Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

বিশ্বজুড়ে ব্যবহৃত মারাত্মক বিষসমূহ

পৃথিবীতে হরেক রকমের বিষ রয়েছে। এদের কোনোটির শনাক্তকরণ সহজ, কোনোটি নীরব ঘাতক, আবার কোনোটি প্রয়োগ করার জন্য তার সাথে একই স্থানে থাকারও প্রয়োজন নেই। কোনোটি অতি-ক্ষুদ্র পরিমাণে প্রয়োগ করা হলে মৃত্যু নিশ্চিত, আবার কোনোটির প্রয়োগ করা হয়েছে কিনা তার হদিশই বের করা দুষ্কর। আজকের আয়োজনে মারাত্মক কিছু বিষ নিয়ে থাকছে আলোচনা।

অ্যাকোনাইট

মঙ্কসহুড বা উল্‌ফবেন গাছে পাওয়া যায় এই বিষ। গাছটিকে ডাকা হয় শয়তানের শিরস্ত্রাণ, বিষের রানী প্রভৃতি নামে। ওষুধ হিসেবে খুবই অল্প পরিমাণে এটি ব্যবহৃত হয়। অল্প থেকে সামান্য বেড়ে গেলে তা হয়ে ওঠে মৃত্যুর কারণ। বলা হয়, এই বিষটি শনাক্ত করা প্রায় অসম্ভব, কেননা ময়নাতদন্তের সময় এর ধরা পড়ার বৈশিষ্ট্য মাত্র একটি। এমনকি খালি হাতে এই বিষে বিষাক্ত গাছের পাতা ছুঁলেও আক্রান্ত হতে পারে কেউ। তাই বিষক্রিয়ার কারণ দুর্ঘটনা নাকি উদ্দেশ্য প্রণোদিত তা জানা বেশ কঠিন।

বিষক্রিয়ার ফলে প্রাথমিকভাবে ডায়রিয়া দেখা দেয়। বমি হতে থাকে, অতঃপর দ্রুতগতিতে হৃদযন্ত্রের অ্যারিথমিয়া, অক্সিজেনশূন্যতা তৈরি হয়। এর ফলে জন্ম নেয় শ্বাসকষ্ট। পাশাপাশি বিভিন্ন অঙ্গে দেখা দেবে অসাড়তা। হৃদযন্ত্র ও শ্বসনতন্ত্রের পক্ষাঘাতের ফলে বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত ব্যক্তির মৃত্যু হয়। ময়নাতদন্তে মৃত্যুর কারণ হিসেবে ধরা পড়ে অক্সিজেন স্বল্পতা বা দম বন্ধ হয়ে যাওয়া।

অ্যাকোনাইট; Source: tumblr.com

ময়নাতদন্তের সময় এর ধরা পড়ার সম্ভাবনা অনেক কম থাকে বলে একে ‘খুন করে বেঁচে যাবার’ পরিকল্পনাগুলোতে ব্যবহৃত হতে দেখা যায়। খুব সামান্য পরিমাণে এটি ব্যবহার করা হলে তা ২ – ৬ ঘণ্টায় ধীরগতির যন্ত্রণাদায়ক মৃত্যু ডেকে আনে। বেশি পরিমাণে এর ব্যবহার বয়ে আনে তাৎক্ষণিক মৃত্যু। তবে ময়নাতদন্তকারী যদি জানেন যে এটি শনাক্তকরণের জন্য ঠিক কী বৈশিষ্ট্যের খোঁজ করতে হবে তাহলে এর প্রয়োগ হয়েছে কিনা জানা সম্ভব।

অ্যাকোনাইটের ব্যবহারের বেশ পরিচিতি আছে। বিষ প্রয়োগের ইতিহাস ঘাঁটলে এর নজির পাওয়া যায়। বলা হয়ে থাকে সম্রাট ক্লডিয়াসকে এক প্লেট মাশরুমে অ্যাকোনাইট মিশিয়ে হত্যা করে তার স্ত্রী এগ্রিপ্পিনা। অ্যাকোনাইটের অপরাধমূলক ব্যবহারের আরেকটি খোঁজ মেলে কয়েক বছর আগের একটি ঘটনায়। বৃটেনের এক মহিলা তার প্রাক্তন প্রেমিককে এ বিষ দেয়ার চেষ্টা করেছিলেন। তিনি আটকও হয়েছিলেন।

আর্সেনিক

পর্যায় সারণীর এক পরিচিত ধাতব পদার্থ আর্সেনিক। এর খুবই সামান্য পরিমাণে উপস্থিতি বেশিরভাগ স্তন্যপায়ী প্রাণীর খাদ্যাভাসে প্রয়োজন। তবে অল্প অল্প করে অনেকদিন এটি শরীরে গেলে তা ক্রমান্বয়ে বেড়ে চলা অসুস্থতার সাথে ডেকে আনে মৃত্যু, আর বেশিমাত্রায় শরীরে গেলে মৃত্যু আসতে পারে কয়েক ঘণ্টার ভেতর।

একসময় ‘বিষের রাজা’ হিসেবে পরিচিতি পাওয়া আর্সেনিক পূর্বে অন্যান্য দ্রব্যাদিতেও ব্যবহৃত হতো। ১৯৫০ সাল পর্যন্তও প্রায় অনেক ধরনের গৃহস্থালি বস্তু, যেমন- দেয়ালে লাগানোর ওয়ালপেপার, রঙ, ধাতু সংকর, ওষুধ, কৃষিকাজে ব্যবহৃত জিনিসপত্র এবং এমনকি প্রসাধন সামগ্রীতেও আর্সেনিকের বহুল ব্যবহার ছিল। ভিক্টোরিয়ানরা প্রসাধনেও ব্যবহার করতো একে। মাত্র দু-তিন ফোঁটা আর্সেনিক একজন মহিলার চেহারাকে করে তুলতো বিবর্ণ ও সাদা, যা ছিল একদম কাঙ্খিত ও মানানসই সাজের অংশ।

ধরা হতো, এভাবে সামান্য পরিমাণে আর্সেনিকের ব্যবহারে কোনো ক্ষতি হবে না, কিন্তু বাস্তবে দুর্ঘটনাবশত আর্সেনিক বিষক্রিয়া কিংবা এর দীর্ঘমেয়াদি ব্যবহার ডেকে আনে নানা ভয়াবহ সমস্যা, যেমন- ক্যান্সার, জন্ডিস, চামড়ায় ফুসকুড়ি ওঠা প্রভৃতি। আর্সেনিক বিষক্রিয়ার লক্ষণসমূহ হলো বমিভাব, বমি কিংবা রক্তবমি, পাকস্থলীয় ব্যাথা এবং অভ্যন্তরীণ রক্তক্ষরণ। বেশি পরিমাণে আর্সেনিকের সংস্পর্শে আসলে কয়েক ঘণ্টার মধ্যে যন্ত্রণাকাতর ধীরগতির মৃত্যু হয়।

আর্সেনিক; Source: flp.it

পূর্বে আর্সেনিক শনাক্তকরণের কোনো উপায় না থাকায় একে বিষ হিসেবে সহজেই ব্যবহার করা হতো। প্রতিদিন অল্প অল্প মাত্রায় আর্সেনিক কাউকে দেয়া হলে তার লক্ষণ ও মৃত্যুর ধরণ দেখলে মনে হবে লম্বা সময় ধরে কোনো রোগে ভুগে ভুগে তার মৃত্যু হয়েছে। আবার ভুক্তভোগী কোনোভাবে বুঝতেও পারবে না যে তাকে খাবারে বা পানীয়ের মাধ্যমে বিষ দেয়া হচ্ছে। আর তাই হোক কল্পকাহিনী, চলচ্চিত্র কিংবা রূঢ় বাস্তবতা- খুনের হাতিয়ার হিসেবে আর্সেনিকই অসংখ্যবার হয়ে উঠেছে প্রথম পছন্দ।

তবে ১৮৩৬ সালে আবিষ্কৃত হওয়া ‘মার্শ পরীক্ষা’ আর্সেনিকের এই মহার্ঘ্য প্রতিচ্ছবিকে ভেস্তে দেয়। মার্শ পরীক্ষা খাদ্য, পানীয়তে শনাক্ত করতে পারে আর্সেনিকের উপস্থিতি। তার উপর এখন আর্সেনিকের হদিশও সহজে মেলে না, তাই খুনের হাতিয়ার হিসেবে এর ব্যবহার এখন আর নেই বললেই চলে।

তবে একসময় বহুল ব্যবহৃত এই বিষাক্ত পদার্থটি কেড়ে নিয়েছে অনেক বিখ্যাত মানুষের প্রাণ। এর মধ্যে নেপোলিয়ন বোনাপার্ট, ইংল্যান্ডের তৃতীয় জর্জ এবং সিমন বলিভার উল্লেখযোগ্য। বর্তমানকালের বেশ উঁচুদরের অপরাধমূলক ঘটনার মধ্যে একটি হলো সান ডিয়েগোর এক মহিলা আর্সেনিক সহযোগে তার স্বামীকে খুন করেন স্বামীর সামরিক অবদানের সুবাদে প্রাপ্ত সুবিধা ও ভাতা হস্তগত করার জন্য। প্রাথমিকভাবে সে অপরাধটি করে বেঁচে গেলেও এক বছর পর যখন তার স্বামীর মৃত্যুর প্রকৃত কারণ ধরা পড়ে তখন তাকে আটক করা হয় এবং শাস্তি হিসেবে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হয়।

অ্যান্টিমনি

আর্সেনিকের ন্যায় এটিও মৌলিক পদার্থের পর্যায় সারণীর একটি অতি-পরিচিত ধাতব মৌল। তবে এটি আর্সেনিকের ন্যায় স্বাদহীন নয়। কাউকে এই বিষ দেয়া হলে ভুক্তভোগী তার জিহ্বায় সহজেই টকভাবযুক্ত ধাতব স্বাদ অনুভব করবে। এ বিষ খাবার ৩০ মিনিটের মধ্যে এর বিষক্রিয়ায় ঘাম, বমি এবং হৃদযন্ত্রের গতি বন্ধ হবার মতো ঘটনা ঘটে। আর্সেনিকের ন্যায় একে ময়নাতদন্তের সময় সহজেই শনাক্ত করা যায়, কেননা এটি খাদ্যনালীর আবরণীতে প্রদাহের সৃষ্টি করে। ‘চায়ের কাপে বিষদাতা’ হিসেবে পরিচিত গ্রাহাম ইয়ং নামক খুনী বিষ হিসেবে অ্যান্টিমনি  ব্যবহারের জন্য বিখ্যাত।

অ্যান্টিমনি; Source: mcgill.ca

রাইসিন

আপনারা যদি ‘ব্রেকিং ব্যাড’ নামক জনপ্রিয় টিভি ধারাবাহিকটি দেখে থাকেন তাহলে বুঝতেই পারছেন এখানে কোন জিনিসটির কথা বলা হচ্ছে। এ ধারাবাহিকটির একটি পর্বে কেন্দ্রীয় চরিত্র ওয়াল্টার হোয়াইট তার হত্যা সংক্রান্ত নাটক সাজাতে রাইসিন নামক বিষটির ব্যবহার করেন।

রাইসিন ক্যাস্টর গাছ তথা Ricinus communis গাছ থেকে পাওয়া যায়। ক্যাস্টর অয়েল বীনে পাওয়া এই পদার্থটি এতই বিষাক্ত যে মাত্র কয়েক দানাই একজন মানুষের প্রাণ নেবার পক্ষে যথেষ্ট। মাস্টার্ড গ্যাসের ন্যায় রাইসিনও সাইটোটক্সিক তথা কোষীয় বিষাক্ততা সৃষ্টিকারী (আণবিক স্তরে আক্রমণকারী)। শারীরিকভাবে প্রোটিনের উত্পাৎদন বন্ধের মাধ্যমে এই কাজটি করে থাকে। ফলশ্রুতিতে শরীরের অভ্যন্তরীণ সকল গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গসমূহ বিকল হয়ে যায়। বিষটি বেশ দ্রুত কাজ করলেও, বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত  ভুক্তভোগীর মৃত্যু হতে ৭ – ১০ দিন সময় লাগে এবং প্রায়শই দেখা যায় এই বিষের লক্ষণসমূহ প্রায় অন্তত ২৪ – ৪৮ ঘণ্টা পর্যন্ত চেপে থাকে।

ক্যাস্টরবীন থেকে পাওয়া যায় রাইসিন; Source: thoughtco.com

রাইসিন শনাক্ত করা খুবই দুরূহ কাজ। যদিও রাইসিন শণাক্তকরনের কোনো নির্দিষ্ট পরীক্ষাপদ্ধতি এখনো নেই, কিন্তু আক্রান্ত ব্যক্তির ডিএনএ পরীক্ষার মাধ্যমে পরীক্ষকগণ ধরে ফেলতে পারেন তার ওপর এটি প্রয়োগ করা হয়েছে কিনা। রাইসিন প্রয়োগের ফলে সৃষ্ট লক্ষণসমূহ হচ্ছে: শ্বাস নিতে কষ্ট হওয়া, ঘাম এবং পালমোনারি এডেমার (ফুসফুসে মাত্রাতিরিক্ত তরলের জমায়েত) সহিত জ্বর। যদি এটি শ্বাসের মাধ্যমে শরীরে গিয়ে থাকে তাহলে দ্রুতগতিতে মৃত্যু হয়।

উদ্ভিজ্জ উৎস থেকে প্রাপ্ত বিষগুলোর মধ্যে সর্বাধিক বিষাক্ত হলো রাইসিন। ১৯৭৮ সালে লন্ডনে জর্জি মারকভ নামক এর বুলগেরিয়ান নাগরিককে খুন করার জন্য এটি ব্যবহৃত হয়। আততায়ী তার শরীরে বিষযুক্ত ক্ষুদ্র বটিকা গুলি করে ঢুকিয়ে দেবার পর তার মৃত্যু হতে সময় লেগেছিল ৭ দিন। হত্যাকারী অলডওয়াইচ টিউব স্টেশনের  বাইরে একটি ছাতার ভেতরে স্থাপিত অস্ত্রের মাধ্যমে বিষাক্ত ক্ষুদে পদার্থটি জর্জি মারকভের শরীরে প্রবিষ্ট করায়।

অ্যাব্রিন

অ্যাব্রিন রাইসিনের সমতুল্য বিষ হলেও এর চেয়ে কম পরিমাণে এটি ব্যবহার করলেও মৃত্যু ঘনিয়ে আসে। শরীরে বিষ যাবার মাধ্যম (শ্বসন, খাদ্যনালী কিংবা ইনজেকশন) অনুযায়ী কয়েক ঘণ্টার ভেতর এই বিষক্রিয়ার লক্ষণগুলো দেখা যায়। লক্ষণসমূহ প্রায় রাইসিনেরই মতো এবং এর ফলে শ্বসনে সমস্যা, বমিভাব, বুকে ব্যথা এবং নিম্ন রক্তচাপ হতে পারে। শ্বসনতন্ত্র বিকল হয়ে যায় এবং মৃত্যু সংঘটিত হয়। যেহেতু রাইসিনের তুলনায় কম পরিমাণে এর ব্যবহারেই মৃত্যু অবধারিত, তাই অ্যাব্রিন শনাক্ত করা রাইসিনের চেয়েও কঠিনতর। তবে রাইসিনের ন্যায় এটিও শরীরে চিহ্ন রেখে যায়, তাই শনাক্তকরণ রাইসিনের তুলনায় কঠিন হলেও তাতে খুব বেশি সমস্যা হয় না।

অ্যাব্রিন পাওয়া যায় Abrin precatorius গাছ থেকে; Source: pinterest

বটুলিনাম টক্সিন

আপনি যদি শার্লক হোমস সিরিজটির ভক্ত হয়ে থাকেন তাহলে অবশ্যই এই বিষটির কথা জেনে থাকবেন। শরীরে এই বিষাক্ত পদার্থের উপস্থিতি থেকে পেশীয় পক্ষাঘাত ঘটে এবং পরবর্তীতে শ্বসনতন্ত্রের পক্ষাঘাত থেকে আসে মৃত্যু। বটুলিনাম টক্সিন থেকে হতে পারে বটুলিজম যার ফলে হৃৎপিণ্ড, যকৃত ও ফুসফুস পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে পড়ে। বটুলিনাম টক্সিন খাদ্য ও পানীয়ের মাধ্যমে ব্যক্তিকে দেয়া যায় এবং বলা হয় এটি মানুষের জানা সবচেয়ে বিষাক্ত পদার্থের একটি। কেননা, গবেষণালব্ধ ফলাফলে দেখা গেছে, মাত্র এক গ্রাম বটুলিনাম টক্সিন মেরে ফেলতে পারে ৮০ হাজারের মতো মানুষ। মাত্র এক চা-চামচেই মারা যেতে পারে এক বিলিয়নেরও বেশি মানুষ!

কুইন্স কাউন্সিলের অন্তর্ভুক্ত এক বাদীপক্ষের উকিল নাইজেল সুইনির মতে, বিশ্বের প্রাণঘাতী সবচেয়ে মারাত্মক বিষগুলোর মধ্যে একটি হলো পঁচে যাওয়া মাংস এবং বিষ্ঠা থেকে তৈরি একপ্রকার বটুলিনাম টক্সিন। এটি তৈরি করা বেশ কষ্টসাধ্য। তার ভাষায়, “মানবপরিচিত সবচেয়ে বিষাক্ত পদার্থ।” মজার কথা হচ্ছে, এই প্রাণহন্তারক বিষের অন্যান্য ব্যবহারও রয়েছে। অতিমাত্রায় ঘাম হওয়া, মাইগ্রেনের ব্যথা এবং মুখের কুঁচকানো ভাব ও বলিরেখা কমাতে এই বিষের ব্যবহার আছে। বার্ধক্যের ছাপ ঢাকতে ব্যবহৃত বোটক্স ইনজেকশনে এই বিষাক্ত পদার্থটি ব্যবহৃত হয়।

বোটক্স; Source: cbsnews.com

বাট্রাকোটক্সিন

বাট্রাকোটক্সিন একধরনের নিউরোটক্সিন যা ‘গোল্ডেন ডার্ট ফ্রগ’ নামক ব্যাঙের চামড়া থেকে পাওয়া যায়। আমাজনীয় ইন্ডিয়ানদের দ্বারা ব্যবহৃত শিকারি ডার্ট বা ক্ষুদে তীরের ফলায় এ বিষ ব্যবহৃত হয়। বৃদ্ধাঙ্গুলির চেয়েও ছোট আকৃতির গোল্ডেন ডার্ট ফ্রগ দশজন মানুষকে মেরে ফেলার জন্য যথেষ্ট পরিমাণ বিষ উৎপাদন করতে পারে। এ প্রাণহন্তারক বিষ মাত্র দুই দানা লবণের সমতুল্য যা শুধু পক্ষাঘাতের জন্যই দায়ী নয়, পাশাপাশি কার্ডিওটক্সিন বা হৃদযন্ত্রের বিষক্রিয়ায় দায়ী পদার্থ হিসেবেও কাজ করে এবং কয়েক মিনিটের মাঝেই ডেকে আনে মৃত্যু। এখনো পর্যন্ত এই বিষের কোনো প্রতিষেধক জানা নেই।

বাট্রাকোটক্সিন; Source: amazingplanetnews.com

বিষাক্ত তীরে ব্যবহৃত হয় বাট্রাকোটক্সিন; Source: skatamal.is

বেলাডোনা

ইতালীয় ভাষায় ‘বেলাডোনা’ শব্দটির অর্থ ‘সুন্দরী নারী’। তবে অধিক সৌন্দর্য যে অনেকসময় বিষবত্‍ প্রমাণিত হতে পারে প্রকৃতিতে তার নজির দর্শাতেই যেন বেলাডোনা উদ্ভিদের অস্তিত্ত্ব। আকর্ষণীয় ফলদায়ী এই উদ্ভিদের বিষাক্ততার কথা বর্ণনা করার পূর্বে কেন মধ্যযুগে এটি নারীদের প্রিয় ও বহুল ব্যবহৃত ছিল তা জেনে নেয়া যাক।

অষ্টাদশ ও উনবিংশ শতাব্দীতে এটিকে ব্যবহার করা হতো ব্যথানাশক, পেশী শিথিলকারক এবং প্রসাধনী হিসেবে। কয়েক ফোঁটা বেলাডোনার নির্যাস গালে মেখে নিলে গাল হয়ে উঠতো লালচে এবং তা অনেকটা আধুনিক যুগে গাল রাঙাতে ব্যবহৃত প্রসাধনের মতো কাজ করতো। আবার চোখে কয়েক ফোঁটা যোগ করলেই এর কার্যকারিতায় চোখের মণি হয়ে উঠতো প্রসারিত ও বড়, যা নারীদের দেখতে আবেদনময়ী করে তুলতো।

কিন্তু এত জনপ্রিয় উদ্ভিদটির মাত্র একটি পাতা যদি কেউ খেয়ে ফেললেও তার পরিণাম হবে প্রাণহানিকর। এ কারণেই বিষাক্ত ফলাযুক্ত তীরে বেলাডোনা ব্যবহার করা হতো। এই গাছে ধরা বেরীগুলোও ভয়ানক। আকর্ষণীয় বেরীগুলোর মাত্র দশটিই আপনার মৃত্যু ঘটানোর জন্য যথেষ্ট। এই গাছকে ‘Deadly Nightshade’ নামেও ডাকা হয়।

বিষাক্ত বেলাডোনা গাছ; Source: herbal-supplement-resource.com

সায়ানাইড

বিষ হিসেবে বহুল পরিচিত সায়ানাইড, যার নাম শোনেননি এমন মানুষের সংখ্যা কমই বটে। নানা বিখ্যাত সিনেমা, সিরিজ, বই এমনকি বাস্তব জীবনেও সায়ানাইডের ব্যবহারের কথা কম বেশি আমরা সবাই জানি। সায়ানাইড একপ্রকার রাসায়নিক পদার্থ যা নানা ধরনের ফল ও গাছে পাওয়া যায় এবং এগুলোর মধ্যে ফলের ভোজ্য অংশটিতে খুব সামান্য পরিমাণে থাকা সায়ানাইড মূত্রের মাধ্যমে শরীর থেকে নিরাপদে বের হয়ে যায়। শারীরিক ওজনের প্রতি কেজিতে ১.৫ মিলিগ্রাম সায়ানাইড শরীরে গেলে তা মৃত্যু ডেকে আনে এবং তা মাত্র কয়েক মিনিটেই।

তেতো আমন্ডের গন্ধযুক্ত সায়ানাইড কারো শরীরে গেলে তার লক্ষণ হিসেবে প্রাথমিকভাবে শরীর শক্তি উৎপাদন করা বন্ধ করে দেয়। এরপর দেখা দেয় মাথাব্যথা, বমিভাব, দুর্বলতা, ঘুম ঘুম ভাব, ঐচ্ছিক পেশির অনৈচ্ছিক সংকোচন, খিঁচুনি এবং স্থবির হয়ে যাওয়া। ফলশ্রুতিতে পরবর্তীতে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে যায়। বেশি পরিমাণে সায়ানাইড শরীরে গেলে তা থেকে শ্বসনতন্ত্র ও হৃদপিণ্ড বিকল হয়ে মৃত্যু ঘটে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মানরা সায়ানাইড ব্যবহার করেছিল রাসায়নিক অস্ত্র হিসেবে। নাৎসি যুদ্ধবন্দীশিবিরে মানুষের ওপর চালানো নানান অমানবিক কার্যকলাপের একটিতে ব্যবহৃত গ্যাস ‘জাইকলন বি’ এর সক্রিয় উপাদান ছিল সায়ানাইড।

ডাইমিথাইল-মার্কারি

​ডাইমিথাইল-মার্কারি একপ্রকার জৈবরাসায়নিক পদার্থ যার কার্যকরী উপযোগিতা খুব কম। এটিকে বলা হয় ধীরগতির ঘাতক, যা খুব ধীরে মানুষকে মৃত্যুর কাছে নিয়ে যায়। এ বিষের সংস্পর্শে আসার কয়েক মাস পর এর লক্ষণ দেখা দেয়। মারাত্মক এই বিষটি বর্ণহীন এবং এযাবৎকাল পর্যন্ত জ্ঞাত সর্বাপেক্ষা শক্তিশালী নিউরোটক্সিনগুলোর একটি। মাত্র ০.১ মিলিলিটার পরিমাণ ডাইমিথাইল-মার্কারি মানুষকে মেরে ফেলার পক্ষে যথেষ্ট। যেহেতু এই বিষাক্ত পদার্থের সংস্পর্শে আসার কয়েক মাস পর প্রাথমিক উপসর্গগুলো দেখা দেয়, তাই যতক্ষণে আক্রান্ত ব্যক্তি বুঝতে পারেন যে তিনি ঠিক নেই, ততদিনে চিকিৎসাসেবার কার্যকরী অবদান রাখার ক্ষমতার বাইরে চলে যান তিনি।

ডাইমিথাইল-মার্কারি; Source: Asia Mercury

পয়জন হেমলক

পয়জন হেমলক ইউরোপ ও উত্তর আফ্রিকার ফুলদায়ী স্থানীয় উদ্ভিদ, যেটি খ্রিস্টপূর্ব ৪০০ অব্দ থেকে প্রাণঘাতী বিষ হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। প্রাচীন গ্রিসে এটি বহুল প্রচলিত ছিল, সে সময়ে কারারুদ্ধ বন্দীদের হেমলক পান করিয়ে মৃত্যু কার্যকর করা হতো। হেমলক কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রকে বিকল করে দেয় এবং হৃৎপিণ্ড, মস্তিষ্কসহ শরীরের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গে অক্সিজেন পৌঁছাবার গতিকে মন্থর করে দেয়। ফলে শরীর পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে পড়ে, যদিও মন ঠিকই সজাগ থাকে। শরীর ধীরে ধীরে অসাড় হয়ে পড়ে এবং শ্বসনতন্ত্রের কার্যকারিতা বন্ধ হয়ে মানুষ মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। কৃত্রিম শ্বাসপ্রশ্বাস ব্যবস্থার মাধ্যমে টানা ৪৮ – ৭২ ঘণ্টা পর্যন্ত (যতক্ষণ না বিষক্রিয়ার লক্ষণসমূহ অন্তর্হিত হয়) শ্বাস-প্রশ্বাস চালু রাখা হলে মৃত্যুকে প্রতিহত করা সম্ভব। মাত্র ০.১ গ্রাম (১০০ মিলিগ্রাম) থেকেই হতে পারে মৃত্যু যা গাছটির ৬ – ৮টি পাতা কিংবা বীজ বা মূলের সামান্য অংশেই পাওয়া যায়।

পয়জন হেমলক; Source: angusbeefbulletin.com

হেমলক ব্যবহার করে কার্যকরকৃত সবচেয়ে আলোচিত মৃত্যু হচ্ছে বিখ্যাত গ্রিক দার্শনিক সক্রেটিসকে দেয়া মৃত্যুদন্ড। খ্রিস্টপূর্ব ৩৯৯ অব্দে নাস্তিকতার জন্য তাকে দেয়া মৃত্যুদণ্ড পয়জন হেমলকের খুব ঘন দ্রবণ পানের মাধ্যমে কার্যকর করা হয়।

ওয়াটার হেমলক

উত্তর আমেরিকায় জন্মানো এই গাছটি মারাত্মক বিষাক্ত। খুব সামান্য পরিমাণ শরীরে এলে তা গবাদি পশু ও মানুষের জন্য মৃত্যুদায়ী। এতে থাকা ‘সিকুটক্সিন’ (cicutoxin) শরীরের কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রে আঘাত হানে। এটি ঐচ্ছিক পেশীসমূহের অনৈচ্ছিক সংকোচন ঘটায় এবং সন্ন্যাস রোগের আক্রমণের ফলে রোগীর মৃত্যু ঘটে।

ওয়াটার হেমলক; Source: pinterest

গবাদি পশুর ক্ষেত্রে এই বিষাক্ত গাছটি গলাধঃকরণ করার ১৫ মিনিট থেকে ৬ ঘণ্টার মধ্যে বিষক্রিয়ার লক্ষণ প্রকাশ পেতে থাকে এবং লক্ষণ প্রকাশের ১৫ মিনিট থেকে ২ ঘণ্টার ভেতর মৃত্যু হতে পারে। সিকুটক্সিন খুব মারাত্মক খিঁচুনি উদ্রেককারী এবং বেশিরভাগ প্রাণী দমবন্ধ হয়ে মারা যায়। হৃৎপিণ্ড ও রক্ত সংবহনতন্ত্র বিকল হয়ে পড়ে। অনিবার্য ফল হিসেবে আসে মৃত্যু।

পোলোনিয়াম

পোলোনিয়াম একপ্রকার তেজস্ক্রিয় বিষ যার কোনো প্রতিকার নেই। মাত্র এক গ্রাম পরিমাণ বাষ্পীভূত পোলোনিয়াম-২১০ মাত্র দুই মাসে প্রায় ১৫ লক্ষ মানুষকে মেরে ফেলার পক্ষে যথেষ্ট! রুশ গুপ্তচর আলেক্সান্ডার লিটভিনেনকোকে হত্যা করতে পোলোনিয়াম ব্যবহার করা হয়। সাধারণত পোলোনিয়ামের মাধ্যমে কাউকে মেরে ফেলতে যতটুকু দরকার, তার চেয়ে প্রায় ২০০ গুণ বেশি পরিমাণে বিষটি তার চায়ের কাপে ব্যবহার করা হয়েছিল বলে জানা যায়। তিন সপ্তাহ পরই লিটভিনেনকো মারা যান।

এটি গ্যাস প্রকোষ্ঠে মৃত্যু কার্যকরে ব্যবহৃত হাইড্রোজেন সায়ানাইড অপেক্ষা ২৫০,০০০ গুণ বেশি শক্তিশালী। পোলোনিয়াম থেকে নির্গত আলফা রশ্মি দেহের অভ্যন্তরে প্রচুর ক্ষতি সাধন করে এবং শরীরের অভ্যন্তরীণ অঙ্গসমূহকে অকার্যকর করে দেয়।

পোলোনিয়াম; Source: theconversation.com

আলেক্সাণ্ডার লিটভিনেনকো;  Source: isplus.live.joins.com

প্রেসিডেন্ট ইয়াসির আরাফাতের কথা মনে আছে নিশ্চয়ই? ২০১২ সালে প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশনের এই নেতার স্ত্রী সুহা আরাফাত, ইয়াসির আরাফাতের অসুস্থতাজনিত লক্ষণসমূহে পোলোনিয়ামের প্রভাব রয়েছে বলে দাবী করে অভিযোগ দায়ের করেন।

ইয়াসির আরাফাত; Source: standard.co.uk

উল্লেখ্য, ২০০৪ সালের ১১ই নভেম্বর ৭৫ বছর বয়সে বমিভাব, পেটের প্রচন্ড সমস্যা এবং অন্যান্য পরিপাকতন্ত্রীয় সমস্যায় ভুগে ইয়াসির আরাফাত শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। একই বছরের অক্টোবরের ১২ তারিখে তার অসুস্থতার সূত্রপাত ঘটে, যদিও ইতোপূর্বে তিনি শারীরিকভাবে সুস্থ ছিলেন বলেই জানা গিয়েছিল। যে ফরাসি হাসপাতালে তিনি চিকিৎসা নেন সেখান থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, রক্তের বিষক্রিয়ার ফলস্বরূপ ঘটা স্ট্রোকের কারণে তার মৃত্যু হয়। কিন্তু ফরাসি তদন্তকারীরা এটি ঠিক কী ধরনের বিষক্রিয়া ছিল সে ব্যাপারে কোনো অনুসন্ধান চালাননি।

আলুর বিষ

পটেটো পয়জন হলো আলু থেকে তৈরিকৃত বিষাক্ত পদার্থ। এটি রাইসিনের চেয়ে কম বিষাক্ত হলেও যথেষ্ট পরিমাণে শরীরে গেলে এটিও মরণছোবল মারতে কম যায় না। আলু থেকে তৈরিকৃত এই বিষটিকে খাদ্য ও পানীয়ের মাধ্যমে মানুষের দেহে পৌঁছে দেয় খুনী। কোমায় চলে যাওয়া‚ খিঁচুনি এবং ফুসফুসীয় বৈকল্য এই বিষের বিষক্রিয়াজনিত লক্ষণ।

পটেটো পয়জন তৈরি হয় আলু থেকে; Source: medscape.com

নিকোটিন

নিকোটিন খাবার কিংবা বিষের মাধ্যমে দেবার পাশাপাশি ইনজেকশনের মাধ্যমেও ভুক্তভোগীর শরীরে প্রবেশ করানো হয়ে থাকে। এটি শরীরে প্রাণঘাতী শকের সৃষ্টি করে‚ যার ফলে মস্তিষ্ক বিকল হয়ে গিয়ে মানুষ কোমায় চলে যায় ও মৃত্যু ঘটে।

তরল নিকোটিন ও নিকোটিনের বিষক্রিয়ার ফলাফল; Source: wallstreetotc.com, ecigarettereviewed.com

পারদ

এই তরল ধাতু গাড়ির ব্যাটারি‚ থার্মোমিটারসহ নানা ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়। পারদ স্পর্শ করলে কোনো ক্ষতি না হলেও এটি শ্বাসের মাধ্যমে কিংবা খেয়ে ফেলার ফলে শরীরে গেলে তা বয়ে আনে মৃত্যুর সওগাত।

পারদ মোট তিন প্রকারের হয়ে থাকে। মৌল দশার পারদ সাধারণত থার্মোমিটারে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। এটি স্পর্শ করলে কোনো ক্ষতি হয় না, কিন্তু শ্বাসের মাধ্যমে শরীরে গেলে কিংবা খেয়ে ফেললে তা মারাত্মক ও মৃত্যুদায়ী।

অজৈব পারদসমূহ সাধারণত ব্যাটারিগুলোতে ব্যবহার করা হয়। এ ধরনের পারদ শুধুমাত্র খেয়ে ফেললেই মৃত্যু ঘটে। জৈব পারদ সামান্য পরিমাণে টুনা ও সোর্ডফিশে দেখা যায়। এগুলো সামান্য পরিমাণে থাকলেও গ্রহণের পরিমাণ নিয়ন্ত্রিত হওয়া উচিত। কোনোভাবেই সাপ্তাহিক ১৭০ গ্রামের বেশি নয়। লম্বা সময় ধরে বা দীর্ঘদিন যাবৎ এটি গ্রহণ করলে তার পরিণাম হতে পারে মারাত্মক।

পারদ; Source: healevate.com, fda.gov

পারদের বিষক্রিয়ার লক্ষণসমূহ হলো র‍্যাশ ওঠা, পেশীজ দুর্বলতা, স্মৃতিহীনতা, শারীরিকভাবে অসাড় হয়ে যাওয়া, দৃষ্টিশক্তি, শ্রবণশক্তি ও কথা বলার ক্ষমতাজনিত সমস্যা দেখা দেয়া। বিষক্রিয়ার পরবর্তী দশায় ঘাম, দ্রুত হৃদস্পন্দন, উচ্চরক্তচাপ দেখা দেয়। একপর্যায়ে ভুক্তভোগীর প্রাণ চলে যায়। পারদজনিত কারণে ঘটা বিখ্যাত মৃত্যু হলো সঙ্গীতজ্ঞ আমাদিউস মোজার্টের মৃত্যু। তার ছিল সিফিলিস রোগ, যার চিকিৎসায় তাকে পারদ দেয়া হয়েছিল। কিন্তু পারদের বিষক্রিয়ায় তিনি মারা যান।

সালফার মাস্টার্ড

সালফার মাস্টার্ড একটি কোষীয় বিষাক্ততা সৃষ্টিকারী পদার্থ যা রাসায়নিক যুদ্ধবিগ্রহে অন্যতম অস্ত্র হিসেবে বিবেচিত। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ব্যবহৃত এই পদার্থটিকে সাধারণত মাস্টার্ড গ্যাস নামে ডাকা হয় এর হলুদাভ বাদামী রঙ ও রসুনের ন্যায় গন্ধের জন্য। যদিও এর কার্যকরী উপাদান হচ্ছে ক্লোরিন। শতকরা মাত্র ১ ভাগেরও কম ক্ষেত্রে মাস্টার্ড গ্যাস মৃত্যুদায়ক। কিন্তু এটি শরীরের চামড়া, চোখ এবং ফুসফুস পুড়িয়ে দেয় ও ফোস্কার সৃষ্টি করে। ফলে দম বন্ধ হয়ে যেতে পারে। যদিও বেশিরভাগ ভুক্তভোগী পুড়ে যাবার কারণে সৃষ্ট ঘায়ে সংক্রমণের ফলে মারা যায়, তবে যদি সংক্রমণ না-ও হয়, তবুও ক্ষতগুলোতে পরবর্তীতে সৃষ্টি হওয়া ক্যান্সার মৃত্যু নিশ্চিত করে।

সালফার মাস্টার্ড গ্যাস; Source: redbubble.com, enacademic.com, thinglink.com

স্ট্রিকনিন

নিরক্ষীয় ডগ বাটন গাছের বীজ থেকে আহরিত স্ট্রিকনিন একধরনের স্ফটিকসদৃশ অ্যালকালয়েড যা পূর্ববর্তীতে প্রচলিত কীটনাশকগুলোতে ব্যবহার করা হতো। স্ট্রিকনিন শরীরে গেলে তা পক্ষাঘাত, দম বন্ধ হয়ে যাওয়া, প্রচণ্ড পেশীয় সংকোচন সৃষ্টি করে। এটি এতটাই শক্তিশালী যে, ভুক্তভোগীর শরীর নিজ থেকেই জ্যাক-নাইফ (অস্ত্রোপচার এর সময়ে রোগীকে উপুড় করে বিশেষ ভঙ্গিমায় রাখার অবস্থান) অবস্থায় চলে যায় এবং ২ – ৩ ঘণ্টায় তার মৃত্যু ঘটে।

স্ট্রিকনিন বিষ এবং এই বিষের ক্রিয়ার ফলে জ্যাক-নাইফ অবস্থায় চলে যাওয়া ব্যক্তি; Source: pinterest.com, thepoisoncast.org

সাকসিনাইল কোলিন

সাক্সামেথোনিয়াম ক্লোরাইড নামেও পরিচিত এই পদার্থটি। চিকিৎসাব্যবস্থায় রোগীকে অচেতন করতে এবং বিভিন্ন ওষুধে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। সাকসিনাইল কোলিন স্বল্পমেয়াদী পক্ষাঘাতের সৃষ্টি করে এবং তা প্রায় ১০ মিনিট পর্যন্ত স্থায়ী হয়। তবে অবশ্যই এটি ঘটে নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে বিশেষজ্ঞদের দ্বারা। যদিও এই পদার্থটির ভালো দিক রয়েছে কিন্তু এর অপব্যবহারের সুযোগও রয়েছে।

সাকসিনাইল কোলিন; Source: gizmodo.com.au

সাকসিনাইল কোলিনকে বলা হয় ‘নিখুঁত মারণ বিষ‘। অনিয়ন্ত্রিত পরিবেশে এটিকে ব্যবহার করা হলে এই পদার্থটি পুরো শরীরকে পক্ষাঘাতগ্রস্ত করে ফেলে। এর মধ্যে রয়েছে শ্বসনতন্ত্রের অঙ্গসমূহ, যার ফলশ্রুতিতে অক্সিজেন স্বল্পতায় দম বন্ধ হয়ে মারা যায় মানুষ। ময়নাতদন্তকালীন পরীক্ষকদের এটি শনাক্ত করতে বেগ পেতে হয়। কেননা, মানবদেহ সাকসিনাইল কোলিনকে দ্রুত ভেঙ্গে ফেলে। তাই এর কোনো জোরালো চিহ্ন থাকে না। তবে এটির বিভিন্ন সূত্র ও ভাঙ্গনের ফলে সৃষ্ট পদার্থসমূহ রয়ে যায় যেগুলো রক্তে সাকসিনাইল কোলিনের উপস্থিতির বেশ ভালো নির্দেশক হিসেবে কাজ করে।

স্যারিন

স্যারিন একপ্রকার বর্ণ ও গন্ধহীন স্নায়ুবিক প্রভাবকারী পদার্থ যা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ব্যবহার করা হয়েছিল। এটি সায়ানাইড অপেক্ষা ২৬ গুণ বেশি মারাত্মক প্রাণনাশক যা শরীরের স্নায়ুগুলোর প্রান্তভাগ নিষ্ক্রিয় করে দেয়। এর ফলে দম বন্ধ হয়ে আসে, পাশাপাশি পাকস্থলী, পিত্তথলি এবং অন্ত্রসহ সব ধরনের পেশীর নিয়ন্ত্রণহীনতা দেখা দেয়, মানুষ কোমায় চলে যায় এবং এক ঘণ্টার মধ্যে মৃত্যু হয়। ​১৯৯৫ সালের ২০শে মার্চ ধর্মীয় গোষ্ঠী ‘Aum Shinrikyo’ টোকিও সাবওয়ে স্টেশনে এটি ব্যবহার করে, এর ফলে ১৩ জনের মৃত্যু হয় এবং ৫৪ জন আহত ও ৯৮০ এরও বেশি মানুষ আক্রান্ত হয়।

টেট্রোডোটক্সিন

অনেক ধরনের মাছে এই বিষটি পাওয়া যায়। পাফার ফিশ বা ফুগু ফিশ নামক মাছ ও ব্লু-রিংড অক্টোপাস থেকে পাওয়া যায় এই বিষ। তবে দুটি উৎস থেকে বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হবার উপায় দু’রকম। এর মধ্যে অক্টোপাসের কামড়ই বেশি বিপজ্জ্বনক।

ব্লু-রিংড অক্টোপাস; Source: dailytelegraph.com.au

অক্টোপাস তার বেদনাহীন কামড়ের মাধ্যমে মানুষের শরীরে বিষের অনুপ্রবেশ ঘটায়, মানুষের শরীরে বিষ ঢেলে দেবার পরও অক্টোপাসটির শরীরে ২৬ জন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষকে মেরে ফেলার পক্ষে যথেষ্ট পরিমাণে বিষ সঞ্চিত থাকে। কয়েক মিনিটেই এই বিষে পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে মানুষ মারা যায়। আঘাতপ্রাপ্তিতে কোনো ব্যাথা অনুভূত না হওয়ায় পক্ষাঘাত দেখা দেবার আগে মানুষ বুঝতেই পারে না যে তাকে বিষাক্ত এ প্রাণীটি কামড়েছে।

অপরপক্ষে পাফার ফিশের ক্ষেত্রে, এই মাছ যদি খাবার জন্য সঠিকভাবে প্রস্তুতকৃত তথা বিষমুক্ত করা না হয় তাহলে এটি খেলে আপনার মৃত্যু হতে পারে। জাপানি খাবার হিসেবে এই মাছটি বেশ প্রচলিত। তবে এই মাছটি প্রস্তুতকরণের জন্য পাচকের বহু বছরের প্রশিক্ষণ থাকা প্রয়োজন, নচেৎ পাফার ফিশকে খাবার যোগ্য করে তোলার কাজটি করবার সুযোগ পাওয়া যাবে না।

পাফার ফিশ; Source: earthsky.org

ভিএক্স

এটি যুক্তরাজ্যে প্রস্তুতকৃত কৃত্রিম স্নায়ু-প্রভাবক বিষ। এটি অ্যাম্বারের ন্যায় রঙযুক্ত গন্ধ ও স্বাদহীন তরল যা স্যারিন অপেক্ষা বেশি শক্তিশালী এবং এটি শরীরে গেলেই তৎক্ষণাত শ্বসনতন্ত্রের বৈকল্য, পক্ষাঘাত দেখা দেয়। এটি তৈরি করার সময় এমনভাবে পরিকল্পনা করা হয়েছিল যেন এটি দিয়ে বেশি মানুষকে হত্যা করা যায়। তবে ১৯৯৩ সালে অনুষ্ঠিত ‘কেমিক্যাল ওয়েপনস কনভেনশন’-এ এটিকে বেআইনি ঘোষণা করা হয়। যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্র ইতোমধ্যে তাদের কাছে সঞ্চিত এই বিষ ধ্বংস করেছে। রাশিয়াও তাদের পদাঙ্ক অনুসরণ করেছে।

ভিএক্স; Source: zidbits.com

মানবসভ্যতা রচিত হয়েছে অজস্র রক্ত ও অপরাধের ইতিহাসের ওপর। স্বার্থসিদ্ধি কিংবা প্রতিহিংসা- এমন নানা কারণে মানুষ মানুষকে করেছে ধ্বংস, নাশ করেছে প্রাণ। এসকল বিষের বিভিন্ন সময়ে ব্যবহার মানুষের এই হিংস্রতারই পরিচয় জ্ঞাপন করে। এসব বিপজ্জ্বনক পদার্থের প্রাণঘাতী ও অপকারী ব্যবহার এড়িয়ে মানব কল্যাণে যদি এগুলোর রাসায়নিক বৈশিষ্ট্যকে কাজে লাগানো যায় তাহলেই তা হবে পৃথিবীতে শান্তি প্রতিষ্ঠার পানে আরো একটি পদক্ষেপ।

Featured Image: tambahcheesy.com/jammulinksnews.com

Related Articles