মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং ইরানের প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানি উভয় দেশের মধ্যে ক্রমবর্ধমান উত্তেজনার মাঝে একে অপরের প্রতি সতর্কবার্তা দিয়েছেন। রুহানির বক্তব্যের জবাবে ট্রাম্প টুইটারে জানিয়েছেন আর কখনও যুক্তরাষ্ট্রকে হুমকি না দিতে, নতুবা ইরানের এমন পরিণতি হবে যা ইতিহাসে খুব কম দেশেরই হয়েছে। ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচির অবসান ঘটাতে এবং জঙ্গি গোষ্ঠীদের সমর্থন দানের কারণে ইরানের উপর চাপ দেওয়ার জন্য ট্রাম্প প্রশাসনের ভাষণ এবং অনলাইন যোগাযোগের কারণে এই আক্রমণাত্মক পরিস্থিতির সূচনা ঘটেছে।
ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচিতে ২০১৫ সালের আন্তর্জাতিক চুক্তি থেকে ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রকে প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নেন। এরপর থেকে ইরান মার্কিন চাপ বৃদ্ধি এবং নিষেধাজ্ঞা আরোপের সম্মুখীন হয়েছে। এই চুক্তি বাতিলের পরে ওয়াশিংটন প্রাথমিকভাবে বিশ্বব্যাপী তেলের বাজার থেকে ইরানকে হটিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা নেয়। নভেম্বর নাগাদ অন্যান্য দেশের কাছে ইরানের কাছ থেকে অশোধিত তেল না কেনার দাবি জানায় তারা। ২০১৫ সালের চুক্তিতে স্বাক্ষরকারী ফ্রান্স, চীন, রাশিয়া ও জার্মানির আপত্তি সত্ত্বেও ওয়াশিংটন এখন ইরানের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করছে। তেহরান জানিয়েছিল, তাদের পরমাণু কর্মকাণ্ড শুধু বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য এবং অন্যান্য শান্তিপূর্ণ প্রকল্পগুলির জন্য।
রুহানি ও ট্রাম্পের বক্তব্য
রবিবারে ইরানের কূটনীতিকদের এক সমাবেশে বক্তব্য রাখেন রুহানি। তিনি বলেন,
জনাব ট্রাম্প, সিংহের লেজের সাথে খেলবেন না, এটা কেবল দুঃখের কারণ হবে।
১৯৭৯ সালে ইসলামী বিপ্লবের পরে শুরু হওয়া উভয় দেশের মধ্যে সৃষ্ট বৈরিভাবের পরে এখনও শান্তি বজায়ের সম্ভাবনা রাখেন রুহানী। ইরানের সাথে যুদ্ধ ও শান্তির ব্যাপারটিকে তিনি ‘মাদার অব অল পিসেস’ এবং ‘মাদার অব অল ওয়ারস’ হিসেবে অভিহিত করেন।
রুহানির এই বক্তব্যের প্রেক্ষিতেই মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প টুইটারে রুহানিকে উদ্দেশ্য করে টুইট করেন সেখানে তিনি লেখেন,
আর কখনও, কখনও যুক্তরাষ্ট্রকে হুমকি দেবেন না, নতুবা ইরানের এমন পরিণতি হবে যা ইতিহাসে খুব কম দেশেরই হয়েছে। আমরা এখন আর এমন কোনো দেশ নই যা আপনার সহিংসতা ও মৃত্যু সম্পর্কে বিবৃতিকে সমর্থন জানাবো। সতর্ক হোন।
এর আগেও ট্রাম্প উত্তর কোরিয়ার কিম জং উনের সাথে টুইটারে এরকম বাকবিতণ্ডায় জড়িয়ে পড়েন। তবে এরপর তারা আলোচনার জন্য কূটনৈতিক পন্থা অবলম্বন করেছেন।
মাইক পম্পেওর বক্তব্য
গত রবিবার মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও বলেন, ইরানী শাসনব্যবস্থা “সরকারের চেয়ে বরং মাফিয়াদের মতো“। যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ায় ইরানী আমেরিকানদের কাছে পম্পেও ইরানের প্রেসিডেন্ট রুহানি এবং পরমাণু চুক্তি নিয়ে আলোচনাকারী ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জাভাদ জারিফের নিন্দা করেন। তিনি আরও জানান, তিনি তেহরানের উপর চাপ অব্যাহত রাখার অংশ হিসাবে নভেম্বরের মাঝে অন্যান্য দেশ কর্তৃক ইরানের তেল আমদানি বন্ধ করার চেষ্টা করতে চেয়েছিলেন।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একজন শীর্ষস্থানীয় মার্কিন কর্মকর্তা এত অধিক সংখ্যক ইরানী আমেরিকানদের সাথে সরাসরি সাক্ষাতে এই প্রথমবারের মতো এমন বক্তব্য রাখেন। ইরানের নেতৃত্বের উপর চাপ বাড়ানোর জন্য এটিকে ট্রাম্প প্রশাসনের কৌশলগত অংশ হিসেবে দেখা হচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্র চুক্তি থেকে সরে এসেছে কেন?
মে মাসে ‘জয়েন্ট কম্প্রিহেন্সিভ প্ল্যান অব অ্যাকশন’ (জেসিপিএ) নামে পরিচিত এই পারমাণবিক চুক্তিকে ট্রাম্প ভয়ানক ও একতরফা চুক্তি হিসেবে অভিহিত করেন, যা তার মতে কখনও স্বাক্ষর করাই উচিত হয়নি। তিনি অভিযোগ করেন চুক্তিটি সে অঞ্চলে ইরানের ‘অস্থিতিশীল কার্যক্রম’ যথেষ্ট পরিমাণে সীমিত করে না। তিনি চুক্তির শর্তগুলো লঙ্ঘন বা শনাক্ত করতে পারেননি।
ইরান তার পারমাণবিক কর্মসূচিকে সম্পূর্ণ শান্তিপূর্ণ বলে দাবি করে। ইন্টারন্যাশনাল অ্যাটমিক এনার্জি এজেন্সি (আইএইএ) এই চুক্তিকে অনুমোদন দিয়েছে। ইরান তার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করছিল বলেও জানায় সংস্থাটি।
মে মাসে পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও সিরিয়া থেকে ইরানী বাহিনী প্রত্যাহার ও ইয়েমেনের বিদ্রোহীদের সমর্থন ত্যাগসহ মার্কিন ও ইরানের মধ্যে কোনো নতুন চুক্তির জন্য কতগুলো শর্তের কথা উল্লেখ করেন। তেহরানের প্রতি কিছু শর্ত হচ্ছে-
· আন্তর্জাতিক পারমাণবিক শক্তি সংস্থা (আইএইএ) এর নিকট তাদের পূর্বের পারমাণবিক সামরিক কর্মসূচির একটি পূর্ণাঙ্গ বিবরণ দান এবং এই ধরনের কাজ চিরতরে ছেড়ে দেওয়া।
· তার প্রতিবেশীদের প্রতি হুমকিমূলক আচরণ না করা, ইসরাইলকে ধ্বংস করার এবং সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতে তাদের ক্ষেপণাস্ত্র উৎক্ষেপনের হুমকি না দেওয়া।
· সব মার্কিন নাগরিক, মার্কিন অংশীদার এবং সহযোগী যারা ইরানে মিথ্যা অভিযোগে আটক আছে বা নিখোঁজ রয়েছে তাদেরকে মুক্তি দান করা।
মার্কিন ট্রেজারি জানিয়েছে, নিষেধাজ্ঞার বাস্তবায়িত হওয়ার আগে ৯০ ও ১৮০ দিনের দুটি সময় থাকবে। ৬ আগস্টের প্রথম সময়সীমাটি মার্কিন ডলারের ক্রয়, সোনা ও অন্যান্য কিছু ধাতুর বাণিজ্য, সেইসাথে বিমান এবং গাড়ি শিল্পকে প্রভাবিত করবে। পরবর্তী সময়সীমা, ৪ নভেম্বর যা ইরানের আর্থিক ও তেল সংস্থাগুলোকে লক্ষ্য করবে।
ইরান বিশ্বের সর্বাধিক তেল উত্পাদনকারী দেশগুলোর মধ্যে একটি। প্রতি বছর দেশটি থেকে শত শত কোটি ডলারের তেল রপ্তানি হয়। তবে দেশটি ইতিমধ্যেই অর্থনৈতিক চাপের সম্মুখীন হয়েছে। দেশটিতে দ্রব্যের ক্রমবর্ধমান মূল্যের কারণে ব্যাপক পরিসরে বিক্ষোভ দেখা দিচ্ছে। এছাড়া দেশটির মুদ্রা রিয়ালের মূল্যও কমে গিয়েছে। ভবিষ্যতে মার্কিন নীতি ও নিষেধাজ্ঞাগুলো তাদের ক্ষেত্রে ভালোই বিরূপ প্রভাব ফেলবে। অবস্থা মোকাবেলা করার জন্য তারা কী ধরনের পদক্ষেপ নেয় তার উপর দেশটির অর্থনীতি অনেকটাই নির্ভর করবে।
Featured Image Source: REUTERS/AFP