Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

ফ্রান্সের রাজনীতিতে এমানুয়েল ম্যাক্রোঁর উত্থান

ফ্রান্স পশ্চিমা বিশ্বের অন্যতম প্রাচীন এবং ভৌগলিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ একটি রাষ্ট্র। তাছাড়া বিশ্বের হাতেগোনা কয়েকটি পারমাণবিক শক্তিধর রাষ্ট্রের মধ্যে ফ্রান্স অন্যতম। পাশ্চাত্যের দেশ হিসেবে ফ্রান্সের ইতিহাস বেশ সমৃদ্ধ এবং বিচিত্র। একসময় ফ্রান্স ছিল রোমান সাম্রাজ্যের অংশ। প্রাচীন রোমানরা খ্রিস্টপূর্ব প্রথম শতকে ফ্রান্স দখল করে নেয় এবং রোমান সাম্রাজ্যের পতন পর্যন্ত ফ্রান্স তাদের দখলেই ছিল। রোমান সাম্রাজ্যের পতনের পর থেকে অষ্টাদশ শতাব্দী পর্যন্ত অনেকগুলো রাজবংশ ফ্রান্স শাসন করেছে। আঠারো শতকে এসে ফ্রান্সের রাজতান্ত্রিক শক্তিগুলোর ক্ষমতা ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পায় এবং আমলাতান্ত্রিক রাষ্ট্রে পরিণত হয়।

ইউরোপে ফ্রান্সের অবস্থান; image source: wikimedia commons 

১৭৮৯ সালে ফরাসি বিপ্লবের মাধ্যমে ফ্রান্সের রাজতন্ত্রের পতন ঘটে। রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা নেমে আসে সমগ্র ফ্রান্স জুড়ে। এরপর নেপোলিয়ন বোনাপার্টের শাসনামলে ফ্রান্স একটি সুসংহত এবং সমৃদ্ধ রাষ্ট্রীয় কাঠামো লাভ করে। আধুনিক যুগে এসে ফ্রান্স একটি স্বতন্ত্র এবং সমৃদ্ধ রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। রাজতান্ত্রিক শাসনামলের সময় ফ্রান্সে একাধিক ভিন্ন ভিন্ন জাতির মানুষ বসবাস করত। তাদের ধর্মেরও ছিল বৈচিত্র্য। যদিও সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ধর্ম ছিল ক্যাথলিক খ্রিস্টান। ফরাসি বিপ্লবের আগপর্যন্ত এসব ভিন্ন ভিন্ন জাতির লোকেরা প্রায় চারশোর মতো ভিন্ন ভিন্ন প্রশাসনিক অঞ্চলে একই রাজার প্রজা হিসেবে বসবাস করত। কালের বিবর্তনে বিগত কয়েক শতক যাবৎ এ অঞ্চলে বসবাসকারী লোকেরা নিজেদের ফরাসি হিসেবে পরিচয় দিতে শুরু করে।

উনবিংশ এবং বিংশ শতকে এসে ফ্রান্স নামক রাষ্ট্রটি শিল্প, শক্তি-সামর্থ্য এবং অর্থনৈতিকভাবে একটি সমৃদ্ধ রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। এসময় ফ্রান্স ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে বিশ্বব্যাপী বিস্তৃত এলাকাজুড়ে নিজেদের ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্য গড়ে তোলে। আফ্রিকা জুড়ে ফ্রান্সের সবচেয়ে বড় উপনিবেশ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। তারই রেশ ধরে আফ্রিকার বিভিন্ন দেশের উপর ফ্রান্স এখনও তাদের কর্তৃত্ব ধরে রেখেছে। আজকের ফ্রান্সের শক্তি-সামর্থ্য এবং পরাশক্তি হওয়ার পেছনে ঔপনিবেশিক শাসনের ভূমিকা সবচেয়ে বেশি। উপনিবেশগুলো থেকে ধন-সম্পদ আর অর্থ অর্জন করে তা দিয়ে শিল্পপ্রতিষ্ঠান, শিক্ষা এবং বাণিজ্যিক কেন্দ্র গড়ে তুলেছে ফ্রান্স। আর এই শিল্প এবং শিক্ষার মাধ্যমে খুব দ্রুতই আধুনিক বিশ্বের শিখরে পৌঁছাতে সক্ষম হয়েছে তারা।

বিশ্বব্যাপী ফ্রান্সের ঔপনিবেশিক শাসনের চিত্র; image source: wikimedia commons 

বিংশ শতকে দু-দুটি মহাযুদ্ধে অংশ নেয় ফ্রান্স। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয় দেশটি। কিন্তু সঠিক নেতৃত্ব বলে ধূলিসাৎ অর্থনীতিকে পুনরায় গড়ে তোলে এবং বিশ্বের শিল্প প্রধান রাষ্ট্র হিসেবে আবির্ভূত হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ফ্রান্স পারমাণবিক সক্ষমতা অর্জন করে। শিক্ষা, শিল্পকলা এবং সাংস্কৃতিকভাবে বিশ্ব আসনে প্রতিষ্ঠিত হয়। বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে সাম্রাজ্যগুলোতে উপনিবেশ বিরোধী আন্দোলন জেগে ওঠে। এ সময় ফ্রান্স তার অধিকাংশ সাম্রাজ্য হারায়। বর্তমানের ফ্রান্স এবং জার্মানি পুরো ইউরোপের রাজনীতি এবং অর্থনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করছে।

আয়তনের দিক দিয়ে ফ্রান্স ইউরোপের তৃতীয় বৃহত্তম রাষ্ট্র। অপরদিকে জনসংখ্যার বিবেচনায় ইউরোপে ফ্রান্সের অবস্থান চতুর্থ। ফ্রান্সের মোট জনসংখ্যা ৮৯.৪৫% জন্মসূত্রে ফরাসি। এছাড়া অভিবাসী রয়েছে ৮.৯% শতাংশ। ফ্রান্সের মোট জনসংখ্যার ৬৪.৫% খ্রিস্টান, ২৫.৫% নিরীশ্বরবাদী এবং ৮% মুসলমান। এছাড়া ইহুদি রয়েছে প্রায় ০.৮%। ২.৭১ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার জিডিপির এই দেশটি বিশ্বের সপ্তম অর্থনীতির দেশ। সেদেশের মানুষের মাথাপিছু আয় প্রায় ৪৩ হাজার মার্কিন ডলার।

১৭৮৯ সালে ফরাসি বিপ্লবের পর থেকে ফ্রান্স একটি সুসংহত রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে; image source: medium.com

রাজনীতি

ফ্রান্স বিশ্বের প্রথম দেশ যেখানে ফরাসি বিপ্লবের মাধ্যমে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। ফরাসি বিপ্লবে উদ্বুদ্ধ হয়ে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন জাতির মানুষেরা স্বাধীনতা এবং গণতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থার জন্য সংগ্রাম করেছে।

ফ্রান্সের রাজনীতি ‘ফরাসি পঞ্চম প্রজাতন্ত্র’-এর ফরাসি সংবিধান দ্বারা নির্ধারিত। একটি আধা-রাষ্ট্রপতি ব্যবস্থা কাঠামোর মাধ্যমে পরিচালিত হয়। সংবিধানে ফ্রান্সকে একটি ‘অবিভাজ্য, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক এবং সামাজিক প্রজাতন্ত্র’ হিসাবে ঘোষণা করা হয়। এছাড়া ফ্রান্সের মানবাধিকার এবং সার্বভৌমত্বের নীতিগুলো ১৭৮৯ সালে ফরাসি বিপ্লবের নীতির সাথে সংরক্ষণ করা হয়েছে। প্রেসিডেন্ট সেদেশের রাষ্ট্রের প্রধান এবং প্রধানমন্ত্রী ফ্রান্সের সরকারপ্রধান হিসেবে নিযুক্ত। কিন্তু রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার হওয়ায় সে দেশের সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী হন প্রেসিডেন্ট। ফরাসি সংসদ সে দেশের জাতীয় সংসদ এবং সিনেটের সমন্বয়ে গঠিত। ৪ অক্টোবর, ১৯৫৮ সালে নিবন্ধিত ‘ফ্রেঞ্চ ফিফথ রিপাবলিক’ নামক সংবিধান দ্বারা রাষ্ট্রটি পরিচালিত হয়।

২০১২ সাল থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ছিলেন ফ্রঁসোয়া ওলঁদ; image source: wikimedia commons 

ফ্রান্সে সেক্যুলার সমাজতান্ত্রিক দলগুলোর প্রভাব বরাবরই বেশি। যদিও বর্তমানে ফ্রান্সে একটি মধ্যমপন্থী সরকার ক্ষমতায় রয়েছে। কিন্তু এর পূর্বে ২০১২-১৭ সাল পর্যন্ত ফ্রান্সে সোস্যালিস্ট পার্টি নামক একটি সমাজতান্ত্রিক দল ক্ষমতায় ছিল, যারা কার্যত ফ্রান্সকে একটি ধর্মবিদ্বেষী রাষ্ট্রে পরিণত করে। সে সময় ফ্রান্সের মুসলমানদের হিজাব পরিধান পর্যন্ত নিষিদ্ধ ছিল। এমনকি অন্যান্য ধর্মের বিভিন্ন বিধি-নিষেধের ওপর কঠোর নীতি আরোপ করা হয়। ২০১৬ সালে নির্বাচনী প্রচারণায় বর্তমান প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল ম্যাক্রোঁ ধর্মীয় রীতিনীতির উপর কঠোরভাবে হস্তক্ষেপ করার জন্য সরকারের কড়া সমালোচনা করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন,

প্রত্যেকে যেন মর্যাদা বজায় রেখে তার ধর্ম পালন করতে পারে, তা আমাদের কর্তব্য। ফ্রান্সের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে মুসলমান নারীদের হিজাব পরিধানের পূর্ণতা স্বাধীনতা রয়েছে। আমরা ধর্মনিরপেক্ষতায় বিশ্বাসী, কিন্তু এর মাধ্যমে কোনো ধর্মকে আঘাত করায় বিশ্বাসী নই। ধর্মনিরপেক্ষতা কোনো ‘প্রজাতন্ত্রের ধর্ম’ নয়।

ফ্রান্সে ডানপন্থী রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ‘ন্যাশনাল র‍্যালি’ এবং ‘দ্য রিপাবলিকানস’ বেশ প্রভাবশালী। অন্যদিকে মধ্যমপন্থী হিসেবে বিবেচিত বর্তমান ক্ষমতাসীন দল ‘অঁ মার্শ’ নিজেদেরকে র‌্যাডিকাল সেন্ট্রিজম এবং ইউরোপীয়পন্থী হিসেবে প্রচার করে। সাবেক অর্থমন্ত্রী এমানুয়েল ম্যাক্রোঁ ২০১৬ সালে এই দলটি প্রতিষ্ঠা করেন এবং নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসেন।

বামপন্থী দলগুলোর মধ্যে সোশ্যালিস্ট পার্টি এবং ফরাসি কমিউনিস্ট পার্টি সবচেয়ে ক্ষমতাশালী। সোশ্যালিস্ট পার্টি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ১৯৬৯ সালে। প্রতিষ্ঠার পর থেকে ধারাবাহিকভাবে তাদের সাফল্য ছিল অকল্পনীয়। সর্বশেষ ২০১২-১৭ সাল পর্যন্ত সোশ্যালিস্ট পার্টি সে দেশের ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ছিল। সোশ্যালিস্ট পার্টির হয়ে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছিলেন ফ্রঁসোয়া ওলঁদ। অন্যদিকে ফরাসি কমিউনিস্ট পার্টি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ১৯২০ সালে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর থেকেই ফ্রান্সে সমাজবাদীদের প্রভাব বাড়তে থাকে। ঠিক সে সময়ই এই দলটি প্রতিষ্ঠিত হয়।

এছাড়া ওয়ার্কার্স কমিউনিস্ট পার্টি অফ ফ্রান্স, ইন্ডিপেন্ডেন্ট ওয়ার্কার্স পার্টি, পল অফ কমিউনিস্ট রিবার্থ ইন ফ্রান্স, পাইরেট পার্টি এবং পপুলার রিপাবলিকান ইউনিয়নও ফ্রান্সের রাজনীতিতে বেশ প্রভাবশালী।

এমানুয়েল ম্যাক্রোঁ

ম্যাক্রোঁর জন্ম ১৯৭৭ সালের ২১ ডিসেম্বর ফ্রান্সের উত্তরের আমিঁয়া শহরে। পড়াশোনা করেছেন ফ্রান্সের বিখ্যাত পারি নঁতের বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শনশাস্ত্রে। পরবর্তীতে তিনি সিয়ঁস পো নামক মর্যাদাসম্পন্ন উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে জনসংযোগ বিষয়ে স্নাতকোত্তর উপাধি অর্জন করেন। সর্বশেষ তিনি ফ্রান্সের খ্যাতিমান ইকোল নাসিওনাল দাদমিনিস্ত্রাসিওঁ নামক উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে ২০০৪ সালে পাশ করে বের হন। এরপর তিনি ফ্রান্সের আঁস্পেকসিওঁ জেনেরাল দে ফিনঁস (অর্থসংস্থান পরিদর্শকদের সাধারণ কার্যালয়) প্রতিষ্ঠানে উর্ধ্বতন সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে তার কর্মজীবন শুরু করেন। পরবর্তীতে রথসচাইল্ড অ্যান্ড কোং নামের একটি প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ ব্যাংকার হিসেবে কাজ করেন।

এমানুয়েল ম্যাক্রোঁর বাল্যকালের ছবি; image source: Gerard Banc/Lycee La Providence Amiens

স্কুলে পড়াকালেই নিজের চেয়ে বয়সে ২৫ বছরের বড় ক্লাস শিক্ষিকার প্রেমে পড়েন ম্যাক্রোঁ। ব্রিজিথ তোনিয়ো নামক ঐ শিক্ষিকা তখন তিন সন্তানের জননী। ম্যাক্রোঁর বয়স যখন ১৬ বছর তখন ঐ শিক্ষিকার বয়স ছিল ৪০ বছর। ম্যাক্রোঁর পরিবার থেকে বাধা দেওয়া হলেও ২০০৭ সালে বিবাহ বন্ধনেআবদ্ধ হন তারা। ফ্রান্সের রাজনীতিতে ম্যাক্রোঁর নাটকীয়ভাবে উত্থানের পূর্বে তিনি হতে চেয়েছিলেন একজন উপন্যাসিক।

স্কুলে পড়া অবস্থায় মাত্র ১৫ বছর বয়সে ম্যাক্রোঁ প্রেমে পড়েন তার চেয়ে বয়সে ২৫ বছরের বড় ক্লাস শিক্ষিকার; image source: france24.com

২০০৬ সাল থেকেই ম্যাক্রোঁ রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন। সে সময় ফ্রান্সের অন্যতম বৃহৎ সমাজতান্ত্রিক দল পার্তি সোসিয়ালিস্তের সদস্য ছিলেন তিনি। ২০০৯ সালে ম্যাক্রোঁ রাজনীতি থেকে অনেকটাই বিচ্ছিন্ন করে নেন নিজেকে।

২০১২ সালের মে মাসে ফ্রান্সের রাষ্ট্রপতি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ওই নির্বাচনে সোশ্যালিস্ট পার্টির পক্ষ থেকে প্রেসিডেন্ট পদে জয়লাভ করেন ফ্রঁসোয়া ওলঁদ। সে বছরই প্রেসিডেন্ট ফ্রঁসোয়া ওলঁদ ম্যাক্রোঁকে রাষ্ট্রপতির কার্যালয়ের উপ-মহাসচিব পদে নিয়োগ দেন। ফলে এমানুয়েল ম্যাক্রোঁ ফরাসি প্রেসিডেন্টের অন্যতম সিনিয়র উপদেষ্টাতে পরিণত হন। ম্যাক্রোঁ তার অবস্থান থেকে যোগ্যতা, দৃঢ়তা এবং আত্মবিশ্বাসের মাধ্যমে সফলতা অর্জন করতে থাকেন। ফলে খুব শীঘ্রই তিনি সরকারের আস্থাভাজন ব্যক্তিত্বে পরিণত হন।

২০১৪ সালের আগস্টে ফ্রান্সের প্রধানমন্ত্রী মানুয়েল ভালস তাঁকে ফরাসি মন্ত্রীসভাতে অর্থনীতি, শিল্প ও ডিজিটাল বিষয়ক মন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দান করেন। ম্যাক্রোঁ যোগ্যতাবলে একজন সরকারি কর্মচারী থেকে পরিণত হন মন্ত্রিসভার একজন গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রীতে। মন্ত্রী থাকা অবস্থায় ব্যবসায়িক এবং শিল্পক্ষেত্রে ম্যাক্রোঁর বেশকিছু সংস্কারের কারণে ফরাসি জনগণের দৃষ্টি কাড়েন তিনি। একই সাথে বেশ জনপ্রিয়তাও অর্জন করেন।

এই জনপ্রিয়তা থেকে উদ্বুদ্ধ হয়েই তিনি ২০১৬ সালের এপ্রিল মাসে ‘অঁ মার্শ’ নামক একটি রাজনৈতিক দল প্রতিষ্ঠা করেন। ২০১৭ সালের নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার জন্য ২০১৬ সালের আগস্ট মাসে তিনি মন্ত্রিপরিষদ থেকে পদত্যাগ করেন। মধ্যমপন্থী এই রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকেই ২০১৭ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন এমানুয়েল ম্যাক্রোঁ।

২০১৭ সালের নির্বাচনে জনমত জরিপে ম্যাক্রোঁ অনেক পিছিয়ে ছিলেন। এ নির্বাচনে তার নিশ্চিত পরাজয় ধরেই নেয়া হয়েছিল। প্রথম পর্বে ম্যাক্রোঁ তুলনামূলক ভালো ভোট পান এবং দ্বিতীয় পর্বে অংশগ্রহণের সুযোগ পান। দ্বিতীয় পর্বে প্রধান প্রতিপক্ষ মারিন ল্যপেনের বিরুদ্ধে ৬৬% ভোট পেয়ে জয়লাভ করেন ম্যাক্রোঁ। ফলে ফ্রান্সের অষ্টম রাষ্ট্রপতি হিসেবে মাত্র ৩৯ বছর বয়সী এমানুয়েল ম্যাক্রোঁ ফ্রান্সের ইতিহাসে সর্বকনিষ্ঠ রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন।

ম্যাক্রোঁ ছিলেন ধর্মনিরপেক্ষতার জোরালো সমর্থক। ২০১৬ সালের অক্টোবর মাসে মারিয়ান সাময়িকীকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন

ব্যক্তিগত বলয়ে কোনো ফরাসি যদি আধ্যাত্মিকভাবে তার ধর্মকে সর্বোচ্চ আইন হিসেবে মানতে চান, সেটা সম্ভব, কিন্তু জনসাধারণ্যের জন্য নির্ধারিত বলয়ে ফরাসি প্রজাতন্ত্রের আইন যেকোনো ধর্মের চেয়ে ঊর্ধ্বে থাকবে।

ম্যাক্রোঁ নিজেকে নিরপেক্ষ বলে দাবি করলেও তার কার্যক্রমে অনেক সময়ই ধর্মবিদ্বেষী আভাস পাওয়া গেছে। তিনি ২০২০ সালের ২ অক্টোবর তথাকথিত ‘ইসলামী উগ্রবাদ’ এর বিরুদ্ধে ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি বজায় রাখার জন্য একটি পরিকল্পনা উন্মোচন করেন। এবং তিনি বলেন সারাবিশ্বে ইসলাম ধর্ম একটি ‘সংকটকালীন অবস্থা’ অতিক্রম করছে। কথিত উগ্রবাদের বিরুদ্ধে তার প্রণীত নীতি হবে ১৯০৫ সালের আইনের আদলে। যে আইনে রাষ্ট্র ও ধর্মকে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে পৃথক ঘোষণা করা হয়েছিল। অক্টোবরের মাঝামাঝি সময়ে এক অভিবাসী ফরাসি বিদ্যালয়ের শিক্ষক স্যামুয়েল পিটের শিরশ্ছেদ করার ফলে ম্যাক্রোঁর ধর্মনিরপেক্ষ আইনের পালে জোর হাওয়া লাগে।

মুসলিম বিশ্বে তুমুল ক্ষোভের মুখে পড়েন ম্যাক্রোঁ; image source: the independent 

ম্যাক্রোঁ বিতর্কিত পত্রিকা শার্লি এবদো থেকে প্রকাশিত হযরত মুহাম্মদ (স)-এর ব্যাঙ্গাত্মক চিত্রগুলো প্রকাশের ব্যাপারে তার জোরালো সমর্থন ব্যক্ত করেন। এবং তিনি যুক্তি দেখান যে এগুলো ফ্রান্সের বাকস্বাধীনতা এবং মুক্তচিন্তার প্রতীক। ফলে ফ্রান্সের সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় এবং পুলিশ প্রহরায় সরকারি ভবনের দেয়ালে হযরত মুহাম্মদ (স) এর ব্যাঙ্গচিত্র প্রদর্শন করা হয়। যদিও মুসলিম বিশ্ব এবং মুসলমানদের পক্ষ থেকে এর তীব্র প্রতিবাদ ও নিন্দা জানানো হয়। কিন্তু ম্যাক্রোঁ দ্ব্যর্থহীনভাবে ঘোষণা করেন যে তাদের বাকস্বাধীনতা এবং মুক্তচিন্তার প্রতীক হিসেবে ব্যাঙ্গচিত্র প্রদর্শন করা বন্ধ করবে না। এতে এমানুয়েল ম্যাক্রোঁ তার রাজনৈতিক জীবনের সবচেয়ে বড় সংকটের মধ্যে পড়েন।

বিশ্বব্যাপী নিন্দার ঝড় ওঠে। বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রধান কর্তৃক নিন্দা জানানো হয়। তাছাড়া মুসলিম বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ফরাসি পণ্য বয়কটের ডাক দেয়া হয়। এতে আর্থিকভাবে ফ্রান্সের ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলো কিছুটা হলেও লোকসানের সম্মুখীন হয়। কিন্তু এখন পর্যন্ত ম্যাক্রোঁ তার সিদ্ধান্তে অনড় রয়েছেন।

ধর্মনিরপেক্ষ ফ্রান্সের রাজনীতি বড়ই বৈচিত্রময়। কমিউনিস্ট শাসনের সময় যখন ফ্রান্স ধর্মবিদ্বেষী হিসেবে গড়ে উঠেছিল, এমানুয়েল ম্যাক্রোঁ সেই ফ্রান্সকে ধর্মনিরপেক্ষ এবং সকল ধর্মের সমান অধিকার নিশ্চিত করেছিলেন। তখন ফ্রান্সে বসবাসরত মুসলমানেরা ম্যাক্রোঁকে জোরালো সমর্থন জানায়। কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় এবং কিছু ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে এমানুয়েল ম্যাক্রোঁর কিছু সিদ্ধান্ত সবচেয়ে বেশি সমালোচিত হচ্ছে সেই মুসলমানদের পক্ষ থেকেই।

This is a Bangla Article. This is About The Rise of Emmanuel Macron in French Politics

All the references are hyperlinked within the article.

Featured Image: Britannica 

Related Articles