একটি শহরের কথা ভাবা যাক। আপনি কর্মস্থলে যাওয়ার জন্য কেতাদুরস্ত হয়ে বের হলেন। বাসা থেকে বেরিয়ে ট্যাক্সি ভাড়া করলেন। কিছুক্ষণের মাঝেই তুমুল বৃষ্টিতে রাস্তাঘাট তলিয়ে গেল এবং ট্যাক্সির পেছনের সিটে প্রবল গতিতে ময়লা পানি প্রবেশ করতে শুরু করেছে।
কিংবা ভাবা যাক এমন এক জনপদের কথা যেখানে বসবাসরত অধিবাসীদের চারপাশে শুধু অথৈ জলরাশি। পাশের বাসায় গপ্পো করতে যাওয়া থেকে শিশুদের স্কুলে পাঠানো কিংবা নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির বিকিকিনি- সবকিছুতেই চাই নৌকো।
যদিও লেখক বলেছিলেন ভাবতে, তবে উপরের দৃশ্যকল্প দুটি সত্যিই ধরণীর বুকে বিরাজ করে। জীবনের ধরন কেমন সেখানে? মানুষ কি পড়ালেখা করে? দৈনন্দিন জীবনের চাকা কীভাবে আবর্তিত হয় এই জনপদে? মানুষ কীভাবে খাপ খাইয়ে নিচ্ছে এহেন দুরবস্থার সাথে? চলুন জেনে আসা যাক সেসব গল্প।
আফ্রিকার সবচেয়ে জনবহুল শহর লাগোস। জলবায়ুগত দিক থেকেও সবচেয়ে নাজুক অবস্থানে আছে শহরটি। ২৪ মিলিয়ন জনসংখ্যার এই অঞ্চলকে বলা হয় নাইজেরিয়ার অর্থনৈতিক চালিকাশক্তি। আর সে কারণেই দেশের নানা প্রান্ত থেকে কাজের সন্ধানে প্রচুর মানুষের নিত্য আসা-যাওয়া লাগোসে। ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার চাপ সইতে না পেরে লাগোসের রাস্তাঘাট একেবারেই অচল হওয়ার পথে, আর সেই সাথে পরিবেশ দূষণও বাড়ছে পাল্লা দিয়ে।
শহরাঞ্চল হিসেবে নাইজেরিয়ার লাগোসের সবচেয়ে বড় ত্রুটি হচ্ছে এর অকার্যকর পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থা। প্রায় পুরোটাই অব্যবস্থাপনাতে পরিপূর্ণ এই প্রক্রিয়ায় গড়ে প্রতিদিন ৬,০০০-১০,০০০ টন ময়লার সৃষ্টি হয়ে থাকে। প্রতিদিন জমা হওয়া এই বিপুল পরিমাণ বর্জ্যের সুষ্ঠু কোনো ব্যবস্থাপনা না থাকায় সামান্য বৃষ্টিতেই তলিয়ে যায় শহরের রাস্তাঘাট। যেখানে-সেখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা আবর্জনার স্তূপ তখন বৃষ্টির পানির সাথে মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। পথচারীদের হেঁটে চলাফেরা কিংবা যানবাহনে চেপে যাতায়াত দুটোই তখন প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে।
পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থার ত্রুটি ছাড়াও লাগোসের এহেন দুর্দশার আরেকটি বড় কারণ ক্রমবর্ধমান সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা। বৈশ্বিক তাপমাত্রা দুই ডিগ্রী সেলসিয়াস বৃদ্ধি পেলে ২১০০ সাল নাগাদ লাগোসকে মুখোমুখি হতে হবে ৯০ সেন্টিমিটার সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির। নাইজেরিয়ার লাগোস কীভাবে এই দুর্যোগের সাথে টিকে থাকার চেষ্টা চালাচ্ছে? যাপিত জীবনের নানা দিক কীভাবে পাল্টে যাচ্ছে?
উপকূলীয় সহনশীলতা
বন্যার পূর্বাভাস প্রদানে নাইজেরিয়ার শুরুর দিকের উদ্যোগ ছিল কেবলই পত্রিকা, মাগ্যাজিন, টেলিভিশন, এবং বেতারের উপর একমুখী নির্ভরশীলতা। একসময় প্রশাসনের উপলব্ধিতে এলো যে এসব কিছুর উপর পুরোপুরি নির্ভরশীলতা থেকে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা খুব একটা সম্ভবপর হয় না। মানুষ যে মুহূর্তে এসব মাধ্যম থেকে বন্যা সম্পর্কে জানতে পারছে ততক্ষণে বড্ড বেশি দেরি হয়ে যায়। শুকনো খাদ্যদ্রব্য মজুদকরণ, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি গোছগাছ করা, আশ্রয়কেন্দ্রে নিরাপদে স্থানান্তরিত হওয়া এসবের জন্য নিদেনপক্ষে যতটা সময় দরকার তা তারা পায় না, কারণ এসব বেতার, পত্রিকা ইত্যাদি বন্যার পূর্বাভাস যথেষ্ট আগে থেকে দিতে পারে না।
এরপর নাইজেরিয়ার কৃষি মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে তৈরি হলো ওয়েটইন অ্যাপ (WetIn App)। এই অ্যাপ প্রচলিত গণমাধ্যমের তুলনায় বেশ আগে বন্যার পূর্বাভাস জানাতে সক্ষম। প্রাথমিক উদ্যোগ হিসেবে এটি নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। তবে এর প্রধান সীমাবদ্ধতা ছিল এটি শুধু কৃষকদের উদ্দেশ্যে নির্মিত ছিল। ফেডারেশনের তিনটি প্রধান বন্যাপ্রবণ অঞ্চলের কৃষক সমাজকে লক্ষ্য করে এই অ্যাপটি যে কোনো সম্ভব্য দুর্যোগের চারদিন পূর্বে সতর্কতা জারি করত। একটি নির্দিষ্ট শ্রেণির সদস্যরা অ্যাপটির কল্যাণে উপকৃত হলেও সম্পূর্ণ সুফলের জন্য দরকার হচ্ছিল আরও পরিপূর্ণ কিছুর।
এই ধাপে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে এগিয়ে আসে নাইজেরিয়ান ফেডারেল অথরিটি। ফ্লাড মোবাইল অ্যাপ নামে তারা একটি অ্যাপ নির্মাণ করে। এই অ্যাপের উল্লেখযোগ্য দিক হলো- এটি পূর্বাভাস তুলনামূলক আগেই জানাতে পারে। এতে করে উপকূলীয় অঞ্চলের অধিবাসীরা প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি গ্রহণের ক্ষেত্রে পর্যাপ্ত সময় পেয়ে থাকেন। অ্যাপটি সকলের কাছে সমাদৃত হয়েছে কারণ পূর্বাভাস প্রদানের ক্ষেত্রে এটি একটি রিয়েল টাইম আপডেট সিস্টেম হিসেবে ভূমিকা রাখতে সক্ষম, অর্থাৎ একটি সুনির্দিষ্ট স্থানের জন্য এটি প্রতি মুহূর্তের হালনাগাদ জানাতে পারদর্শী। আর এই কাজ করতে অ্যাপটি ব্যবহার করে থাকে নাইজেরিয়ান হাইড্রোলজিক্যাল সার্ভিস এজেন্সি (এনএইচএসএ) থেকে সংগৃহীত তথ্যসমূহ।
ভাসমান স্থাপনা
লাগোসের জল পরিবেষ্টিত অঞ্চল ম্যাকোকো। এটি ভেনিস অব আফ্রিকা নামেও খ্যাত। গোলকধাঁধাবৎ এই অঞ্চল প্রকৃতপক্ষে একটি বস্তি, যা পুরোটাই পানির ওপর অবস্থিত। এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যাওয়ার একমাত্র উপায় ক্যানু (একধরনের নৌকাবিশেষ)। কল্পনা করতে বললেও কষ্টকর হবে, তবে এটিই ম্যাকোকোর নির্মম বাস্তবতা যে এই অঞ্চলের জনগণের পর্যাপ্ত বিদ্যুৎ এবং স্বাস্থ্যকর পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থা দুটোরই বড্ড অভাব। তবে পাশাপাশি এটাও স্বীকার করতে হবে যে ম্যাকোকো ফ্লোটিং স্কুলের মতো অনিন্দ্যসুন্দর ও বুদ্ধিদীপ্ত স্থাপত্যশৈলীর সৃষ্টিও ল্যাগোসের এই অঞ্চলেই।
ম্যাকোকোর এই বিশেষ স্থাপনা নিয়ে কিছু কথা না বললেই নয়। ম্যাকোকোর এই স্কুলগুলোর নকশা করা হয়েছে অনেকটা পিরামিডের আদলে। অর্থাৎ চূড়ার দিকটা সরু ও কোণাকৃতির এবং নীচের দিকটা সমতল একটি পাটাতন। পাটাতনের নীচে কিছু সংখ্যক পুনর্ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিকের ড্রাম জুড়ে দেওয়া হয় (প্লবতার ধারণার প্রয়োগ)। এই ড্রামগুলোর ওপর ভর করে পুরো স্থাপনাটি ভেসে থাকে। প্রশ্ন হচ্ছে- পানির ওপর চিরাচরিত চারকোণা গড়নের কিছু নির্মাণ না করে পিরামিডকে কেন নকশার অনুপ্রেরণা হিসেবে নিতে হলো? পানির ওপর কিছু নির্মাণের ক্ষেত্রে স্থাপনার মৌলিক উপাদান যদি খুব হালকা হয় তবে সেক্ষেত্রে পিরামিড আকৃতির কিছু বানানো হলে তার অভিকর্ষজ কেন্দ্র তুলনামূলক নীচে অবস্থান করে। এর পাশাপাশি পিরামিডের আদলে স্থাপনার ছাদে দু’পাশে দুটি ঢাল থাকলে বর্ষণপ্রবণ অঞ্চলে সহজেই বৃষ্টির পানি নেমে যেতে পারে। এই দুটি সুবিধার কথা মাথায় রেখেই পিরামিডের গঠনশৈলীকে মাথায় রেখে নকশা করা ম্যাকোকোর এই স্কুলগুলো ইতোমধ্যেই সারা বিশ্বের নজর কেড়েছে।
ফেরির বিশেষায়িত ব্যবহার
আমাদের দেশে বর্তমানে বেশ কিছু স্থানে ফেরি পারাপারের সুবিধা আছে। এসব ফেরি মূলত যানবাহন পারাপারের কাজই করে থাকে। অন্যদিকে লাগোসের ফেরিগুলো বিশেষভাবে যাত্রী পরিবহনের জন্যই নির্মিত। যেহেতু অতিবৃষ্টির দরুন লাগোসের সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থার যথেষ্টই নাজেহাল দশা, তাই প্রশাসন ও ব্যক্তিগত বিভিন্ন উদ্যোগে বদৌলতে অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন ব্যবস্থা বেশ শক্তিশালী অবস্থানে পৌঁছেছে। বর্তমানে লাগোসে ৪০টিরও বেশি ফেরি রুট এবং ৩০টিরও বেশি বাণিজ্যিক জেটি ও টার্মিনাল ব্যবহৃত হচ্ছে যাত্রী পরিবহনের লক্ষ্যে। অপরিকল্পিত ও ভঙ্গুর সড়ক যোগাযোগের কারণে যে বিপুল পরিমাণ সময় প্রতিদিন যাত্রীদের নষ্ট হয়, যে অবর্ণনীয় দুর্দশার সম্মুখীন তাদের হতে হয় প্রত্যহ, তাতে সক্রিয় এই নৌ-পরিবহন ব্যবস্থা যেন এক পশলা স্বস্তির ঠিকানা।
সময় কিংবা দুর্দশার কথা ব্যতীত নৌ-পরিবহন ব্যবস্থার আরও একটি চমকপ্রদ দিক রয়েছে। সেটি হলো এর পরিবেশগত প্রভাব। যাত্রীপ্রতি কার্বন নিঃসরণের পরিমাণ হিসেব করলে একটি বাস কিংবা একটি ট্যাক্সির চেয়ে একটি ফেরি অধিকতর পরিবেশবান্ধব। বাস, ট্যাক্সি এসবের চেয়ে ফেরি যথেষ্ট পরিমাণে কম কার্বন নিঃসরণ করে।