ইমরান খানের সাবেক স্ত্রী জামিমা একবার তাকে প্রশ্ন করেছিলেন, আর কত সময় ধরে তিনি রাজনীতিতে সফলতাবিহীন অনুগমন চালিয়ে যাবেন এবং কোন বিন্দুতে পৌঁছুলে তিনি তার রাজনৈতিক জীবনকে বৃথা হিসেবে মেনে নিবেন? উত্তরে ইমরান খান বলেছিলেন, “Dream has no time frame” অর্থাৎ “স্বপ্নের নির্ধারিত কোনো সময়সীমা থাকে না“।
বলছিলাম পাকিস্তানের বিশ্বকাপ জয়ী সাবেক অধিনায়ক ইমরান খানের কথা। বিভিন্ন দেশের রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের উত্থান নিয়ে আমাদের সিরিজের প্রথম পর্বে ছিল রাশিয়ান প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির ভ্লাদিমিরোভিচ পুতিনের গল্প। এর দ্বিতীয় পর্বে আজ বিশ্লেষিত হবে পাকিস্তানের তেহরীক-ই-ইনসাফের নেতা ইমরান খান নিয়াজির রাজনীতিতে অনুগমনের ইতিহাস।
ক্রিকেট জনপ্রিয়তা থেকে রাজনীতি
১৯৭২ সালে টেস্ট ক্রিকেটে এবং ১৯৭৪ এ ওয়ানডেতে অভিষেক হয় ইমরানের। অভিষেকের পর ১৯৮২ – ১৯৯২ সাল পর্যন্ত টানা দশ বছর নেতৃত্ব দিয়েছেন পাকিস্তানি ক্রিকেটের, হয়েছেন পাকিস্তানের সকল অধিনায়কদের মধ্যে সেরা। এমনকি এখনও পর্যন্ত পাকিস্তানের সর্বকালের সেরা ক্রিকেটার হিসেবে ইমরান খানকেই বিবেচনা করা হয়ে থাকে। না হবারও কোনো যৌক্তিকতা নেই, কেননা পাকিস্তানের ইতিহাসে মাত্র একবারই বিশ্বকাপ ঘরে তোলার সুযোগ হয়েছিল আর সেবার পাকিস্তানের নেতৃত্বে ছিলেন কিংবদন্তী ক্রিকেটার ইমরান খান। সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ ক্রিকেট অলরাউন্ডারদের তালিকাতেও তার স্থান উপরের সারিতেই। ১৯৪৭ এ স্বাধীনতা লাভের পর যখন রাষ্ট্র পাকিস্তান চারিদিক থেকেই বিপর্যস্ত, নিজেদের স্বৈরাচারীতার ফলে ১৯৭১ সালে অখণ্ড পাকিস্তান ভেঙ্গে খান-খান। গর্ব করার মতো কিছুই নেই পাকিস্তানের। তখন সমগ্র জাতির আশার আলো হয়ে আবির্ভূত হন তিনি। আলো ছড়াতে গিয়ে একসময় জনসাধারণ তাকে পৌঁছে দেয় জনপ্রিয়তার সর্বোচ্চ শিখরে।
ইমরান খানের রাজনীতিতে আসার পেছনে টনিক হিসেবে জনপ্রিয়তা ছিল অন্যতম একটি কারণ তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কেননা তার রাজনৈতিক ক্যারিয়ার শুরুই হয় ১৯৯৬ সালে, অথচ ১৯৮৮ সালে পাকিস্তানের মুহম্মদ খানের সরকারের পতনের পর জেনারেল জিয়াউল হক তাকে যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারের মন্ত্রী হবার আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। এমনকি পরবর্তীতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধানমন্ত্রী মইন কোরেশীর কাছ থেকেও পেয়েছেন আমন্ত্রণ। রাজনৈতিক জ্ঞান না থাকলেও সে সময় তার তুমুল জনপ্রিয়তাকে পুঁজি করতেই তাকে যে, এসব আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল তা আর বিবেচনার অবকাশ রাখে না। তবে সেসব আমন্ত্রণ সবিনয়ে প্রত্যাখ্যান করেন তিনি। চালিয়ে যান ক্রিকেটের ঘোড়া। ১৯৯৩ সালের ক্রিকেট থেকে অব অবসর নেন ইমরান। ধারাভাষ্য এবং পত্রিকায় লেখালেখি করে সময় কাটাচ্ছিলেন তখন। ভারতীয় উপমহাদেশের গণ্ডি পেড়িয়ে ততদিনে সমগ্র বিশ্বেই খ্যাতি লাভ করেন তিনি।
১৯৯৬ সালে ইমরান তার নিজের বাসভবন জামান পার্কে বসে বেশকিছু কাছের এবং নতুন বন্ধু মিলে সিদ্ধান্ত নেন রাজনৈতিক দল গঠনের। শুরুতে দলটির নাম দিয়েছিলেন ‘জাস্টিস পার্টি’, পরবর্তীতে নাম পরিবর্তন করে হয় তেহরীক-ই-ইনসাফ। ড. আরিফ আলভি, নাইমুল হক, তেহরীক-ই-ইনসাফের শাসনতন্ত্রের রূপকার হামিদ খানসহ প্রতিষ্ঠাকালীন প্রায় এক ডজনেরও বেশি সদস্য এখনো নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে ইমরান খানের দল তেহরীক-ই-ইনসাফের জন্য।
রাজনীতির পথে যাত্রা শুরু
মানুষের কাছে সহজে গ্রহণযোগ্যতা পাবার জন্য নিজের জনপ্রিয়তার পাশাপাশি ধর্মকে পুঁজি হিসেবে নিয়ে নেন তিনি। নিজের ইসলামি আদর্শের ইমেজ প্রদর্শন করেন জনমানুষের সামনে। তবে এতো সহজেই রাজনীতির মাঠ দাঁড়ানো সম্ভব হয়নি তার পক্ষে। ২০০২ সালে প্রথমবারের মতো নির্বাচনে অংশ নেয় তার দল। হাস্যকর হলেও সত্যি, সেবার তার দল আসন পায় মাত্র একটি! এবং সেটি ছিল তার নিজের এলাকাতে অংশ নেয়া তার নিজের আসন। তবে সে ঘটনায় ভেঙ্গে পড়েননি ইমরান। জাতীয় পরিষদে তার দায়িত্ব পালন করেছেন নির্দিষ্ট মেয়াদের পুরোটা জুড়েই।
রাজনীতির মারপ্যাঁচ না বুঝে শুরুর দিকে পারভেজ সরকারকে সমর্থন দিয়েছিলেন ইমরান। এজন্য অবশ্য তাকে খেসারৎ দিতে হয়েছে ২০০৮ এর নির্বাচনে। ইমরান খানকে সে সময় গৃহবন্দি করে রাখে তারই আস্থাভাজন পারভেজ মোশাররফ। ক্ষোভে ফেটে পড়েন ইমরান। রাজনীতির মাঠে ততদিনে বেশ সক্রিয় হয়ে উঠেছেন তিনি। শিখেছেন অনেক কিছুই। ক্ষোভ প্রকাশের মাধ্যম হিসেবে বয়কট করেন ২০০৮ এর নির্বাচন। তার নির্বাচন বয়কটের সিদ্ধান্তের সুফল দেখা দেয় ২০১৩ সালে।
মুসলিম লীগ এবং পিপলস পার্টি উভয়েই ইমরান খানের জনপ্রিয়তার পরিমাণটা ঠিক ধরতে পারেনি। ২০১১ সালের ৩০শে অক্টোবর নিজেকে অনন্য এক উচ্চতায় স্থাপন করেন ইমরান। প্রায় পাঁচ লক্ষ লোকের সমাগম ঘটে ইমরান খানের একটি জনসভায়। প্রয়াত বেনজির ভুট্টোর নির্বাসন থেকে ফেরার পর শেষবার ১৯৮৬ সালের একটি জনসভায় এতো লোকের সমাগম দেখেছিল পাকিস্তান। তারপর দেখল ২০১১ সালে।
ইমরান খানের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধির আরও নানানিধ কারণ রয়েছে। তিনি ক্ষমতাসীন পিপলস পার্টির বৈদেশিক নীতির প্রচণ্ড বিরোধিতা করেন এবং পাশাপাশি ট্রাম্প কার্ড হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিরোধিতা করতে থাকেন যা পাকিস্তানের সাধারণ জনগণের মধ্যে চিন্তার খোড়াক সৃষ্টি করে। এভাবে সাধারণ মানুষের কাছে তার গ্রহণযোগ্যতার মাত্রা আরও সমৃদ্ধ হয়। ‘নয়া পাকিস্তান’ তৈরির ঘোষণা দিয়ে তিনি তরুণ প্রজন্মের কাছেও জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন।
রাজনীতিতে জনপ্রিয় হয়ে ওঠা
২০১৩ সালের নির্বাচনে তার দল তেহরীক-ই-ইনসাফ জাতীয় নির্বাচনে অংশ নেয় এবং বেশ ভালোই সমর্থন পায় মানুষের কাছ থেকে। ৩৫টি আসনে জয় লাভ করে আবির্ভূত হয় পাকিস্তানের তৃতীয় রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে। নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগ এনে মুসলিম লীগের নওয়াজ শরিফের পদত্যাগের দাবিতে তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলেন। পানামা পেপারের দুর্নীতির অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় আন্দোলনে আরও গতির সঞ্চার হয় এবং শেষ পর্যন্ত গদি ছেড়ে পদত্যাগ করতে বাধ্য হয় শরিফ। এর মাধ্যমে পাকিস্তানের রাজনীতিতে আরও একটি লক্ষ্য অর্জনে সমর্থ হন ইমরান।
বর্তমানে পাকিস্তানের রাজনীতিতে সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়তা অর্জন করে আছে পাকিস্তান মুসলিম লীগ। এরপরেই দ্বিতীয় অবস্থানে আছে ইমরানের তেহরীক-ই-ইনসাফ। যদিও পিপলস পার্টির জনপ্রিয়তাও একেবারেই কম নয়। তবে বেনজির ভুট্টোর শূন্যতা এখনো পূরণ করতে পারেনি পিপলস পার্টি। যার ফলে ইমরান খানের জন্য কাজগুলো আরও সহজ হয়ে গেছে।
আসন্ন নির্বাচনে জনপ্রিয়তার বিচারে তেহরীক-ই-ইনসাফের চেয়ে মুসলিম লীগ এগিয়ে আছে আকাশ-পাতাল পার্থক্য নিয়ে। তবে বিগত পাঁচ বছরে ইমরানের জনপ্রিয়তাও বেড়েছে অসামান্য পরিমাণেই। ক্রিকেটের মাঠে বিশ্বকাপটা জিতলেও রাজনৈতিক বিশ্বকাপটা এখনো জিততে পারেননি তিনি। ব্যক্তিগতভাবে ইমরান খান মনে করছেন সময় হয়েছে দায়িত্ব নেবার এবং সে কারণে তেহরীক-ই-ইনসাফও প্রস্তুত পুরোদস্তুর।
বিতর্কিত ইমরান
মুসলিম প্রধান পরিবারে জন্ম নেবার পরও ধর্মীয় অনুশাসন মেনে না চলার অভিযোগ আছে ইমরানের বিপরীতে। ভারত এবং ইংল্যান্ডের বেশ কয়েকজন নারী অভিনেত্রীর সাথে সম্পর্কের কথা শোনা যায় ‘ক্রিকেটার ইমরানের’ বিরুদ্ধে । ভারতীয় নায়িকা জিনাত আমানের সাথে তার ঘনিষ্ঠতার খবর অপ্রকাশিত নয়। এছাড়া ইংল্যান্ডে বেনজির ভুট্টোর সাথেও তার সম্পর্ক ছিল বলে অনেকে বলে থাকেন। দেশের বাইরের নাইট ক্লাবগুলোতে তার ছিল অবাধ বিচরণ। আর সে কারণে বিভিন্ন মিডিয়া তার নাম দেয় ‘নাইটক্লাব ম্যাগনেট’।
রাজনীতিতে প্রবেশ করার পর এসব কিছু ছেড়ে সম্পূর্ণ ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলার অঙ্গীকার করলেও নিজ দলের নারী কর্মীকে অশালীন বার্তা দেবার অভিযোগ উঠেছে ইমরান খানের বিরুদ্ধে। তবে এসব কিছুকে বিরোধী দলের চক্রান্ত হিসেবেই দেখছেন ক্রিকেট মাঠের এই প্লেবয়।
বাংলাদেশের সাথে পাকিস্তানের যুদ্ধ নিয়ে মন্তব্য করেও অনেকবার সমালোচিত হয়েছেন তিনি। তবে এ ব্যাপারে তার বক্তব্য বরাবরই স্ববিরোধীতায় আচ্ছাদিত। ১৯৭১ সালের যুদ্ধে পাকিস্তানের বর্বরতাকে স্বীকার করে বাংলাদেশের কাছে পাকিস্তানকে ক্ষমা চাইতে বলেন ইমরান। এ ব্যাপারে তিনি আরও বলেন, পাকিস্তানের মিডিয়া এতটাই সেন্সরপূর্ণ ছিল যে কারণে প্রকৃত সত্য পাকিস্তানের মানুষ জানতে পারেনি।
আবার অন্যদিকে ইমরানের রাজনৈতিক আত্মজীবনী পাকিস্তান: এ পার্সোনাল হিস্ট্রি প্রকাশিত হয় ২০১১ সালে। সে বইয়ে তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধকে ‘গৃহযুদ্ধ’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন এবং সম্পূর্ণ যুদ্ধটাকেই ভারতের চক্রান্ত হিসেবে দেখছেন। এমনকি সর্বশেষ বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধী সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও আলী আহসান মুজাহিদের ফাঁসির কার্যকর করারও নিন্দা জানিয়েছেন তিনি। এসব আলামত রাজনীতির ঘোলা জলে তার গভীর নিমজ্জনেরই ইঙ্গিত বহন করে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।
ইমরান খান তার আত্মজীবনীতে রাজনীতিতে আগ্রহের কথা উল্লেখ করেছেন এবং এ বিষয়ে তাকে বেশ আশাবাদীও মনে হয়েছে। তিনি তার বইতে লিখেছেন, “আমি খেলার মাধ্যমে উপলব্ধি করেছি, তুমি তোমাকে যতবেশি চ্যালেঞ্জ করবে, নিজের ভেতরের সুপ্ত শক্তিমত্তা ততবেশি করে আবিষ্কার করতে পারবে। যে মুহূর্ত থেকে তুমি আরামপ্রিয় হয়ে উঠবে তখন থেকেই তোমার নিম্নমুখী গমন শুরু হয়ে যাবে।”
তিনি মনে করেন পাকিস্তান ক্রিকেট দলের ক্যাপ্টেন হিসেবে তিনি যেমন সাফল্য বয়ে এনেছেন, ঠিক তেমনিভাবে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হয়েও সাফল্য বয়ে আনবেন। রাজনীতিতে প্রায় বিশ বছর পার করার পর এ বিষয়ে বেশ দক্ষতাও অর্জন করেছেন ইমরান। যার প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে তার সাম্প্রতিক কাজে-কর্মে। তবে তার দৌড় কতটুকু তা বোঝা যাবে ২০১৮ সালে পাকিস্তানের সাধারণ পরিষদের নির্বাচনে। আর ততক্ষণ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে আমাদের সবাইকে।