Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

গিনেজ ঋষি: অভিনব সব রেকর্ড গড়া যার নেশা

একটু ভাবুন তো, কেউ একজন বিশ্ব রেকর্ড করার জন্য তার নিজের সবগুলো দাঁত ফেলে দিয়েছেন। তারপর মুখের মধ্যে ৪৯৬টি কোমল পানীয় পানের স্ট্র ঢুকিয়ে বিশ্ব রেকর্ড করেছেন। কেউ বা অভিনব বিশ্ব রেকর্ড গড়ার জন্য নয়াদিল্লি থেকে পিৎজা অর্ডার করিয়ে প্রথমে তা লন্ডন, তারপর লন্ডন থেকে ওয়াশিংটন এবং ওয়াশিংটন থেকে সানফ্রানসিস্কোতে নিয়ে ডেলিভারি করিয়েছেন। আর এ সবই করেছেন মাত্র ২৭ ঘন্টার মধ্যে। কিংবা গিনেজ বুকে নাম ওঠানোর জন্য তার সমগ্র দেহ ট্যাটু এঁকে ভরে ফেলেছেন, যার মধ্যে রয়েছে শতাধিক দেশের পতাকা এবং বিশ্বের বিভিন্ন বিখ্যাত মানুষের প্রতিকৃতি, যেমন- রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথ কিংবা বারাক ওবামার ছবি।

বিষয়টি গল্পের মতো মনে হলেও পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে এমনই একজন বৃদ্ধ নাগরিক রয়েছেন, যিনি একের পর এক এমন অভিনব সব রেকর্ড গড়ে চলেছেন। তার নাম হর প্রকাশ ঋষি। গিনেজ বুকে নাম লেখানোর সুবাদে এখন তার নিজের নামই পরিবর্তন হয়ে গেছে; নিজের নামের শুরুতে যুক্ত হয়ে গিয়েছে ‘গিনেজ’। তার বাড়ি ভারতের নয়াদিল্লিতে। বর্তমান বয়স ৭৬ বছর। পেশাগত দিক থেকে তিনি একজন মোটর যন্ত্রাংশের মেকানিক।

হর প্রকাশ ঋষি ওরফে গিনেজ ঋষি; Image Credit: Har Prakash Rishi/Al Jazeera

১৯৯০ সালে তিনি সর্বপ্রথম গিনেজ বুকে নিজের নাম অন্তর্ভুক্ত করতে সক্ষম হন। সেবছর তিনি একটি স্কুটারে চড়ে একটানা ১,০০১ ঘন্টা পথ পরিভ্রমণ করেন। এতে তিনি সমগ্র ভারতের প্রায় ৩০,৯৬৫ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করেন। ১৯৯০ সালের ২২ এপ্রিল থেকে ৩ জুনের মধ্যে, অর্থাৎ মোট ১২ দিনে তিনি এই বিশাল পথ অতিক্রম করেন, যা গিনেজ বুকে একটানা দীর্ঘ সময় স্কুটার চালানোর রেকর্ড হিসেবে জায়গা করে নেয়। তার আগে অন্য কেউ একটানা এত সময় স্কুটারে করে ভ্রমণ করতে পারেননি। 

গিনেজ ঋষি নিজের সেসব রেকর্ড আর নথিপত্র নিয়ে একটি যাদুঘর গড়ে তুলেছেন, যাদুঘরের দেয়ালগুলো তার অর্জিত রেকর্ডের সার্টিফিকেটে ঢেকে গিয়েছে। সেখানে বসেই তিনি বলেন,

আমি আমার ১০০সিসি স্কুটার দিয়ে আরও দুজন বন্ধুকে সাথে নিয়ে সারা ভারত ঘুরে বেড়াই। এর মধ্যে আমরা প্রায় সকল প্রদেশ অন্তর্ভুক্ত করি, যার মধ্যে দুর্গম মহারাষ্ট্র প্রদেশটিও ছিল। 

এটিই ছিল তার প্রথম বিশ্ব রেকর্ড। এই রেকর্ড গড়ার পর থেকেই মানুষ তাকে ‘মিস্টার গিনেজ’ নামে ডাকতে শুরু করে। সেই অভিজ্ঞতা তুলে ধরতে গিয়ে তিনি বলেন,

আমি তখন ভাবলাম, ‘তাহলে কেন আমি আমার নাম পরিবর্তন করে ফেলছি না? আমার নাম কি পরিবর্তন করে ফেলা উচিৎ নয়?’ এই ভাবনা থেকে আমি তখন গিনেজ বুক ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস পাবলিকেশন কর্তৃপক্ষের কাছে একটি আবেদন জানালাম যে, আমি আমার নাম পরিবর্তন করে গিনেজ ঋষি রাখতে চাই। তারা তখন আমার আবেদন গ্রহণ করলেন।   

নিজের তৈরি করা যাদুঘরে গিনেজ ঋষি; Image Credit: Har Prakash Rishi/Al Jazeera

পরবর্তীতে তিনি দীর্ঘ ১০ বছর যাবত গিনেজ রেকর্ডস ক্লাব অফ ইন্ডিয়ার সভাপতি ছিলেন। তিনি দাবী করেন, এ সময় তিনি অনেক ভারতীয়কে তার নিজের রেকর্ড ভাঙার উপায় ও করণীয় শিখিয়ে দিয়েছিলেন। 

২০০৯ সালে ভারতে অবস্থিত রাশিয়ান দূতাবাসের একটি অনুষ্ঠানে তিনি দাওয়াত পান। সেখানে তিনি দেখেন কিছু রাশিয়ান শিশু তাদের দেশের পতাকা নিয়ে গর্ব করছে এবং নেচে নেচে উৎসব করছে। তখন তিনি রেকর্ড গড়ার আরেকটি নতুন থিম খুঁজে পান। তিনি বলেন,

তখন আমি ভাবলাম, তাহলে আমি কেন আমার সারা দেহে সমগ্র বিশ্বের সকল পতাকা ধারণ করবো না? 

থিম পাওয়ার সাথে সাথেই তিনি তা বাস্তবায়ন শুরু করে দিলেন। তিনি তার সমগ্র দেহে মোট ৪৯৯টি পতাকা ট্যাটু করেন (স্বাধীন দেশের বাইরেও অনেকগুলো দেশ ও অঞ্চলের পতাকা অংকন করেন)। এবং তার পেটের উপরে সারা বিশ্বের একটি মানচিত্র অংকন করেন। তিনি বলেন,

যখনই আমি কোনো দেশে যাই, তখন সে দেশের লোকেরা আমাকে জিজ্ঞাসা করে, তাদের দেশের পতাকাটি আমার শরীরের কোন জায়গায় অবস্থিত।

তিনি আরও জানান, তার সেই ট্যাটুতে একটি বিশেষ স্লোগান লেখা ছিল,

আসুন আমরা সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হই। 

গিনেজ ঋষির সারা দেহে বিভিন্ন পতাকার ট্যাটু; Image Source: jagran.com 

এই স্লোগানটি তিনি তার দেহের চামড়ায় রাশিয়ান, গ্রিক, ফ্রেঞ্চ, হিব্রুসহ বিশ্বের বিভিন্ন প্রভাবশালী ভাষায় স্থায়ীভাবে লিপিবদ্ধ করে নেন। পাশাপাশি তিনি তার দেহে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও মহাত্মা গান্ধীর একটি ছবিও ধারণ করেন।  

২০১১ সালে তিনি মুখের ভিতর রেকর্ড পরিমাণ স্ট্র ধারণ করে গিনেজ বুকে নাম লেখান। সেই অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরতে গিয়ে তিনি বলেন,

২০১১ সালে আমি যখন মুখে রেকর্ড পরিমাণে সঙ্কুচিত স্ট্র ধারণ করার সিদ্ধান্ত নিলাম, তখন আমি বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হলাম। মুখের মধ্যে পর্যাপ্ত পরিমাণে স্ট্র ধারণ করতে পারছিলাম না। ফলে পরের দিন আমি ডেন্টিস্টের কাছে যাই এবং আমি আমার সকল দাঁত ফেলে দিতে বলি। তারপর আমি মুখের মধ্যে ৪৯৬টি স্ট্র ধারণ করে বিশ্ব রেকর্ড গড়ি। 

মুখে সর্বাধিক স্ট্র ধারণ করার রেকর্ডটিও গিনেজ ঋষির দখলে; Image Source: terpanas.id

তিনি তার মুখের মধ্যে ৬৫টি জ্বলন্ত মোমবাতি ধারণ করেও বিশ্ব রেকর্ড গড়েছেন। আবার একটি স্ট্রর সাহায্যে মাত্র ৩৯ সেকেণ্ডের মধ্যে  ৫০০ গ্রাম ওজনের এক বোতল সস খেয়ে ফেলার অভিনব রেকর্ডটিও তার দখলে রয়েছে।    

তিনি বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে দীর্ঘতম উইল তৈরি করার রেকর্ডটি নিজের দখলে নেয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। এজন্য তিনি ৯,৫০০ পৃষ্ঠারও বেশি একটি উইল প্রস্তুত করছেন। 

তিনি এখন পর্যন্ত কমপক্ষে ২০টি বিশ্ব রেকর্ড গড়েছেন, যার মধ্যে ৭টি গিনেজ বুকের বিশ্ব রেকর্ডের তালিকায় ইতিমধ্যেই নিবন্ধিত হয়েছে। বাকি রেকর্ডগুলো লিমকা রেকর্ড বুকে নিবন্ধিত হয়েছে। এ বিষয়ে তিনি বলেন,

আমি গিনেজ বুকের ২০টিরও অধিক বিশ্ব রেকর্ড ভেঙেছি, কিন্তু এটি অত্যন্ত দুঃখজনক বিষয় যে, গিনেজ বুক কর্তৃপক্ষ আমার মাত্র সাতটি বা আটটি রেকর্ড তাদের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেছে। এখনো আমার প্রায় পনেরোটি বিশ্ব রেকর্ড গিনেজ বুকের সার্টিফিকেট পাওয়ার অপেক্ষায় পেন্ডিং রয়েছে। 

সবচেয়ে বেশি পতাকার ট্যাটু দেহে ধারণের রেকর্ডটি তার দখলে; Image Credit: REUTERS

অদ্ভুত সব নেশা আর পরিকল্পনা তার মাথায় ঘোরাঘুরি করে। এখন তিনি তার দেহকে কোনো একটি প্রতিষ্ঠানকে দান করে যাওয়ার পরিকল্পনা করছেন। যাদেরকে তিনি অনুরোধ করে যাবেন, যেন তার মৃত্যুর পর তার দেহকে একটি স্বচ্ছ কফিনে বাধিয়ে রাখা হয়, যাতে দর্শনার্থীরা তখনও তার দেহের ট্যাটুগুলো দেখতে পারেন। তার অর্জিত রেকর্ড নিয়ে তিনি বলেন,

এই বৃদ্ধ বয়সে আমি আর চাই না যে, কেউ আমার রেকর্ডসমূহ ভেঙে ফেলুক। যতদিন সম্ভব আমি আমার রেকর্ডসমূহ অক্ষত অবস্থায় দেখে যেতে চাই। 

কিন্তু তিনি নিজেও জানেন যে, তার এই ইচ্ছা পূরণ হওয়া মোটেই সহজ ব্যাপার নয়। তার দুঃখটা আসলে অন্য জায়গায়। প্রায়শই তিনি তার প্রতিবেশী ও আত্মীয়স্বজন দ্বারা নিগ্রহের শিকার হন। তারা তার শরীরে ট্যাটু থাকায় কটুক্তি করেন এবং তার বিশ্ব রেকর্ডসমূহকে তারা অবজ্ঞার চোখে দেখেন। গিনেজ ঋষি বলেন,

সবাই ভাবে আমি পাগল। মানুষ আমাকে বোকা বলে সম্বোধন করে। তারা আমাকে নিয়ে বিদ্রুপ করে। পেছন থেকে আমাকে ‘পাগল’, ‘বোকা’ ইত্যাদি নামে ডাক দেয়। কিন্তু আমি তাদের কথার কোনো জবাব দেই না।  

নিজ বাসগৃহে গিনেজ ঋষি; Image Credit: REUTERS

রাজত কুমার, যিনি তিন বছর আগে গিনেজ ঋষির প্রতিবেশী ছিলেন, তিনি বলেন,

তার ধ্যান ধারণা আমার কাছে প্রথম দিকে খুব কঠিন মনে হতো। কিন্তু যখন সংবাদমাধ্যমে আমি তার অর্জনের কথা দেখতে পাই তখন আমি তার প্রতি মুগ্ধ হয়ে যাই। 

রাজত কুমার জানান, তিনি প্রতিবেশী থাকা অবস্থায় ঋষির সাথে খুব একটা কথা বলতেন না, কারণ ঋষি খুব বদ মেজাজের লোক। কিন্তু বিশ্ব রেকর্ড গড়ার কারণে তিনি ঋষিকে আজীবন সম্মান দেখিয়ে যাবেন,

আমি শুনেছি আমার অন্যান্য প্রতিবেশীরা তাকে নিয়ে পেছনে পেছনে বিদ্রুপ করে। তারা আমার সামনে বসেও এসব করার চেষ্টা করেছে। কিন্তু আমি তাদের সাথে একমত নই। আমি ঋষিকে সম্মান জানাই। তিনি অবিশ্বাস্য সব রেকর্ড গড়েছেন। তার এসব আবেগ কিংবা আসক্তি নিয়ে কে কী বললো তাতে তার কিছু আসবে যাবে না। 

 

“আমি যদি এই মানুষগুলোর কথায় কান দিতাম, তাহলে আমি কখনোই এসব অর্জন করতে পারতাম না”- গিনেজ ঋষি; Image Source: India Today

তবে ঋষির স্ত্রী বিমলা তার এই কাজকে সমর্থন করেন। তিনি বলেন,

তিনি যদি এই কাজ করে আনন্দ পান, তাহলে কেন তিনি এই কাজ করবেন না?

বিমলা জানান, ঋষির হৃদয় এখনো তরুণদের হৃদয়ের মতো। কিন্তু মাঝে মাঝে তিনি বিদ্রুপের শিকার হন। তখন তিনি মৃদু হাসেন আর তার অর্জিত স্বর্ণপদকগুলোর দিকে তাকান এবং বলে ওঠেন,

আমি যদি এই মানুষগুলোর কথায় কান দিতাম, তাহলে আমি কখনোই এসব অর্জন করতে পারতাম না।  

This article is in bengali language. This is about the Guinness Rishi: The elderly Indian obsessed with breaking records. All sources are hyperlinked inside article

Featured Image: Har Prakash Rishi/Al Jazeera

Related Articles