বর্তমান এবং পূর্বের অনেক ক্রিকেটারই ক্রিকেটে নাম-যশ-খ্যাতি লাভের পূর্বে নানাবিধ পেশায় নিয়োজিত ছিলেন। কেউ কেউ আবার সেসব পেশায় ঈর্ষণীয় সাফল্যও পেয়েছেন। হয়তো সেসময় তাদের পেছনে বিশাল ফ্যাশনের ভিড় ছিল না, যা পরবর্তী ক্রিকেট জীবনে তারা উপভোগ করেছেন। এ তালিকা বেশ দীর্ঘই বটে। ভাবতে অবাকই লাগে জীবনের পথচলায় এদের কেউ ছিলেন ডাক্তার, কেউবা শিক্ষক, কেউ টিকিট চেকার, আবার কেউ ট্রাক ড্রাইভার। চলুন তাহলে সেসব খেলোয়াড়দের সম্পর্কে একনজরে জেনে নিই, যারা ক্রিকেটার হওয়ার পূর্বে অন্য পেশায় নিজেদের নিয়োজিত রেখেছিলেন।
শিক্ষক পেশায় ক্রিকেটাররা
অনেক ক্রিকেটার ক্লাসরুম এবং ড্রেসিংরুমের মধ্যে কী নিখুঁত সমন্বয় করতে পারতেন তা বলার অপেক্ষা রাখে না। প্রাক্তন দুই অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটার বিল উডফুল এবং পল শ্যাহান ছিলেন তেমনই দুজন ক্রীড়া ব্যক্তিত্ব। ১৯৩২-৩৩ সালের ঐতিহাসিক বডিলাইন সিরিজের অস্ট্রেলিয়া দলের ক্যাপ্টেন ছিলেন ব্যাটসম্যান বিল উডফুল। তিনি ক্রিকেট খেলার পাশাপাশি মেলবোর্ন হাই স্কুলের গণিত শিক্ষক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। পরবর্তীতে তিনি ঐ স্কুলের প্রধান শিক্ষক পদে দীর্ঘদিন সাফল্যের সাথেই তার শিক্ষকতা পেশা চালিয়ে যান।
মেলবোর্ন হাই স্কুলের খানিক দূরেই মেলবোর্ন গ্রামার স্কুলে শিক্ষক হিসেবে কর্মরত ছিলেন প্রাক্তন অস্ট্রেলিয়ার টেস্ট ব্যাটসম্যান পল শ্যাহান। তিনি ২০০৯ সাল পর্যন্ত ঐ স্কুলে প্রধান শিক্ষক হিসেবে নিয়োজিত ছিলেন। বর্তমানে তিনি মেলবোর্ন ক্রিকেট ক্লাবের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
পুলিশ কর্মকর্তা ছিলেন যারা
অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডের দুজন প্রাক্তন ক্রিকেটার বেশ সুনামের সাথেই পুলিশের সদস্য হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। সারা দুনিয়ার ব্যাটসম্যানদের ত্রাস বোলার শেন বন্ড তার এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছিলেন, পুলিশ কর্মকর্তা হিসেবে তিনি সেসময় যে প্রশিক্ষণ পেয়েছিলেন তা পরবর্তীতে তার ক্রিকেট কর্মজীবনেও ব্যাপক প্রভাব ফেলেছিল।
অত্যন্ত সুপরিচিত ক্রিকেটার ও প্রাক্তন ভারতীয় বোলিং কোচ জো ডয়েস অস্ট্রেলিয়ার ঘরোয়া ক্রিকেটে ডানহাতি পেস বোলার হিসেবে কুইন্সল্যান্ড বুলস দলের হয়ে তার ক্রিকেটজীবন শুরু করেন। কিন্তু তার আগে থেকেই তিনি আট বছর অস্ট্রেলিয়ার পুলিশ বিভাগে গোয়েন্দা অফিসার হিসেবে কর্মরত ছিলেন।
চিকিৎসক ছিলেন যারা
ক্রিকেটারের সাথে চিকিৎসক হিসেবে পেশাজীবন শুরু করা এমন ক্রীড়া ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে যে নামটি প্রথমে আসে তিনি আর কেউ নন, স্বনামধন্য ইংলিশ ক্রিকেটার ও বিখ্যাত ডাক্তার ডব্লিউ. জি. গ্রেস; ক্রিকেট মাঠেও ‘দ্য ডক্টর’ নামেই যিনি সবচেয়ে বেশি পরিচিত ছিলেন।
গ্রেসকে নিয়ে ক্রিকেট মহলে বেশ মজার মজার কাহিনী প্রচলিত রয়েছে। অ্যালুমিনিয়ামের ব্যাটে ব্যাটিং করা কিংবা আউট হওয়ার পরও ক্রিজে থেকে যাওয়া, খেলতে খেলতে মাঠে ঘুমিয়ে পড়া ইত্যাদি নানা মজার কাহিনীতে ভরপুর গ্রেসের ক্রিকেটজীবন। ক্রিকেটের পাশাপাশি তিনি ছিলেন সেসময়ের বেশ নামকরা চিকিৎসকও। পারিবারিক পেশা হিসেবে চিকিৎসক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করলেও তার মন পড়ে থাকতো সেই ২২ গজের ক্রিকেট মাঠে। এমনও অনেক সময় হয়েছে রোগী চেম্বারে বসে আছে কিংবা মৃতদেহ বরফজলে ডুবিয়ে রাখা হয়েছে, কিন্তু গ্রেসের কোনো পাত্তা নেই। তিনি ব্যস্ত ক্রিকেট মাঠে। খেলা সেরে এসে তবেই ছুরি-কাঁচি হাতে নেবেন। তারপরও তিনি রোগীদের কীভাবে সময় দিতেন তা এক বিস্ময়! ৫০ বছর বয়স পর্যন্ত তিনি ক্রিকেট খেলেছেন। প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে ৫৪ হাজার রান এবং ১২৪টি শতক এবং ২,৮০০ এর অধিক উইকেট নিয়েছেন।
অস্ট্রেলিয়ার বিখ্যাত অলরাউন্ডার মন্টি নোবল ছিলেন একজন দন্ত চিকিৎসক। ১৯০৯ সালে তিনি হয়েছিলেন অস্ট্রেলিয়ার জাতীয় দলের ক্যাপ্টেন। জাতীয় দলের প্রতিনিধি হিসেবে চারবার ইংল্যান্ড সফর করেছেন।
একজন যোগ্যতাসম্পন্ন দন্ত চিকিৎসক হওয়াতে বিভিন্ন জায়গায় এভাবে ভ্রমণের সময় তিনি সেসব অঞ্চলের দন্ত চিকিৎসার নতুন নতুন কৌশল পরীক্ষা করার সুযোগ পেতেন। প্রায়ই বিভিন্ন জায়গা থেকে দন্ত চিকিৎসায় ব্যবহৃত উন্নত যন্ত্রপাতি সঙ্গে করে অস্ট্রেলিয়ায় নিয়ে আসতেন তিনি।
রেলওয়ের টিকিট চেকার
রেলওয়ের টিকিট চেকার হিসেবে যার নামটি আসে, তিনি হলেন ভারতের প্রাক্তন অধিনায়ক মহেন্দ্র সিং ধোনি। রেলের টিকিট পরীক্ষক হিসেবে তার প্রথম পেশা জীবনে পা রাখেন ধোনি। পরবর্তীতে ক্রিকেটার হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য চাকরি হতে অব্যাহতি নেন।
গাড়িচালক হিসেবে জীবন শুরু করেছিলেন যারা
নিউজিল্যান্ডের হয়ে প্রথম ১০০ টেস্ট উইকেট নেয়া বোলার ডিক ম্যাটজ ক্রিকেটারের পাশাপাশি ট্যাক্সিচালক হিসেব জীবিকা নির্বাহ করতেন। কারণ সেসময় নিউজিল্যান্ডের খেলোয়াড়রা ক্রিকেটকে পেশা হিসেবে নেয়ার কথা কল্পনাও করতে পারতেন না। একবার পাকিস্তান দল নিউজিল্যান্ডে খেলতে গিয়েছে। ক্রিকেট ম্যাচ কভার করার জন্য কমার আহমেদ নামের এক পাকিস্তানি সাংবাদিক দলের সাথে সেই সফরে গিয়েছিলেন। তিনি হোটেল থেকে স্টেডিয়ামে যাতায়াতের জন্য একটি ট্যাক্সি ঠিক করলেন। ট্যাক্সিতে ওঠার সময় তিনি খেয়াল করেননি ট্যাক্সিচালকের মুখ। কিন্তু স্টেডিয়ামে পৌঁছে যেই ট্যাক্সির বিল পরিশোধ করতে যাবেন তখন তিনি সেই ট্যাক্সি চালককে দেখে তাজ্জব বনে যান। তার সেই ট্যাক্সি চালক আর কেউ নন, নিউজিল্যান্ডের বোলার ডিক ম্যাটজ।
ডিক ম্যাটজের মতোই আরেকজন খেলোয়াড় গাড়ি চালাতেন। তাবে তিনি চালাতেন ট্রাক। তিনি অস্ট্রেলিয়ার আক্রমণাত্মক ফাস্ট বোলার মিচেল জনসন। তার বোলিং দক্ষতা বিপক্ষ দলের ব্যাটিং লাইনে কাঁপন ধরায়। তিনি ট্রাকে বিভিন্ন প্লাম্বিংয়ের জিনিসপত্র আনা-নেওয়া করতেন। সারাদিন কাজের শেষে নিয়মিত ট্রেনিং জারি রাখতেন মিচেল।
ক্রিকেটের আগে অন্য খেলায় জড়িত ছিলেন যারা
অস্ট্রেলিয়ার বিখ্যাত ক্রিকেটার ইয়ান চ্যাপেল একজন বেসবল খেলোয়াড় হিসেবে তার পেশাজীবন শুরু করেছিলেন। বেসবল প্লেয়ার হিসেবে অস্ট্রেলিয়ার জাতীয় দলেও ডাক পান তিনি। কিন্তু পরবর্তীতে বেসবল ছেড়ে ক্রিকেটার হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেন।
প্রাক্তন কেনিয়ান ব্যাটসম্যান দীপক চুড়াসামা ক্রিকেটার হওয়ার পূর্বে ছিলেন একজন টেনিস খেলোয়াড়। বিভিন্ন স্তরে দেশের হয়ে টেবিল টেনিস খেলেছেন। ১৯৮২ সালে টেবিল টেনিস খেলোয়াড় হিসেবে তিনি ভারতের কমনওয়েলথ গেমসে অংশগ্রহণ করেন।
এ বি ডি ভিলিয়ার্সও তেমনি এক ক্রিকেটার যিনি ক্রিকেটের পরিবর্তে রাগবী ও ব্যাডমিন্টনকে বেশি প্রাধান্য দিতেন। এমনকি জাতীয় দলের হয়ে জুনিয়র পর্যায়ের ফুটবল এবং হকিতেও প্রতিনিধিত্ব করেছেন তিনি।
এয়ার পাইলট হিসেবে নিয়োজিত ছিলেন যারা
১৯৮০-এর দশকের ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেট দলের অন্যতম সদস্য ছিলেন কলিন ক্রফট। এই দীর্ঘদেহী ক্রিকেটার ছিলেন একজন সাড়া জাগানো ফাস্ট বোলার। অ্যান্ডি রবার্টস, মাইকেল হোল্ডিং ও জোয়েল গার্নারের সাথে দলের অগ্রযাত্রায় রাখেন গুরুত্বপূর্ণ অবদান। এই চার রত্নের বিধ্বংসী বোলিং আক্রমণে বিপক্ষ ব্যাটসম্যানদের ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা শুরু হয়ে যেতো। ১৯৭৭ সালে পাকিস্তানের বিপক্ষে টেস্ট অভিষেক ঘটে। পাকিস্তানের বিপক্ষে তার ২৯ রানে ৮ উইকেট আজ অবধি ওয়েস্ট ইন্ডিজের ফাস্ট বোলারদের মধ্যে সেরা। এই বিখ্যাত ক্রীড়া ব্যক্তিত্ব ক্রিকেটের পাশাপাশি একটি এয়ারলাইন্সের এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলার হিসেবে নিযুক্ত ছিলেন।
১৯৮৫-৮৬ সালের ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান সফরের জন্য ইংল্যান্ড এক নতুন ফাস্ট বোলারকে দলের সঙ্গে নিয়ে যায়। রিকি এলকক নামের ইংলিশ ফাস্টবোলার বার্বাডোজে জন্ম নিলেও তার পরিবার ইংল্যান্ডে এসে বাস করতে থাকে। তার দুর্দান্ত ফাস্ট বোলিং সকলকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিল। তার পেস আর নিয়ন্ত্রিত বোলিংয়ে বিপক্ষ ব্যাটসম্যানদের রান করতে বেশ বেগ পেতে হতো। কিন্তু ইনজুরির কারণে সেই সফর তো বটেই, কোনোদিন ইংল্যান্ডের জাতীয় দলের হয়ে খেলা হয়নি তার। কিন্তু প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে তিনি তার প্রতিভার স্বাক্ষর রেখে যান। ৪৬টি ম্যাচ খেলে ১১৭টি উইকেট শিকার করেন। অবসর গ্রহণের পর তিনি বার্বাডোজে ফিরে যান এবং একটি বাণিজ্যিক বিমানের পাইলট হিসেবে কর্মরত ছিলেন।