পানি আমাদের দৈনন্দিন জীবনের এক অতি প্রয়োজনীয় উপাদানের নাম। বলা হয় ‘পানির অপর নাম জীবন’। পৃথিবীর বাইরে অন্য কোনও গ্রহ মানব বসতির উপযুক্ত কি না তার খোঁজ চলছে। সেই অভিযানে প্রথমেই খুঁজে দেখা হচ্ছে সেই গ্রহে পানি আছে কি না বা থাকার সম্ভাবনা আছে কি না। সুতরাং বোঝাই যাচ্ছে, পানি মানব সভ্যতার এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। পানি আমাদের বেঁচে থাকার জন্য অতি প্রয়োজনীয় হলেও পানীয় জলের তীব্র সংকট পুরো পৃথিবীব্যাপী।
অতি সম্প্রতি ভারতের তামিলনাড়ু রাজ্যে দেখা দিয়েছে তীব্র পানি সংকট। গ্রীষ্মের খরতাপের মাঝেও সেখানে জনগণ অতিষ্ঠ পানীয় জলের অভাবে। গোসলের পানি নেই, খাবার পানি নেই, পানির জন্য লাইন ধরে অপেক্ষারত মানুষ মারামারি করছে, এমনকি পানির অভাবে রেস্তোরাঁগুলোও বন্ধ হওয়ার উপক্রম। চারদিকে পানির জন্য হাহাকার। এমনই কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি তামিল নাড়ু রাজ্যের রাজধানী চেন্নাই শহর।
তামিল নাড়ু রাজ্যের রাজধানী চেন্নাই এখন দক্ষিণ ভারতের অর্থনৈতিক হাবে পরিণত হওয়ার স্বপ্নে বিভোর। আধুনিকতার ছোঁয়া লেগেছে শহরটির চেহারায়। শহরটিতে এরই মধ্যে অনেক উন্নয়ন হয়েছে। বিস্তর অবকাঠামোগত উন্নয়ন কাজ করা হয়েছে শহরটিকে ঘিরে। এতে এর প্রাকৃতিক পরিবেশ-প্রতিবেশের উপর ব্যাপক প্রভাব পড়েছে।
আশির দশকে এখানে ব্যাপক উন্নয়নকাজ শুরু হয়, যা পরবর্তীতেও চলতে থাকে। এতে চেন্নাইয়ের প্রাকৃতিক জলভূমি ক্ষতিগ্রস্থ হয় এবং ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নামতে থাকে। ১৯৮০ সাল থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত সেখানে এত উন্নয়নমূলক নির্মাণকাজ আর ভবন নির্মাণ হয়েছে যে শহরের সীমানা ৪৭ বর্গ কিলোমিটার থেকে বেড়ে ৪০২ বর্গ কিলোমিটারে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। সেই সাথে শহরের জলবেষ্টিত এলাকার পরিমাণ ১৮৬ বর্গ কিলোমিটার থেকে কমে গিয়ে ৭১.৫ বর্গ কিলোমিটারে পৌঁছেছে। পরিবেশের উপর এই চাপ শহরটির জলবায়ুর ও আবহাওয়ার উপর বিরুপ প্রভাব ফেলে দিয়েছে। স্বাভাবিক বৃষ্টিপাতের চক্র ক্ষতিগ্রস্থ হওয়ায় চেন্নাইয়ে প্রায়ই অতিবৃষ্টি, খরা বা বন্যা স্বাভাবিক রুপ লাভ করেছে।
ঐতিহাসিকভাবে চেন্নাইয়ের কৃষিভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল পানিকে কেন্দ্র করে। ফলে প্রতি গ্রামেই ছিল একাধিক ‘ইরি’ বা কুয়া। তামিল নাড়ুর তিন জেলা চেন্নাই, থিরুভাল্লোর আর কাঞ্চিপুরামেই ছিল প্রায় ছয় হাজার কুয়া, যার কোনো কোনোটা ১,৫০০ বছরেরও অধিক পুরনো। কিন্তু উন্নয়ন আর নগরায়নের ধাক্কায় সেসব আর টিকে থাকতে পারেনি।
১৮৭৬ সালের মাদ্রাজ দুর্ভিক্ষের সময় ব্রিটিশ কমান্ডার পুঝাল গ্রামের একটি ছোট ইরিকে ব্যাপকভাবে সম্প্রসারিত করে চেন্নাই শহরের খাবার পানির সরবরাহকারী রিজার্ভার বা জলাধারে পরিণত করেন। পরে রিজার্ভারটির নাম হয় ‘রেড হিলস রিজার্ভার’। সেটাই ছিল চেন্নাই শহরের জন্য বানানো প্রথম খাবার পানি সরবরাহকারী প্রজেক্ট। আর সে থেকেই শহরের লোকজন দূরবর্তী পানির উৎসের উপর নির্ভর করে শহরের ভেতরে থাকা জলাধার আর ছোট ছোট জলবেষ্টিত জায়গাগুলোকে ভরাট করে গড়ে তোলে ভবন আর অন্যান্য স্থাপনা।
উদাহরণ হিসেবে বলা যায় প্রাচীন ‘মাইলাপোর ট্যাংক’ এর কথা। ৭০ একর আয়তনের এই ট্যাংকটির পুরোটা ১৯২০ সালে ভরাট করে সেখানে গড়ে ওঠে আজকের আবাসিক এবং বাণিজ্যিক এলাকা ‘টি নাগার’। এতে যেমন পানির উৎসের উপর আঘাত আসে, তেমনি প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট হয়ে জলবায়ুর উপর প্রভাব পড়া শুরু হয়।
উত্তর-পূর্বীয় মৌসুমী বায়ু যা এ অঞ্চলে বৃষ্টিপাত নিয়ে আসে তা এখন অনিশ্চিত এবং অনেকটাই অনিয়মিত হয়ে পড়েছে। অথচ এটি সাধারণত অক্টোবর থেকে নভেম্বরে চলে আসার কথা। কিন্তু ২০১৮ সালের ঐ সময়কাল চেন্নাইয়ের ইতিহাসে অন্যতম শুকনো মৌসুম হিসাবে রেকর্ড করা হয়।
বর্তমানে চেন্নাই শহর যে চারটি প্রধান জলাধার এর উপর নির্ভরশীল তা খরা এবং মৌসুমী বৃষ্টির অভাবে শুকিয়ে গেছে এবং ভূগর্ভস্থ পানির স্তর অনেক বেশি নিচে নেমে যাওয়াই মূলত এই তীব্র পানি সঙ্কটের কারণ।
চেন্নাই শহরটি রেড হিলস, চোলাভরম, পুন্ডি এবং চেম্বারামবাক্কাম নামক চারটি প্রধান জলাধার এর উপর নির্ভরশীল। জলাধারগুলোর পানির মূল উৎস সেখানে হওয়া বার্ষিক মৌসূমী বৃষ্টিপাত। ২০১৮ সালে সেখানে পরিমাণের তুলনায় খুবই কম বৃষ্টিপাত হয়। যার ফলে দেখা দিয়েছে এই তীব্র পানীয় জলের সংকট। যেখানে গড়ে ৭৫৭.৬ মিলিমিটার বাৎসরিক বৃষ্টিপাত হয় সেখানে ২০১৮ সালে চেন্নাইয়ে মাত্র ৩৪৩.৭ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। যা স্বাভাবিকের তুলনায় ৫৫ শতাংশ কম। তাছাড়া ২০১৭ সালেও চেন্নাইয়ে স্বাভাবিকের চেয়ে কম বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছিল। গত দুই বছরের এই অস্বাভাবিক বৃষ্টিপাতের ফলে শহরের প্রধান চারটিসহ অন্যান্য জলাধারগুলো শুকিয়ে এসেছে।
২০১৯ সালের ১৯ জুনকে চেন্নাই সিটির পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে ‘ডে জিরো’ হিসেবে ঘোষণা দেয়া হয়। এ দিনে শহরের প্রধান চারটি রিজার্ভার বা জলাধারই পুরোপুরি শুকিয়ে যায় এবং প্রায় কোনো পানি জলাধারগুলোতে ছিল না।
অবস্থা এমনই দাঁড়িয়েছে যে, আবাসিক হোটেল বন্ধ করে দেয়া হচ্ছে, অথবা বোর্ডারদের মাঝে পানি রেশনিং করা হচ্ছে। চেন্নাই মেট্রো স্টেশনগুলোতে এয়ার কন্ডিশন বন্ধ করে দেয়া হয়েছে পানি বাঁচাতে। অফিস-আদালতে চাকরিজীবীদের বাড়িতে বসে কাজ করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে যাতে পানি বাঁচানো যায়। কিন্তু এতেই কি সমাধান হচ্ছে? হচ্ছে না, কারণ বাসা-বাড়িতেও তো একই সংকট।
এই সংকটে সাধারণ জনগনের পানির চাহিদা মেটাচ্ছে চেন্নাই মেট্রো ওয়াটার আর কিছু প্রাইভেট পানি সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের ট্যাংকার। কিন্তু প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানের পানির উচ্চমূল্য সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে। তাই সরকারি পানির ট্যাংকারের সামনেই অধিকাংশ মানুষের ভীড়। লাইন দিয়ে মানুষ পানির জন্য অপেক্ষা করছে- শহরের সর্বত্রই এখন এই চিত্র দেখা যাচ্ছে।
শহরের আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতিতেও পানির অভাবের প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। পানি নিয়ে বিবাদে জড়িয়ে এক ব্যক্তি তার প্রতিবেশীকে ছুরিকাঘাত করায় তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
সংকট কিছুটা কাটিয়ে উঠতে ভারত সরকার একটি বিশেষ ট্রেনের ব্যবস্থা করেছে। চলতি বছরের ১২ জুলাই এই বিশেষ ট্রেনটি পঁচিশ লক্ষাধিক লিটার পানি নিয়ে চেন্নাইয়ের রেল স্টেশনে পৌঁছে। নতুন এই ট্রেন সার্ভিসটি চেন্নাই শহর থেকে ৩৬০ কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত একটি ড্যাম থেকে প্রতিদিন প্রায় দশ মিলিয়ন লিটার পানি চেন্নাই শহরে নিয়ে আসবে। ট্রেন সার্ভিসটি যতদিন না এই সংকট কাটিয়ে ওঠা যাচ্ছে ততদিন চলতে থাকবে।
বলা হয়ে থাকে, যদি তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয় তাহলে তা হবে পানিকে কেন্দ্র করে। বিশ্বব্যাপী পানির সংকট আজ সর্বজনস্বীকৃত। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম কর্তৃক ২০১৯ সালে পানি সংকটকে বিশ্বের জন্য অন্যতম বৃহত্তম ঝুঁকি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
পৃথিবীর মোট পানির মাত্র ০.০১৪ শতাংশ পানি পানোপযোগী ও সহজলভ্য, বাকি ৯৭ শতাংশ পানিসম্পদ পানযোগ্য নয়। সুতরাং বোঝাই যাচ্ছে পানীয় জলের এই অনুপাত কোনোভাবেই পৃথিবীর এই বর্ধিষ্ণু জনসংখ্যার অনুপাতে যথেষ্ট নয়। সমস্যা এখানেই, তাহলে কি সত্যি আমরা পানি নিয়ে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়বো? এই সংকেতই কি পাচ্ছি আমরা এই সংকটের মাধ্যমে?