বহু বছর ধরেই চীনের লক্ষ্য দ্রুত গতির রেল শিল্প তৈরি করা। এখন তারা পুরো দেশ জুড়েই দ্রুত গতির ট্রেন চলাচলের ব্যবস্থা করছে। গত দশকে রেলখাতে তারা প্রায় ২.৪ ট্রিলিয়ন ইউয়ান অর্থাৎ প্রায় ৩৬০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার খরচ করেছে। তৈরি করেছে ২২,০০০ কিলোমিটার রেললাইন। পুরো পৃথিবীতে যত কিলোমিটার রেললাইন আছে তাদের সম্মিলিত যোগফল চীনে অবস্থিত রেললাইন থেকে কম। এই পরিসংখ্যান থেকেই বোঝা যাচ্ছে যে, রেলশিল্পকে উন্নত করতে কী পরিমাণ বিনিয়োগ করছে চীন সরকার। রেলখাতে এই বিনিয়োগের ফলে চীন অর্থনৈতিকভাবে উন্নত হয়েছে। কারণ দ্রুত চলাচলের কারণে চীনের প্রতিটি শহরের মধ্যে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি হয়েছে, যাওয়া-আসার সময় কম লাগছে, দ্রুত মালামাল পরিবহণের সুব্যবস্থা হয়েছে, এমনকি কোনো কোনো ক্ষেত্রে আকাশপথ থেকে রেলপথে যোগাযোগ অর্থনৈতিক দিক দিয়ে লাভবান বলে মনে হচ্ছে।
দ্রুতগতির রেল যোগাযোগ হওয়ার কারণে অর্থনীতিতে চীনের শক্তিশালী হওয়ার কিছু কারণ আছে। যেমন- কয়েক বছর আগে বসবাসের জন্য এবং অফিসের কাজের জন্য উঁচু উঁচু অবকাঠামো শুধু চীনের কয়েকটি বড় শহরে তৈরি হতো। তাই অবকাঠামো নির্মাণ প্রতিষ্ঠানগুলো এসব অঞ্চলের বাইরে গিয়ে বসতবাড়ি তৈরি করতে পারছিল না, কারণ বসবাসের সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা না থাকার কারণে সেসব অঞ্চলে গিয়ে মানুষ থাকতে পছন্দ করবে না। দেখা যাবে তাদের কাজের জায়গা থেকে বসবাসের জায়গা অনেক দূরে হয়ে গিয়েছে। কিন্তু দ্রুতগতির রেললাইন চীনের প্রায় প্রত্যেকটি শহরের ভেতর দিয়ে যাওয়ার কারণে এখন অন্যান্য শহরও আধুনিক হওয়ার সুযোগ পাচ্ছে, সেখানেও বসবাসের জন্য আকাশচুম্বী দালান, কলকারাখানা, বিভিন্ন শিল্প-প্রতিষ্ঠানের শাখা অফিস তৈরি হচ্ছে।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার এখানে লক্ষ্য করলে বোঝা যায় যে, আগে চীনের কয়েকটি অঞ্চলকে কেন্দ্র করে ব্যবসায়িক কাজ হতো, কিন্তু এখন প্রায় সব শহরেই সবধরনের কাজ হচ্ছে এবং অন্যান্য শহরগুলো সর্বক্ষণ কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সাথে দ্রুত যোগাযোগ রক্ষা করতে পারছে। সময়ের অপচয় রোধের পাশাপাশি জায়গার অপচয় কমছে, বেকারত্ব কমছে, কাজের সুযোগ বাড়ছে, চীন অর্থনীতিতে আরও বলবান হয়ে উঠছে।
একটি উদাহরণ দিলে ব্যাপারটি আরও পরিষ্কার হবে। চীনের একটি শহর হচ্ছে লাংফাং। বেইজিং থেকে এই শহরের দূরত্ব ৬০ কিলোমিটার। গত ৭ বছরে এই শহরের জমি থেকে শুরু করে বাসাবাড়ির দাম প্রায় চারগুণ বেড়ে গিয়েছে। কারণ ২০১১ সালে দ্রুতগতির রেল যোগাযোগের ব্যবস্থা শুরু হলে বেইজিং থেকে আগে যেখানে আসতে সময় লাগতো এক ঘণ্টার বেশি, সেখানে এখন সময় লাগে ১৮ মিনিট। যোগাযোগ ব্যবস্থার এমন উন্নতির ফলে বেইজিং এ অবস্থিত কিছু কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন নতুন ক্যাম্পাস লাংফাংয়েও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এর ফলে যেমন বেইজিং এর উপর মানুষের নির্ভরতার চাপ কমেছে, তেমনই অন্যান্য শহরে বসবাসকারী শহরবাসীরা বেইজিং এর মতো সুযোগ সুবিধা পাচ্ছে। নিজ শহরেই সবধরনের সুযোগ-সুবিধা থাকার কারণে নিজেদের আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নতি হচ্ছে।
কিছু কিছু শহর আছে যেখানে সরাসরি দ্রুতগতির রেল চলাচলের ব্যবস্থা নেই, অন্য শহর হয়ে সেখানে যেতে হয়। দ্রুতগতির রেলযোগাযোগের কারণে এরকম শহরগুলোও উপকার পাচ্ছে। যেমন ইয়াংজু নামক ছোট্ট শহর।
সরাসরি রেল যোগাযোগ না থাকলেও বেইজিং থেকে সাংহাইয়ের মধ্যকার দ্রুতগতির রেল যোগাযোগ ব্যবহার করে সেখান থেকে জিংউ এবং নানজিং এর দ্রুত গতির ট্রেন ধরে পর্যটকরা ইয়াংজুর স্লেন্ডার লেক বলে একটি পর্যটনকেন্দ্রে যেতে পারে। এই রেল যোগাযোগ ব্যবস্থা শুরু হওয়ার পর ২০১৪ সালের হিসেব অনুযায়ী এক বছরের মধ্যে ইয়াংজু নামক এই শহরের পর্যটক সংখ্যা প্রায় ত্রিশ শতাংশ এবং পর্যটন শিল্পের আয় ১৮ শতাংশ বেড়ে গিয়েছে।
চীনের দ্রুত রেল চলাচল ব্যবস্থা বিমান যাত্রাকেও পেছনে ফেলে দিচ্ছে। লক্ষ্য করা যাচ্ছে, চীনের এক প্রদেশ থেকে অন্য প্রদেশে বিমান করে যেতে যে সময় লাগছে, ট্রেনে যাতায়াত করলে ত্রিশ থেকে চল্লিশ মিনিট কম সময় লাগছে। যেমন জিয়ানিং হচ্ছে দুবেই এর একটি ছোট শহর। সেনজেন থেকে এর দূরত্ব ১,২০০ কিলোমিটার এবং ইউহান থেকে ৮০ কিলোমিটার। সেনজেন থেকে জিয়ানিং পর্যন্ত দ্রুত ছুটে চলা ট্রেনে করে গেলে চার থেকে সাড়ে চার ঘণ্টা লাগে। কিন্তু বিমানে করে গেলে পাঁচ ঘণ্টা লেগে যায়। এই জিয়ানিং কিন্তু চীনের মাঝামাঝিতে অবস্থিত। যদি মাঝে অবস্থিত একটি শহর দ্রুত রেলযোগাযোগ থেকে সময়ের হিসেবে এমন উপকার পেতে পারে, তাহলে চীনের চারদিকের দূরবর্তী অন্যান্য শহরগুলো আরও বেশি সুযোগ পাবে ।
ইউরোপের দেশগুলোর মধ্যে যে রেলযোগাযোগ আছে তাদের থেকেও অর্থনৈতিক দিক দিয়ে বেশি লাভবান হচ্ছে চীন। রেলখাতকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে চীন সরকার কাজ করছে। বুলেট ট্রেন নিয়ে জাপান এবং যুক্তরাষ্ট্রের সাথে পাল্লা দিচ্ছে চীন।
রেল যোগাযোগে আধুনিক প্রযুক্তি প্রয়োগ করে যাত্রীদের সর্বোচ্চ সুবিধা এবং ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলোকে দ্রুত পরিবহন ব্যবস্থা দিয়ে চীন এখন এতটাই সফল যে, তারা হংকংয়ের সাথে এরকম দ্রুত গতির রেল যোগাযোগ করার কার্যক্রম শুরু করেছে। এই যোগাযোগ ব্যবস্থা দিয়ে তারা দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্যিক সম্পর্ক আরও দৃঢ় হবে। এর ফলে এই দুই দেশের মধ্যে গুয়াংজু-সেনজেন-হংকং এক্সপ্রেস রেলের মতো আরও কিছু রুট তৈরি করা যাবে।
উপরের আলোচনা থেকে বোঝা যাচ্ছে যে, চীনের মতো এত বড় একটি দেশ রেলখাতে বিনিয়োগ বাড়িয়ে তাদের অর্থনীতিকে চাঙা করে তুলছে। তাদের এই বিনিয়োগ অত্যন্ত সুদূরপ্রসারী এবং দীর্ঘ সময়ের জন্য সাধারণ মানুষের কল্যাণ বয়ে নিয়ে আনবে। সবশেষে এই কয়েকটি শিক্ষা আমরা পেতে পারি। যেমন
– ট্রেনে চলাচল করলে অনেক মানুষ একসাথে যাতায়াত করে বলে সেখানে খরচ, বাস এবং বিমান থেকে তুলনামূলক কম। তাই সঠিক সিদ্ধান্তের মাধ্যমে যদি যেকোনো দেশ তাদের রেল যোগাযোগ উন্নত এবং দ্রুত করতে পারে, তাহলে সাধারণ মানুষের যাতায়াত সুযোগ সুবিধা বহুলাংশে বৃদ্ধি পাবে।
– দ্রুত রেল যোগাযোগের মাধ্যমে একটি শহরের সাথে আরেকটি শহরের সংযোগ দ্রুত হয়। ফলে ব্যবসা, যাতায়াত, ই-কমার্স, হাউজিং সকল দিক দিয়ে উন্নতি হয়। একটি দেশের প্রত্যেকটি অঞ্চল মৌলিক অধিকারের দিক থেকে স্বাবলম্বী হতে পারে। সরকারি যেকোনো কাজ দ্রুত হয়।
– সবশেষে পড়াশোনা এবং চাকরির দিক দিয়েও প্রত্যেকটি অঞ্চল এগিয়ে আসতে পারে। যেমন- আমাদের দেশে সাধারণ মানুষের ইচ্ছা ঢাকা কেন্দ্রিক হওয়া। কারণ ঢাকায় যে সুযোগ সুবিধা পাওয়া যায় সেটা অন্যান্য অঞ্চলে পাওয়া যায় না। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করার জন্য পরিবার ছেড়ে সবাই ঢাকাতে আসতে চায়, চাকরির সন্ধানে সবাই ঢাকায় আসতে চায়। যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো হলে দেশের প্রতিটি অঞ্চলেই চাকরির সুযোগ বৃদ্ধি পাবে, ভালো ভালো বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে উঠবে এবং দেশের কেন্দ্রীয় অঞ্চলের সাথে খুব সহজেই সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রক্ষা করতে পারবে।
একটি দেশের উন্নতির একটি বিশাল অংশ দ্রুত এবং নির্ভরযোগ্য যোগাযোগ ব্যবস্থার উপর নির্ভর করে। চীন এই ব্যাপারটি বুঝতে পেরেছে এবং সেভাবেই এগিয়ে যাচ্ছে। তাই হাতেনাতে ফল পাচ্ছে। আমাদের দেশেও ব্যাপারটা এমন হলে কেমন হতো?
ফিচার ইমেজ – procoletive.com.br