Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

রক্তের গ্রুপিং ও রক্ত সঞ্চালন: কী, কেন, কীভাবে

রক্ত মানবদেহের অতি জটিল এক উপাদান। মানবদেহের প্রতিটি অংশই অতিশয় গুরুত্ব বহন করে, একটি অপরটিকে ছাড়া সচল নয়। আর রক্ত সবকিছু থেকে এক ধাপ এগিয়ে। রক্ত সকল অংশের পালনকর্তা, পরিচালনকর্তা, রক্ষাকর্তা, নিয়ন্ত্রণকর্তা, কর্মকর্তা। আরো কিছু বিশেষণ লাগালেও খুব একটা ভুল হবে না।

রক্তের পরিচয় হিসেবে বলা যায়, “রক্ত এক বিশেষ জটিল তরল সংযোজক কলা।” ‘বিশেষ’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে রক্তের কার্যক্রম অনেক জটিল ও গুরুত্বপূর্ণ হওয়ার কারণে। এছাড়াও ‘বিশেষ’ হওয়ার আরেকটি কারণ হলো রক্ত মানবদেহের একমাত্র সংযোজক কলা, যা তরল অবস্থায় বিরাজমান। এমনিতে সংযোজক কলা কঠিন অবস্থায় থাকে; পেশি কিংবা অস্থি-তরুণাস্থি এসবই সংযোজক কলা।

কলা (Tissue) হলো কোষগুচ্ছ; অনেকগুলো প্রায় সমআকারের কোষ যখন একই স্থান থেকে তৈরি হয়ে একত্রে অবস্থান করে এবং একই ধরনের কাজ সম্পাদন করে, তখন সেই কোষগুচ্ছকে একত্রে ‘কলা’ বলা হয়। কলা চার ধরনের হতে পারে। যে কলা দুই বা ততোধিক স্থানের মাঝে সামঞ্জস্য তৈরি করে, অর্থাৎ যোগাযোগ রক্ষা করা কিংবা কোনো বস্তু আদান-প্রদানের কাজ করে, তাকে বলা হয় সংযোজক কলা। অস্থি ও তরুণাস্থি একত্রে যুক্ত হয়ে মানব শরীরের আকার তৈরি করে, পেশিগুলো অস্থির সাথে যুক্ত হয়ে চলন ক্ষমতা প্রদান করে। সংযোজক কলা হিসেবে রক্তের কাজ হলো শরীরের সকল বস্তু রক্তের মধ্য দিয়ে পরিবাহিত হয়। জীবাণু থেকে শুরু করে প্রতিষেধক, বায়ুমণ্ডলের বাতাস থেকে শুরু করে খাদ্যকণা সহ অারো অনেক কিছু পরিবাহিত হয় রক্তের মাধ্যমে। রক্ত শরীরের প্রতিটি বিন্দুতে পুষ্টি প্রেরণের মধ্য দিয়ে একত্রে বেঁধে রেখেছে শরীরের সব উপাদানকে।

রক্তের দুটো অংশ- রক্তরস ও রক্তকণিকা। রক্তরসের মাঝে কণিকাগুলো ভাসমান থাকে, পরিবহন সহজে হয়। কণিকা হলো রক্তের কোষ। সবকিছুরই কোষ থাকে, কোষকে বলা হয় গঠন একক। অস্থি-তরুণাস্থিরও কোষ রয়েছে।

রক্তে তিন ধরনের কোষ থাকে। লোহিত কণিকা, শ্বেত কণিকা ও অণুচক্রিকা। তিন ধরনের কণিকারই তিনটি পৃথক প্রধান কার্যক্রম রয়েছে। লোহিত কণিকা হলো প্রধান পরিবাহক, শ্বেত কণিকার কাজ হলো বাহ্যিক পরিবেশ থেকে অভ্যন্তরীণ পরিবেশকে সুরক্ষা প্রদান ও রোগ-জীবাণুর হাত থেকে রক্ষা করা আর অণুচক্রিকার কাজ রক্ত জমাট বাঁধানো। প্রধান কাজ ছাড়াও অনেক ধরনের গৌণ কাজও সম্পাদন করে থাকে এ কণিকাগুলো।

লোহিত রক্তকণিকা; Source: interactive-biology.com

শ্বেত রক্তকণিকা; Source: medfitrehab.com

অণুচক্রিকা; Source: youtube.com

লোহিত কণিকায় হিমোগ্লোবিন থাকে। হিমোগ্লোবিনের রং লাল হওয়ায় আমরা রক্তকে লাল বর্ণের দেখি। হিমোগ্লোবিন শ্বসনে সহায়তা করে। লোহিত কণিকার গায়ে লাগানো থাকে এক ধরনের অ্যান্টিজেন।

ব্লাড গ্রুপিং বুঝতে হলে অ্যান্টিজেন-অ্যান্টিবডি ব্যাপারগুলো আগে বুঝতে হবে। আমাদের শরীরের অভ্যন্তরে যা তৈরি হচ্ছে, যা আমাদের জৈবিক কার্যাবলীতে অবদান রাখছে, এগুলো শরীরের নিজস্ব সম্পত্তি। এগুলো থেকে শরীরের কোনো ঝুঁকির সম্ভাবনা নেই। যে সকল বস্তু কিংবা জীবাণু বাহ্যিক পরিবেশ থেকে শরীরে প্রবেশ করছে, যা শরীরের নিজস্ব সম্পত্তি নয়, এসব কিছুই অ্যান্টিজেন। জীবাণু, ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া সবই অ্যান্টিজেন। এই অ্যান্টিজেনগুলো স্বভাবতই শরীরের ক্ষতিসাধন করে থাকে। শ্বেত রক্তকণিকা যেহেতু রোগ প্রতিরোধী, এটি তাই অ্যান্টিজেনগুলোকে প্রতিহত করার চেষ্টা করে। প্রতিহত করার অনেকগুলো পদ্ধতির মাঝে একটি হলো ‘অ্যান্টিবডি সিস্টেম’। শ্বেত রক্তকণিকা অ্যান্টিবডি তৈরি করে। অ্যান্টিবডি শরীরের যে অংশকে অপরিচিত মনে করবে, তাকেই সরাসরি ধ্বংস করতে উদ্যত হয়।

শরীরের নিজস্ব কিছু অ্যান্টিজেন রয়েছে, যা শরীরের অপকারের বদলে উপকার করে থাকে, এগুলো জন্ম থেকেই শরীরে রয়েছে বলে এগুলোকে অ্যান্টিবডি ধ্বংস করে না। শ্বেত রক্তকণিকার একটি টাইপ হলো T-Lymphocyte। এর বেশ কিছু কাজের মাঝে একটি কাজ হলো স্মৃতিরক্ষা। এটি শরীরের উপকারী বস্তুকে চিনে রেখে অপকারী জীবাণু অর্থাৎ অ্যান্টিজেনকে চিহ্নিত করে থাকে। অ্যান্টিজেন শনাক্ত হলেই অ্যান্টিবডি সিস্টেম শুরু করে ধ্বংসযজ্ঞ।

উল্লেখ্য, বর্তমানে বাংলাদেশে ‘অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স’ আন্দোলন চলছে। সামান্য জ্বরে আমরা অনেকেই অ্যান্টিবায়োটিক সেবন করে ফেলি না বুঝে। এটি যে কীভাবে ক্ষতি করছে, সেটা আমরা বুঝি না। পুরো ব্যাপারটিই অ্যান্টিবডি-অ্যান্টিজেন সম্পর্কিত।

রক্তের গ্রুপিংয়ের পেছনে অ্যান্টিবডি-অ্যান্টিজেনই মূলত গুরুত্বপূর্ণ। রক্তের অ্যান্টিজেনকে চিকিৎসাবিজ্ঞানে বলা হয় অ্যাগ্লুটিনোজেন, আর অ্যান্টিবডিকে বলা হয় অ্যাগ্লুটিনিন। অ্যাগ্লুটিনোজেন রক্তকণিকা লোহিত রক্তকণিকার গায়ে (যাকে ‘Surface Area’ বলা হয়) সংযুক্ত থাকে। অ্যাগ্লুটিনোজেন দেখে বলে দেয়া যায় রক্তটি কোন গ্রুপের। প্রশ্ন থেকে যায়, অ্যান্টিজেন যদি আমাদের শরীরের ক্ষতি করে, তাহলে রক্তের লোহিত কণিকায় অ্যাগ্লুটিনোজেন নামক অ্যান্টিজেন থাকা সত্ত্বেও তা ক্ষতি কেন করছে না। এর উত্তর হলো- অ্যাগ্লুটিনোজেন শরীরের নিজস্ব অ্যান্টিজেন। T-Lymphocyte বেশ ভালোমতোই চেনে একে, জন্ম থেকেই শরীরে রয়েছে এটি।

T-Lymphocyte; Source: commons.wikimedia.org

একজনের রক্তে এক ধরনের অ্যান্টিজেন রয়েছে। আমরা যদি তার শরীরে একই অ্যান্টিজেন প্রবেশ করাই, তাহলে তার কোনো ক্ষতি হবে না। কিন্তু যদি অপর অ্যান্টিজেন সম্বলিত রক্ত প্রবেশ করাই, তাহলে মানুষটি মারা যাবে। অ্যান্টিবডি সিস্টেম শরীরের সমস্ত রক্ত জমাট বাঁধিয়ে ফেলবে। ১৯০১ সালে কার্ল ল্যান্ডস্টাইনার রক্তের গ্রুপিং করেন লোহিত কণিকার গায়ে লেগে থাকা অ্যান্টিজেনের ভিত্তিতে।

কার্ল ল্যান্ডস্টাইনার; Source: genetics.org

চিকিৎসাবিজ্ঞানে রক্তের অনেক ধরনের গ্রুপিং পদ্ধতি রয়েছে। তবে ল্যান্ডস্টাইনার কর্তৃক আবিষ্কৃত ABO সিস্টেমকে প্রধান পদ্ধতি হিসেবে গণ্য করা হয়। এছাড়াও আরো একটি প্রধান ব্লাড গ্রুপিং সিস্টেম হলো Rh Factor সিস্টেম। এই Rh Factor এর উপস্থিতি-অনুপস্থিতি অনুসারে বলা হয় পজিটিভ রক্ত নাকি নেগেটিভ রক্ত।

ছোটখাটো বেশ কিছু ব্লাড গ্রুপিং পদ্ধতি রয়েছে, সেগুলো বিশেষ ক্ষেত্রে আমাদের প্রয়োজন হয়। যেমন- MN সিস্টেম, এর দ্বারা পিতৃত্ব পরীক্ষা করা যায়। এখানে ব্লাড গ্রুপিংয়ের দুটো প্রধান পদ্ধতি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো।

ABO সিস্টেম

প্রথমেই আসা যাক ABO সিস্টেমের ব্যাপারে। ABO সিস্টেমে দুই ধরনের অ্যান্টিজেন অর্থাৎ অ্যাগ্লুটিনোজেন রয়েছে। অ্যাগ্লুটিনোজেন-A, অ্যাগ্লুটিনোজেন-B। এ দুইয়ের উপস্থিতি-অনুপস্থিতির উপর ভিত্তি করে চার ধরনের ব্লাড গ্রুপ হয়ে থাকে।

  • যদি লোহিত কণিকার গায়ে অ্যাগ্লুটিনোজেন-A অবস্থান করে, তবে সেটি A গ্রুপের রক্ত।
  • যদি লোহিত কণিকার গায়ে অ্যাগ্লুটিনোজেন-B অবস্থান করে, তবে সেটি B গ্রুপের রক্ত।
  • যদি লোহিত কণিকার গায়ে অ্যাগ্লুটিনোজেন-A ও অ্যাগ্লুটিনোজেন-B দুটোই অবস্থান করে, তবে সেটি AB গ্রুপের রক্ত।
  • যদি লোহিত কণিকার গায়ে কোনো অ্যাগ্লুটিনোজেন অবস্থান না করে, তবে সেটি O গ্রুপের রক্ত।

রক্তের বিভিন্ন গ্রুপ; Source: shutterstock.com

অ্যাগ্লুটিনোজেনের সাথে যুগপৎভাবে থাকে অ্যাগ্লুটিনিন। রক্তের অ্যাগ্লুটিনিনও দু’ধরনের। আলফা (যা মূলত অ্যান্টিবডি-A) ও বিটা (যা মূলত অ্যান্টিবডি-B) অ্যাগ্লুটিনিন। অ্যাগ্লুটিনোজেনের সাথে যুগপৎভাবে অ্যান্টিবডি সিস্টেম কীভাবে জড়িয়ে আছে সেই ব্যাখ্যাও দেন কার্ল ল্যান্ডস্টাইনার। এটিকে বলা হয় ‘ল্যান্ডস্টাইনারের সূত্র’। সূত্রের বিবৃতিতে বলা হয়,

“যদি লোহিত রক্ত কণিকার গায়ে কোনো অ্যাগ্লুটিনোজেন অবস্থান করে, তবে একই সাথে তার বিপরীত অ্যাগ্লুটিনিন অবস্থান করবে। আর যে অ্যাগ্লুটিনিনটি অবস্থান করবে, তার সমকক্ষীয় অ্যাগ্লুটিনোজেন কখনোই লোহিত রক্তকণিকায় অবস্থান করবে না।”

উদাহরণ দিলে ব্যাপারটি বুঝতে সহজ হবে। A গ্রুপের রক্তের কথা ধরা যাক। এর লোহিত রক্তকণিকায় অ্যাগ্লুটিনোজেন-A রয়েছে, সেই সাথে রয়েছে বিপরীত অ্যাগ্লুটিনিন অর্থাৎ অ্যান্টি-B। অ্যান্টি-B অবস্থান করাতে এই রক্তে কখনো অ্যাগ্লুটিনোজেন-B অবস্থান করতে পারবে না। যদি অ্যাগ্লুটিনোজেন-B অবস্থান করে, তবে অ্যান্টি-B অবস্থান করবে না।

এই দীর্ঘ আলোচনার সারমর্ম হিসেবে বলা যায়,

  • A গ্রুপের রক্তে অ্যাগ্লুটিনোজেন-A এবং অ্যান্টি-B অবস্থান করে।
  • B গ্রুপের রক্তে অ্যাগ্লুটিনোজেন-B এবং অ্যান্টি-A অবস্থান করে।
  • AB গ্রুপের রক্তে অ্যাগ্লুটিনোজেন-A ও অ্যাগ্লুটিনোজেন-B দু’টোই অবস্থান করে এবং এতে কোনো অ্যান্টিবডি নেই।
  • O গ্রুপের রক্তে কোনো অ্যাগ্লুটিনোজেন নেই, তবে অ্যান্টি-A ও অ্যান্টি-B অবস্থান করে।

রক্তের অ্যাগ্লুটিনোজেন ও অ্যাগ্লুটিনিন; Source: commons.wikimedia.org

এই হলো ABO ব্লাড গ্রুপিং সিস্টেম। A গ্রুপ রক্তের বাহক মানুষের শরীরে যদি B গ্রুপের রক্ত প্রবেশ করানো হয়, তাহলে মানুষটির শরীরে পূর্ব থেকে অবস্থানরত অ্যান্টি-B প্রবেশকৃত রক্তের অ্যাগ্লুটিনোজেন-B কে শনাক্ত করতে সক্ষম হবে এবং অ্যান্টিজেন হিসেবে চিহ্নিত করে পুরো শরীরের রক্তই জমাট বাঁধিয়ে ফেলবে। জমাট বাঁধানোর কাজটি শ্বেত রক্তকণিকা করে থাকে, শরীরে রক্ত তরল রাখার দায়িত্বটিও কিন্তু শ্বেতকণিকার। শ্বেতকণিকার একটি টাইপ হলো বেসোফিল, যা হেপারিন নামক এক বস্তু তৈরি করে। এই হেপারিন রক্তকে জমাট বাঁধতে দেয় না।

এই ব্যাপারে একটি ভুল ধারণা কারো কারো মনে দানা বাঁধতে পারে। অনেকেই নিশ্চিতভাবে বলে দেন, “সন্তান পিতা ও মাতার মধ্যে যে কোনো একজনের ব্লাড গ্রুপ পাবে।” আসলে কথাটি সম্পূর্ণ ভুল বলাটাও ঠিক না, তবে এতে যুক্তিগত কিছু সমস্যা রয়েছে। সন্তান তার শরীরে যা কিছু পাবে, সবই পিতা ও মাতা দু’জনের কাছ থেকে মিলিয়ে পাবে। কিন্তু বাবা-মায়ের হুবহু ব্লাড গ্রুপ সন্তানের না-ও থাকতে পারে। যেমন- পিতা ও মাতা দুজনেরই ব্লাড গ্রুপ যদি A হয়, তাহলে এটা নিশ্চিত বলা যায় না যে সন্তান A গ্রুপেরই অধিকারী হবে। সন্তান O গ্রুপেরও হতে পারে, তবে AB কিংবা B গ্রুপের হবে না।

এই বিষয়টি বোঝার জন্য আলোচনা করতে হবে ক্রোমোসোম নিয়ে। একটি কোষের নিউক্লিয়াসে অবস্থান করে ক্রোমোসোম। ক্রোমোসোমেই থাকে আমাদের শারীরিক গঠনের নীলনকশা। এতে সবকিছু পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে লেখা থাকে; কেমন হবে চুলের রং, কেমন হবে উচ্চতা, লিঙ্গ, বাহ্যিক গড়ন সহ সবকিছু। মানবদেহে প্রতিটি কোষে ক্রোমোসোম থাকে ৪৬টি। সন্তানের শরীরের কোষের ক্রোমোসোমের ২৩টি আসে বাবার কাছ থেকে, ২৩টি আসে মায়ের কাছ থেকে। এই ৪৬টির মাঝে এক জোড়া হলো সেক্স ক্রোমোসোম। সন্তানের লিঙ্গ নির্ধারণ করাই এই জোড়ের কাজ। বাকি বাইশ জোড়া শরীরের বাকি সব গঠনের দায়িত্ব পায়। ক্রোমোসোমের নির্দিষ্ট একককে আবার বলা হয় জিন (Gene)। বাইশ জোড়ার মাঝে কোনো এক ক্রোমোসোম জোড়ে থাকে নির্দিষ্ট জিন, যা রক্তের গ্রুপ নির্ধারণ করে দেয়।

পরবর্তী অংশ শুরুর পূর্বে মেন্ডেলীয় ‘প্রকট’ ও ‘প্রচ্ছন্ন’ এ দুটো ব্যাপারে ধারণা থাকা দরকার। মেন্ডেলের মতে, প্রতিটি বাহ্যিক বৈশিষ্ট্যের পেছনে অবশ্যই দুটো জিন দায়ী থাকবে। যদি জিন দুটো একই রকম (হোমোলোগাস) না হয়ে ভিন্ন (হেটেরোলোগাস) হয়, তাহলে প্রকট-প্রচ্ছন্নের ব্যাপারগুলো চলে আসে। হেটেরোলোগাস এক জোড় জিনের একটি বলছে চুলের রং কালো হবে, অপরটি বলছে চুলের রং বাদামী হবে। দুটো মিলিয়ে দেখা গেলো চুলের রং হয়েছে কালো। অর্থাৎ একটি জিনের বৈশিষ্ট্য প্রকাশ পেয়েছে। যার বৈশিষ্ট্য প্রকাশ পেয়েছে সেটি মেন্ডেলীয় প্রকট জিন, আর অপরটি মেন্ডেলীয় প্রচ্ছন্ন জিন। এখানে উদাহরণকে সহজ করতে চুলের রং উল্লেখ করা হলো। চুলের রং, চোখের রং, উচ্চতা এমন ব্যাপারগুলোর পেছনে মূলত দুইয়ের অধিক জিন দায়ী থাকে, যাদের আমরা পলিজিন (Polygene) বলি।

রক্তের তিনটি অ্যাগ্লুটিনোজেনের জন্য দায়ী তিনটি জিন; A, B ও O। A গ্রুপের পেছনে দায়ী জিনজোড় হতে পারে AA কিংবা AO। B গ্রুপের পেছনে দায়ী জিনজোড় হতে পারে BB কিংবা BO। A ও B জিনদ্বয় হলো মেন্ডেলীয় প্রকট জিন, O হলো মেন্ডেলীয় প্রচ্ছন্ন জিন। তাই রক্তের গ্রুপ নির্ধারণকারী জিনদ্বয়ের একটি A ও অপরটি O হওয়া সত্ত্বেও রক্তের গ্রুপ হবে A। একইভাবে জিনজোড় BO হলে রক্তের গ্রুপ দাঁড়াবে B। অপরদিকে AB গ্রুপের পেছনে দায়ী জিনজোড় হলো A ও B। এই গ্রুপে দুটো ভিন্ন জিন থাকে, দুটোর বৈশিষ্ট্যই সমানভাবে প্রকাশ পেয়েছে। এটি মেন্ডেলীয় সূত্রের ব্যতিক্রম, একে ‘সমপ্রকটতা’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়। একইভাবে O গ্রুপের জন্য দায়ী জিনজোড় OO।

আবারো পিতা-মাতা-সন্তানের রক্তের গ্রুপ সম্পর্কিত আলোচনায় ফিরে যাই। ধরা যাক, পিতার রক্তের গ্রুপের পেছনে দায়ী জিনদ্বয় AO, মাতার জিনদ্বয়ও AO। সন্তান যদি পিতার কাছ থেকে O জিন আর মাতার কাছ থেকেও O জিন পায়, তাহলে সন্তানের জিনজোড় দাঁড়াবে OO। সন্তানের রক্তের গ্রুপ হবে O। তখন দেখা যাবে, A গ্রুপের রক্তধারী মা-বাবার সন্তানের রক্তের গ্রুপ হবে O। অর্থাৎ বোঝা গেলো মা-বাবার রক্তের গ্রুপই যে সন্তানের হতে হবে, এমন কোনো বাধ্যবাধকতা নেই।

Rh Factor সিস্টেম

আরেকটি প্রধান ব্লাড গ্রুপিং সিস্টেম হলো Rh Factor। এই ফ্যাক্টরটি যদি লোহিত রক্তকণিকার গায়ে উপস্থিত থাকে, তবে রক্তটি হবে পজিটিভ গ্রুপভুক্ত, আর যদি না থাকে, রক্ত হবে নেগেটিভ গ্রুপভুক্ত।

Rh সিস্টেমে অ্যাগ্লুটিনোজেনটির জন্য দায়ী জিনের সংখ্যা ছয়টি; C, c, D, d, E, e। C, D ও E হলো মেন্ডেলীয় প্রকট জিন আর c, d ও e হলো মেন্ডেলীয় প্রচ্ছন্ন জিন। মানুষের শরীরে যেকোনো তিনটি জিন উপস্থিত থাকবে, একে বলা হয় পলিজেনিক। যেকোনো তিনটি জিন উপস্থিত থাকার একটি নিয়ম রয়েছে, কখনো দুটো একই প্রকট ও প্রচ্ছন্ন জিন একসাথে অবস্থান করবে না। অর্থাৎ যদি C অবস্থান করে, তবে c অবশ্যই অনুপস্থিত থাকবে।

Rh Factor এর উপস্থিতি কেবলমাত্র D জিনের উপস্থিতির উপর নির্ভর করে। D জিন উপস্থিত থাকা মানে Rh Positive, অনুপস্থিত থাকা মানে Rh Negative। যেমন- যদি কারো জিনোমে জিনত্রয় এভাবে থাকে- cDE, তবে তার Rh Positive হবে। এখানে উল্লেখ্য, পিতা ও মাতার মাঝে যেকোনো একজনেরও যদি Rh Positive হয়, সন্তানের অবশ্যই Rh Positive পাওয়া যাবে।

ABO ও Rh Factor- এই দুই ব্লাড গ্রুপিং সিস্টেমের নিয়মানুযায়ী ব্লাড গ্রুপিং করা হয়ে থাকে। মোট আট ধরনের রক্ত পাওয়া সম্ভব এতে করে: A+, A-, B+, B-, AB+, AB-, O+ ও O-।

রক্তের গ্রুপ সংক্রান্ত আলোচনার পর এবার ব্লাড ট্রান্সফিউশন অর্থাৎ রক্ত সঞ্চালনের ব্যাপারে কিছু জানা যাক। ‘রক্ত সঞ্চালন’ মানে হলো একজনের শরীর থেকে রক্ত অন্যের শরীরে প্রদান করা। কোনো একটি গ্রুপের রক্ত কাকে দেওয়া যাবে, কাকে দেওয়া যাবে না, এ ব্যাপারে প্রধান বিষয়গুলো এখানে তুলে ধরা হলো।

A গ্রুপের রক্তে রয়েছে অ্যান্টি-B। এই রক্ত যখনই অ্যাগ্লুটিনোজেন-B এর দেখা পাবে, পুরো রক্ত জমাট বাঁধিয়ে ফেলবে। অতএব অ্যাগ্লুটিনোজেন-B রয়েছে এমন রক্ত A গ্রুপধারী ব্যক্তির শরীরে প্রবেশ করতে দেয়া যাবে না। তাহলে এবার ভেবে বের করুন তো, কোন কোন গ্রুপের রক্তে অ্যাগ্লুটিনোজেন-B নেই? অবশ্যই O গ্রুপ। এতে কোনো অ্যাগ্লুটিনোজেন নেই। আবার A গ্রুপের রক্তেও নেই। তাহলে A গ্রুপধারী ব্যক্তিকে A কিংবা O গ্রুপের রক্ত দেয়া যাবে। প্রশ্ন যদি হয় কোনো মানুষের জীবন বাঁচানো নিয়ে এবং A গ্রুপের রক্ত যদি না পাওয়া যায়, তবে O গ্রুপ দিয়ে মানুষটির জীবন রক্ষা করতে হয়। যেহেতু O গ্রুপের রক্তে অ্যান্টি-A রয়েছে, সেক্ষেত্রে কিছু জটিলতা থেকেই যায়। তবে A গ্রুপধারীর রক্তে উক্ত অ্যাগ্লুটিনোজেন হলো নিজস্ব অ্যান্টিজেন, এটিই হলো ভরসার কথা।

Blood Group Compatibility; Source: santelvgar.blogspot.com

যদি প্রশ্ন করা হয়, কোন রক্ত সবাইকে দেয়া সম্ভব? উত্তর হলো, যে রক্তে কোনো অ্যাগ্লুটিনোজেন নেই, সেই রক্ত সকলের শরীরে প্রবেশ করানো যাবে। একে বলা হয় Universal Donor Blood। এ কারণে O গ্রুপের রক্ত সকলেই গ্রহণ করতে পারবে। আবার যদি প্রশ্ন আসে, কোন গ্রুপের রক্তধারী ব্যক্তির শরীরে সকল গ্রুপের রক্তই প্রবেশ করানো সম্ভব? উত্তর হলো যে রক্তে কোনো অ্যাগ্লুটিনিন নেই, সেই রক্ত বাকি সকল রক্ত গ্রহণ করতে পারবে। একে বলা হয় Universal Receiver Blood। এ কারণে AB গ্রুপধারী ব্যক্তির শরীরে যেকোনো গ্রুপের রক্ত দেওয়া যাবে।

এবার রক্ত সঞ্চালনের ক্ষেত্রে Rh Factor এর ভূমিকাটিও বলে ফেলা যাক। আগেই জানা গেছে, Rh Factor পিতা-মাতা যেকোনো একজনের থাকলেই সন্তানের রক্তে Rh Positive পাওয়া যাবে। Rh Positive ধারীর রক্তে Rh Factor উপস্থিত রয়েছে। এটি অ্যান্টিজেন। যদি Rh Factor না থাকে রক্তে, তবে অবশ্যই এর অ্যান্টিবডি প্রস্তুত করবে শ্বেত রক্তকণিকা। অতএব Rh Negative ব্যক্তির শরীরে Rh Positive রক্ত প্রবেশ করানো যাবে না। কেননা Rh Negative রক্তে তাহলে Rh Factor এর বিরুদ্ধে তৈরি হবে অ্যান্টিবডি। রক্ত সঞ্চালনে তাই Rh Factor খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়।

সবশেষে ব্লাড গ্রুপ নির্ণয়ের পদ্ধতিটি সম্পর্ক জানা যাক। ঘরে বসে যে কেউ মুহূর্তের মাঝেই ব্লাড গ্রুপ নির্ণয় করতে পারেন। এজন্য ‘Blood Grouping Kit’ পাওয়া যায় বাজারে। এতে তিনটি ছোট শিশি ভর্তি তরল থাকে। একটি নীল রঙের তরল, একটি হলুদ রঙের তরল, একটিতে স্বচ্ছ তরল। নীল তরলটি হলো অ্যান্টি-A, হলুদটি হলো অ্যান্টি-B, স্বচ্ছটি হলো অ্যান্টি-D। অ্যান্টি-D Rh Factor এর উপস্থিতি নির্ণয় করবে।

একটি কাঁচের স্লাইডে তিন ফোঁটা রক্ত নিয়ে তিন শিশি থেকে এক ফোঁটা করে তরল পৃথকভাবে রক্তের তিন ফোঁটার সাথে মিশিয়ে ফেলুন। এই লেখাটি মনোযোগ দিয়ে পড়ে থাকলে নিশ্চয় বুঝতে পারবেন এরপর কী হতে যাচ্ছে। রক্তের স্যাম্পলে যদি অ্যাগ্লুটিনোজেন-A থেকে থাকে, তবে অ্যান্টি-A মেশানো রক্তের ফোঁটা জমাট বেঁধে যাবে কয়েক সেকেন্ডের মাঝে। অ্যান্টি-A মেশানো রক্তের ফোঁটা জমাট বেঁধেছে দেখেই আমরা বুঝে নেবো, রক্তে অবশ্যই অ্যাগ্লুটিনোজেন-A রয়েছে। দেখা গেলো অ্যান্টি-B মেশানো দ্বিতীয় ফোঁটা জমাট বাঁধেনি, অর্থাৎ এতে অ্যাগ্লুটিনোজেন-B ছিলো না। অ্যান্টি-D মেশানো তৃতীয় ফোঁটা রক্তকে যদি জমাট বাঁধতে দেখা যায়, তবে বুঝতে হবে Rh Factor উপস্থিত রয়েছে, অর্থাৎ নিঃসন্দেহে এই রক্ত Rh Positive। এভাবে আমরা বলে দিতে পারবো রক্তটি A+ গ্রুপের।

রক্তের গ্রুপ নির্ণায়ক উপাদান; Source: maxwinhealthcare.in

খুব সহজ না পুরো প্রক্রিয়াটি? বিজ্ঞানের কোনো প্রক্রিয়াই সহজ থাকে না শুরুতে, সবকিছুকেই সহজ বানিয়ে নিতে হয়। দিন যতই যাচ্ছে, সবকিছু আধুনিক আর সহজতর হয়ে উঠছে, যন্ত্রনির্ভর হয়ে উঠছে। তবুও যেকোনো কিছুর মূল প্রক্রিয়া ও কারণ জানা থাকা অন্যরকম এক আনন্দদায়ক ব্যাপার।

তথ্যসূত্র

E. Hall, John (2016). Textbook of Medical Physiology. Issue 13. p. 477-482

ফিচার ইমেজ- fi.edu

Related Articles