কয়েদীর অভাবে জেলখানাগুলো বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, বোঝার মতো করে বয়ে বেড়ানো জেলখানাগুলো বন্ধ করে দিতে হবে। শেষ চেষ্টা হিসেবে প্রতিবেশী দেশগুলোকে অনুরোধ করে যদি কয়েদি পাওয়া যায়। না তাও পাওয়া যাচ্ছে না। কী আর করা! বন্দিদের জন্যে সকল ধরনের সুযোগ সুবিধা সম্বলিত জেলখানাগুলো এবার বন্ধ করে দিতেই হবে। রূপকথা নয়, ইউরোপের বুকে দাঁড়িয়ে থাকা দেশ নেদারল্যান্ডেই ঘটছে এমন ঘটনা।
নেদারল্যান্ডের আইনশৃংখলা পরিস্থিতির সুনাম আছে দুনিয়াজুড়ে। প্রতিটি শিশু বাধ্যতামূলকভাবে স্কুলে যায়, পড়াশোনা করে, শিল্পোন্নত দেশটিতে আছে প্রতিটি তরুণের কর্মক্ষেত্রের নিশ্চয়তা। আইন ভঙ্গ করার ঝামেলায় জড়িয়ে জেলে যাওয়ার সময়টা কোথায়? তাই নেদারল্যান্ড নিজেদের কারাগারগুলোকে বেলজিয়াম ও নরওয়ের ব্যবহারের জন্যে অনুরোধ করে আসছে। বেলজিয়াম ও নরওয়ের নিজেদের কারাগারগুলোরও বেশিরভাগই খালি। তাই নেদারল্যান্ড সরকার ২০১৩ সালে তাদের উনিশটি জেলখানা পুরোপুরি বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছে। যার ফলে জেলখানা রক্ষণাবেক্ষণ সংক্রান্ত কাজের সাথে জড়িত প্রায় ২,০০০ কর্মী বেকার হয়ে গিয়েছিলেন।
জেলখানাগুলোর সাথে শরণার্থীদের যোগাযোগ কোথায়?
পুরো ইউরোপজুড়েই বাড়ছে অশান্ত মধ্যপ্রাচ্য থেকে আসা আশ্রয়প্রার্থী শরণার্থীদের সংখ্যা। এই শরণার্থীদের সিংহভাগ আসছেন সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ কবলিত অঞ্চলসমূহ থেকে। সমুদ্রপথে বিপদসঙ্কুল পথ পাড়ি দিয়ে ইউরোপে এসেও তাদের শান্তি নেই। তাদের জায়গা করে দিতে ইউরোপের বেশিরভাগ দেশকেই হিমশিম খেতে হচ্ছে। কিন্তু জেলখানার সাথে শরণার্থীদের যোগাযোগ কোথায়?
ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের হিসেব অনুসারে সাগর পাড়ি দিয়ে বৈধ কিংবা অবৈধ উপায়ে ২০১৫ সাল নাগাদ প্রায় ১৩,২১,৫৬০ জন আশ্রয়প্রার্থী ইউরোপের বিভিন্ন দেশে পাড়ি জমিয়েছে। যাদের বেশিরভাগই জানেন না সেখানের নিয়ম-কানুন, আছে ভাষাগত সমস্যাও। উষ্ণ মরুপ্রান্তর থেকে জীবনের ভয়ে পালিয়ে এসে ইউরোপের তীব্র শীতের কবলে পড়েছেন এই শরণার্থীরা।
জেলখানাগুলোই হবে শরণার্থী শিবির
২০১৫ সাল নাগাদ শুধু নেদারল্যান্ডেই আশ্রয়ের আশায় পাড়ি জমিয়েছেন প্রায় ৬০ হাজার আশ্রয়প্রার্থী। মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে আসা এই আশ্রয়প্রার্থীর ঢল সামলে নিতে শুরুতে নেদারল্যান্ডকেও বেগ পেতে হয়েছে। বিপুল পরিমাণ এই আশ্রয়প্রার্থীকে মাথা গোঁজার ঠাঁই করে দিতে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের বাকি দেশগুলোর মতো নেদারল্যান্ড সরকারের কপালেও পড়েছিলো চিন্তার ভাঁজ। কিন্তু তখনই নেদারল্যান্ডের কারা রক্ষণাবেক্ষণ বিভাগ খুঁজে বের করলো এক অদ্ভুত সমাধান। শরণার্থীদের বাসস্থানের চাপ সামলাতে দেশের কারা বিভাগ খুলে দিয়েছে অব্যবহৃত জেলখানাগুলো। দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ সেসব জেলখানাতেই নিরাপদে থাকার সুযোগ পেয়েছেন এই শরণার্থীরা।
সিরিয়ার যুদ্ধবিধ্বস্ত অঞ্চলগুলো থেকে দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে বাবা মায়ের সাথে অনেক শিশু পাড়ি জমিয়েছে নেদারল্যান্ডে। শরণার্থী শিশুদের অনেকেই বেড়ে উঠছে আশ্রয়কেন্দ্রে হিসেবে ব্যবহৃত হওয়া এই জেলখানাগুলোতে। তাই জেলখানাগুলোর বিনোদন ব্যবস্থাকে শিশুবান্ধব করতে কাজ করছে কর্তৃপক্ষ। সব বয়সী শিশুদের বিনোদনের জন্য কিছু না কিছু ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে।
আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হওয়া এই জেলখানাগুলোতে শিশু আর তরুণদের সংখ্যা তুলনামুলক বেশি। আর তাই আশ্রয়কেন্দ্রগুলোর বদ্ধ পরিবেশ যাতে শিশুদের মানসিক বিকাশকে বাধাগ্রস্ত না করে, তাই সেগুলোকে আরো বেশি শিশুবান্ধব এবং নিরাপদ করতে কারা কর্তৃপক্ষ কাজ করে যাচ্ছে।
সুন্দর, খোলামেলা আর পরিকল্পিতভাবে নির্মিত এই ডাচ জেলখানাগুলো দেখে এই শরণার্থীদের অনেকেই জেলখানা বলে ভাবতেই পারেননি। শরণার্থীদের অনেকেই জানেন যে, তাদের এই বাসস্থান পূর্বে জেলখানা হিসেবে ব্যবহৃত হতো, তবে এই ব্যাপারে তাদের মধ্যে নেই বিন্দুমাত্র কোনো আক্ষেপও। মাথা গোঁজার নিরাপদ আশ্রয় পেয়েই খুশি তারা। পাশাপাশি ডাচ সরকারের কাছে কৃতজ্ঞ এই শরণার্থীরা। আমেরিকান গণমাধ্যম এসোসিয়েটেড প্রেসকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে এমনটাই দাবি করেছেন এখানে বসবাসরত এক সিরিয়ান শরণার্থী।
জেলখানাগুলোতে মানবিক সাহায্যের অংশ হিসেবে নিয়মিত খাদ্য, চিকিৎসাসহ প্রয়োজনীয় সেবাসমূহের বেশিরভাগই দিচ্ছে ডাচ সরকার। তবে ক্রমবর্ধমান শরণার্থীর সংখ্য্যার সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে তাদের চাহিদা। তাদের খাদ্য-বস্ত্রের মতো চাহিদা মেটাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে নেদারল্যান্ড সরকারকে।
এই শরণার্থী শিবিরের জনসংখ্যার একটি বড় অংশ তরুণ জনগোষ্ঠী। তাই তাদেরকে উপযুক্ত শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলতেও জোর দিচ্ছে ডাচ সরকার। নেদারল্যান্ডের আইন অনুযায়ী ১৮ বছরের নিচে সকল শিশুর জন্যে শিক্ষাগ্রহণ বাধ্যতামূলক। আর ইউরোপের বেশিরভাগ দেশের মতো নেদারল্যান্ডসেও প্রাথমিক এবং মাধ্যমিক স্তরে সকল শিশুর শিক্ষার ব্যয়ভার বহন করে রাষ্ট্র। এই শরণার্থী শিশুরাও যাতে এই সুবিধার আওতায় আসতে পারে, তাই ডাচ সরকার পদক্ষেপ নিচ্ছে। মধ্যপ্রাচ্য সহ বিভিন্ন দেশ থেকে আসা আশ্রয়প্রার্থী শরণার্থীরা শিশুরাও এখন এই সুবিধা ভোগ করতে পারবে। আশ্রয়কেন্দ্রে থাকা প্রতিটি শিশুর শিক্ষা নিশ্চিত করতে ডাচ সরকারের নেওয়া অসামান্য এই পদক্ষেপ কুড়িয়েছে বিশ্বব্যাপী প্রশংসা।
পাশাপাশি আশ্রয়কেন্দ্রে থাকা এসব শিশুদের শিক্ষা নিশ্চিত করতে ডাচ সরকার ইউনিসেফকে বরাদ্দ করছে ১৪ মিলিয়ন ইউরো। এই সাহায্যের অর্থ দিয়ে নেদারল্যান্ডের সীমানার বাইরেও বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে থাকা শরণার্থী শিবিরগুলোতে অবস্থানরত সিরিয়ান শিশুদের শিক্ষার সুযোগ নিশ্চিত হবে।
শরণার্থী শিবিরগুলোতে মধ্যবয়স্ক তরুণদের সংখ্যাটাও কম নয়। তাই কর্তৃপক্ষ এই তরুণদের জন্যে ব্যবস্থা করে দিচ্ছে বিশেষায়িত ট্রেনিংয়ের। যেখানে ট্রেনিং নিয়ে কর্মক্ষত্রে প্রবেশ করা সুবিধাজনক হবে। পাশাপাশি এই তরুণ জনগোষ্ঠীর মধ্যে উচ্চ শিক্ষায় আগ্রহীদের সহায়তার জন্যে দেওয়া হচ্ছে শিক্ষাঋণ। শরণার্থী হিসেবে আসা তরুণদেরকে শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে নেদারল্যান্ডের নিয়ম-কানুনও, যাতে আইনভঙ্গ করে সত্যিকারের জেলে তাদের যেতে না হয়।
শরণার্থী হিসেবে নেদারল্যান্ডে আসার আগে যে ব্যক্তি যে কাজে নিয়োজিত ছিলেন, এখানেও অনেকটা সে কাজেই ফিরে যাবার তাগিদ দিয়েছে কারা কর্তৃপক্ষ। ফলে নিজেদের চাহিদা মেটাবার পাশাপাশি নিজের দক্ষতা দিয়ে অন্যকে সেবা দেওয়াটা সহজ হয়ে উঠেছে। যেমন- শরণার্থী হিসেবে নেদারল্যান্ডে আসার আগে যারা সেলুন চালাতেন, আশ্রয়কেন্দ্রেও তারা একই কাজ করছেন।
কারাগারের ভেতরে নির্মিত এই আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে ধীরে ধীরে অভ্যস্ত হয়ে উঠছেন শরণার্থীরা। জীবনের মৌলিক চাহিদাগুলোর সাথে পাচ্ছেন বাড়তি নিরাপত্তাও।
তাদেরকে বন্দী করে রাখা হয়েছে কি?
এই শরণার্থীদের কিন্তু জেলখানায় বন্দী করে রাখা হয়নি। তারা কর্তৃপক্ষের অনুমতি সাপেক্ষে বাইরে যেতে পারেন। কেউ যদি এই আশ্রয়কেন্দ্র ছেড়ে যেতে চান সেই স্বাধীনতাও তাদের আছে।
মধ্যপ্রাচ্য থেকে পাড়ি জমানো এই শরণার্থীদের একটা বড় অংশই ইউরোপের চরম ঠান্ডা আবহাওয়ার সাথে মোটেই পরিচিত নন। তাই মধ্যপ্রাচ্যের কঠিন উষ্ণ আবহাওয়া পেছনে ফেলে ইউরোপের তীব্র শীতের সাথে যুদ্ধ করার জন্যে যে আশ্রয়টুকু তাদের দরকার ছিলো সেটুকু তাদের ভালোভাবেই দিতে পেরেছে জেলখানার ছোট এই কামরাগুলো।