(পর্ব ৫ এর পর থেকে)
কোভিডের শুরু থেকে ইউক্রেন ও বিচ্ছিন্নতাবাদী অঞ্চলের মধ্যে মাত্র একটা চেকপয়েন্ট সবসময় খোলা ছিল। এটার অবস্থান পিসকির ৯০ মাইল উত্তর-পূর্বে স্ট্যানিৎসিয়া লুহানস্কা শহরে। এটা এলপিআরের বাইরে রুশ সীমান্তের কাছে রেড জোনের সবচেয়ে উত্তরের অংশে অবস্থিত। যুদ্ধের শুরুর দিকে স্ট্যানিৎসিয়ার এক ধ্বংস হয়ে যাওয়া সেতুর ওপর বেসামরিক মানুষজনের ছবি বিশ্বজুড়ে প্রচার করা হয়। এটা যেন সারায়েভোর কথা মনে করিয়ে দিচ্ছিল।
আমি যখন আগস্টে স্ট্যানিৎসিয়া লুহানস্কাতে যাই, তখন আমার কাছে স্নায়ুযুদ্ধের সময়ের জার্মানির কথা মনে পড়ে। সীমান্তের চেকপয়েন্টের সামনে ছিল এক বিশাল সাদা স্মৃতিস্তম্ভ, যাতে ছিল একটা লাল সোভিয়েত তারকা। সেখানের ফলকে লেখা, “অত্র গ্রামে ১৯৪২ সালে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ২৪২ যুদ্ধবন্দির সম্মানে।” চেকপয়েন্টটাকে ফ্রন্টের অন্যান্য জায়গার মতো নতুন করে সাজানো হয়েছে। সেতুটাও সংস্কার করা হয়েছে। কার্গো কন্টেইনার রাখার জায়গাগুলো এটিএম মেশিন, এনজিও অফিস, ক্যাফে দিয়ে প্রতিস্থাপন করা হয়েছে। ট্যাক্সি চালকরা অপেক্ষা করছে যাত্রীর জন্য।
চেকপয়েন্টের ইউক্রেন অংশে মানুষজনের ভিড় দেখা গেল, যারা এলপিআরে প্রবেশের অপেক্ষা করছে। তবে বেশিরভাগ লোকই ছিল এলপিআর থেকে ইউক্রেনে আসার পথে। তারা আসছিল পরিবারের খোঁজ নিতে, তাদের সম্পত্তির খোঁজ নিতে, কেউ বা আসছিল কেনাকাটা করতে। ইউক্রেন অংশে পণ্যের দাম কম, মানেও তুলনামূলক ভালো।
একটা ক্যাফেতে এক পরিবারকে দেখলাম মিনিবাসের জন্য অপেক্ষা করছেন। বাবা-মায়ের হাতে ছিল ব্যাগ, একটা বড় পানির বোতল আর একটা প্লাস্টিকের ব্যাগে রাখা স্ন্যাকস। তারা সতর্কতার সাথে তাদের ছোট ছেলে আর মেয়েকে নিয়ে একটা ছাতা আকৃতির টেবিলে বসা ছিল। মা পরিচয় দিলেন তার নাম মারিয়া। তারা যাচ্ছিলেন সেভেরোদনেৎস্কে তাদের এক আত্মীয়ের বাড়িতে। তারা লুহানস্ক থেকে বের হওয়ার জন্য তিন ঘণ্টা অপেক্ষা করেছিলেন। সেখানেই থাকতেন তারা।
তার ছেলের হাতে একটা ছোট গিটারের কেস দেখলাম। আমি এটা নিয়ে জানতে চাইলে তিনি বললেন, ও পিয়ানো বাজানোও শিখছিল। সে ইউক্রেনীয় দেশাত্ববোধক গান বাজাতে পছন্দ করে। এটা শুনে ছেলেটা মনে হলো ভয় পেল। আমি এবার খেয়াল করলাম তার বোনও ভীত হয়ে গেল।
মারিয়া তখন বললেন, “সত্যি কথা বলতে আমরা আর ফিরে যেতে চাই না। আমাদের জন্য লুহানস্ক ছেড়ে যাওয়াটাই কল্যাণকর হবে।”
তাকে দেখে মনে হচ্ছিল অনেক দিন ধরে কথাগুলো মনের মধ্যে পুষে ছিলেন কাউকে বলার জন্য। এখন বলতে পেরে তাকে খুব নির্ভার লাগছিল। আমি জিজ্ঞেস করি কেন তারা চলে যেতে যান। মারিয়া কোনো দ্বিধা ছাড়াই সন্তানদের তাকিয়ে বলেন, “এদের ভবিষ্যতের জন্য।”
তার স্বামী আমার দিকে অস্বস্তি নিয়ে তাকালেন। তার ভাবভঙ্গি দেখে পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছিল, মারিয়ার সাথে আমার কথা বলা পছন্দ করছেন না। কিন্তু তিনি কিছু বলার আগেই তাদের মিনিবাস এসে পৌঁছে গেল। আমি ও আমার দোভাষী তাদের প্রস্তাব দিলাম আমরাই তাদের ড্রাইভ করে নিয়ে যাব সেভেরোদনেৎস্কে। তারা চাইলে টিকিট রিফান্ড করতে পারে। তখন তার স্বামীও রাজি হয়ে গেলেন সাথে সাথে। তারা তাদের সব অর্থ পালানোর পেছনে খরচ করে ফেলেছে। এখন যত অতিরিক্ত নগদ অর্থ সাথে রাখতে পারে, ততই তাদের লাভ।
আমরা ড্রাইভ করতে করতে মারিয়ার গল্প শুনছিলাম। মারিয়া জানালেন- তারা কয়েক বছর ধরেই পালানোর চিন্তা করছিলেন। তারা তাদের অবস্থান ধাপে ধাপে পরিবর্তন করছিলেন। শেষ পর্যায়ে তারা মধ্য ইউক্রেনের এক শহরে একটা অ্যাপার্টমেন্ট কিনে নেন। তারা এর আগে কখনো সেখানে যাননি। তারা জায়গাটা শুধু মানচিত্রে দেখেছেন। এটা একটা শিল্পকেন্দ্রের কাছে। তিনি আশা করছেন তার স্বামী ওলেকসান্দার সেখানকার কোনো বিদ্যুৎ কেন্দ্রে কাজ জোটাতে পারবেন।
লুহানস্কে তিনি ছিলেন এক খনি শ্রমিক। তার খনি বন্ধ হয়ে গেলে তিনি কাজ করতে যান একটা অবৈধ উন্মুক্ত খনিতে। সেখানে কাজ করা ছিল ভয়াবহ বিপজ্জনক। তার অনেক বন্ধুর মৃত্যুও হয়েছে সেখানে। মারিয়া ছিলেন এক ফ্রিল্যান্স টিউটর। তার বাবার পাওয়া পেনসন ও তাদের জমানো অর্থ দিয়ে নতুন বাড়ির কেবল ডাউন পেমেন্ট দিতে সমর্থ হয়েছিলেন তারা। তিনি তাদের ১০ বছর বয়সী ছেলে আন্দ্রি ও ৬ বছর বয়সী মেয়ে কিরাকে এক স্কুলে ভর্তি করে দিয়েছেন।
চেকপয়েন্ট থেকে আমরা যত দূরে যাচ্ছিলাম, ভবিষ্যৎ নিয়ে মারিয়ার কথায় ততই উত্তেজনা প্রকাশ পাচ্ছিল। একইসাথে লুহানস্কের অপমানজনক জীবন নিয়েও কথা চলে আসলো। তিনি বলেন, “লুহানস্কের সবকিছুর অবস্থাই খুব জরাজীর্ণ। সেখানে আপনি সুস্থ আর অবস্থাসম্পন্ন লোককে নিলেও তারা একেকটা নেশাখোরে পরিণত হবে।”
সেখানকার কর্মক্ষেত্রের বেতন হয়ে গেছে যুদ্ধের সময়কার চেয়ে অনেক কম। জিনিসপত্রের দামও অনেক বেশি। বিদ্যুৎ বিভ্রাট আর খাবারের সঙ্কট খুবই সাধারণ ঘটনা। আসলে সবকিছুরই অভাব সেখানে। যেসব পণ্য পাওয়া যায়, সেগুলো মূলত রাশিয়ার পরিত্যক্ত মাল। এমনকি খাবারের জন্য মানুষের লাইনও দেখা যায় সেখানে। এ যেন সোভিয়েত আমলের সবচেয়ে বাজে সময়গুলোর স্মৃতি মনে করিয়ে দেয়। জনগণের জন্য সরকারি সেবামূলক কার্যক্রমের অবনতি হয়েছে কিংবা একেবারেই বিলীন হয়ে গেছে। রাস্তায় বর্জ্য জমা হয়ে পড়ে থাকে। হাসপাতালগুলোও অকেজো হয়ে যাচ্ছে। অনেক ডাক্তার পালিয়ে গেছে কিংবা কোভিডে মৃত্যুবরণ করেছে।
মারিয়ার বেশিরভাগ পরিচিত মানুষজন, এমনকি তার পরিবারের অনেক সদস্যও রাশিয়ার প্রতি অন্ধ আনুগত্য প্রকাশ করে। তারা এ দুর্দশার জন্য ইউক্রেনকে দায়ী করে। মারিয়া তাদেরকে তুলনা করছিলেন স্বামীর নির্যাতনের শিকার হওয়া বধূর সাথে। রাশিয়া তাদের যতই অত্যাচার করুক, তারা ততই রাশিয়ার কাছে ছুটে যায়।
সেখানকার সর্বস্তরে বিরাজ করছিল রাশিয়ার প্রোপাগান্ডা। কিরা আর তার ক্লাসমেটদেরকে নার্সারি স্কুল থেকেই মিলিটারি ইউনিফর্ম পরে সোভিয়েত আমলে যুদ্ধের সঙ্গীত গাইতে হতো। কিরা ছিল ‘ওয়ার বেবি’। তার জন্ম হয়েছে এই দখলদারদের সময়ে। সে এর বাইরের দুনিয়া সম্পর্কে কিছু জানে না। প্রতিদিন তার চোখের সামনে বন্দুক দেখে অভ্যস্ত। তার নার্সারি স্কুলের বাইরে অস্ত্রধারী গার্ডরা ট্রিগারে আঙ্গুল দেওয়া অবস্থায় থাকত। মারিয়া বলে ওঠেন, “একটা নার্সারি স্কুলের সামনে তাদেরকে কেন ট্রিগারে আঙ্গুল দিয়ে থাকতে হবে?”
আন্দ্রিই যুদ্ধের আগের সময়টা অল্প অল্প মনে করতে পারে। রাতে তার ঘুম হয় না। সবসময়ই ভীতসন্ত্রস্ত থাকে। এমনকি প্যারানয়েডও হয়ে যায়। মারিয়া যখন বাড়িতে ইউক্রেনীয় সঙ্গীত বাজাতেন, আন্দ্রিই তখন দৌড়ে সব জানালা বন্ধ করে দিত, আর মাকে অনুরোধ করত গান বন্ধ করার জন্য। তার ভয় ছিল বাইরের কেউ তাদের গান বাজানোর আওয়াজ শুনে ফেলবে।
মারিয়ার সমস্যাটা ঘুম নিয়ে ছিল না। তবে তার ঘুমের মাঝে একই দুঃস্বপ্ন বার বার ফিরে আসত। এক লোক তার দিকে রকেট চালিত গ্রেনেড তাক করে আছে। তিনি চিৎকার করে বলেন, “গুলি করো! গুলি করো আমাকে!” লোকটি ট্রিগারে টান দেয়। তার ঘুম ভেঙে যায়।
আন্দ্রিই আর কিরা আমাদের কথা শুনছিল। তারা বিড়বিড় করে বাবা-মায়ের কাছে প্রশ্ন করছিল। তাদেরকেও দেখে নিশ্চিন্ত মনে হচ্ছিল। আন্দ্রিই জানালা দিয়ে বাইরে তাকালো। তার দৃষ্টির মাঝে খুব একটা বিস্ময় ছিল না। অন্যদিকে কিরা একটা বড় চকলেট বার চর্বণ করছিল।
কিন্তু ওলেকসান্দারকে দেখে মনমরা মনে হচ্ছিল। মারিয়ার মতো লুহানস্কের জীবন নিয়ে তার কোনো ঘৃণা ছিল না। মারিয়া জানান, সেখানকার স্বাধীনতা না থাকার ব্যাপারটা নিয়ে তার কোনো মাথা ব্যথা ছিল না। তার কণ্ঠে একই সাথে ভালোবাসা আর ক্রোধের মিশ্রণ টের পেলাম। মারিয়া তার স্বামীকে কৌতুক করে “বিচ্ছিন্নতাবাদী”ও ডাকলেন। তিনি এ প্রসঙ্গে কোনো তর্ক করেননি। তিনি খুব একটা কথা বলেননি। শুধু তাদের ফেলে আসা সময় নিয়ে মারিয়ার কিছু অভিযোগের ব্যাপারে প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছিলেন। তিনি ৪০ বছর বয়সে আবার সবকিছু নতুনভাবে শুরু করা নিয়ে চিন্তিত ছিলেন।
লুহানস্কে তখনো তাদের একটা বাড়ি আর গাড়ি ছিল। ওলেকসান্দারের মা তখনো সেখানে ছিলেন। কর্তৃপক্ষ যদি তাদের পালানোর খবর টের পায়, তবে তার মায়ের কী হবে তিনি শুনেছেন, পালিয়ে যাওয়াদের পরিবারের সদস্যদের মাসের পর মাস, এমনকি বছর ধরেও জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। অনেকেই গুম হয়ে যায়।
মারিয়া জানান, সেখানে রাশিয়া নিয়ে কোনো সমালোচনা করা যায় না। এমনকি ইন্টারনেটেও করা যায় না। সবাই খুব ভীত। আমি জানতে চাইলাম, সমালোচনা করলে কী হয়। ওলেকসান্দার উত্তর দিলেন,
“তারা তখন আপনাকে তাদের একটা বেসমেন্টে নিয়ে যাবে।”
মারিয়া তার জীবনের গল্পগুলো বলে নিজেকে ভারমুক্ত করেছিলেন, কিন্তু সতর্ক থাকতে ভোলেননি। তিনি আমাকে তাদের পারিবারিক নামটা জানাননি। আমরা যখন সেভেরোদনেৎস্কে পৌঁছালাম, তিনি আমাদের বললেন তাদেরকে একটা ব্যাংকের সামনে নামিয়ে দিতে। তিনি আমাকে জানতে দিতে চাননি তারা কোথায় থাকছেন।
ওলেকসান্দার গাড়ি থেকে নেমে হ্যান্ডশেক করে আমাকে বললেন, “আপনাকে যদি কোনো সারনেম ব্যবহার করতেই হয়, তবে লিখে দেবেন ইভানভ। তাহলে আমার যদি কখনো সেখানে ফিরে যাওয়ার প্রয়োজন হয়, তারা আমাকে গুলি করে মারবে না।”
(পরবর্তী অংশ পর্ব ৭-এ)