ফুল নিঃসন্দেহে প্রকৃতির সবচেয়ে সুন্দর সৃষ্টিগুলোর একটি। ফুল না থাকলে কি প্রকৃতি এত রঙিন হতো? এত সুন্দর, এত মোহনীয় হতো? নিসর্গের সবুজ শ্যামলিমা মনে হয়তো প্রশান্তি এনে দিতে পারে, কিন্তু ফুল মনকে অদ্ভুত রঙের বর্ণচ্ছটায় রাঙিয়ে দেয়। প্রশান্তির আবেশের উপরে নিবিড় সুখানুভূতির পরশ বুলিয়ে দেয়। তাই তো আমরা ফুল ভালোবাসি। বাহারি রঙ, মনমাতানো সৌরভ বা রকমারি আকৃতি- ফুলের অনন্য সৌন্দর্যের পেছনে ভূমিকা রয়েছে প্রতিটি উপাদানেরই ৷ তবে ফুলের সৌন্দর্য নির্ধারণে রঙকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ বললে কি বেশি বলা হবে? তা যা-ই হোক না কেন, ফুলের রাজ্যে রঙের গুরুত্ব নিয়ে বিতর্কের অবকাশ নেই। লাল-নীল, গোলাপি-হলুদ, সাদা-বেগুনি প্রভৃতি বিচিত্র রঙের ফুলে শোভিত বাগানে হাঁটতে কার না ভালো লাগে। ধরা যাক, এখনই আপনি একটা বাগানের মালিক হয়ে গেলেন। কোন রঙের ফুলকে প্রাধান্য দেবেন? আপনার প্রিয় রঙের?
আচ্ছা, আপনার প্রিয় রঙ কি বেগুনি? বেগুনি আপনার প্রিয় রঙ হোক বা না হোক, প্রকৃতিতে যে রঙের ফুল সবচেয়ে বেশি পাওয়া যায় তার মধ্যে বেগুনি অন্যতম। এন্থোসায়ানিন নামের একধরনের পিগমেন্টের উপস্থিতির কারণে ফুল বেগুনি-রঙা হয়। অনেক রকম শেডের কারণে আপনার বাগানকে রাঙাতে বেগুনি একাই যথেষ্ট। চলুন এবারে পরিচিত হই একঝাঁক বেগুনি সুন্দরীর সাথে।
লাইলাক (Syringa vulgaris)
প্রকৃতিতে লাইলাক ফোটে বসন্তের আগমনী বার্তা জানিয়ে। বসন্তে বিপুল প্রাচুর্য আর ঐশ্বর্য নিয়ে লাইলাক গাছ ছেয়ে যায় হালকা বেগুনি রঙের ফুলে। চার পাপড়ির অনবদ্য আকৃতির লাইলাকের অবারিত সৌন্দর্য আপনাকে মুগ্ধ করবেই। আপনি যখন লাইলাকগুচ্ছের কাছাকাছি যাবেন, তীব্র সুগন্ধে মোহমুগ্ধ হবেন আপনি।
লাইলাক ভালোবাসার প্রতীক। যুক্তরাষ্ট্রের নিউ হ্যাম্পশায়ার অঙ্গরাজ্যের “স্টেট ফ্লাওয়ার” এই ফুলটি। আমেরিকার নানা জায়গায় বার্ষিক লাইলাক উৎসব পালিত হয়। যেমন- প্রতি বছর মে মাসে পালন করা হয় ” লাইলাক সানডে”।
গ্রিস, সাইপ্রাস, লেবাননে ইস্টারের সময়ে লাইলাকের ব্যাপক ব্যবহার লক্ষণীয়। লাইলাকের আদি-নিবাস দক্ষিণ-পূর্ব ইউরোপ এবং পূর্ব এশিয়া। তবে যেকোনো উষ্ণ এলাকায় এটি চাষযোগ্য। হিউমাসে পরিপূর্ণ উর্বর মাটি যেখানে সূর্যালোকের আনাগোনা বেশি- এমন জায়গায় লাইলাক ভালো জন্মে।
এনিমোন ( Anemone blanda)
গ্রিক দেবী আফ্রোদিতি তার প্রেমিক অ্যাডোনিসের মৃত্যুতে কাঁদলে, তার কান্না আর অ্যাডোনিসের রক্ত থেকে নাকি তৈরি হয়েছে এনিমোন ফুল। ভিক্টোরিয়ান সংস্কৃতিতে এনিমোন ফেলে আসা ভালোবাসার প্রতিনিধিত্ব করে। মিশরীয় ও চীনা সংস্কৃতিতে এনিমোন এ পাংশু রঙের কারণে ভঙ্গুরতা ও অসুস্থতার প্রতীক। চার থেকে ২৭টি পাপড়ি সম্বলিত এনিমোনের প্রস্ফুটন কাল শরৎ এবং বসন্ত।
শক্ত শাখার আগায় ঝুলে থাকা বেগুনি এনিমোনের দল খুবই দৃষ্টিনন্দন। ১২০ প্রজাতির এনিমোন আছে পৃথিবীতে। বহুবর্ষজীবী এই উদ্ভিদ যেকোনো উষ্ণ এলাকায় চাষযোগ্য৷ এনিমোনকে “উইন্ড ফ্লাওয়ার” বলা হয়। নতুন পাপড়িগুলোকে প্রস্ফুটিত হওয়ার সুযোগ দিয়ে দমকা বাতাসে ঝরে যায় এর মরে যাওয়া পাপড়িগুলো।
আইরিশ
আইরিশ জ্ঞান আর সাহসের প্রতীক। বেগুনি আইরিশ জ্ঞানের প্রতিনিধিত্ব করে। বসন্ত বা গ্রীষ্মের শুরুতে রাজকীয় সৌন্দর্য নিয়ে প্রকৃতিকে রাঙাতে আসে আইরিশ। গ্রিকদের রংধনুর দেবী আইরিশের নামে নামকরণ করা হয়েছে ফুলটির। গ্রীষ্মে আপনার বাগানকে সত্যিই রামধনু রঙে রাঙিয়ে দেবে আইরিশ। সবচেয়ে পরিচিত আইরিশ হচ্ছে বিয়ার্ডেড আইরিশ। সাইবেরিয়ান ও জাপানিজ আইরিশও বেশ বিখ্যাত।
আইরিশ গাছ ৬ ইঞ্চি থেকে ৪ ফুট লম্বা হয়। আইরিশ ফুল দেখতে সুন্দর হলেও বিষাক্ত। বসন্তের শুরুতে শুষ্ক পাইনবনের কিনারে আইরিশ ফুটতে দেখা যায়। পুকুর বা যেকোনো জলাশয়ের পাড়ে লাগানো বেগুনি আইরিশ আপনার চোখ জুড়াবে।
ভার্বিনা (Verbena borariensis)
গ্রীষ্মের কড়া রোদ্দুরে বাগানকে ফুলে ফুলে সুশোভিত দেখতে চাইলে আপনাকে অবশ্যই ভার্বিনা লাগাতে হবে। ভার্বিনা পাঁচ পাপড়ির নজরকাড়া ছোট ছোট ফুল। ২৫০ প্রজাতির বৈচিত্র্য নিয়ে বেঁচে থাকা ভার্বিনার আদিনিবাস দক্ষিণ আমেরিকা। ভার্বিনা একবর্ষজীবী বা বহুবর্ষজীবী উদ্ভিদ। তবে একবর্ষজীবী ভার্বিনা লাগানোই ভালো। কারণ গ্রীষ্মে ফুল ফোটার পর, অন্য ঋতুতে গাছের অবস্থা বেহাল হয়ে যায়। বাগানের সবচেয়ে শুষ্ক আর রৌদ্রজ্জ্বল জায়গায় লাগাতে হবে ভার্বিনা গাছ।
ফুল নানা রঙের হয়। এর মধ্যে আছে হালকা থেকে গাঢ় বেগুনি। বাতাসের দোলায় দুলতে থাকা একগুচ্ছ বেগুনি ভার্বিনা আপনার মন ভালো করে দেবেই।
ল্যাভেন্ডার (Lavandala augustifolia)
লম্বা শাখায় চক্রাকারে ফুটে থাকা ল্যাভেন্ডার ফুলের রাজ্যে অনন্য নাম। বাগান বা ফুলদানির সৌন্দর্যবর্ধনে ল্যাভেন্ডারের তুলনা নেই। গ্রীষ্মে ঘন সবুজ পাতার আড়াল থেকে কাণ্ডের আগায় চেপে বের হয়ে আসে অজস্র ল্যাভেন্ডার।
অনেকদিন ধরে ফুটে থাকে, সহজে ঝরে না। ল্যাভেন্ডার বহুবর্ষজীবী গুল্ম জাতীয় উদ্ভিদ। ৪৭টি প্রজাতি আছে। এরমধ্যে Lavandala augustifolia প্রজাতির বিশেষ বেগুনি রঙ থেকে নামকরণ করা হয়েছে ল্যাভেন্ডার রঙের। আদিনিবাস ইউরোপ, পূর্ব এশিয়া। ভূমধ্যসাগরীয় এলাকায় উৎপত্তি বলে কাঠ ফাটানো রোদ আর শুষ্ক মাটিতে টিকে থাকতে পারে।
ল্যাভেন্ডার শোভিত বাগানে হাঁটার সময় এর তীব্র সৌরভ টের পাবেন। ল্যাভেন্ডার শুধু সৌন্দর্যেই অপূর্ব নয়, ঔষধি গুনেও অনন্য। ল্যাভেন্ডারের নির্যাস থেকে হার্বাল চা ও এসেনশিয়াল অয়েল তৈরি হয়।
ডেলফিনিয়াম (Delphinium sp.)
উত্তর গোলার্ধ ও আফ্রিকার পাহাড়ি অঞ্চলে ফুটতে দেখা যায় ডেলফিনিয়াম। এটি ৩০০ প্রজাতির হত, এর সকল প্রজাতি বিষাক্ত। বহুবর্ষজীবী এই উদ্ভিদের পাতাগুলো সূচালো, কয়েক খণ্ডে বিভক্ত। সাধারণত পাঁচটা পাপড়ি একসাথে একটা খালি পকেটের মতো তৈরি করে।
বসন্তের শেষ থেকে গ্রীষ্মে ডেলফিনিয়ামের পত্র-পল্লবী প্লাবিত হয় ফুলে ফুলে। আর্দ্র ও ঠাণ্ডা মাটিতে ভালো জন্মে। আকর্ষণীয় কোনো ফুলের তোড়া তৈরিতে বা যেকোনো ধরনের শোভাবর্ধনে ডেলফিনিয়াম ব্যবহারের ঐতিহ্য বহুদিনের।
এস্টার
একদা বিস্তৃত প্রজাতির এই উদ্ভিদ এখন এসে ঠেকেছে ১৮০ টিতে। সবগুলোই শুধু ইউরেশিয়া অঞ্চলে জন্মে। এস্টার শরতের প্রকৃতিতে রঙের ছোঁয়া নিয়ে আসে।
গ্রীষ্ম থেকে শরত পর্যন্ত অঢেল পুষ্প বিতরণ করে এস্টার গাছ। সূর্যালোক পড়ে, সেচব্যবস্থা ভালো – এমন মাটিতে এস্টার ভালো জন্মে। ১৯১৮ সালে হাঙ্গেরিতে সংঘটিত “এস্টার বিপ্লব” এর কল্যাণে ইতিহাসে ঠাঁই পেয়েছে এস্টার।
বার্জিনিয়া
বার্জিনিয়া শক্তপোক্ত, প্রায় চিরহরিৎ উদ্ভিদ। এশিয়াতে আদিনিবাস হলেও বর্তমানে সারাবিশ্বের বাগান প্রেমীদের হৃদয়ে জায়গা করে নিয়েছে এর বৈচিত্র্যের কারণে। হৃদপিন্ডাকৃতির সবুজ পাতার পটভূমিতে উঁকি দেয় রঙিন ফুল।
সহজেই বাগানে জন্মানো যায়। এরা সাধারণত ১২ থেকে ২৪ ইঞ্চি দীর্ঘ হয় যা পাথুরে বাগানের জন্য আদর্শ। ফুল সুন্দর হলে কী হবে, বেশিদিন থাকে না। বার্জিনিয়ার উজ্জ্বল বেগুনি রঙের উচ্ছলতা ও প্রাচুর্যে আপনি মুগ্ধ হবেনই।
ক্যান্ডিটাফট
অপূর্ব নান্দনিকতায় শোভিত ফুলেল বৃক্ষ যদি স্বল্প খরচে পেতে চান, তবে ক্যান্ডিটাফট আপনার জন্য। অনায়াসে আপনার গ্রীষ্মকালীন বাগানের মধ্যমণি হতে পারে এই ফুলটি। বর্ণিল রঙে রাঙা ক্যান্ডিট্রাফটের পাপড়ির সজ্জা দারুণ চমকপ্রদ।
বাগানের বেডে শুয়ে থাকা বা ঝুড়ি থেকে আলতোভাবে ঝুলতে থাকা হালকা বেগুনি ক্যান্ডিটাফটের স্নিগ্ধতা আপনার মন ছুঁয়ে যাবে। তবে গন্ধটা নাকে লাগলে নিশ্চিতভাবেই মুগ্ধতার ঘোর কেটে যাবে। কারণ এই ফুলের গন্ধ প্রচণ্ড উৎকট।
আফ্রিকান লিলি
লিলি অব দ্য নীল অথবা আফ্রিকান লিলি অথবা অ্যাগাপান্থাস। এই সুন্দর ফুলটিকে একনজর দেখলে ভালো না বেসে পারা যায় না। গোলাকার পুষ্পমঞ্জরিতে ২০ থেকে ১০০টি নলাকার ফুল সজ্জিত থাকে। প্রকৃতিতে ঐশ্বর্যমণ্ডিত এই ফুলের আবির্ভাব ঘটে গ্রীষ্মের শুরুতে বা শরতে।
ফুলদানি বা বাগানে নান্দনিকতা আনয়নের পাশাপাশি তোড়াকে অপূর্ব মাধুর্যে রাঙিয়ে তোলে ফুলটি। গরম আবহাওয়ায়, উর্বর জমিতে এই ফুল ভালো জন্মে। লবণাক্ততা সহ্য করতে পারে বলে উপকূলীয় এলাকায় লাগানোর জন্য এই ফুল বেছে নেয়া যায়।
এছাড়া আমাদের অতি পরিচিত সালভিয়া, কসমস, ডালিয়া থেকে শুরু করে হাইড্রেঞ্জা, ব্যাপ্টিসিয়া, জেরানিয়াম, ক্যান্টমিন্ট, ভেরোনিকাসহ অসংখ্য চোখ ধাঁধানো বেগুনি ফুল রয়েছে প্রকৃতিতে যাদের শৈল্পিক উচ্ছলতায় মুগ্ধ না হয়ে পারা যায় না। তো আপনার বাগানের জন্য কোন ফুলগুলো বেছে নিলেন সেটা আমাদের জানাতে ভুলবেন না!
প্রিয় পাঠক, রোর বাংলার ‘বিশ্ব’ বিভাগে এখন থেকে লিখতে পারবেন আপনিও। সমৃদ্ধ করে তুলতে পারবেন রোর বাংলাকে আপনার সৃজনশীল ও বুদ্ধিদীপ্ত লেখনীর মাধ্যমে। আমাদের সাথে লিখতে চাইলে আপনার পূর্বে অপ্রকাশিত লেখাটি সাবমিট করুন এই লিঙ্কে: roar.media/contribute/