সম্প্রতি ভুটানের দোকলাম মালভূমি অঞ্চলে আধিপত্য স্থাপনকে কেন্দ্র করে ভারত-চীনের দ্বৈরথ সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়েই চলছে। দোকলামকে ঘিরে ভারত ও চীনের সেনাবাহিনীর মুখোমুখি অবস্থানের ফলে দু’পক্ষের মধ্যেই উত্তেজনা পৌঁছেছে চরমে। কোনো পক্ষই কাউকে ছাড় দিতে নারাজ। অভিযোগ পাল্টা অভিযোগের নিমিত্তে পরিস্থিতির উত্তালতায় জন্ম নিতে পারে আরেকটি চীন-ভারত যুদ্ধ, যার হাওয়া বাংলাদেশ কিংবা দক্ষিণ এশিয়ার সব দেশের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
বিতর্কের শুরু
২০১৭ সালের ৪ জুন চীন-ভুটান দোকালাম সীমান্তের পাশে দিয়ে একটি রাস্তা নির্মাণে ভারত চীনকে বাধা দিলে বিতর্কের সূত্রপাত হয়। ভারতের বাধা দেবার অন্যতম কারণ হিসেবে তারা দাবি করছে, রাস্তাটি সিকিম সীমান্তের খুব কাছ ঘেঁষে নির্মাণ করা হচ্ছে যা ভারতের সার্বভৌমত্বের পক্ষে ক্ষতিকর। ভৌগোলিকভাবে রাস্তাটি ভারত-ভুটান-চীন সীমান্তে জংশনের মধ্যে পড়ে যাচ্ছে। যদিও রাস্তাটি ভুটান এবং চীনের জন্য বিতর্কিত, তবে এক্ষেত্রে দিল্লি চাচ্ছে নিয়ন্ত্রণটা আসুক ভুটানের হাতেই।
রাস্তাটি নির্মিত হলে কৌশলগতভাবে অরক্ষিত ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় সাতটি প্রদেশে চীনের অধিগম্যতা সহজ হবে বলে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে ভারত। ‘চিকেনস নেক’ বিবেচিত ভারতের মূল ভূখণ্ড থেকে বিতর্কিত রাস্তাটির দূরত্ব মাত্র ২০ কিলোমিটার।
ভারতের সামরিক কর্মকর্তা এবং আঞ্চলিক বিশ্লেষক সুবির ভৌমিক বলেছেন যে তারা চীনের এই রাস্তা নির্মাণের প্রতি আপত্তি জানিয়েছেন এবং তা বন্ধ করে দিয়েছেন। এমনকি ভারতীয় বাহিনী লালটেনের নিকটবর্তী ফাঁড়ির দু’টি চীনা বাঙ্কার উড়িয়ে দিয়েছে বলেও দাবি করছেন তিনি। তবে এ ব্যাপারে চুপ থাকেনি চীনা জওয়ানেরা। একই স্থানে চীন কর্তৃক ভারতীয় সেনাদের ব্যবহৃত দুটি বাঙ্কার উড়িয়ে দেবার অভিযোগ করেছে দিল্লি।
সম্প্রতি ঘটে যাওয়া এসব ঘটনার মধ্য দিয়ে চীন-ভারত দ্বৈরথ প্রতিনিয়ত বেড়েই চলছে। দুই দেশের গণমাধ্যমও নিজেদের পক্ষে প্রচার প্রচারণা চালাচ্ছে বেশ ঢালাওভাবেই। এক্ষেত্রে বেইজিং থিম্পুর সাথে সরাসরি বিষয়টি মীমাংসা করতে চাইলেও বাধ সাধছে ভারত। অবশ্য তার কারণও খুবই স্পষ্ট। ভুটানের সাথে ভারতের সম্পর্ক বরাবরের মতোই ভাল। আর ১৯৪৯ সালে ভারত-ভুটানের প্রতিরক্ষা চুক্তি অনুযায়ী ভুটানের পররাষ্ট্র এবং প্রতিরক্ষা ইস্যু ভারতেরই দেখাশোনা করার কথা। ২০০৭ সালে কিছু বিধি পরিবর্তন করে চুক্তি পুনরায় নবায়ন করেছে ভুটান।
তেলে-বেগুনে জ্বলছে চীন ও ভারত
সার্বিক পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে দোকলাম মালভূমি থেকে দু’দেশের সেনাবাহিনী প্রত্যাহারের আহ্বান জানিয়েছেন ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ। তিনি মনে করছেন চীন জোরপূর্বক ভুটানের ভূখণ্ড দখল করতে চাইছে যেখানে বিশ্বের বেশিরভাগ দেশই ভারত তথা ভুটানের সমর্থনে আছে। এদিকে ভারতে চীনের রাষ্ট্রদূত লুয়ো ঝাউহুই শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য ভারতকে সীমান্ত থেকে নিঃশর্তে ভারতীয় সেনা প্রত্যাহার করতে বলেছেন। এ ব্যাপারে চীনের কঠোর ভূমিকা প্রকাশ পেয়েছে তাদের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র উ কিয়ানের বক্তব্যে। চীনের সেনাবাহিনী নড়ানোর চেয়ে পর্বত নড়ানো সহজ বলে হুশিয়ার করেছেন উ কিয়ান। এভাবে দু’পক্ষই শক্ত অবস্থান ধরে রাখতে চাইছে।
দু’পক্ষের মুখোমুখি অবস্থানের ফলে ১৯৬২ সালের চীন-ভারত সীমান্ত যুদ্ধের কথাও উঠে আসছে। ১৯৬২ সালের ভারত এবং বর্তমান ভারত এক নয় বলে চীনকে সতর্ক করেছেন ভারতের প্রতিরক্ষা ও অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি। তিনি মনে করছেন চীনের এ আগ্রাসন ভারতের প্রাদেশিক অখণ্ডতা বজায় রাখার পরিপন্থী। পাল্টা জবাবে পিছিয়ে নেই চীনও। ৬২’র যুদ্ধে ভারতের পরাজয়ের কথা মনে করিয়ে দিয়ে ভারতকেও সতর্ক করে দিয়েছে তারা। ১৯৬২’র চাইতেও নিজেদের অনেক বেশি শক্তিশালী হিসেবে দাবি করছে বেইজিং।
ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণে চীনের চাইতে সুবিধাজনক অবস্থায় আছে ভারত। কারণ সিকিম অঞ্চলটি চীনের নিকটতম ভূখণ্ডের চাইতে বেশ উঁচু। এতে করে ভারতীয় সেনাবাহিনী যেকোনো সময়ে অতর্কিত হামলা করে চীনা সামরিক বাহিনীকে কাবু করতে পারবে সহজেই। এবং চীনারা ভারতের এই প্রাকৃতিক অনুগ্রহ নষ্ট করতে চায় বলে মনে করছেন ভারতের অবসর প্রাপ্ত মেজর জেনারেল গগনজিৎ সিং।
তবে ভারতের প্রাকৃতিক অবস্থানগত এ সুবিধা কতটা কাজে আসবে তা সময়ই বলে দেবে। কারণ এই সুবিধা হিতে বিপরীত হতে যাচ্ছে ভারতের জন্যই। দোকলামে ভারতের সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপের মাধ্যমে রাস্তা নির্মাণ কাজ বন্ধ হওয়ায় এটিকে চীনের সার্বভৌমত্বের পক্ষে ক্ষতিকর দাবি করেছে চীন। একইসাথে সেসব ভারতীয় সেনাদের অনুপ্রবেশকারী হিসেবে আখ্যায়িত করেছে তারা। পাশাপাশি চীনের গ্লোবাল টাইমস বলছে ভারত ভুটানের নিজস্ব ভূখণ্ড রক্ষার প্রশ্নে সহায়তা করতে পারে, কিন্তু বিতর্কিত অঞ্চলের প্রশ্নে নয়। এবং রাস্তা নির্মাণে ভারতের এই হস্তক্ষেপকে ভুটানের সার্বভৌমত্বের জন্যও হুমকিস্বরূপ মনে করছেন তারা।
এমতাবস্থায় পরিস্থিতি ভারতের জন্য আরও সংবেদনশীল ও চাঞ্চল্যকর হতে চলেছে। কেননা চীন-ভুটান সম্পর্কের মাঝে ভারতের এই হস্তক্ষেপ মোটেই ভারত-ভুটান-চীন পর্যন্ত সীমাবদ্ধ নেই। তা চলে গেছে সুদূর কাশ্মীর পর্যন্ত। গ্লোবাল টাইমসের ভাষ্য অনুসারে, ভারত যদি ভুটান-চীন সম্পর্কের মাঝে নাক গলাতে পারে, তবে ভারত-পাকিস্তান-কাশ্মীর ইস্যুতে তৃতীয় কোনো পক্ষ যে কারো পক্ষপাতিত্ব করতেই পারে। ভারতের যুক্তি অনুসারেই পাক-ভারত বিতর্কিত অঞ্চলে অন্য দেশের সেনাবাহিনী প্রবেশের যৌক্তিকতা তৈরি হয় বলে দাবি তাদের।
বিপাকে ভুটান
থিম্পু শুরু থেকেই বেইজিংকে এই রাস্তা নির্মাণ বন্ধের আবেদন জানিয়ে আসছে। চীনের রাস্তা নির্মাণের এই প্রয়াসের মাধ্যমে দুই দেশের চুক্তি ভঙ্গ হয়েছে বলে মনে করছেন দিল্লিস্থ ভুটানের রাষ্ট্রদূত বাস্তব নামগায়েল। ভুটানের নিরাপত্তা বিশ্লেষক জয়দিপ সাইকি বিবিসিকে বলেছেন, সার্বভৌমত্ব ইস্যুকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে চীন নেপালের মতো তাদেরকেও নিজেদের দিকে ভিড়াতে চাইছে এবং সরাসরি থিম্পুতে যোগাযোগ স্থাপনের চেষ্টা চালাচ্ছে।
দোকলাম ইস্যুতে ভুটান নিজেরাই নিজেদের সমস্যা সমাধান করতে চাইছে বলে মনে হচ্ছে। এমনকি দোকলামে ভুটানের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায় ভারতের এই চাপাচাপিকে ভারতের স্বার্থ হিসেবেই দেখছেন তারা। অন্তত ভুটানের আইনজীবী ওয়াংচা সাংগ এমনটাই মনে করছেন। সাউথ এশিয়া মনিটরে দেয়া মতামতে তিনি লিখেছেন, দোকলামসহ ভুটানের প্রতিটি স্থানই তাদের জন্য সমান গুরুত্ববহ এবং পবিত্র। প্রতিটি স্থানের গুরুত্বই তাদের কাছে সমান। এক্ষেত্রে সিকিম এবং দোকলাম যথাক্রমে ভারত ও চীনের জন্য সমান গুরুত্ব ও তাৎপর্যপূর্ণ উল্লেখ করে তিনি দু’পক্ষকেই বাস্তবতা মেনে নেবার আহ্বান জানান।
পরিশেষ
দোকলাম ইস্যুকে কেন্দ্র করে হিন্দুদের তীর্থস্থান তিব্বতের নাথুলা অভিমুখে গমনকারী ৫০ তীর্থযাত্রীকে ফিরিয়ে দিয়েছে চীন। দোকলাম (চীনের ভাষায় দংলাং) থেকে ভারতীয় সৈন্য প্রত্যাহার না করা পর্যন্ত সীমান্ত বন্ধ থাকবে বলে ঘোষণা করলেও পরবর্তীতে রুট পরিবর্তন করে তাদের ভ্রমণের সুযোগ দিয়েছে বেইজিং।
অতি সম্প্রতি ব্রিকসভুক্ত দেশের সম্মেলনে ভারতের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবং চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং-এর সাক্ষাৎ হয়। সাক্ষাতে একে অন্যের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করলেও দোকলাম ইস্যু নিয়ে কোনো কথা হয়নি বলে জানা গেছে। অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষক মনে করছেন চীন-ভারতের এ দ্বৈরথ শীতল যুদ্ধের দিকে এগোচ্ছে।
২০০৮ সালের নভেম্বরে দোকলাম নিকটবর্তী ভারত-ভুটান-চীন জংশনের ভারতীয় সীমান্তে অবস্থিত দুটি ভারতীয় বাঙ্কার উড়িয়ে দেয় চীনা সৈন্যরা। এর আগেও বেশ কয়েকবার সীমান্তে উত্তেজনা সৃষ্টি হয় দু’দেশের মধ্যে এবং এখন পর্যন্ত চীন-ভারত দ্বৈরথের অন্যতম কারণ হচ্ছে দু’দেশের মধ্যবর্তী বিতর্কিত সীমান্ত। মাঝে বেশ কয়েকবার চীনা সৈন্য কর্তৃক ভারতীয় ভূখণ্ড দখলের খবরও শোনা গেছে। তবে পরবর্তীতে তা কূটনৈতিক আলোচনার মাধ্যমে মীমাংসা করা হয়।
সঙ্কট কাটাতে এ মুহূর্তে আলোচনার টেবিলে বসার বিকল্প কিছুই নেই। অনর্থক বিলম্বের ফলে সেখানে নাক গলাতে পারে তৃতীয় কোনো শক্তি যা দু’দেশের কারোর জন্যেই মঙ্গলজনক হবে না বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা। এখন দেখবার বিষয় কীভাবে এবং কতদিনে এই সঙ্কটের নিরসন ঘটে।