Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে নির্বিচারে হত্যা এবং সংঘর্ষ

পৃথিবী সৃষ্টির পর থেকে ভূমি বা মাটি গড়ে উঠেছে প্রাকৃতিকভাবে, তৈরি হয়েছে প্রকৃতি। প্রাকৃতিক নিয়মে এ প্রকৃতি নানান স্থানে নানানভাবে গড়ে উঠেছে। এজন্য কোথাও হয়েছে উচু টিলা, আবার কোথাও বয়ে চলেছে নদীর স্রোতধারা। বিশ্বপ্রকৃতি জানে না কোনো ভূখণ্ড, চেনে না কোনো জাতি। প্রকৃতি নিজের উপর নিজস্ব অধ্যাদেশ জারি করে বেড়ে উঠেছে আপন গৌরবে, ছড়িয়েছে তার সৌন্দর্য। তবে মানুষ বেশিদিন এই গৌরব স্থায়ী হতে দেয়নি। পৃথিবীর মানচিত্রকে করেছে রক্তাক্ত প্রান্তর, কেটে করেছে ছিন্ন-ভিন্ন। আর এই ছিন্ন-ভিন্নতাকে বাস্তবে রুপদান করেছে সীমান্ত। যুগে যুগে মানুষ কাঁটাতার দিয়ে নিজেদের বিভক্ত করেছে এবং চেষ্টা করেছে একে অন্যের ওপর কর্তৃত্ব স্থাপনের। প্রভাব বিস্তারের এ খেলায় উভয় পক্ষ নির্বিচারে হত্যা করেছে নিরীহ মানুষ।

ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত

ভৌগোলিকভাবে বাংলাদেশের প্রায় সমস্ত সীমানা জুড়ে রয়েছে ভারতের সীমানা। প্রায় ৪০৯৬ কি.মি. দীর্ঘ এই আন্তর্জাতিক সীমান্ত প্রহরায় নিয়োজিত আছে বাংলাদেশের বিজিবি (বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ) এবং ভারতের বিএসএফ (বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্স)-এর সদস্যরা। অবৈধ অভিবাসন, চোরাচালান, পাচার, সরকারবিরোধী গোষ্ঠীর অনুপ্রবেশ বন্ধে কাজ করে যাচ্ছে এই দুই সীমান্ত রক্ষী বাহিনী। মূলত এদের কাজ দেশের অভ্যন্তরে শান্তি রক্ষার্থে সীমান্ত পাহারা নিশ্চিত করা।

সীমান্ত পাহারায় ভারতের সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর সদস্যরা; ছবিসূত্রঃ গেটি ইমেজ

বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত একে অন্যের সাথে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িত। এমন অনেক বাড়িঘর আছে যে বাড়িতে একটি ঘর হয়ত বাংলাদেশের, অন্যটা পড়েছে ভারতে। আবার রান্নাঘরটা পড়েছে বাংলাদেশে আর টয়লেটটা পড়েছে ভারতে। অনেকের ক্ষেতখামার একেবারে ভারতের সীমান্ত ঘেঁষে গড়ে উঠেছে। এসব স্থানে বসবাসরত অনেকের আত্মীয়-স্বজন দুই দেশের মধ্যেই ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসবাস করছেন। এমন অবস্থায় বাংলাদেশ থেকে সাময়িক সময়ের জন্য ভারত গমন বেশ সাধারণ একটি ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এবং এদের সকলেই অনিচ্ছাকৃতভাবে ভারতে প্রবেশ করছে, যাদের বলা হয় ‘ইন-এডভার্টেন ক্রসিং’

ইন-এডভার্টেন ক্রসিংকারীদের মধ্যে অধিকাংশই থাকে অতীব সাধারণ জনগণ যারা কখনোই কোনো ধরনের আগ্নেয়াস্ত্র বহন করে না। এ ব্যাপারে বিজিবি মহাপরিচালক বলেন, “তারা (বিজিবি-বিএসএফ) এসব সাধারণ অবৈধ অভিবাসীদের পুলিশের কাছে স্থানান্তর না করে সামান্য লিখিত এজহার নিয়ে ছাড়পত্র দিয়ে দেয় যাতে পরবর্তীতে আর এ কাজ না করে। আর চোরা চালানের সময় কেউ ধরা পড়লে তাকে পুলিশের কাছে প্রেরণ করা হয়।

তবে বিজিবি মহাপরিচালকের বক্তব্য কতটুকু বাস্তবিক তা ব্যাপক আকারে প্রশ্নবিদ্ধ। ব্রিটিশ প্রভাবশালী পত্রিকা দ্য গার্ডিয়ানের তথ্যানুসারে, একবিংশ শতাব্দীর প্রথম এক দশকেই ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে প্রায় ১০০০ বাংলাদেশিকে নির্বিচারে হত্যা করেছে বিএসএফ, যাদের মধ্যে অধিকাংশই ছিল সাধারণ নিরস্ত্র এবং স্থানীয় গ্রামের বাসিন্দা। এ সকল হত্যাকাণ্ডের জন্য কাউকেই অভিযুক্ত করা হয়নি।

বিএসএফের নির্যাতনের শিকার এক বাংলাদেশি; ছবিঃ ঢাকা ট্রিবিউন

এসব ক্ষেত্রে বিএসএফের দাবি তারা আত্মরক্ষার্থে গুলি চালিয়েছে। তবে সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায় বিএসএফের দাবি স্রেফ হাস্যকর। কেননা এসব নিরস্ত্র সাধারণ মানুষ কখনোই বিএসএফের ওপর হামলা চালায়নি। উপরন্তু অনেকেই প্রাণ বাঁচানোর জন্য পালানোর চেষ্টা করেছে। অনেক সময় তারা বিএসএফের অবৈধ আগ্রাসনের হাত থেকে বাঁচার জন্য ইট, পাথর, বড়জোর চাকু ছুড়ে মেরেছে। তবে তা কোনোভাবে জীবননাশক হিসেবে স্বীকৃতিযোগ্য নয়।

এছাড়া ভারতের ফৌজদারি কার্যবিধির ৪৬ ধারা অনুযায়ী, মৃত্যুদণ্ড কিংবা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড প্রাপ্ত কিংবা পাবার উপযোগী কোনো অপরাধী ব্যতীত গ্রেফতার এড়ানোর চেষ্টাকারী কারো ওপর মৃত্যুদণ্ড ঘটানোর মতো কোনো ধরনের ক্ষমতা প্রয়োগ করা যাবে না। এক্ষেত্রে বিএসএফ ভারতের ফৌজদারি কার্জবিধিকে প্রতিনিয়ত বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে যাচ্ছে। এর পাশাপাশি ভারতীয় সংবিধানের ২১ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, যেকোনো প্রকার অমানবিক এবং মানহানিকর আচরণ থেকে প্রত্যেক ব্যক্তিকে সুরক্ষা দেবার কথা উল্লেখ রয়েছে। এমনকি ভারতীয় দণ্ডবিধি অনুযায়ী জখম সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ।

তবে বিএসএফের কর্মকাণ্ডে এসব আইন কানুনের কোনো প্রকার প্রয়োগেরই দেখা মেলে না। বরঞ্চ তার উল্টোটাই ঘটতে দেখা যায় সর্বদা। শুধুমাত্র ভুলক্রমে জিরো পয়েন্টের কাছাকাছি চলে যাবার কারণে বহু বাংলাদেশি নাগরিককে মারধরের ঘটনা ঘটছে অহরহ। এমনকি রাতের বেলা অন্ধকারে মাছ ধরতে গিয়ে ভুলক্রমে ভারতীয় সীমান্তের কাছাকাছি চলে যাওয়ায় অনেককেই ধরে নিয়ে গিয়ে বেধড়ক মারধোর করা হয়। পত্রিকার পাতা খুললে এমন অসংখ্য সংবাদের দেখা মিলে প্রায়শ।

রাতের আঁধারে টহলরত বিএসএফ সদস্য; ছবিসূত্রঃ হিউম্যান রাইটস

বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত নিরীহ বাঙালিদের জন্য এক মৃত্যুপুরী হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। অনেক বিএসএফ অফিসার প্রকাশ্যে এসব স্বীকার করেও পার পেয়ে যাচ্ছেন। যেখানে পাক-ভারত সীমান্তে একটি হত্যা হলেও তা প্রায় প্রতিটি পত্রিকার শিরোনামে রুপ নেয়, সেখানে বাংলাদেশের সীমান্তে হত্যা নিতান্তই সাধারণ ঘটনা হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে এবং বরাবরই উপেক্ষিত হয়ে আসছে। সীমান্তে নিয়ন্ত্রণ এবং শান্তি বজায় রাখার নামে সীমান্তবর্তী এসব সাধারণ মানুষের ওপর গরু পাচারকারী এবং চোরাচালানের অভিযোগ এনে প্রতিনিয়ত নির্বিচারে এদেরকে হত্যা করে যাচ্ছে বিএসএফ। মাঝে মাঝে দু’একটি অপরাধের বিরুদ্ধে মামলা করা হলেও বিএসএফের আদালতে বিচারের নামে প্রহসন করা হয়। অপরাধী অনেক সময় নির্দোষ, আবার অনেক সময় খুবই স্বল্প সময়ের সাজা পেয়েই ছাড়া পেয়ে যায় এবং পুনরায় ভঙ্গ করতে থাকে ভারতীয় সংবিধান।

চাঞ্চল্যকর ফেলানি হত্যাকাণ্ড

বাংলাদেশের সীমান্তে বিএসএফের নৃশংস অত্যাচারের কসাইবৎ উদাহরণ হচ্ছে ফেলানি হত্যাকাণ্ড। ২০১১ সালের ৭ই জানুয়ারি কাঁটাতারের বেড়া পাড় হবার সময় ফেলানী খাতুনকে লক্ষ্য করে গুলে ছোড়ে বিএসএফ সদস্য অমিয় ঘোষ। এতে করে গুলিবিদ্ধ হয়ে মৃত্যুবরণ করে ফেলানী। তার বাবার দাবি, হত্যাকরার পর প্রায় ৫ ঘণ্টা ফেলানিকে ঝুলিয়ে রাখা হয় কাঁটাতারের বেড়ায়। অর্থাৎ নির্বিচারে হত্যা করার পর তাকে কাঁটাতারে ঝুলিয়ে বিএসএফের চরম পৈচাশিকতা প্রকাশ পায়।

হত্যা করার পর কাঁটাতারে ঝুলিয়ে সর্বোচ্চ অমানবিকতা প্রকাশ করে বিএসএফ; ছবিঃ বিবিসি

এরকম অমানবিক হত্যাকাণ্ডের ছবি দ্রুত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে এবং বিএসএফের এহেন কাণ্ড ব্যাপক আকারে সমালোচনার তীরে বিদ্ধ হয়। দেশ-বিদেশের নানান সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত হয় এই ছবি, ওঠে নিন্দার ঝড়। দুই বাংলার মানুষই এ হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ জানায়। বিএসএফ নিজ উদ্যোগে মামলা দায়ের করে তাদের আদালতে।

২০১৩ সালের অগাস্টে ফেলানি হত্যার বিচার কার্যক্রম শুরু হয়। এবং প্রহসনের এই বিচারে হত্যাকারী অমিয় ঘোষকে নির্দোষ প্রমাণ করে খালাস দেয়া হয়। তবে এ রায় সচেতন মহল কর্তৃক প্রত্যাখ্যান করা হলে তা আবার বিচারের জন্য গৃহীত হয়। এরপর থেকে এখন পর্যন্ত বেশ কয়েকবার বিচারকার্য শুরু হলেও প্রতিবারই তা মুলতবি হয়ে আসছে এবং এখনো পর্যন্ত বিচারকার্য প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।

বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত যুদ্ধ

বাংলাদেশ জন্মের ৩০ বছরের মাথায় প্রথমবারের মতো বিডিআর-বিএসএফ যুদ্ধ সংগঠিত হয়। ২০০১ সালের এপ্রিলের তৃতীয় সপ্তাহে বাংলাদেশের অধ্যুষিত এলাকা পাদুয়ায় বিএসএফ অবৈধভাবে রাস্তা নির্মাণের কাজ শুরু করে যা আন্তর্জাতিক আইন এবং ভারত বাংলা সীমান্ত চুক্তির পরিপন্থি। এমতাবস্থায় তৎকালীন বিডিআর (বর্তমান বিজিবি) পাদুয়ার দখল নেয়।

ইন্দো-বাংলা সীমান্ত; ছবিঃ টাইমস অব ইন্ডিয়া

তবে এ ঘটনায় চুপ করে বসে থাকেনি বিএসএফ। ঘটনার ২ দিন পর পাদুয়া থেকে ৮০ কি.মি. দূরে বাংলাদেশের সীমান্তে ঢুকে বিডিআরের বারইবাড়ি ঘাঁটিতে ভারি অস্ত্রসহ হামলা চালায় বিএসএফ। সেখানে বিডিআর সদস্যরা চাতুরতার পরিচয় দেন এবং সুকৌশলে প্রথম ধাক্কা সামাল দেন। এবং কিছুক্ষণ পরই কাউন্টার আট্যাক করলে যুদ্ধ শুরু হয়। প্রায় ২ দিন ব্যাপী এই যুদ্ধে দুই বাংলাদেশি বিডিআর সদস্য নিহত হন এবং এর বিপরীতে ১৬ জন বিএসএফ সদস্য নিহত হন বলে ঢাকা থেকে জানানো হয়। পরবর্তীতে দিল্লি এবং ঢাকার মধ্যস্থতায় বিষয়টি মীমাংসিত হয় এবং যুদ্ধ সমাপ্তি লাভ করে।

পৃথিবীর যেকোনো সীমান্তের চাইতে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে সবচেয়ে বেশি হতাহতের ঘটনা ঘটে। গত দশকের পরেও বিএসএফের পাশবিক নির্যাতন থেমে থাকেনি। ২০১১ সালে সীমান্তে নিহত হয় ৩১ বাংলাদেশি, ২০১২ সালে ৩৮ জন, ২০১৩ সালে ২৯ জন, ২০১৪ সালে ৩৩ জন, ২০১৫ সালে ৪৫ জন এবং সর্বশেষ ২০১৬ সালে প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সীমান্ত রক্ষীদের হাতে নিহত হয়েছে ৩০ জন বাংলাদেশি।

বছরের পর বছর যাচ্ছে, কিন্তু হত্যার গ্রাফে কোনো পরিবর্তন হচ্ছে না। মাঝে মাঝে সীমান্ত রক্ষার নামে বাংলাদেশের সীমান্তে ঢুকে নিরস্ত্র সাধারণ মানুষের ওপর আক্রমণের অভিযোগও রয়েছে বিএসএফের ওপর। এসব অভিযোগের সুরাহা করবার আশায় বিজিবি-বিএসএফ সীমান্ত বৈঠক ও সম্মেলন হলেও তা থেকে যায় কাগজে কলমে। আর দিন শেষে বিএসএফ হয়ে ওঠে আরো বেপরোয়া। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন এভাবে সম্মেলন এবং পতাকা বৈঠকে কাজ হবে না, এ সমস্যা সমাধানে প্রয়োজন রাজনৈতিক পদক্ষেপ।

ফিচার ইমেজ সোর্স – গেটি ইমেজ

Related Articles