পানির নিচে বেশ ফকফকা দেখতে পাচ্ছেন ঘর আর নানারকম অবকাঠামো। আর মাথার উপরে নীল পানি! অদ্ভুত লাগছে না শুনতে? মানুষ যখন প্রথম সমুদ্রের তলদেশে ডুবে থাকা শহরগুলো খুঁজে পেল, তখন ব্যাপারটা মেনে নেয়া বেশ কষ্টকর হয়ে পড়েছিলো তাদের পক্ষেও। তবে ইতিহাসের পাতা থেকে উঠে আসা এসব শহরের রহস্যও কিন্তু বেশ নজরকাড়া। কেউ জানে না ঠিক কেন পানির নিচে ডুবে আছে আস্ত একটি শহর, কেউ জানে না কখন হয়েছিলো এমন শহরের উৎপত্তি। শুধু জানে, শহর কেবল আকাশের নিচেই নয়, পানির নীচেও আছে। একটু অন্যরকম আর অদ্ভুত এই শহরগুলোকে চলুন একটু দেখে আসা যাক।
ডুবন্ত শহর – কিউবা
২০০১ সালের ১৪ মে। সেদিন একটি জরিপের কাজে পশ্চিম কিউবায় গিয়েছিলেন মেরিন ইঞ্জিনিয়ার পলিন জালিটজোকি ও পল ওয়েজেউইয়েগ। আর সেখানেই হঠাৎ খুব অন্যরকম একটি ব্যাপার আবিষ্কার করলেন তারা। পানির নীচে গোটা একটা শহর, কম কথা নাকি? সাথে সাথে খবর চলে গেল সবার কাছে। তারা শহরে ফিরে এলেন। সাথে আনলেন রোবট। সেই রোবট পানির নীচে গিয়ে চালালো অনুসন্ধান। পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলল আরো অনেক দিন। পিরামিড, বাড়িঘর, বারান্দা, রাস্তা- সবকিছু পাওয়া গেল এক এক করে ডুবন্ত এই শহরে। পানির নীচে ডুবে থাকার গভীরতা নির্ণয় করে জানা গেল, আজ থেকে প্রায় ৫০,০০০ বছর আগে নির্মিত হয়েছিলো শহরটি। আর দশটা শহরের মতোই বিকশিত হচ্ছিলো। মজার ব্যাপার হল, এত বছর আগে এমন প্রযুক্তি বা নির্মাণে উন্নত কোনো গোত্র বা মানুষ ছিল না। তাহলে কীভাবে জন্ম নিল এমন শহর? আর শেষ পর্যন্ত কেন পানির তলায় ডুবে গেল এই শহরটি?
উত্তর যে যার মতো করে সাজিয়ে নিয়েছে। কেউ বলে ভিনগ্রহবাসীদের কান্ড, কেউ আবার বলে প্রাকৃতিক কোনো দুর্যোগের ফল। বহুকাল আগে আটলান্টিস নামে এক হারিয়ে যাওয়ার শহরের কথা শোনা যায়, যেটা এখনও খুঁজে পাওয়া যায়নি। অনেকে কিউবার এই ডুবন্ত শহরকে সেই আটলান্টিস বলেও মনে করেন।
পিনাল ডেল রিও প্রদেশের গুয়ানাহাকাবাইব পেনিনসুলার উপকূলের ধারে কাছেই এই শহরটি অবস্থিত।
পাভলোপেত্রি
পৃথিবীতে অনেক ডুবন্ত শহর আছে। সেগুলোর মধ্যে সবচাইতে বেশি বয়সী শহর হিসেবে ধরা হয় পাভলোপেত্রিকেই। একে মানুষ খুঁজে পায়ও অনেক আগে। সেই ১৯০৪ সালের কথা। এই স্থানের আশেপাশে মানুষের তেমন একটা যাতায়াত ছিল না, ছিল না কোনো নাম। ঠিক সেই সময় পাভলোপেত্রিকে খুঁজে পান ফোকিয়োনোস নেগ্রিস নামের এক ভদ্রলোক। তবে এর বর্তমান পরিচিতি হয় ১৯৬৭ সালে। এলফোনিসস গ্রাম আর পাভলোপেত্রি নামক এক গ্রামের মাঝে অবস্থিত এই শহরের নাম মানুষ দেয় পাভলোপেত্রি।
ব্রোঞ্জ যুগে এই শহরের জন্ম হয়েছিলো বলে ধারণা করা হয়। পুরো শহরের আয়তন ৩,২২, ৯১৭ বর্গমাইল। ঘর-বাড়ি, উপাসনালয়, রাস্তা- সবকিছুই আছে এই শহরে। এমনকি যে অংশটুকু ভেঙে পড়েছে বা ক্ষয়ে গেছে- সেটার নকশাটুকুও ঠিকঠাক আছে শহরের ভেতরে। খুব সাজানো-গোছানো ব্যাপার বলা চলে। কৃষি, কাপড় বোনা, ব্যবসার মতন ব্যাপারগুলো তৈরি করে নিতে পেরেছিলো শহরবাসীরা- এমনটাই মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। কেমন করে শহরটি পানির নীচে চলে গেল? অনেকে মনে করেন, ভূমিকম্পের ফলে পানির নীচে চলে গিয়েছিলো শহরটি। অনেকের ধারণা আবার ভিনগ্রহের প্রাণীদের নিয়ে।
গ্রীসের পেলোপনেশিয়ায় অবস্থিত দক্ষিণ ল্যাকোনেশিয়ায় খুঁজে পাওয়া যাবে পাভলোপেত্রিকে। ইচ্ছে করলে আপনিও নৌকা নিয়ে একবার দেখে আসতে পারেন এই ডুবন্ত শহরটিকে!
ক্যাম্বে
বলছিলাম গালফ ক্যাম্বের কথা। ২০০১ সালে খুঁজে পাওয়া যায় এই শহরটিকে। প্রাচীন সব ডুবন্ত শহরের তালিকায় নাম আছে ক্যাম্বের ডুবন্ত শহরেরও। কেউ এর নাম দেয়নি। তবে তাই বলে মানুষের যে একে নিয়ে আগ্রহ কম তা কিন্তু নয়!
ক্যাম্বের ডুবন্ত শহরকে বরফ যুগের শহর বলে মনে করা হয়। বরফ যুগে সত্যিই এমন শহর গড়ে তোলার মানসিকতা কারো ভেতরে ছিল কিনা কিংবা তেমন কোনো সভ্যতা আসলেই ছিল কিনা- এ নিয়ে অনেক বিতর্ক আছে। তবে ক্যাম্বের ডুবন্ত শহর একটি বাস্তব সত্য।
ধারণা করা হয়, বরফ যুগ শেষ হয়ে গেলে বেশিরভাগ বরফ গলে যায়। আর তখন ধীরে ধীরে পানির নিচে চলে যায় ক্যাম্বের এই শহর। তবে ভারতীয়রা কিন্তু শহরটির একটু অন্যরকম ব্যাখ্যা দেয়ার চেষ্টা করেছেন সবসময়। তাদের কাছে ক্যাম্বের অন্য এক রূপ হল মহাভারতে উল্লিখিত কৃষ্ণের ডুবে যাওয়া শহর। দ্বারকা নামে মহাভারতে লিখিত এই শহরটি ডুবে যায় অনেক আগে গোমতী নদীর ধারে। তাই কেবল যৌক্তিক বা অযৌক্তিক নয়, এই সবকিছুকে পেছনে ফেলে ধর্মীয় একটি দৃষ্টিভঙ্গিও আছে ক্যাম্বের ডুবন্ত শহরের।
বিমিনি রোড
বিমিনি রোডের অবস্থান বাহামায়। বাহামার উত্তর বিমিনি দ্বীপে প্রথম খুঁজে পাওয়া যায় বিমিনি নামের এই অদ্ভুত শহরটিকে। মাঝে মাঝে অবশ্য বিমিনি রোডকে বিমিনি ওয়ালও বলা হয়। চুনাপাথরের বেশ লম্বা একটা দেয়ালের চিহ্ন খুঁজে পাবেন আপনি এখানে। সেগুলো দেখলে আপনার মনে হবে, সারি বেঁধে এখানে কোনো দেয়াল নির্মাণ করা হয়েছিল কোনো শহরের জন্য। তবে এখন এগুলো কেবলই অতীত।
১৯৬৮ সালের ২ সেপ্টেম্বরের কথা। সমুদ্রের গভীরে সাঁতার কাটছিলেন জোসেফ ম্যাসন ভ্যালেন্টাইন, জ্যাকস ম্যায়োল এবং রবার্ট এংলোভ। আর সেসময় হঠাৎ অদ্ভুত কিছু একটা দেখতে পান তারা। তাদের চোখের সামনে নীলচে রঙের পানি ছিল বটে, তবে সেটা ছাড়াও ছিলো আরেকটু ভারী কিছু। এরপর শুধু এই তিনজন নয়, একের পর এক মানুষ আসতে শুরু করলো বিমিনি শহর দেখতে।
সমতল, এবড়ো-থেবড়ো, চারকোনা, গোলাকার, অর্ধ-চতুষ্কোণ প্রায় সবরকম আকৃতির পাথর পাওয়া যায় বিমিনি রোডে। অনেকের মতে, এই পাথরগুলো সামুদ্রিক স্রোতের মাধ্যমে জড় হওয়া পাথর থেকে জন্ম নিয়েছে। কিন্তু সবাই এই ব্যাখ্যা এত সহজে মানতে চাননি। ফলে এখনও অব্দি বিমিনি রোডকে মানুষের কোনো এক সভ্যতার নিদর্শন বলেই মেনে আসছে সবাই। সেই সাথে আছে কিছু অতিপ্রাকৃতিক ব্যাপার স্যাপারও।
অনেকে হারিয়ে যাওয়া আটলান্টিসের সাথেও যুক্ত করছেন বিমিনি রোডের নাম।
ইয়োনাগুনি মনুমেন্ট
ডুবন্ত শহরগুলোর কথা বলতে গেলে যে কয়েকটি শহরের নাম উঠে আসে, তাদের মধ্যে অন্যতম ইয়োনাগুনি মনুমেন্ট। শহরটির অবস্থান ইয়োনাগুনি দ্বীপের কাছে। মানুষের মুখ খোদাই করা ভাস্কর্য, বাসস্থান, প্রাসাদ, পানির ব্যবস্থা, উপাসনালয়- সবকিছুই আছে এখানে। অন্তত একটা গোটা শহর হতে যা দরকার তার সব তো আছেই!
ধারণা করা হয়, প্রায় ২,০০০ বছর আগে ভূমিকম্পের কবলে পড়ে পানির নিচে ডুবে যায় ইয়ানোগুনি মনুমেন্ট। খ্রিস্টপূর্ব ১০,০০০ অব্দে তৈরি হয়েছিলো এই শহরটি। ইয়োনাগুনি সমুদ্রের বরফ জমে গেলে সেখানে সময় কাটাতে যান অনেকেই। প্রফেসর কিহাচিরো আরাটাকেও গিয়েছিলেন একই উদ্দেশ্যে। আর সেখানেই তার চোখে পড়ে অন্যরকম এই শহর।
ফিচার ইমেজ- Youtube