পর্তুগাল বললেই আমাদের অনেকের চোখের সামনে ভেসে আসে ক্রিস্টিয়ানা রোনালদো আর লুই ফিগোর কথা, কিংবা জাহাজে ঘুরে ঘুরে দেশ আবিষ্কার করে বেড়ানো ভাস্কো-দা-গামার কথা। কিন্তু এই দেশটির আরো একটি পরিচয় আছে, যা খুব কম মানুষই জানে। আর তা হলো দেশটির এক বিষাদমাখা পরিচয়। বিষাদময় কোনো দেশের কথা বলতে গেলে যে দেশটির কথা প্রথমে উচ্চারিত হয়, তা হচ্ছে পর্তুগাল। ‘ওয়ার্ল্ড হ্যাপিনেস রিপোর্ট’ অনুযায়ী, বিশ্বের ১৫৭টি বিষাদময় দেশের তালিকায় পর্তুগালের স্থান ৮৯ হলেও পৃথিবীর আর কোনো দেশকে নিয়ে ‘বিষাদেরেই বাসি ভালো’-গোছের কোনো ব্যাপার নেই। দেশটির বাসিন্দাদের কাছে একেকটা দিন শুধু উদাসীনতায় ভরা নয়, সব দিনই বিষাদে মাখামাখি।
পর্তুগাল দক্ষিণ-পশ্চিম ইউরোপের একটি রাষ্ট্র। দেশটির উত্তরের ভূমি পর্বতময় ও সবুজের হাতছানি মাখা। উত্তরের দিকটা শীতল আবহাওয়া এবং প্রচুর বৃষ্টিপাত সম্পন্ন, দক্ষিণের আবহাওয়া আবার একেবারেই ভিন্ন। সেই অঞ্চলটি বেশ উষ্ণ এবং মাইলের পর মাইল জুড়ে রয়েছে বিস্তৃত রৌদ্রোজ্জ্বল বেলাভূমি।
পর্তুগীজরা সামাজিক, বন্ধুবৎসল, সহায়তাকারী এবং উত্তরাধিকারসূত্রে বিষণ্ণ সমাজের ধারা বহন করছে। কেউ পর্তুগাল ভ্রমণে আসলে দেখতে পাবেন শহরজুড়ে ব্যস্ত কফি শপ, রেস্টুরন্টে বসে তরুণদের উদ্দামতা, রাস্তায় বসে গানের আসর, স্থানীয় ও পর্যটকরা এসবে মিলে মিশে একাকার। তাহলে কোথা থেকে আসে এ বিষণ্ণতা? এটি বুঝতে হলে পর্তুগীজদের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে বুঝতে হবে। পর্তুগীজদের ইতিহাসে যেমন রয়েছে সমুদ্রযাত্রা এবং ফলশ্রুতিতে প্রিয়জনকে নিয়ত বিদায়, তেমনই রয়েছে বহিঃশত্রুর আক্রমণ ও একনায়কতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার প্রভাব, ফলে তাদের জীবনযাত্রার মধ্য দিয়ে ‘ফাদো’ ও ‘সউদেদ’ শব্দ দুটি সংস্কৃতির মধ্যে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে গেছে।
‘ফাদো’ পর্তুগীজ সঙ্গীতের এমন এক ধারা, যেখানে শুধুমাত্র একটি গিটারের সাহায্যে গানের মধ্য দিয়ে ব্যথিত হৃদয়ের আবেগ, হারানোর বেদনা, ভালোবাসা, আশা-আকাঙ্ক্ষার লোকগাঁথা পরিস্ফুটিত হয়। ফাদো মিউজিকের উৎপত্তি বা কীভাবে এ সঙ্গীত পর্তুগীজ সমাজের সাথে মিশে গেল, তার সঠিক ইতিহাস পাওয়া না গেলেও, অনুমান করা হয়, দেশ হিসেবে পর্তুগাল প্রতিষ্ঠার অনেক আগে থেকে এই সঙ্গীতের জন্ম। এক গবেষণায় জানা যায়, ১৮২০ সালের দিকে পর্তুগীজ সমাজে এর ব্যবহার শুরু হয়েছে।
বর্তমানে গানের কথা, বাচনভঙ্গী বা আধুনিক বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহার হলেও ফাদো সঙ্গীতের মূল ধারা এখনও অপরিবর্তিতই রয়ে গেছে। তা নিয়ে পর্তুগীজরা গর্ববোধও করে থাকে। পর্তুগাল ভ্রমণে এসে কোনো পর্যটক ফাদো শুনেননি তা ভাবাই যায় না। পর্তুগীজ ভাষা বোঝে না তেমন লোকও ফাদোর সুরে মোহিত হয়ে পড়েন। শ্রোতারা হয়তো ভাষাটা বুঝতে পারেন না, কিন্তু গায়কের গানের মধ্যে যে আবেগ ও বেদনাভরা দুঃখ প্রকাশ পায়, তা শ্রোতার হৃদয়কেও ছুঁয়ে যায়।
‘সউদেদ’ পর্তুগীজ ভাষায় এক অতি সুন্দরতম শব্দ। ইংরেজি কিংবা অন্য কোনো ভাষায় এ শব্দের অন্য কোনো উপযুক্ত অর্থ খুঁজে পাওয়া যায়নি। অক্সফোর্ড শব্দকোষে সউদেদের আভিধানিক অর্থ বলতে মানুষের নস্টালজিক সময় হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে। কিন্তু পর্তুগীজদের কাছে এই শব্দটি তার চেয়েও বেশি কিছু। এই শব্দের সাথে জড়িয়ে রয়েছে একটি দেশের মানুষের গভীর ভাবাবেগ।
পর্তুগীজরা তাদের সমাজ জীবনে পরিবার-পরিজন, পরিচিত আত্মীয়, বন্ধুবান্ধবদের মাঝে এই শব্দটি প্রতিনিয়ত ব্যবহার করে থাকে, তাদের ফেলে আসা স্মৃতিময় অতীতকে বারবার ফিরে পেতে চায় এই শব্দের মাধ্যমে। তারা একজন যখন আরেকজনকে বিদায় বেলায় পর্তুগীজ ভাষায় বলে, ‘ভওউ তার্ সউদেদস্ তোয়স্’, তার অর্থ হলো ‘আমি তোমাকে মিস করবো’। কারো বিদায়লগ্নে এই শব্দ ক’টি তাদের হৃদয়ের তীব্র ব্যঞ্জনাকেই আমাদের সামনে তুলে ধরে।
কখন থেকে সউদেদ শব্দটি পর্তুগীজ সমাজে এলো, তা জানতে হলে আমাদেরকে ইতিহাসের পেছনের দিকে ফিরতে হবে। পঞ্চদশ থেকে অষ্টাদশ শতক পর্যন্ত পর্তুগীজরা সমুদ্রপথে ব্যবসা এবং দেশ আবিস্কারের নেশায় উন্মত্ত হয়ে পড়ে। বছরের পর বছর পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন সেসব মানুষদের কথা ভেবে পরিবারের লোকদের দিন অতিবাহিত হতে থাকে। আর তখনই প্রিয়জনদের বিদায়, তাদের নস্টালজিক সময়ের কথা ভেবেই সউদেদ-এর ব্যবহার এবং ফাদো মিউজিকের উদ্ভব ঘটে।
শুধু কি তাই? পর্তুগীজ ভাষায় লেখা নানা কবিতা ও গল্প উপন্যাসেও একধরনের বিষণ্ণতার চিরায়িত ছবি ফুটে উঠে। আর এভাবেই পর্তুগীজ সমাজে বিষণ্ণতা এক চিরস্থায়ী রূপ পায়। ঠিক যেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের লেখা ‘মন ভালো নেই’ কবিতারই এক রূপ দৃশ্যায়িত হয় পর্তুগীজদের মাঝে।
মন ভালো নেই মন ভালো নেই মন ভালো নেই
কেউ তা বোঝে না সকলি গোপন মুখে ছায়া নেই
চোখ খোলা তবু চোখ বুজে আছি কেউ তা দেখেনি
প্রতিদিন কাটে দিন কেটে যায় আশায় আশায়।।
কবিতাটি আওড়াতে আওড়াতে হয়তো তারা ধূসর এক সন্ধ্যায় রেল ব্রীজ পেরিয়ে যেতেন। উদাসীনতা আর বিষাদে মাখামাখি হয়ে কাটতো এসব মানুষের একেকটা দিন।
আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, সে দেশের কেউই একজন অন্যজনকে ‘হ্যাভ আ নাইস ডে’ বলে সম্বোধনই করেন না। “কেমন আছেন?” এমনতর জিজ্ঞাসায় যে সাধারণ উত্তরটি পর্তুগীজবাসীদের কাছ থেকে পাবেন তা হলো, “এই তো, চলে যাচ্ছে“- গোছের। ভূমধ্যসাগরের জল-হাওয়াও নাকি মন ভালো করতে পারে না পর্তুগালের বাসিন্দাদের।
বিষণ্ণতা হয়ে গেছে পর্তুগীজদের সংস্কৃতিরই একটি অংশ। তাদের কাছে এই বিষাদই যেন আনন্দঘন। এই বিষণ্ণতার প্রতিচ্ছবি পরতে পরতে ছড়িয়ে রয়েছে সে দেশের শিল্প, সাহিত্য, এমনকি স্থাপত্য-ভাস্কর্য-চিত্রকলায়ও। এর মধ্যে কখনো কখনো উঁকি দেয় অতীতবিলাস। বর্তমানকে সরিয়ে দিয়ে পর্তুগীজরা ছুঁতে চান এক অসম্ভব অতীতকে। সেটি পাওয়া সম্ভব নয় জেনেই তারা বিষণ্ন হন। সেটা পরিচিত কোনো মুখ, ঘরের আসবাব, পরিচিত খাবার বা ঘরের কোনো গৃহপালিত পশুও হতে পারে, কিংবা তাদের পরম্পরাগত মিউজিক ফাদোও হতে পারে। এই ফাদো শব্দের মধ্যেও বিমর্ষতার এক চিত্র পাওয়া যায়। ফাদো শব্দের আক্ষরিক অর্থ নিয়তি। আর এই নিয়তি নামটিতেই তো লুকিয়ে রয়েছে বিষণ্নতার অলিখিত টান।
বিষণ্ণ দেশের তালিকায় লেবাননের পরেই রয়েছে পর্তুগাল। বাংলাদেশের অবস্থান তো আরও পরে, ১১০তম। কিন্তু তারপরও বাংলাদেশ কিংবা লেবাননে বিষণ্ণতা নিয়ে এ ধরনের অতিমাত্রিকতা নেই। মন খারাপের বিষয়গুলো এখানে ব্যক্তিগত গন্ডিতেই সীমাবদ্ধ। পর্তুগীজদের মতো জাতিগত বিষণ্ণ দেশ, তীব্র দারিদ্র্যে জর্জরিত আফ্রিকা মহাদেশেও হয়তো নেই। তবে এই দেশগুলোর সাথে যদি কেউ পর্তুগালকে এক পাল্লায় রেখে হিসেব করতে বসেন, তাহলে তিনি ভুল করবেন। পর্তুগীজরা তাদের এই অন্তর্নিহিত বিষাদকে রীতিমতো উপভোগ করেন।
এটা মনে হওয়া খুবই স্বাভাবিক, দেশসুদ্ধ লোক বেশ খানিকটা বিমর্ষকামী। কিন্তু পর্তুগীজদের সাথে কিছুদিন মেলামেশা করলে দেখা যাবে, ব্যাপারটি আপনার কাছে অন্যরকম মনে হওয়ায় স্বাভাবিক। বিষাদের মধ্য দিয়ে পর্তুগীজরা প্রতিনিয়ত তাদের মনোজগতে এমন কিছুর সন্ধানে ব্যস্ত, যেন প্রকৃতি, মানুষ সবকিছুর ভিতরে এক বিষাদের ধারা আবিষ্কার করে তারা মজে আছে সেই অনাবিল সৌন্দর্যে। পর্তুগীজরা মনে করে, তাদের এই বিষাদ এক সহনীয় বিষাদ। একে ঠিকমতো লালন করতে পারলে মনের গভীর থেকে প্রকৃত সুখ বহমান ধারার মতো তাদের জীবনধারায় বইতে থাকবে।
মনোবিদরা দীর্ঘদিন ধরেই পড়ে রয়েছেন পর্তুগীজদের এহেন মানসিকতার উৎস জানার জন্য। ২০০৮ সালে ‘জার্নাল অফ এক্সপেরিমন্টাল সোশ্যাল সাইকোলজি’তে প্রকাশিত এক গবেষণা জানাচ্ছে, বিষাদ স্মৃতিশক্তি বাড়ায়। এই জার্নালের আরেকটি নিবন্ধ বলছে, বিষাদে বিচারশক্তি বাড়ে। পর্তুগীজদের সামগ্রিকভাবে সেসব বেড়েছে কিনা, সে কথা অবশ্য জার্নাল জানায়নি।