সেন্ট এলিজাবেথ চার্চ। এই শহরটির চারপাশ দেখার জন্য চার্চের সাথে রয়েছে একটি অবজারভেশন টাওয়ার। এখানেই রয়েছে পোল্যান্ডের বৃহত্তম চিড়িয়াখানা। পর্যটকদের জন্য ওডার নদীতে নৌকায় চেপে শহরটির চারদিক ঘুরে দেখার ব্যবস্থা রয়েছে।
ওয়ারস (Warsaw)
পোল্যান্ডের রাজধানী ওয়ারস যেন ছাই থেকে উঠে আসা ফিনিক্স পাখি। শাস্ত্রীয় সুরকার ফ্রেড্রিক চপ্পিনের জন্মস্থান এই শহর। দ্বাদশ শতকের কাছকাছি সময়ে শহরটির গোড়াপত্তন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় শহরটির অনেকটাই ধ্বংস করে ফেলা হয়েছিল। বিশ্বযুদ্ধের পর শহরটিকে আবার নতুনভাবে পুনরুজ্জীবিত করা হয়। ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট এবং সাংস্কৃতিক কেন্দ্র হিসেবে শহরটিকে সাজিয়ে তোলা হয়েছে। শহরের ওল্ড টাউন স্কোয়ারের মাঝখানে রয়েছে ঢাল-তলোয়ার হাতে মারমুখী মৎস্যকন্যার এক বিশাল স্থাপত্য যা সকলের দৃষ্টি কাড়ে। এই স্থাপত্যের কারণে ওয়ারসকে বলা হয় ‘দ্য সিটি অফ মারমেইড’। এখানেই রয়েছে কোপারনিকাস বিজ্ঞান কেন্দ্র, যা পর্যটকদের কাছে অন্যতম আকর্ষণীয় স্থান।
তোরান (Torun)
ভিস্তুলা নদীর ধারে অবস্থিত জ্যোতির্বিজ্ঞানী কপারনিকাসের জন্মস্থান হিসেবে পরিচিত তোরান শহরটি ন্যাশনাল জিওগ্রোফির চোখে বিশ্বের ৩০টি সুন্দর শহরের মধ্যে জায়গা করে নিয়েছে। শহরটিতে এখনও মধ্যযুগের বেশ কয়েকটি পুরনো স্থাপনা রয়েছে। শহরের টাউন হলটি ত্রয়োদশ শতকে নির্মিত। ঐ সময়ের অনেক পুরাতন গির্জা, ক্যাথেড্রাল পর্যটকদের দৃষ্টিতে আকর্ষণীয় স্থান।
চেস্টচোয়া (Czestochowa)
শহরটির গুরুত্বপূর্ণ দর্শনীয় স্থান ব্ল্যাক ম্যাডোনার স্থাপত্য। এটি রাখা আছে জাস্না গোরা মনেস্ট্রিতে। চতুর্দশ শতাব্দীর এক অনবদ্য স্থাপনা এবং পর্যটকদের অন্যতম এক তীর্থস্থান এই মনেস্ট্রি। পোল্যান্ডের জাতীয় ঐতিহাসিক মনুমেন্টগুলোর একটি এটি। ব্ল্যাক ম্যাডোনা স্থাপত্যটিতে রয়েছে কুমারী মেরি এবং তার কোলে শিশু যীশু, দুজনেই কৃষ্ণাঙ্গ। পোলিশদের বিশ্বাস, ব্ল্যাক ম্যাডোনার কাছে কোনো কিছু তীব্রভাবে চাইলে তিনি তা পূরণ করেন।
ক্র্যাকো (Krakow)
পোল্যান্ডে ওয়াওয়েল পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত ক্র্যাকো শহরটি। ক্র্যাকোকে ধনীদের শহর বলা হয়ে থাকে। এটি পোল্যান্ডের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর। সপ্তম শতাব্দীতে একটি গ্রাম হিসেবে ক্র্যাকো পরিচিতি লাভ করে। বর্তমানে শহরটি সাংস্কৃতিক, প্রশাসনিক এবং অর্থনৈতিক কার্যক্রমের জন্য অধিক পরিচিত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়, নাৎসিরা ইহুদীদের ধরে এনে ক্র্যাকোর একটি ঘাঁটিতে প্রাথমিকভাবে রাখার ব্যবস্থা করেছিল এবং পরবর্তীতে সেখান থেকে তাদেরকে কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে পাঠিয়ে দেয়া হতো। শহরটির পাশ দিয়ে বয়ে গেছে ভিস্তুলা নদী। পুরাতন শহরের স্মৃতিচিহ্ন নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ক্র্যাকো। শহরের মেইন টাউন স্কয়ারের পথ ধরে এগিয়ে যেতে যেতে চোখে পড়বে প্রাচীন পোল্যান্ড স্থাপত্য ও ঐতিহ্যের এক অপূর্ব শিল্পকর্ম।
ম্যালবর্ক (Malbork)
মধ্যযুগের নিদর্শনের এক শহর ম্যালবর্ক। তবে জার্মানীদের দেয়া ‘মেনেনবুর্গ’ নামটি সর্বাধিক পরিচিত। ত্রয়োদশ শতাব্দীতে টিউটনিক সাম্রাজ্য এখানে তাদের সদর দফতর প্রতিষ্ঠা করে। মধ্যযুগীয় নানা নিদর্শনের সাক্ষী এই ম্যালবর্ক। এখানে রয়েছে ইউরোপের বৃহত্তম গোথিক দুর্গ, যার নামকরণ করা হয়েছে ভার্জিন মেরির নামে। শহরটিতে রয়েছে তিনটি ঐতিহাসিক দুর্গ। এগুলো বিশ্বের প্রথম ইটের তৈরি দুর্গ। এই দুর্গ নির্মাণে নাকি আনুমানিক ২৩০ বছর লেগেছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় দুর্গের অধিকাংশই ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। পরবর্তীতে পেলিশ সরকার তা পুনরুদ্ধারে সচেষ্ট হয়।
গেডেন্সক (Gdansk)
ডেনজিগ নামেও শহরটি পরিচিত। উত্তর পোল্যান্ডের সবচেয়ে বড় শহর এবং প্রধান বন্দর এই গেডেন্সক। বাল্টিক সাগরের তীরে অবস্থিত দশম শতকের কাছাকাছি সময়ে নগরটি প্রতিষ্ঠিত। শহরটির এক মিশ্র রাজনৈতিক ইতিহাস আছে। বিভিন্ন সময়ে শহরটি জার্মানি এবং পোল্যান্ডের অন্তর্গত ছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পোল্যান্ডের স্থায়ী এক অংশ হিসেবে শহরটি আত্মপ্রকাশ করে। শহরটিতে অনেক ঐতিহাসিক নিদর্শন রয়েছে। পোলিশ রাজাদের ভ্রমণের জন্য নির্মিত রয়েল রোড, সেন্ট মেরি গির্জা এবং বিশ্বের বৃহত্তম ইট গির্জা অন্যতম দর্শনীয় স্থান।
এছাড়া পোলান্ড দেশটিতে অসউইজ, টাট্রা পর্বত, বেইলওইজা ফরেস্ট, লুবিন, সোপোত শহরের মতো আরো অনেক খ্যাতিসম্পন্ন দর্শনীয় টুরিস্ট স্পট রয়েছে যা পর্যটকদের মনে জায়গা করে নিয়েছে।
দেশটিতে ভ্রমণ করলে একজন দর্শনার্থী যেমন বিশ্বের পুরাতন শহরের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের স্বাদ যেমন পেতে পারেন, ঠিক তেমনি আধুনিকতার ছোঁয়ায় গড়া ত্রিমাত্রিক জগৎ দেখেও বিমুগ্ধ হতে পারেন। প্রতিটি দর্শনীয় স্থানেই রয়েছে পর্যটকদের থাকা খাওয়ার সুব্যবস্থা। তবে আর দেরি কেন? এখনই বেরিয়ে পড়ুন ইতিহাস ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যে ঘেরা পোল্যান্ডের উদ্দেশ্যে।
ফিচার ইমেজ: wikimedia commons