সৌদি আরব কানাডার সাথে অভূতপূর্ব কূটনৈতিক সংকটে জড়িয়ে পড়েছে। গতকাল সোমবার সৌদি আরব হঠাৎ করেই কানাডার রাষ্ট্রদূতকে বহিষ্কার করেছে এবং কানাডাতে অবস্থিত নিজেদের রাষ্ট্রদূতকে দেশে ফিরে আসার নির্দেশ দিয়েছে। একই সাথে দেশটি কানাডার সাথে তাদের নতুন করা সকল ব্যবসায়িক চুক্তি বাতিল ও কানাডাগামী সকল ফ্লাইট বন্ধ করার ঘোষণা দিয়েছে, এবং কানাডায় অবস্থিত কয়েক হাজার সৌদি ছাত্রছাত্রীকে অন্যত্র সরিয়ে নেওয়ারও সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আর এসব কিছুই তারা করেছে সৌদি আরবের নারী অধিকার নিয়ে করা কানাডার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে!
সংকটের শুরু কোথা থেকে?
Canada is gravely concerned about additional arrests of civil society and women’s rights activists in #SaudiArabia, including Samar Badawi. We urge the Saudi authorities to immediately release them and all other peaceful #humanrights activists.
— Foreign Policy CAN (@CanadaFP) August 3, 2018
মানবাধিকার সূচকে সৌদি আরবের অবস্থান সবসময়ই একেবারে নিচের দিকে থাকে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অবশ্য যুবরাজ মুহাম্মদ বিন সালমানের উদ্যোগে সৌদি আরব নারীদের অধিকারের ব্যাপারে বেশ কিছু সংস্কারমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। কিন্তু একই সময়ে প্রচুর রাজনৈতিক ভিন্ন মতাবলম্বী এবং নারী অধিকার কর্মীদেরকে গ্রেপ্তারও করেছে সৌদি প্রশাসন। জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক সংস্থার হাইকমিশনারের বক্তব্য অনুযায়ী, শুধুমাত্র গত আড়াই মাসেই সৌদি আরব অন্তত ১৫ জন নারী অধিকার কর্মীকে গ্রেপ্তার করেছে। এদের অনেকের বিরুদ্ধে বিদেশী রাষ্ট্রের হয়ে সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রসহ বিভিন্ন ধরনের অভিযোগ আনা হয়েছে, যার ফলে তাদের ২০ বছরের পর্যন্ত কারাদণ্ড হতে পারে।
সর্বশেষ গত সপ্তাহে সৌদি আরব আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন নারী অধিকার কর্মী সামার বাদাউইকে গ্রেপ্তার করে। ৩৩ বছর বয়সী সামার বাদাউই সৌদি আরবের নারীদের ড্রাইভিংয়ের অধিকারের জন্য এবং রাস্তায় চলাফেরার সময় পুরুষ অভিভাবক সাথে রাখার বাধ্য বাধকতার বিরুদ্ধে লড়াই করে আসছিলেন। ২০১২ সালে তিনি US International Women of Courage Award অর্জন করেছিলেন। সৌদি সরকার এর আগেও তাকে গ্রেপ্তার করেছিল। তার স্বামী ওয়ালিদ আবুল খাইর, যিনি নিজেও একজন মানবাধিকার কর্মী, সৌদি কারাগারে ১৫ বছরের কারাদণ্ড ভোগ করছেন। তার ভাই রাইফ বাদাউই, যিনি একজন ব্লগার, অনলাইনে বিতর্কিত মতামত প্রকাশ করার কারণে ১০ বছরের কারাদণ্ড ভোগ করছেন।
Very alarmed to learn that Samar Badawi, Raif Badawi’s sister, has been imprisoned in Saudi Arabia. Canada stands together with the Badawi family in this difficult time, and we continue to strongly call for the release of both Raif and Samar Badawi.
— Chrystia Freeland (@cafreeland) August 2, 2018
রাইফ বাদাউইর স্ত্রী এবং সন্তান-সন্ততিরা কানাডার নাগরিক, যার ফলে কানাডা বাদাউই পরিবার নিয়ে সব সময়ই উদ্বেগ প্রকাশ করে এসেছে। সামার বাদাউইর গ্রেপ্তারের পর গত ২ আগস্ট কানাডার পররাষ্ট্রমন্ত্রী ক্রিস্টিয়া ফ্রিল্যান্ড এক টুইট বার্তায় বলেন, কানাডা বাদাউই পরিবারের এই দুঃসময়ে তাদের সাথেই আছে। তিনি একইসাথে রাইফ ও সামার বাদাউইকে মুক্তি দেওয়ার জন্য সৌদি সরকারের প্রতি জোরালো আহ্বান জানান। তার এই বক্তব্যের একদিন পরেই কানাডার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে এক বার্তায় সৌদি সরকারের প্রতি সামার বাদাউইসহ গ্রেপ্তারকৃত সকল নারী অধিকার কর্মীকে ‘তাৎক্ষণিকভাবে’ মুক্তি দেওয়ার আহ্বান জানানো হয়।
কানাডার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এই বক্তব্যকে সৌদি আরব তাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ের উপর হস্তক্ষেপ হিসেবে গ্রহণ করে। বক্তব্যটি প্রকাশিত হওয়ার পর থেকেই সৌদি আরবের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে অনলাইনে এর বিরুদ্ধে তীব্র প্রচারণা শুরু হয়। সৌদি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে ক্রিস্টিয়া ফ্রিল্যান্ডের বক্তব্যকে সৌদি আরবের সার্বভৌমত্বের উপর হস্তক্ষেপ বলে দাবি করা হয় এবং এর বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার অধিকার তাদের আছে বলে জানানো হয়।
সৌদি আরব কী কী ব্যবস্থা নিয়েছে?
#Statement | The Canadian position is an overt and blatant interference in the internal affairs of the Kingdom of #SaudiArabia and is in contravention of the most basic international norms and all the charters governing relations between States.
— Foreign Ministry 🇸🇦 (@KSAmofaEN) August 5, 2018
কানাডার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কেবলমাত্র একটি বিবৃতির বিপরীতে সৌদি আরব রীতিমতো সাহসী এবং আগ্রাসী পদক্ষেপ গ্রহণ করে। তারা সৌদি আরবে নিযুক্ত কানাডিয়ান রাষ্ট্রদূত ডেনিস হোরাককে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করে এবং তাকে দেশটি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য মাত্র ২৪ ঘণ্টা সময় বেঁধে দেয়। একইসাথে তারা কানাডা থেকে নিজেদের রাষ্ট্রদূতকেও দেশে ফিরিয়ে আনে। কানাডার সাথে নতুন করা সকল বাণিজ্য ও বিনিয়োগ চুক্তি বাতিলের সিদ্ধান্তও ঘোষণা করে সৌদি আরব। ২০১৬ সালে দেশ দুটির মধ্যে বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল প্রায় ৩০০ কোটি ডলার। যদিও বাতিল করা বাণিজ্য ও বিনিয়োগ চুক্তির অর্থমূল্য কত, তা এখনও পরিষ্কার না।
কানাডার সাথে শিক্ষা বিনিময় সংক্রান্ত সকল চুক্তি বাতিল করতে যাচ্ছে বলেও জানিয়েছে সৌদি আরব। কানাডার দ্য স্টার পত্রিকার তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে প্রায় ১৬,০০০ সৌদি ছাত্র কানাডাতে পড়াশোনা করছে। চুক্তি বাতিলের ফলে এই শিক্ষার্থীরা কানাডাতে পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হবে। তবে সৌদি আরবের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন জানিয়েছে, দেশটির শিক্ষা মন্ত্রণালয় কানাডায় অবস্থানরত সকল সৌদি শিক্ষার্থীকে অন্যান্য দেশে স্থানান্তরের জন্য জরুরি পরিকল্পনা গ্রহণ করার উদ্যোগ নিয়েছে। এছাড়াও অন্যান্য ব্যবস্থার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, সৌদি আরবের রাষ্ট্রীয় এয়ারলাইন্স সাউদিয়া আগামী সোমবার থেকে কানাডার সাথে যোগাযোগ রক্ষাকারী সকল ফ্লাইট বাতিল করার ঘোষণা দিয়েছে।
#Statement | We consider the Canadian ambassador to the Kingdom of Saudi Arabia persona non grata and order him to leave within the next 24 hours.
— Foreign Ministry 🇸🇦 (@KSAmofaEN) August 5, 2018
তবে কানাডার বিরুদ্ধে গৃহীত পদক্ষেপগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বিতর্কিত ছিল, ইনফোগ্রাফিক কেএসএ নামক একটি টুইটার অ্যাকাউন্ট থেকে কানাডার বিরুদ্ধে দেওয়া হুমকিটি। অ্যাকাউন্টটি যদিও একটি বেসরকারি সৌদি সংস্থার, কিন্তু এতে সৌদি সরকারের বার্তাই প্রচারিত হয়ে থাকে। গতকাল সোমবার অ্যাকাউন্টটি থেকে একটি ছবি টুইট করা হয়, যেখানে এয়ার কানাডার বিমানকে টরন্টোর আকাশসীমায় সুউচ্চ ভবনগুলো লক্ষ্য করে ছুটে দেখা যায়। ছবিটির উপর লেখা প্রবাদগুলোর সারমর্ম ছিল, অন্যের বিষয়ে অযাচিত নাক গলালে তার ফলাফলও অনাকাঙ্ক্ষিত হয়।
ভবন লক্ষ্য করে ধাবমান প্লেনের ছবি এবং সেই সাথে প্রচ্ছন্ন হুমকিকে অনেকেই ব্যাখ্যা করেন যে, অ্যাকাউন্টটি এর মধ্য দিয়ে কানাডাকে ৯/১১ এর সন্ত্রাসী হামলার মতো একটি হামলার হুমকি দিয়েছে। কারণ ২০০১ সালে টুইন টাওয়ারের ঐ হামলায় ঠিক এভাবেই ভবন লক্ষ্য করে প্লেন ছুটে গিয়েছিল এবং ঐ হামলাকারীদের সাথে সবচেয়ে বেশি সম্পৃক্ততা ছিল সৌদি আরবের। হামলার দায়ে অভিযুক্ত সন্ত্রাসী সংগঠন আল-কায়েদার প্রধান ওসামা বিন লাদেন ছাড়াও হামলাকারীদের মধ্যে ১৯ জনই ছিল সৌদি নাগরিক। সৌদি আরবের তথ্য মন্ত্রণালয় অবশ্য জানিয়েছে, ঐ অ্যাকাউন্টটি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে এবং ব্যাপারটি তদন্ত করে দেখা হচ্ছে।
Now deleted, here a screenshot of the threatening Saudi “infographic” featuring an airliner headed for the Toronto skyline. pic.twitter.com/LrkCLxxjFk
— Tobias Schneider (@tobiaschneider) August 6, 2018
কানাডা কী প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে?
স্বাভাবিকভাবেই কানাডা সৌদি আরবের কাছ থেকে এরকম তীব্র প্রতিক্রিয়া আশা করেনি। তারা সৌদি আরবের বিভিন্ন পদক্ষেপের ব্যাখ্যা দাবি করেছে। তবে তারা একই সাথে এও বলেছে যে, তারা সব সময়ই কানাডায় এবং বহির্বিশ্বে মানবাধিকার ও নারী অধিকারের পক্ষে দাঁড়াবে। কানাডার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ম্যারি-পায়ার বারিলের ভাষায়, কানাডা সব সময়ই বিশ্বজুড়ে নারী অধিকার ও মত প্রকাশের স্বাধীনতাসহ সব ধরনের মানবাধিকার রক্ষায় কাজ করে যাবে। তিনি আরও বলেন, তার সরকার কখনোই এই মূল্যবোধ রক্ষায় পিছপা হবে না।
সৌদি আরবের এ ধরনের পদক্ষেপে যদিও উভয় রাষ্ট্রই অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতির সম্মুখীন হবে, কিন্তু এতে কানাডার ক্ষতির পরিমাণ তুলনামূলকভাবে বেশি হতে পারে। কানাডা তাই সৌদি আরবের বিরুদ্ধে পাল্টা ব্যবস্থা নেওয়ার পরিবর্তে সমঝোতায় আগ্রহী। নাম প্রকাশ করে একাধিক সূত্রের বরাত দিয়ে বার্তা সংস্থা রয়টার্স জানিয়েছে, ব্যাপারটির মীমাংসা করার জন্য কানাডা সৌদি আরবের মিত্র রাষ্ট্রগুলো, বিশেষ করে আরব আমিরাত এবং যুক্তরাজ্যের সাথে যোগাযোগ করছে।
Featured Image Source: Business Insider