Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

বাংলাদেশ প্রসঙ্গে চীন-ভারত দ্বন্দ্ব

আয়তনে অত্যন্ত ক্ষুদ্র একটি দেশ, বাংলাদেশ। অর্থনৈতিকভাবে খুব বেশি সমৃদ্ধও নয়। দেশের সিংহভাগ মানুষ এখনো দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে। এমন একটি দেশের প্রতি পৃথিবীর অন্যান্য দেশের তেমন কৌতূহল না থাকবার কথা। কিন্তু বাস্তব পরিস্থিতি অন্যরকম।

পৃথিবীর সর্ববৃহৎ উপসাগর, বঙ্গোপসাগর। ভারত যেভাবে এগিয়ে যাচ্ছে, সে পথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা বজায় রাখার ক্ষেত্রে বহির্বিশ্বের জন্য বাংলাদেশের বঙ্গোপসাগর খুবই তাৎপর্যপূর্ণ একটি স্থান। যেকোনো পরাশক্তিই বঙ্গোপসাগরকে নিজের আয়ত্তে রাখতে চাইবে। এক্ষেত্রে অবশ্য এশিয়ার আরেক মহারথি চীন সবচেয়ে বেশি এগিয়ে। সম্প্রতি ঘটে যাওয়া নানা ঘটনা চীন-ভারত উত্তেজনার পালে হাওয়া দিয়ে গেছে। চীন এবং ভারতের রাজনৈতিক সমীকরণের মাঝে বাংলাদেশের অবস্থান প্রাকৃত।

ভারতের সাথে চীনের রয়েছে পুরনো হিসাব-নিকাশ; Source: eurasiantimes.com

অতি সম্প্রতি ভারত এবং চীন উভয়েই বাংলাদেশের সাথে সম্পর্ক উন্নয়নের চেষ্টা করছে। অবশ্য শুধু চীন বললেও ভুল হয় না, কারণ পার্শ্ববর্তী দেশ হিসেবে ভারতের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক নানাভাবেই উন্নীত হয়ে আছে। ইদানীং চীনের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক উন্নয়ন হতে দেখে শঙ্কা বেড়েছে ভারতের। তাই তারা নতুন উদ্যমে চেষ্টা করে যাচ্ছে বলে মনে করছেন বিবিসি সাংবাদিক মোয়াজ্জেম হোসেন।

ইস্ট এশিয়া ফোরামে ফরেস্ট কুকসন এবং টম ফেলিক্স জোয়েনক নামে দুজন অস্ট্রেলিয়ান গবেষণা প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে ‘China and India’s geopolitical tug of war for Bangladesh’ শিরোনামে একটি নিবন্ধ প্রকাশ করেছে, যার বাংলা অর্থ দাঁড়ায়, ‘বাংলাদেশ নিয়ে চীন এবং ভারতের ভূ-রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব যুদ্ধ’। এটি প্রকাশের কিছুদিন পরপরই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক ওয়ার্ল্ড পলিটিক্স রিভিউয়ে প্রকাশিত হয় ‘Why India and China Are Competing for Better Ties With Bangladesh’ (বাংলাদেশের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক গড়তে কেন ভারত আর চীনের মধ্যে এত প্রতিদ্বন্দ্বিতা?) শীর্ষক আরেকটি মতামত। উড্রো উইলসন ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর স্কলারসের মাইকেল কুগেলম্যান তার এই মতামতটি প্রকাশ করেন।

বাংলাদেশ প্রশ্নে চীন এবং ভারতের অবস্থান নিয়ে সমগ্র বিশ্ব সর্বদা সরব, অল্প কিছুদিনের মধ্যেই প্রকাশিত দুটি নিবন্ধ স্পষ্টভাবেই তা প্রমাণ করে। উপরোক্ত নিবন্ধ দুটিতে রয়েছে বাংলাদেশ প্রসঙ্গে ভারত এবং চীন সম্পর্কে কিছু পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণ।

বাংলাদেশ নিয়ে চীন এবং ভারতের ভূ-রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব যুদ্ধ

ভারতের সরকারের দৃষ্টিতে জাতীয় নিরাপত্তা, রাজনৈতিক এবং ধর্মীয় কারণে বাংলাদেশ তাদের গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবেশী। ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোর সাথে যোগাযোগ রক্ষায় বাংলাদেশ ভারতের গুরুত্বপূর্ণ করিডোর এবং অরক্ষিত শিলিগুড়ি করিডোরের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিকল্প পথ, যা ইতোপূর্বে চীনের সেনাবাহিনী কর্তৃক হুমকির মুখে পড়েছিল। এছাড়া বাংলাদেশে চলমান ধর্মীয় মৌলবাদ ভারতের দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে।

চীন বাংলাদেশসহ সমগ্র এশিয়াকেই বাণিজ্য, অর্থনীতি এবং সামরিক সহযোগিতার মাধ্যমে প্রভাবিত করতে চাচ্ছে। বাংলাদেশে ভারত ও চীন উভয়েই বাণিজ্য বিস্তারের মাধ্যমেই প্রভাব বিস্তারে আগ্রহী। উভয়েরই বাংলাদেশে ব্যাপক বাণিজ্য উদ্বৃত্ততা বিদ্যমান।

বাংলাদেশ-চীন সম্পর্ক; Source: xinhuanet.com

বছরে প্রায় ১৬-১৭ বিলিয়ন ডলার সমমূল্যের পণ্য বাংলাদেশে রপ্তানি করে চীন, ভারতের পরিমাণটা এর অর্ধেক। অর্থাৎ, বছরে প্রায় ৮ বিলিয়ন ডলারের পণ্য বাংলাদেশে রপ্তানি করে ভারত। আমদানির প্রশ্নে আবার ঠিকই একই চিত্র। তবে তা ডলারের অঙ্কে নয়, ব্যবধানের অঙ্কে। প্রতি বছর চীন বাংলাদেশ থেকে আমদানি করে মাত্র ৭৫ কোটি ডলারের পণ্য আর ভারত আমদানি করে ২৬ কোটি ডলারের পণ্য। তবে ভারতের ক্ষেত্রে বাণিজ্য সম্পর্ক সর্বদা পরিসংখ্যান বা সংখ্যা দিয়ে মাপা যায় না। ধারণা করা হয়, বছরে প্রায় দুই থেকে তিন বিলিয়ন ডলারের অবৈধ বাণিজ্য হয় বাংলাদেশ আর ভারতের মধ্যে, যার সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণই বলা চলে ভারতের হাতে। এছাড়া রেমিট্যান্স হিসেবেও বাংলাদেশ থেকে আর দুই থেকে চার বিলিয়ন ডলার আয় করে ভারত। আর বাংলাদেশকে বৈদেশিক সহায়তা দেয় ১৫ কোটি ডলার। এক্ষেত্রে চীন দেয় অধিকগুণ বেশি, প্রায় ১০০ মিলিয়ন ডলার। সম্প্রতি শি জিনপিং বাংলাদেশ ভ্রমণের পর প্রায় ২৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বৈদেশিক সহায়তা দেবার কথা ঘোষণা করেন, যা বাংলাদেশের জন্য আশার আলো বৈকি।

অবকাঠামো প্রকল্পে ভারত এবং চীন উভয়েই বিপুল অঙ্কের টাকা প্রস্তাব করছে বাংলাদেশকে। বড় আকারে রেল প্রকল্প এবং গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ প্রকল্পের সাথে জড়িত হতে উভয়েই বদ্ধপরিকর। তবে এসব প্রকল্পে বাংলাদেশ খুব বেশি লাভবান হচ্ছে না। উল্টো সুন্দরবনের কাছে কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্প বাংলাদেশের প্রাকৃতিক পরিবেশকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলেছে। বাংলাদেশে বড় ধরনের বিনিয়োগ করার কথা থাকলেও বিনিয়গের পরিমাণটা বরাবরের মতোই থেকে গেছে অত্যন্ত ক্ষুদ্র। তবে সামরিক উপকরণ সরবরাহে ভারতের চাইতে চীন ভালোই এগিয়ে আছে। কিছুদিন আগে সরবরাহতকৃত দুটি ডুবোজাহাজ সেটাই প্রমাণ করেছে।

বাংলাদেশের নৌবহরে ডুবোজাহাজের সংযুক্তি ভারতের দুশ্চিন্তার কারণ; Source: sputniknews.com

সাংস্কৃতিক প্রভাব বিস্তারে চীনের কাছে ভারতের অবস্থান অপ্রতিরোধ্য। ভাষাগত এবং সংস্কৃতির মিল থাকায় ভারতের তুলনায় চীনের প্রভাব নেই বললেই চলে। বাংলাদেশের ঘরে ঘরে ভারতের টেলিভিশন চ্যানেলের অনুষ্ঠান প্রচারিত হয় আর চীনা সংস্কৃতি সম্পর্কে সেরকম জ্ঞান না থাকাটাই স্বাভাবিক।

ফরেস্ট কুকসন এবং টম ফেলিক্স জোয়েনকের মতে, রাজনৈতিক প্রশ্নে বাংলাদেশের রাজনৈতিক দল বিএনপিকে একটি ইসলাম এবং পাকিস্তানপন্থী দল মনে করে ভারত। স্বভাবতই আওয়ামী লীগের প্রতিই সহানুভূতিশীল হবে তারা। অপরপক্ষে আওয়ামী লীগের সাথে সম্পর্ক বজায় রাখবার পাশাপাশি ‘ভারত বিরোধী এবং সেনাপন্থী’ বিএনপির সাথেও সুসম্পর্ক বজায় রাখছে চীন।

বাংলাদেশের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক গড়তে কেন ভারত আর চীনের মধ্যে এত প্রতিদ্বন্দ্বিতা?

মাইকেল কুগেলম্যানের বক্তব্যে কিছুটা ভিন্নতা পরিলক্ষিত হয়। তিনি বলছেন, বাংলাদেশ এবং ভারতের বর্তমান সম্পর্ক মোটামুটি ভালো এবং নিকট অতীতে তা আরও উন্নতি লাভ করেছে। দুই দেশের সরকারই সন্ত্রাস দমনে কঠোর ভূমিকা পালন করে থাকে। তবে বেশ কিছু ঝামেলাও রয়েছে। সাম্প্রতিক রোহিঙ্গা ইস্যু এর মধ্যে একটি। এছাড়া তিস্তার পানি বণ্টন নিয়েও ভারত সরকারের ব্যাপক দুশ্চিন্তা রয়েছে। কারণ বাংলাদেশ অনেক দিন থেকে পানি বণ্টনের জন্য ভারতের ওপর চাপ সৃষ্টি করলেও পশ্চিমবঙ্গের স্থানীয় সরকারের কারণে পানি বণ্টন সম্ভব হচ্ছে না। তবে সবকিছু ছাপিয়ে, বাংলাদেশের সাথে চীনের সুসম্পর্ক গড়ে ওঠা ভারতের জন্য সবচেয়ে পীড়াদায়ক, কেননা তারা দিল্লির অন্যতম প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী।

তিস্তায় বাঁধ দিয়ে পানি আটকে রেখেছে ভারত; Source: offroadbangladesh.com

পররাষ্ট্রনীতির প্রশ্নে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সমালোচনা করেন মাইকেল কুগেলম্যান। তার মতে, ভারতের পররাষ্ট্রনীতি নির্ধারণী মহলের তৈরিকৃত একটি ক্যাচি স্লোগান ‘নেইবারহুড ফার্স্ট’ প্রকৃত অর্থে ব্যর্থ। মূলত প্রতিবেশী দেশগুলোর সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখতেই এই স্লোগান ব্যবহার করলেও তারা তা করতে পারছে না। উদাহরণ হিসেবে কিছুদিন আগে তারা নেপালে সবধরনের খাদ্য সরবরাহ বন্ধ করে দেয়। এছাড়া ইসলামাবাদে অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া সার্কের সম্মেলন বাতিল করতেও তাদের বাধ্য করেন। শুধুমাত্র বাংলাদেশের ক্ষেত্রেই তারা তাদের নীতির সবটুকু কার্যকরের পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারে। এই অবস্থায় ভারতের ঘাড়ের কাছ দিয়ে চীনের সাথে বাংলাদেশের সুসম্পর্ক ভারতের জন্য দুশ্চিন্তার এবং চীনের জন্য তা কৌশলগত সাফল্যও বটে।

চীন যদি বাংলাদেশের উপকূলে কোনো প্রকার নৌসম্বন্ধীয় স্থাপনা তৈরি না করে, তাহলে ভারতের চিন্তা করার প্রয়োজন নেই বলেই মনে করেন যুক্তরাষ্ট্রের এই রাজনৈতিক বিশ্লেষক। তার ধারণা, বেইজিংকে ঢাকা নিশ্চয়ই তাড়িয়ে দেবে না। বরং তাদের পুঁজি এবং বিনিয়োগ লাভের চেষ্টা করবে। এ ব্যাপারে তিনি উদাহরণ হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে তুলে ধরেন। তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্র একইসাথে ভারত এবং পাকিস্তানের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রেখে চলছে। এ ব্যাপারে চীন শীঘ্রই নিশ্চয়তা প্রদান করবে বলেই ধারণা করছেন তিনি।

বাংলাদেশের অবস্থান

বঙ্গোপসাগরে ভারত চীনের এই ভূ-রাজনৈতিক দ্বৈরথে বাংলাদেশ কোনোভাবেই ভুক্তভোগী হচ্ছে না বলে মনে করছেন ফরেস্ট কুকসন এবং টম ফেলিক্স জোয়েনক। উল্টো কৌশলগত অবস্থান বজায় রেখে বাংলাদেশ দুই পক্ষকে উৎসাহ প্রদান করে নিজেদের ফায়দা লুটে নেবে। চীন এবং ভারত যতটুকুই দিক না কেন, তারচেয়েও অনেক বেশি তারা হাতিয়ে নেবে এবং ঢাকার এ ব্যাপারে স্পষ্ট  ধারণা রয়েছে বলে মনে করছেন তারা।

সাম্প্রতিক রোহিঙ্গা ইস্যুতে মায়ানমারের বিরুদ্ধে যেকোনো সিদ্ধান্তে চীন ভেটো দিচ্ছে। মিত্রপক্ষ ভারতের কাছ থেকেও আশানুরূপ সাড়া পাচ্ছে না বাংলাদেশ। উল্টো অনেক সময় তারা মিয়ানমারের পক্ষেই পথা বলছে। আর এসব আচরণ প্রমাণ করে দিয়েছে যে, চীন ও ভারত বাংলাদেশের সুদিনের বন্ধু। চীন এবং ভারত উভয়েই চাইবে দুর্বল বাংলাদেশের ওপর প্রভাব বিস্তার করে বঙ্গোপসাগরে নিজেদের কর্তৃত্ব স্থাপন করতে। বাংলাদেশ এই সুযোগে দুই দেশের থেকে তার প্রাপ্যটা বুঝে নিতে সচেষ্ট হবে বলেই বিশ্বাস করেন তারা।

বিপন্ন রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী; Source: scmp.com

ভারত এবং চীনের বৈদেশিক নীতি পরিবর্তনের মাধ্যমে অবস্থার পরিবর্তন ঘটতে পারে। উভয়ের কেউই বাংলাদেশ থেকে পণ্য আমদানিতে কোনোপ্রকার সুবিধা দিচ্ছে না। যত টাকা ঋণ হিসেবে দিচ্ছে, তার চেয়ে বেশি টাকা তারা আদায় করে নিচ্ছে। তবে এক্ষেত্রে ভারতের চাইতে চীনের অবস্থান ভালো। কেননা ভারতের চাইতে চীনের বাণিজ্য অনেক বেশি বিস্তৃত। বাংলাদেশ যদি চীনের রপ্তানি সুবিধা পেয়ে যায় তাহলে স্বাভাবিকভাবেই তারা চীনের দিকেই ঝুঁকে পড়বে বলে মনে করছেন ফরেস্ট কুকসন এবং টম ফেলিক্স জোয়েনক।

ফিচার ইমেজ- সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট

Related Articles