“ভালোবেসে, সখী, নিভৃতে যতনে
আমার নামটি লিখো তোমার-
মনের মন্দিরে…”
কবিগুরু রবি ঠাকুরের জীবনেও এসেছিল অমোঘ প্রেম, তা বিনে কি হতো কখনও এতো কালজয়ী মহা সৃষ্টি? প্রেম মানব মনের এক শাশ্বত বহি:প্রকাশ। প্রেম-ভালোবাসা আমাদের জীবনের সাথে ওতপ্রোতভাবেই মিশে আছে। কারো পক্ষে তাকে অস্বীকার করা সম্ভব নয়। যুগে যুগে প্রেম নিয়ে রচিত হয়েছে কতই না গল্প-গাঁথা। সেসব প্রেম কাহিনী পড়ে আমরা কখনও আবেগে ভেসেছি, আবার কখনোবা বিয়োগাত্মক করুণ পরিণতিতে অঝোর ধারায় কেঁদেছি। একেকটি ভালোবাসার উপাখ্যান যেন এক একটি আশ্রয়ের আকুতি, যাকে ঘিরে ঘর বাঁধে হাজার কল্পনা, আবেগ, অনুভূতি। সে অনুভূতি যেন বলে যায়…
“নিরাশ্রয় পাঁচটি আঙুল তুমি নির্দ্বিধায়
অলংকার করে নাও, এ আঙুল ছলনা জানে না…”
হেলাল হাফিজের ছলনার রাজ্যে মাঝে মাঝে এখনও বাস্তব পৃথিবীতে টোকা দিয়ে যায় এমন সব সত্যিকার প্রেমের গল্প যাদের আবেদন রোমিও-জুলিয়েট, শিরিন-ফরহাদ, লাইলি-মজনুর প্রেম গাঁথার চেয়ে কোনও অংশে কম নয়। ভালোবাসা দিবস মানেই ১৪ ফেব্রুয়ারি। প্রায় ৭ দশক পর গত বছরের ভালোবাসার মাসেই ঘটে গেলো এমন এক মধুর সুখকর পরিণতি যার বিচ্ছেদ ঘটেছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ইতিহাসে। তার ঠিক ৮ মাস পরেই পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেই এ গল্পের পরিসমাপ্তি ঘটালেন প্রেমিকযুগলের একজন। তিনি হলেন জয়েস মরিস।
এই প্রেম কাহিনীর শুরুটা হয়েছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়। সময়টা ঠিক ১৯৪৪, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মিত্রপক্ষের হয়ে যুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন ২১ বছরের মার্কিন যোদ্ধা। নাম তার নরউড থমাস। মার্কিন অধিবাসী হলেও সেই সময়টায় তিনি লন্ডনে বসবাস করছিলেন। থমাস বলেন, একদিন তিনি বন্ধুদের সঙ্গে বাইরে বেরিয়ে ছিলেন। টেমসের তীরে সুন্দরীদের উপর নজর ঘোরাফেরা করছিল তার। সে বয়সে যা হয় আর কী! টেমসের উপর সেতু দিয়ে পার হওয়ার সময় চোখ আটকে গিয়েছিল সেদিন তার সেই স্বপ্নের রানী জয়েস মরিসের উপর। তরতর করে সেতু থেকে নেমে এসে মরিসের আশপাশে ঘোরাফেরা করতে শুরু করেন থমাস। সে-ই দুজনের প্রথম দেখা।
সে সময় মরিস লন্ডনে নার্সিং প্র্যাকটিস করছিলেন। এরপর কয়েক মাস ডেট করেই কেটে গেলো থমাস ও মরিসের। দুজনেই গভীর প্রেমে পড়ে যান। মরিস থমাসকে ‘টমি’ নামে ডাকতেন। নরউডের কাছে মরিসের সৌন্দর্যের ব্যাখ্যা ছিল এইরকম- “I’d always look at her and think, My God, that is one sweet girl“। মরিসের হাসি দেখেই থমাস প্রেমে পড়েছিলেন। শুরু হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। থমাসের ডাক আসে নরম্যান্ডির যুদ্ধের ময়দানে। তারপরেই ঘটে দীর্ঘ বিচ্ছেদ। যুদ্ধ শেষে আর দেখা হয়নি তাদের।
যুদ্ধ থেকে ফিরে থমাস মরিসকে চিঠি লিখেছিলেন। থমাস চিঠিখানা লিখেছিলেন সুন্দর একটি গোছানো সংসার গড়ে তোলার প্রত্যয়ে। কিন্তু হায় অদৃষ্ট! মরিস তাকে ভুল ভেবে বসেছিলেন। মরিস ভেবেছিলেন যে থমাস অন্য নারীর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ ছিলেন। কিন্তু মরিসের কারণেই তিনি সে সম্পর্ক ছিন্ন করে আবার নতুন সংসার গড়ে তোলার চিন্তা করছেন। সেই ভুল ভেবেই মরিস চান নি আর থমাসের সাথে যোগাযোগ রাখতে।
পরবর্তীতে থমাস অন্য নারীকেই বিয়ে করে নিলেন আর মরিসও আরেকজনের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে অস্ট্রেলিয়া থেকে গেলেন। কিন্তু মরিসের সংসার টিকলো না বেশিদিন। তিনি ডিভোর্স দিয়েই আলাদা হলেন তার স্বামীর কাছ থেকে। অন্যদিকে থমাসের ৫৬ বছরের সংসার জীবন সুখেরই চলছিল কিন্তু ২০০১ সালে দুর্ভাগ্যবশত তার স্ত্রীও মারা যান।
এদিকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রেমের ইতিহাস পাড়ি দিলো প্রায় ৭০ বছর। দুজনেরই চুলে পাক ধরেছে, চোখের দৃষ্টি গিয়েছে কমে। কে যে কোথায় চলে গেছে তার রাখেনি কেউ খোঁজ। কিন্তু এতো বছর পরেও যে দেখা হওয়া সম্ভব তা বোধ হয় এ প্রেমিকযুগলের স্বপ্নেরও অতীত ছিল। গল্পের মতো শোনালেও সেটাই সত্য।
পেরিয়ে গিয়েছে ৭০ বছর। বদলেছে অনেক কিছু। কে, কোথায় ছিল কারও খোঁজ রাখলো না দুজনের কেউই। এভাবেই কেটে যাচ্ছিল সেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রেমিকযুগলের একাকী দিনগুলো। একদিন হঠাৎ কী যেন মনে হলো মরিসের, তিনি তার ছেলে রবকে বললেন থমাসের সাথে যোগাযোগ করার কথা। মরিস তার ছেলে রবের সাথে থমাসের কথা শেয়ার করেছিলেন। ১৯৪৪ সালের যুগ থমাস-মরিসকে আলাদা করলেও উন্নত প্রযুক্তির অবদানে ২০১৬ সালে ইন্টারনেটের যুগে তাদের আর আলাদা করা গেলো না।
মরিস রবের সহযোগিতায় স্কাইপের মাধ্যমেই যোগাযোগ করলেন থমাসের সাথে। প্রায় ঘণ্টা দুয়েক অনলাইনে কথা হয় তাদের। প্রথম কথাতেই মরিস থমাসকে ‘টমি’ নামেই সম্বোধন করেন। থমাস তখন আবেগে আপ্লুত হয়ে বলেই ফেলেন, সেদিন যদি মরিস তার কথায় স্টেটসে চলে আসতেন, তবে তারা ৭০টি বছর একসাথেই কাটাতে পারতেন। মরিস তার বুড়ো প্রেমিককে দেখার ইচ্ছে প্রকাশ করেন। কিন্তু থমাস জানান, তিনি যা রোজগার করেন, তাতে তার পক্ষে অস্ট্রেলিয়া যাওয়া সম্ভব নয়।
পরবর্তীতে এই প্রেমিকযুগলের কাহিনী ইন্টারনেটে ভাইরাল হয়ে যায় এবং শত শত মানুষের আবেদন আসে ৭ দশক আগে হারিয়ে যাওয়া যুগলকে পুনঃএকত্রিত করার উদ্দেশ্যে। একজন আগন্তুক Virginian-Pilot থেকে তাদের ঘটনা জানতে পেরে GoFundMe নামে একটি একাউন্ট খুলে তাদের জন্যে অর্থ সংগ্রহ শুরু করেন। সকলের উৎসাহে ৭,৪৪২ ডলারের ফান্ড জমা হয়। এদিকে আবার তাদের কথা প্রচার পাওয়ার পর এয়ার নিউজিল্যান্ড থমাসকে বিনামূল্যে ফার্স্ট ক্লাস টিকেটে অস্ট্রেলিয়ার অ্যাডিলেড যাওয়ার ব্যবস্থা করে দেয় যেখানে ৭ দশক পর মরিসের সাথে তার দেখা হয়।
সত্যিই সব প্রত্যাশীদের দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসান ২০১৬ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারিতেই ৭০ বছর পর এক বসন্তে ৯৩ বছরের প্রেমিকের সঙ্গে দেখা হয়েছে ৮৮ বছরের প্রেমিকার। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের যোদ্ধা নরউড থমাস অস্ট্রেলিয়া গিয়েছিলেন হারিয়ে যাওয়া প্রেমিকা জয়েস মরিসকে একবার চোখের দেখা দেখতে।
দেখা হওয়ার পূর্ব মুহুর্তে তারা দুজনেই এতটাই খুশি ছিলেন যে, দেখা হলে কী বলবেন, কী করবেন তা ভেবেই পাচ্ছিলেন না। তাদের অনুভূতি ছিল ঠিক কোনো এক বসন্তে টেমসের তীরে নতুন করে প্রেমে পড়ার মতোই। অ্যাডিলেডে তারা তিন সপ্তাহ কাটানোর পর থমাস ভার্জিনিয়াতে ফিরে গেলেন। ফিরে যাওয়ার পরেও তাদের সপ্তাহে কমপক্ষে চারবার কথা হতো, তারা আবার দেখা করার প্ল্যান সাজাতেন।
থমাস ভেবেছিলেন ১৯৯০ সালের এক প্লেন ক্রাশে মরিস মারা গেছেন, কারণ তিনি দুর্ঘটনায় মৃতদের নামের তালিকায় তার নামেরই একজনকে খুঁজে পেয়েছিলেন। সেদিন মরিস বেঁচেছিলেন হয়তোবা তাদের পুনঃসাক্ষাতের দিনটির অপেক্ষায়। তাদের দেখা হওয়ার ৮ মাস পর ডিসেম্বরের ১০ তারিখেই ৮৯ বছর বয়সে হার্ট অ্যাটাকে মারা যান জয়েস মরিস। শেষ দেখার সময়েও থমাসের নিকট মরিস ছিলেন হাসিখুশিমাখা, উচ্ছল এক জীবন্ত প্রাণের প্রতিচ্ছবি।