
তরুণ প্রজন্মের কাছে অনলাইনে গেম খেলা এক ধরণের নেশার মতো হয়ে দাঁড়িয়েছে। ক্ল্যাশ অফ ক্ল্যান, লীগ অফ লেজেন্ডস কিংবা মিনি মিলিশিয়ার মতো গেমের মধ্যে বুঁদ হয়ে থাকা তরুণ-তরুণীর সংখ্যা নেহাতই কম না। ঘরে বসে, ক্লাসের ফাঁকে, এমনকি বইখাতার মধ্যে ফোন লুকিয়ে রেখে গেম খেলা সেই ব্যক্তিটি কি কখনো ভাবতে পারবে এমন একটি গেম হতে পারে তারই মতো প্রায় ১৩০ জন তরুণের মৃত্যুর একমাত্র কারণ? ছেলেমেয়ের অনলাইন গেমের প্রতি নেশা নিয়ে যে বাবা-মায়েরা ইতোমধ্যে চিন্তিত ছিলেন, তাদের চিন্তার পারদ এবার আকাশ ছুঁয়ে যাবে বৈকি!
গল্প নয়, সত্যিই সম্প্রতি এমন একটি ঘটনা ঘটেছে রাশিয়াতে। ঘটেছে বললে হয়তো ব্যাপারটার গুরুত্ব ঠিক বোঝা যায় না, বলা ভালো ‘ঘটে চলেছে’ এমন একটি ঘটনা। পুরো বিষয়টির কেন্দ্রে রয়েছে একটি বিতর্কিত অনলাইন গেম যার নাম ‘দ্য ব্লু হোয়েল গেম’ বা ‘ব্লু হোয়েল চ্যালেঞ্জ’। বাংলা করলে নামটি দাঁড়াবে ‘নীল তিমি চ্যালেঞ্জ’। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ইন্টারনেটের মাধ্যমে খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে এই গেমটি।
 
আত্মহত্যায় প্ররোচনা দানকারী গেমটি, ytimg.com
গেমটির নিয়ম হলো সোশ্যাল গেমিং পেজের অ্যাডমিনিস্ট্রেটরের নির্দেশ মোতাবেক ৫০ দিন ধরে বিভিন্ন টাস্ক পূরণ করতে হবে যার মধ্যে রয়েছে নিজেকে আহত করা, গভীর রাতে ঘুম থেকে উঠে হরর মুভি দেখা ইত্যাদি। শুরুর দিকের টাস্কগুলো বেশ সহজ এবং অন্যান্য গেমের চেয়ে আলাদা হওয়ায় মজা পেয়ে যায় প্লেয়াররা। এর মধ্যে ছিল অ্যাডমিনিস্ট্রেটরদের পাঠানো ভিডিও ও ছবি দেখা, ভোর ৪.২০ এ ঘুম থেকে উঠে ক্রেইনে চড়া ইত্যাদি। তবে প্লেয়ার যত উপরের লেভেলে পৌঁছায়, টাস্কও তত কঠিন হয়। ফাইনাল চ্যালেঞ্জ হিসেবে প্লেয়ারকে আত্মহত্যা করার নির্দেশ দেয়া হয়। ‘ব্লু হোয়েল’ কথাটিও এসেছে সমুদ্র তীরবর্তী নীল তিমি থেকে, যাকে আত্মহত্যার প্রতীক হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
‘ব্লু হোয়েল’ গেমটি শুরু হয় ২০১৩ সালে, রাশিয়ায়। গেমটির সূত্রপাত ঘটে ‘ভিকোন্তাকে’ নামক সোশ্যাল নেটওয়ার্কে, যার পরিচালক ছিল ‘এফ৫৭’। এফ৫৭ মূলত ‘ডেথ গ্রুপ’ নামে পরিচিত। ২০১৫ সালে গেমটির জের ধরে প্রথম আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে বলে জানা যায়। প্রতিদিন ইন্সটাগ্রামে ‘ব্লু হোয়েল’ গেমটিতে কে কোন লেভেলে আছে তা পোস্ট করার রীতিমতো একটি অসুস্থ প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায়। মজার ব্যাপার হলো ‘ব্লু হোয়েল’ গেমটি একবার ডাউনলোড করার পর তা আর সহজে আনইন্সটল করা যায় না। আর মুহুর্মুহু আসা নোটিফিকেশন আপনাকে বাধ্য করবে গেমটিতে কী চলছে বা পেজটিতে কী হচ্ছে তা একবার ঢুঁ মেরে দেখে আসতে। প্রতিটি টাস্ক কমপ্লিট করে তার ছবি গেমিং পেজটিতে আপলোড করার নিয়মও রয়েছে। কাজেই সমবয়সী অন্যান্য তরুণ-তরুণীদের গেমটিতে দ্রুত এগিয়ে যাওয়া দেখে স্বভাবতই বাকিরাও তাতে অ্যাকটিভ হওয়ার একটি তাড়না অনুভব করেন। এভাবেই একের পর এক তরুণ-তরুণী যুক্ত হচ্ছেন আত্মঘাতী এই গেমটির সাথে।
 
আত্মহত্যার প্রতীক নীল তিমি, ytimg.com
গেমটি নিয়ে মাথা ব্যথার শুরু হয় তখনই, যখন তিন মাসের মধ্যে রাশিয়া এবং তার পার্শ্ববর্তী এলাকায় ১৬ জন তরুণী আত্মহত্যা করে। ২০১৬ সালের এই ঘটনাটি প্রথমবার সর্বসাধারণের সামনে তুলে ধরেন রাশিয়ান এক সাংবাদিক। অল্প সময়ের মধ্যে এত জন সমবয়সীর আত্মহত্যার ঘটনায় টনক নড়ে পরিবারের সদস্য থেকে শুরু করে প্রশাসনিক পর্যায়েরও। পুলিশ খোঁজ নিয়ে জানতে পারে সাইবেরিয়ার দুই স্কুল ছাত্রী ইউলিয়া কনস্তান্তিনোভা (১৫) এবং ভেরোনিকা ভলকোভা (১৪) বহুতল ভবনের ছাদ থেকে লাফ দিয়ে আত্মহত্যা করে। তদন্তকারী কর্মকর্তাদের এই দুটি ঘটনাকে বিচ্ছিন্ন মনে হয়নি, বরং তাদের মধ্যকার যোগসূত্র খুঁজতে খুঁজতে কেঁচো খুঁড়তে গিয়ে যেন সাপই বেরিয়ে আসে। আত্মহত্যার আগে ইউলিয়া তার সোশ্যাল পেইজে একটি তিমির ছবি পোস্ট করে এবং তার সাথে ক্যাপশন লিখে যায় ‘সমাপ্ত’। এই সূত্র ধরেই তদন্ত চালিয়ে যায় পুলিশ, আর খুব শীঘ্রই একটি-দুটি নয়, গোটা বিশ্বে প্রায় ১৩০টি আত্মহত্যার কেস এবং তার সাথে ‘ব্লু হোয়েল’ গেমটির সম্পৃক্ততার ব্যাপারে নিশ্চিত হন তারা।
রাশিয়ার পাশাপাশি অন্যান্য দেশেও যে গেমটির প্রভাব ছড়িয়ে পড়ছে, তা টের পেয়ে অনলাইন জগতের উপর কড়া নজরদারি রাখার নির্দেশ দেয়া হয় সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর পুলিশকে। সেখান থেকেই বেরিয়ে আসে আরও কিছু ভয়ংকর তথ্য। আর্জেন্টিনায় সান জোয়ান নামের ১৪ বছরের এক কিশোরকে মানসিক হাসপাতালে ভর্তি করা হয়, ব্লু হোয়েল গেমটির প্রতি আসক্তি তাকে বাস্তব পৃথিবী থেকে একদম আলাদা করে দিয়েছিল। লা প্লাটায় ব্লু হোয়েল গেমটির টাস্ক কমপ্লিট করতে গিয়ে ১২ বছরের একটি মেয়ে নিজের হাত কেটে ক্ষতবিক্ষত করে ফেলেছে বলে পুলিশে রিপোর্ট করে মেয়েটির দাদা-দাদী। এ বছরের জুনের ২৭ তারিখে ১৬ বছরের এন্ট্রে রায়োস হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করে। গেমটির ফাইনাল লেভেলে উঠে আত্মহত্যার চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে ৩১ মে থেকে হাসপাতালে ভর্তি থাকা ছেলেটি শেষ পর্যন্ত গেমে জিতে গেলেও হেরে যায় জীবনের কাছে।
ব্রাজিলের অবস্থাও বেশ খারাপ। রাজধানী সাও পাওলোতে মাসৌদ প্লাজা নামের একটি বিলাসবহুল হোটেলে বেড়াতে আসে কয়েক জোড়া কপোত-কপোতী। তাদের সবার বয়স ১৮ থেকে ১৯ বছরের মধ্যে। এদের মধ্যে লুইস নামের এক যুবক মাথায় গুলি করে মেরে ফেলে তার বান্ধবী কায়েনাকে এবং তার পরপরই নিজেও আত্মহত্যা করে একই উপায়ে। কর্তৃপক্ষ খোঁজ নিয়ে জানতে পারে এর পিছনেও লুকিয়ে আছে ‘ব্লু হোয়েল’ গেমের কালো হাত। ১৭ বছরের বাউরু ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস দেয় যেখানে লেখা ছিল “সব দোষ ঐ নীল তিমির“। তার কয়েক মিনিট পরেই ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়ে সে। সৌভাগ্যবশত দমকল বাহিনীর কর্মীরা দ্রুত তৎপরতায় তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যায়। পরবর্তীতে মিলিটারি পুলিশ এবং মায়ের সহায়তায় রক্ষা পায় আরও বেশ কিছু তরুণের প্রাণ। গেমটির সাথে সম্পৃক্ত আরও অন্তত ২০ জন তরুণকে উদ্ধার করে গেমের দুনিয়া থেকে তাদের বের করে আনার প্রক্রিয়া চলছে।
২০১৬ সালের ৩ জুন ইতালীতে একটি প্রেস কনফারেন্স ডেকে ব্লু হোয়েলের চ্যালেঞ্জগুলোকে ‘ব্যাড জোক’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়। জাতীয় সংবাদপত্রগুলোতে অবশ্য এটিকে রাশিয়ান গেম হিসেবেই স্বীকৃতি দেয়া হয় এবং তরুণদের মধ্যে এর জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকে। এর কয়েকদিন পরেই ব্লু হোয়েল চ্যালেঞ্জের অংশ হিসেবে আত্মহত্যা করে লেগহর্ন নামের এক কিশোর। পত্রিকাগুলো এই আত্মহত্যার সাথে ব্লু হোয়েলের সম্পর্কের কথা জোর দিয়ে বললেও এটিকে ব্যক্তিগত ট্র্যাজেডি বলে পুরো বিষয়টিকে ধামাচাপা দেয় কর্তৃপক্ষ। এ বছরের ১৪ মে তদন্তের রিপোর্ট সহ সামনে আসে বিভিন্ন চ্যানেল। ধীরে ধীরে লেগহর্নের মতো ব্লু হোয়েল গেমের শিকার আরও বেশ কিছু হতভাগ্য শিশু-কিশোরের আত্মহত্যার খবর প্রচার পায় সর্বত্র।
 
এভাবেই চলছে একের পর এক আত্মহত্যা, hallelujah.co
এই বিপুল সংখ্যক তাজা প্রাণের ঝরে পড়ার পিছনে কার হাত রয়েছে তা নিয়ে চিন্তায় পড়ে যায় পুলিশ। আদাজল খেয়ে মাঠে নামা কর্তৃপক্ষ তখন খোঁজ পায় ফিলিপ বুদেকিনের। সাইকোলজির একজন প্রাক্তন শিক্ষার্থী তিনি, যাকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করা হয়। সোশ্যাল মিডিয়ার অসুস্থ ক্রেইজের সাথে জড়িত এই গেমটির উদ্ভাবক তিনি। রাশিয়ান এই গেম ডেভেলপার তার ভিক্টিমদের ‘বায়োলজিক্যাল ওয়েস্ট’ বলে দাবি করেন এবং তিনি সমাজকে আবর্জনামুক্ত করছেন বলে জানান। রাশিয়ার তরুণীদের তিনি নিজের প্রেমের জালে এমনভাবে ফাঁসিয়েছেন যে, আত্মহত্যার পূর্বে তরুণীরা বুদেকিনের ঠিকানায় পাঠানো সুইসাইড লেটারে লিখে যায় ‘Happy to die’।
 
এই সেই ফিলিপ বুদেকিন, ytimg.com
ফিলিপ বুদেকিনের মতে তার ভিক্টিমরা পরবর্তীতে সমাজের ক্ষতি করবে এটি তিনি আগেই বুঝতে পেরেছেন, তাই ২০১৩ সাল থেকেই চলছে তার এই পরিষ্কারকরণ কর্মসূচি। গত জুন মাসে মস্কো থেকে ফিলিপকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। সাইক্রিয়াটিস্টরা তাকে বিকৃত মস্তিষ্কের অধিকারী হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন। ফিলিপের গ্রেপ্তারে আশ্বস্ত হন অনেক অভিভাবক। তবে একটি পেজের একজন অ্যাডমিনকে গ্রেপ্তার করে সমস্যার সমাধান করা আদৌ সম্ভব নয়। খুব দ্রুত রাশিয়ার সীমানা পার করে ইউরোপের অন্যান্য দেশ, এমনকি এশিয়াতেও ছড়িয়ে পড়ছে গেমটির প্রভাব। এখনই যদি সোশ্যাল মিডিয়ায় এ ব্যাপারে যথাযথ সতর্কতা জারি করা না হয়, তবে আমরাও হয়তো সম্মুখীন হবো এমনই কোনো বিকৃত মস্তিষ্কের মাস্টারমাইন্ডের ভয়ংকর কোনো ‘ক্লিনজিং’ কর্মসূচীর। কাজেই ব্যাপারটিকে গুরুত্ব সহকারে নেয়ার এখনই সঠিক সময়। এই কাজে এগিয়ে আসতে হবে আমাদের সবাইকে।
ফিচার ইমেজঃ ytimg.com
 
                                    
															 
															 
															 
															 
															 
															 
															 
															 
                       
                       
                      