আধুনিকতার এই যুগে দুরন্ত সব যানবাহন ছাড়া চলাচলের কথা চিন্তাও করা যায় না! তবে যদি বলা হয় যে, এমনটি সম্ভব এবং হচ্ছেও, তাহলে কি বিষয়টি বিশ্বাসযোগ্য হবে? হতেই হবে! কারণ ঠিক এমনই এক অদ্ভুত জায়গা বাস্তবেই রয়েছে যেখানে চলে না কোনো গাড়ি-ঘোড়া! জায়গাটির নাম গ্যাথ্রুন। নেদারল্যান্ডের দৃষ্টিনন্দন ছোট্ট এই গ্রামটি অ্যামস্টারডাম থেকে ১০০ কি.মি. দূরে অবস্থিত।
শান্ত পরিবেশ, আঁকাবাঁকা খাল, কাঠ দিয়ে বানানো ছোট ছোট সেতু আর রঙ-বেরঙের নানান ফুলের সমারোহ এই গ্রামটিতে। আর এখানকার বাড়ি-ঘরগুলোর কথা তো না বললেই নয়। ২০০ বছরের পুরনো এই বাড়িগুলো একটুও বদলায়নি, ঠিক একই রকম আছে। আকার আকৃতিতে দেখতে অনেকটা খামার বাড়ির মতোই সেখানকার ঘরগুলো।
গ্যাথ্রুনে যেকোনো ধরনের যানবাহন ব্যবহারের উপর কঠোর নিষেধাজ্ঞা জারি করা আছে। যদিও পর্যটকরা এই সুন্দর জায়গা দেখতে এসে ভিড় জমানোর কারণে এই নিয়মের খানিকটা পরিবর্তন হয়েছে। তাই এখন সেখানে সাইকেল চালানোর অনুমতি আছে। তবে বেশিরভাগ সময়ে জলপথেই যাতায়াত হয়ে থাকে সেখানে। গ্রামের সনাতন দিকটিতে কোনো অলিগলিও নেই। গ্যাথ্রুনে ১৮০টিরও বেশি সেতু রয়েছে।
বহু আগে থেকেই পর্যটকদের মূল আকর্ষণ হলো সেখানকার নৌকা। পর্যটকেরা সেখানে গিয়ে মোটর বাইক, ডোঙ্গা (ছোট নৌকা) ভাড়া করতে পারে যেগুলো চলে ইলেকট্রিক মোটরে। আরামদায়ক ডাবল সিট থাকার কারণে এই ইলেকট্রিক মোটরে চালানো নৌকাগুলোই পর্যটকদের কাছে অধিক জনপ্রিয়।
রুপকথার মতো সুন্দর এই জায়গাটিকে জনপ্রিয় করে তোলার জন্য একজনকে ধন্যবাদ না দিলেই নয়। আর তিনি হলেন বার্ট হ্যান্সট্রা। এই ডাচ চলচ্চিত্র নির্মাতা ১৯৫৮ সালে তার নির্মিত বিখ্যাত কমেডি মুভি ফানফেয়ার এর শুটিং করেছিলেন গ্যাথ্রুনে। মূলত তখন থেকেই আলোচনায় আসে ও জনপ্রিয় হয়ে ওঠে এই সুন্দর জায়গাটি। ধীরে ধীরে পর্যটকেরা ভিড় জমাতে থাকে নয়নাভিরাম এই গ্রামটি দেখতে। গ্যাথ্রুনের অর্থনীতিতে তাই এখন পর্যটন শিল্পেরই বেশি অবদান আছে বলা যায়।
এই গ্রামের কাঁচা বাজার, মালামাল এমনকি রেস্টুরেন্টের ডেলিভারিও হয় নৌকায় যাতায়াতের মাধ্যমে। তিনটি কারণে গ্যাথ্রুন পৃথিবীর অন্য যেকোনো জায়গা থেকে একেবারেই আলাদা। প্রথমত, এখানে সবকিছুই ছোটখাটো। যেমন- ঘর-বাড়ি, খাল, সেখানে জনসংখ্যা কম, নৌকাগুলো ছোট, এমনকি সেখানকার সুপারমার্কেটগুলোও আয়তনে ছোট। দ্বিতীয়ত, সেখানে যে ১৮০টি সেতু রয়েছে, তার সবগুলোই কাঠের তৈরি। তৃতীয়ত, গ্যাথ্রুন নেদারল্যান্ডের ঠিক মাঝামাঝি হওয়ার কারণে পৃথিবীর যেকোনো প্রান্ত থেকে যাওয়াটা বেশ সহজসাধ্য।
গ্যাথ্রুনের ইতিহাস
সর্বপ্রথম ১২৩০ খ্রিস্টাব্দে ভূমধ্যসাগরীয় কয়েকজন পলাতক এই গ্রামটি প্রতিষ্ঠা করে। তারা পিট নির্যাস (ত্রয়োদশ শতাব্দীর দিকে শক্তির উল্লেখযোগ্য উৎস ছিলো) বহন করার সুবিধার্থে গ্রামের দুটি প্রান্তের সংযোগস্থলস্বরূপ কয়েকটি খাল কাটে। প্রথম প্রথম তারা এই শক্তির উৎসের খোঁজে বিভিন্ন জায়গায় খনন করতে থাকে। আর এভাবেই পুরো গ্যাথ্রুন জুড়ে তারা চালাতে থাকে খনন কাজ।
খনন কাজের পরের ধাপটি ছিলো সেগুলো বহন করে নিয়ে যাওয়া। এক প্রান্ত থেকে থেকে অন্য প্রান্তে যাওয়ার জন্য খাদ ও খাল কাটা। এর ফলস্বরূপ পুরো গ্যাথ্রুন সেজে ওঠে একেবারে ভিন্ন এক আঙ্গিকে।
গ্যাথ্রুনের নামকরণ
‘গ্যাথ্রুন’ শব্দটির আক্ষরিক অর্থ হলো ‘ছাগলের শিং’। এই নামকরণ করেন সেখানকার প্রথম অধিবাসীরা, যারা জলাভূমিতে পেয়েছিলো শত শত ছাগলের শিং! এই শিংগুলো ছিলো দশম শতাব্দীর বন্যার অবশিষ্টাংশ। তবে এখন সেখানে ঐ শিংগুলো আর নেই এবং গাছপালাগুলোও একেবারেই ভিন্ন। ১৯৭৩ সাল পর্যন্ত গ্রামটি একটি ভিন্ন পৌরসভা ছিলো। সরল, শান্ত ও মনোরম এই গ্রামটিকে বলা হয় ‘উত্তরের ভেনিস শহর’ বা ‘ছোট ভেনিস’। ইতালির শহরটির সাথে অবকাঠামোর মিল থাকায় এমন নাম দেয়া হয়েছে। এই গ্রামে কোনো রাস্তা না থাকলেও আছে সাইকেল চালানোর মতো সরু কিছু অলিগলি আর অসংখ্য সেতু।
গ্যাথ্রুন নিয়ে কিছু তথ্য
- গ্রামটি সমুদ্রসীমা থেকে কয়েক মিটার নিচে অবস্থিত। সেখানকার মাটি এতটাই নরম যে, সেখানে রাস্তা-ঘাট বানানো অসম্ভব। তাই এই গ্রামটি কোনো ধরনের গাড়ি-ঘোড়াও চলাচল করে না। রাস্তা-ঘাট বলতে সেখানে শুধুমাত্র সাইকেল চালানোর মতো সরু পথগুলোই আছে।
- সাইকেল ছাড়া নৌকাই গ্যাথ্রুনের একমাত্র যানবাহন। স্থানীয় নৌকাগুলোকে পান্টারস্ বলে এবং এগুলো নিয়মিত যাতায়াত ও মালামাল বহনের জন্য ব্যবহার করা হয়।
- যেহেতু সেখানে খাল আর নৌকারই সমারোহ, সেহেতু সেখানকার বাচ্চারাও বেশ ভালো নৌকা চালাতে পারে। বলা হয়ে থাকে যে, সেখানে বাচ্চারা হাঁটার আগেই নৌকা চালানো শিখে যায়।
- পুরো গ্যাথ্রুন আঠারো শতকের সব খামারবাড়ি দিয়ে ভরপুর। খড়ের এই বাড়িগুলোতে ২-৩টি করে রুম থাকে। প্রতিটি বাড়ির সাথে সিঁড়ি থাকে যা দিয়ে খালে নামা যায়।
- সেখানে ৪ মাইলেরও বেশি খাল রয়েছে যেগুলোর উপরে রয়েছে কাঠের ব্রিজ।
- এই গ্রামটির ইতিহাস ৮০০ বছর পুরনো।
- গ্যাথ্রুনের জনসংখ্যা খুবই কম। মাত্র ২,৬০০ লোকের বসবাস সেখানে।
- নৌকা ব্যবসায় বেশ সমৃদ্ধিশালী এই গ্রামটি। পুরো গ্রামের যাতায়াত ব্যবস্থা নৌকার উপর নির্ভর করায় নৌকার রমরমা ব্যবসা চলে সেখানে। একেকটি নৌকা বানাতে মোট সময় লাগে ৩-৪ সপ্তাহ।
- গ্যাথ্রুনে রয়েছে বেশ কয়েকটি রেঁস্তোরা। আর সেই রেঁস্তোরাগুলোর প্যানকেক বেশ জনপ্রিয়।
- বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সেখানকার নাগরিকেরা ‘হুইস্পার বোট’ নামের নৌকা ব্যবহার করে থাকে। কারণ এটি ইঞ্জিনবিহীন নৌকা হওয়ায় শান্ত পরিবেশ বজায় থাকে ও ধোঁয়ায় পরিবেশ দূষিতও হয় না।
- গ্রীষ্মকাল আর শীতকালের গ্যাথ্রুনের চেহারা একেবারেই আলাদা। গ্রীষ্মকালে খালগুলো পানি দিয়ে পূর্ণ থাকে। আবার শীতকালে সেই খালের পানিই জমে বরফ হয়ে যায়। বরফে ঢাকা গ্যাথ্রুন দেখে চেনার কোনো উপায় থাকে না। এই বরফের উপর শীতকালে সেখানকার নাগরিকেরা আইস স্কেটিং করে।
- সেখানে জলপথে চলাচলের জন্য বিভিন্ন ধরনের নৌকাগুলো হলো- কায়াক, রো-বোট, সেইল-বোট, হুইস্পার বোট, পান্ট, স্লোয়েপ (অভিজাত ইলেকট্রিক বোট) ইত্যাদি।
- ১০০ বছরের পুরাতন কিছু খবরের কাগজের আর্টিকেলের মাধ্যমে জানা যায় যে, শুরুর দিকে এই খালগুলো মানুষের যাতায়াতের সাথে সাথে পশুদের এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় নিয়ে যাওয়ার কাজেও ব্যবহার করা হতো।
- ‘টি ওল্ডে ম্যাট আস’ নামে একটি জাদুঘর আছে যেখানে গ্যাথ্রুনের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি সম্পর্কে জানা যায়। এই জাদুঘরটি তৈরি করা হয়েছিলো ১৯৮৮ সালে।
- গ্যাথ্রুনের ঐতিহ্যবাহী নৌকার নাম ‘পান্টার’। লম্বা ও সরু গড়নের এই নৌকাটির সাথে ভেনিসের জনপ্রিয় নৌকা ‘গন্ডোলা’-এর অনেক মিল রয়েছে। জাদুঘরে রাখা বিভিন্ন ছবি দেখে বোঝা যায় যে, দৈনন্দিন কাজের পাশাপাশি বাণিজ্যিক কাজেও ব্যাপকভাবে ব্যবহার করা হতো এই নৌকাটি। এখনও গ্যাথ্রুনের নাগরিকদের কাছে দৈনন্দিন ব্যবহারের কাজে ‘পান্টার’ই বেশ জনপ্রিয়।
- গ্যাথ্রুনে ঘুরতে যাওয়ার সবচাইতে ভালো সময় হলো এপ্রিলের মাঝামাঝি থেকে অক্টোবরের মাঝামাঝি সময়টা।
মাত্র ২,৬০০ মানুষের এই জায়গাটি শহরের কোলাহল থেকে হারিয়ে যাওয়ার মতো শান্ত একটি জায়গা। সেখানকার মানুষদের মতে, মাঝে মাঝে সবচাইতে জোরে যদি কোনো আওয়াজ শোনা যায়, তা হলো হাঁসের ডাক! এখন নিশ্চয়ই আপনার হারিয়ে যেতে ইচ্ছে করছে এই প্রশান্ত ও নিবিড় গ্রামে, তাই না?