বিকেল বেলায় অ্যালার্মের শব্দে ঘুমটা হঠাৎ করে ভেঙে যেতেই বুকটা বেশ কিছুক্ষণ জোরে জোরে হাতুড়ি পেটানোর শব্দ শুনিয়ে গেলো। ঘুম ঘুম চোখেই মেসেজ আর নোটিফিকেশন চেক করতে ফেসবুকে ঢুকলাম। সাথে সাথে পরিচিত এক বড় ভাইয়ের স্ট্যাটাসে #MeToo হ্যাশট্যাগ দেখে আটকে গেলাম, বুঝতে চাইলাম ব্যাপারটা আসলে কী। সেই ভাইয়ের স্ট্যাটাসটা ছিলো এমন-
“#MeToo Protect your boy child too J”
সাথে সাথেই কেমন যেন শারীরিক নির্যাতন জাতীয় কোনোকিছুর আভাস পেয়ে অজানা আশঙ্কায় বুকটা কেঁপে উঠলো। আসলে বর্তমানে আমরা এমন সময়ে বাস করছি যে, যখন তখন আমাদেরকে কোনো না কোনো নারীর উপর শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের খবর শোনার জন্য প্রস্তুত থাকতে হয়। যৌন হয়রানির মতো নিকৃষ্ট একটি ব্যাপার হয়ে উঠেছে বেশ প্রচলিত একটি ঘটনা, যা কোনোভাবেই কাম্য নয়।
যা-ই হোক, আসল ব্যাপারটি ঘাটাতে ফেসবুকে #MeToo হ্যাশটাগ লিখে সার্চ দিতেই চোখ ছানাবড়া হবার দশা। বন্ধু তালিকায় আরো অনেকেই একই হ্যাশট্যাগ দিয়ে স্ট্যাটাস দিয়েছে। সবার স্ট্যাটাসের মূল বক্তব্যই যৌন হয়রানিকে কেন্দ্র করে। সমাজের বর্তমান অবক্ষয়কে অনুসরণ করে স্ট্যাটাস প্রদানকারীদের মাঝে নারীদের সংখ্যাই ছিলো অনেক। সেই সাথে অনেক পুরুষও এই অবক্ষয়ের প্রতিকার চেয়ে হ্যাশটিগটি দিয়ে স্ট্যাটাস আপলোড করেছেন।
প্রতিটি স্ট্যাটাসেই মিশে রয়েছে আর্তনাদ, দৈনন্দিন জীবনে চলতে গিয়ে নারীদের যেসব যৌন হয়রানির সম্মুখীন হতে হয় সেগুলোর খণ্ডচিত্র, মানুষরুপী পশুদের বিরুদ্ধে জেগে ওঠার ডাক এবং সর্বোপরি একটি সুন্দর সমাজ বিনির্মাণের লক্ষ্যে সকলকে আন্তরিকতার সাথে এগিয়ে আসার আহ্বান।
লেখার খাতিরে প্রথমে সেসব স্ট্যাটাস থেকে ঘুরে না আসলে ভার্চুয়াল জগতে ঘুরপাক খাওয়া হাহাকারের প্রকৃত মাত্রা অনুধাবন করা সম্ভব নয়। তাই আগে চলুন সেসব স্ট্যাটাসই দেখে আসা যাক আগে।
এ ব্যাপারে নিজের হতাশা ব্যক্ত করে ফাহমিদা ফারজানা অনন্যা লিখেছেন,
“#Metoo গল্পগুলো অন্য কোন দিনের জন্য তোলা থাক। এখনকার মত শুধু একটা দীর্ঘশ্বাস :)”
হ্যাশটিগটির হঠাৎ করেই বিপুল প্রচলন দেখে দাউদ আহমেদ অনিক আশঙ্কা ব্যক্ত করে লিখেছেন,
“these too many #metoo s prove the condition of our country!”
ওদিকে এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য কী করা যেতে পারে, সেই সম্পর্কে চমৎকার কিছু পরামর্শ দিয়েছেন মইনুল ইসলাম শুভ। তার মতে,
“#metoo এবং #notme নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে যে হাইপ উঠেছে তার পজিটিভ দিক আছে, কিন্তু চিরাচরিতভাবে সচেতন মানুষগুলো এখানে কমন। ১০ টাকায় ১০ জিবি ইন্টারনেট বা ধামাকাদার লাখো ভিউওয়ালা গানের মত যদি মূল্যবোধ বা অন্য লিংগকে সম্মান করার শিক্ষা সাধারণ বা অতি সাধারণের দোরগোড়ায় না পৌঁছানো যায় তাহলে কিছুই ফলপ্রসু হবে না। গণমাধ্যম এবং স্কুল-কলেজে নিয়মিত পাঠদানের সাথে যদি এই শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা যেতো তা বোধোদয় অনেকটা এগিয়ে যেতো।”
জনপ্রিয় বাংলা ফেসবুক গ্রুপ Do Something Exceptional (DSE)-এ লিজা শামীম এই বিষয়ে সচেতনতা তৈরি করতে লিখেছেন,
“#metoo
If all the women and men who have been sexually harassed or assaulted wrote “Me too” as a status update, we might give people a sense of the magnitude of the problem.
Copy and paste to share if you’ve been a victim at any age, in whatever scale. #metoo”
নিজের দুঃসহ অভিজ্ঞতার কথা উল্লেখ করে ঈথা চাকমা লিখেছেন,
“#metoo was molested as in a child, sexually harassed and assulted as I grew up, looked down by men on gender taboos andnd stigmas, objectified for having habits as in men; #metoo faced violence in relationship, still get eye-raped almost every single day I go out in the city; #metoo faced other women criticising me for having/practising equal rights as in men.
If all the women who have been sexually harassed or assaulted wrote “Me too” as a status, we might give people a sense of the magnitude of the problem. #metoo
Please copy/paste if appropriate.”
শৈশব ও কৈশোরে একইরকম হয়রানির যন্ত্রণাময় অভিজ্ঞতার কথা ফেসবুকে শেয়ার করেছেন শেখ ফাতেমা ওয়ারা-
“#MeToo
I was also harassed as like so many girls in the world! I was harassed when I was a kid of class 3, I was almost abused when i was only a student of class 8!
I didn’t know how to react at that time but after some time I learnt to react, to shout, to slap, to punch and overall to be bold.
Keep up your courage girls, speak up before it’s too late.”
উপরে ছয়জনের ফেসবুক স্ট্যাটাস দেখেই বোঝা যাচ্ছে যে, সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্বব্যাপী অত্যন্ত আলোচিত বিষয়গুলোর মাঝে এটি একটি। শুধু ফেসবুকই বা বলছি কেন, একই কথা বলা যাবে টুইটারের বেলাতেও। এখন পর্যন্ত দুই শব্দের এ হ্যাশট্যাগটি ৫ লাখেরও অধিকবার ব্যবহৃত হয়েছে টুইটারে। ফেসবুক এক্ষেত্রে আরো এগিয়ে। জনপ্রিয় এ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এখন পর্যন্ত ৬ লাখ বারেরও বেশি ব্যবহৃত হয়েছে #MeToo হ্যাশট্যাগ, যার ফলশ্রুতিতে এ বিষয়ে আলাপচারিতা ছাড়িয়েছে ৬০ লাখের সীমানা!
যে হ্যাশট্যাগ নিয়ে এত আলোচনা, সেটা হঠাৎ করে কোথা থেকে আর কোন ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতেই বা এলো সেটা নিয়ে অনেকেরই কৌতুহলের শেষ নেই। এবার চলুন সেই ঘটনার কথাই জানা যাক।
সাম্প্রতিক সময়ে হলিউড পাড়া সরগরম হয়ে উঠেছে হার্ভে ওয়েইনস্টাইনের মতো প্রখ্যাত চলচ্চিত্র প্রযোজকের বিরুদ্ধে ওঠা যৌন হয়রানির অভিযোগকে কেন্দ্র করে। দ্য গ্যাংস অফ নিউ ইয়র্ক, পাল্প ফিকশন, দ্য ইংলিশ পেশেন্ট, স্পাই কিডস, দ্য লর্ড অফ দ্য রিংস ট্রিলজির মতো বিখ্যাত সব চলচ্চিত্রের প্রযোজনা করেছেন তিনি। শুধু তা-ই নয়, ১৯৯৮ সালে ‘শেক্সপিয়ার ইন লাভ’ সিনেমার জন্য তিনি অস্কারের মতো মহামূল্যবান পুরষ্কারও বগলদাবা করে নেন।
অথচ এমন গুণী একজন মানুষের ভেতরেও যে এত ভয়াবহ একটি পশু বসবাস করতে পারে, সেটা ঘুণাক্ষরেও কল্পনা করেনি তার ভক্তসমাজ, যা জানা ছিলো শুধুমাত্র তার অঙ্গনে কাজ করা মানুষদেরই। এতদিন তার দ্বারা যৌন হয়রানির শিকার হওয়া নারীরা চুপ করে থাকলেও শেষ পর্যন্ত ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যায় তাদের। তাই একে একে অভিযোগ আসতে থাকে নানা দিক থেকে। অভিযোগকারীদের মাঝে রয়েছেন অ্যাঞ্জেলিনা জোলি, রোজ ম্যাকগুয়েন, কারা ড্যালেভিনের মতো অভিনেত্রীরা।
হয়রানির শিকার হওয়া অভিনেত্রীদের অভিজ্ঞতার কথা শুনলে আশ্চর্য হয়ে যেতে হয়।
- ফরাসি অভিনেত্রী ও মডেল ইভা গ্রিন ওয়েইনস্টাইনের হাতে হয়রানির শিকার হন প্যারিসে। বুড়োকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে সেখান থেকে চলে আসেন তিনি।
- তার হাতে হেনস্তার শিকার হয়ে প্রথমবারের পরই তার সাথে আর কোনো কাজ করেন নি অ্যাঞ্জেলিনা জোলি।
- মার্কিন অভিনেত্রী গিনেথ প্যালট্রোর বয়স যখন ২২ বছর, তখন শুটিং শুরুর আগে হোটেল স্যুটে তার গায়ে হাত দেন ওয়েইনস্টাইন, প্রস্তাব দেন বেডরুমে যাবার।
- মদ্যপ অবস্থায় কেট বেকিন্সেলকে শারীরিক সম্পর্কের প্রস্তাব দিয়েছিলেন তিনি। এতে রাজি না হওয়ায় বছরের পর বছর বেকিন্সেলকে ভীতি প্রদর্শন করে যান তিনি।
- কারা ডেলেভিনকে তার সামনে জোরপূর্বক অন্য নারীর সাথে সমকামিতায় লিপ্ত করতে চেয়েছিলেন তিনি। সেখান থেকে কোনোমতে পালিয়ে আসেন কারা।
একইরকম অভিযোগ এসেছে অভিনেত্রী লিয়া সিদোঁ, হিথার গ্রাহাম, অ্যাঞ্জি ইভহার্ট, এরিকা রোজেনবাম, মিনকা কেলি, টারা সাবকফ, রোজ ম্যাকগোয়ান সহ দু’ডজনেরও বেশি অভিনেত্রীর কাছ থেকে।
নিজের দোষ স্বীকার করে নিলেও অপরাধের ফল ওয়েইনস্টাইনকে ঠিকই ভোগ করতে হয়েছে। দ্য ওয়েইনস্টাইন কোম্পানির বোর্ড অফ ডিরেক্টরস থেকে বরখাস্ত করা হয়েছে তাকে; অ্যাপল, অ্যামাজনের মতো কোম্পানিগুলো সম্পর্কচ্ছেদ করেছে ওয়েইনস্টাইন কোম্পানির সাথে। ব্রিটিশ একাডেমী অফ ফিল্ম এন্ড টেলিভিশন আর্টস ওয়েইনস্টাইনের সদস্যপদ বাতিল করেছে। অস্কার প্রদানকারী একাডেমী অফ মোশন পিকচার আর্টস এন্ড সায়েন্সেসও তাকে বহিষ্কার করেছে। তার বিরুদ্ধে তদন্তে নেমেছে নিউ ইয়র্ক ও লন্ডনের পুলিশ বিভাগ। অনুমিতভাবেই সবচেয়ে বড় আঘাত এসেছে তার স্ত্রী জর্জিনা চ্যাপম্যানের কাছ থেকে। ১০ অক্টোবর তিনি ওয়েইনস্টাইনের সাথে বিচ্ছেদের ঘোষণা দেন।
সাধারণত কারো সাথে কোনো বিষয়ে সহমত প্রকাশে আমরা ‘আমিও (Me Too)’ শব্দটি ব্যবহার করে থাকি। যেমন- ‘আমিও তোমার সাথে পুরোপুরি একমত’ কিংবা ‘আমিও ঠিক এমনটাই ভেবেছিলাম’। এই ঐক্যমত প্রকাশের ধারা থেকেই Me Too শব্দযুগলকে একত্রিত করে #MeToo হ্যাশট্যাগে ছেয়ে গেছে ফেসবুক, টুইটার ও ইন্সটাগ্রাম।
রোজ ম্যাকগোয়ান ওয়েইনস্টাইনের বিরুদ্ধে অভিযোগকারীদের মাঝে একজন সেটি আগেই বলা হয়েছে। ‘চার্মড’ নামক একটি টিভি সিরিজে তার সাথে অভিনয় করেছিলেন অভিনেত্রী এলিসা মিলানো। মিলানোই রবিবার সন্ধ্যায় এক টুইটে লেখেন,
“এক বন্ধুর পরামর্শ: যদি যৌন নিপীড়ন কিংবা হয়রানির শিকার হওয়া সকল নারীই ‘Me Too’ লিখে স্ট্যাটাস দিতো, তাহলে হয়তো লোকজনকে আমরা সমস্যার গভীরতা সম্পর্কে বোঝাতে পারতাম। আপনি যদি যৌন নিপীড়ন কিংবা হয়রানির শিকার হয়ে থাকেন, তাহলে এই টুইটের রিপ্লাইয়ে ‘Me Too’ লিখুন”।
এরপরই যেন ঝড় শুরু হয়ে যায়। প্রায় ৪০ হাজারের মতো নারী এবং কিছু সংখ্যক পুরুষ মিলানোর সেই টুইটের রিপ্লাই দিয়েছিল। সোমবার সকালে দেখা যায় সোয়া ৩ লাখেরও অধিক পোস্টে এসে গেছে #MeToo হ্যাশট্যাগ। অনেক নামীদামী অভিনেত্রীরাও আছেন এ তালিকায়। এদের মাঝে আছে ‘এক্স ম্যান’ সিরিজের অভিনেত্রী অ্যানা প্যাকুইন, ‘উইল এন্ড গ্রেস’ খ্যাত তারকা ডেব্রা মেসিং, গায়িকা শেরিল ক্রো, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটর এলিজাবেথ ওয়ারেন, দেশটির সংসদ সদস্য স্টেলা ক্রেসি সহ আরো অনেকেই। পিছিয়ে নেই পুরুষরাও। নারীদের তুলনার অনেক কম হলেও জীবনের কোনো না কোনো পর্যায়ে যারা যৌন হেনস্তার শিকার হয়েছেন, তারাও সোচ্চার হয়েছেন এ অনাচারের বিরুদ্ধে, জানিয়েছেন নিজেদের দুঃসহ অভিজ্ঞতার কথা।
আমাদের আশেপাশের সমাজটা দিন দিন যেন কেমন হয়ে যাচ্ছে, দেখে প্রতিনিয়ত নিজেকে জিজ্ঞেস করতে হয়, “এ কোন দুনিয়ায় আছি আমরা!” পত্র-পত্রিকার পাতা খুললে, টেলিভিশন অন করলে প্রতিদিনই দেশের কোথাও না কোথাও নারীদের যৌন হেনস্তার খবর চোখে পড়ে। প্রতিদিন খবরে আসে হয়তো বড়জোর ১০-১৫টি হয়রানির খবর। কিন্তু রাস্তাঘাটে কত হাজার হাজার মা-বোন যে শুধুমাত্র মানুষরুপী কিছু পশুর কথা ও চোখের নজরে নির্যাতনের শিকার হচ্ছে, সেই খবর কখনো পত্রিকায় আসবে না। হয়রানির শিকার হওয়ার পর তার ভগ্ন মানসিক দশা সম্পর্কে জানবে হাতেগোনা অল্প কজন মানুষই। তার ভয়ে ভয়ে পথ চলার সঙ্গী হয় না কেউই, এগিয়ে আসে না কেউ নিরাপত্তা দিতে। আর কেউ যদি তাদের নিরাপত্তা যায়, তাহলে তাদেরও শায়েস্তা হতে হয় বখাটেদের হাতে, কখনো হারাতে হয় সাধের জীবনটাই। হয়রানির শিকার মেয়েটি কখনো আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছে, কখনো আবার বখাটেরাই শেষ করে দিচ্ছে সম্ভাবনাময় এক রমণীর সুন্দর ভবিষ্যতের স্বপ্নকে।
সময়টা তাই এখনই। নিজে সচেতন হোন, অন্যদেরও সচেতন করুন। #MeToo হ্যাশট্যাগ এসেছে জনগণকে সচেতন করতে, তাদের কর্তব্যের কথা মনে করিয়ে দিতে। শুধুমাত্র যদি আপনি এ খবর পড়ে আবার নিজের কাজে মন দিয়ে বসেন, তাহলে হয়তো আমরা আমাদের মা-বোনদের জন্য সুন্দর সমাজ বিনির্মাণের পথ থেকে আরো কিছুটা পিছিয়ে গেলাম। সিদ্ধান্তটা তাই দিনশেষে আপনার, সিদ্ধান্ত সমাজটাকে বদলের দিকে এগিয়ে নেয়ার।