অতি সম্প্রতি উত্তর কোরিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে সম্পর্ক চরম আকার ধারণ করেছে। দেশ দুটির মধ্যকার বাকযুদ্ধ অস্ত্রযুদ্ধের দিকে দ্রুত বেগে ধাবমান হচ্ছে। গত জুলাই মাসে উত্তর কোরিয়ার দূর পাল্লার মিসাইল (ক্ষেপণাস্ত্র) পরীক্ষার পর থেকেই এমন অবস্থার সূচনা। আন্তর্জাতিক মহল প্রেসিডেন্ট কিম জং উনের নেতৃত্বাধীন দেশটিকে বার বার নিষেধ করলেও তারা ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষায় ইস্তফা দিচ্ছে না। ফলে সম্প্রতি জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ শাস্তিস্বরূপ উত্তর কোরিয়ার উপর আবারও ব্যবসায়িক নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে।
জবাবে প্রশান্ত মহাসাগরে অবস্থিত যুক্তরাষ্ট্রের মালিকানাধীন দ্বীপ গুয়ামে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালানোর কথা বলেছে কোরিয়া উপদ্বীপের দেশটি। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পও বলেছেন, “যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনী যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত রয়েছে“।
এখন সত্যি সত্যি যুদ্ধ শুরু হয়ে গেলে উত্তর কোরিয়া ক্ষেপণাস্ত্র হামলা যে গুয়ামে সীমাবদ্ধ রাখবে না সেটা বোঝা যাচ্ছে। কিন্তু তাদের ক্ষেপণাস্ত্র যুক্তরাষ্ট্রের মূল ভূখণ্ডে হামলা চালাতে কতটা সক্ষম? কত দূর পৌঁছাতে পারবে ক্ষেপণাস্ত্রগুলো? এমন নানা প্রশ্ন লোকজনের মনে। তাই চলুন জেনে নেওয়া যাক, উত্তর কোরিয়ার ক্ষেপণাস্ত্র সক্ষমতা সম্পর্কে।
উত্তর কোরিয়ার দক্ষিণ পিওনগান প্রদেশে অবস্থিত স্ট্রাটেজিক রকেট ফোর্সের নিয়ন্ত্রণে দেশটির ক্ষেপণাস্ত্র সম্ভার। কোরিয়ান পিপল’স আর্মির একটি শাখা ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করার ছয়টি স্থায়ী স্থান পরিচালনা করে। এর বাইরেও অনেকগুলো ভ্রাম্যমাণ ইউনিট আছে, যেগুলো দেশের সব প্রান্তে নিয়ে যাওয়া সম্ভব এবং যেকোনো স্থান থেকে ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করতে পারে। ফলে সেগুলো চিহ্নিত করাও কঠিন।
রাশিয়ার নির্মিত ‘স্কাড’ দিয়ে ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচি শুরু করে উত্তর কোরিয়া। সর্বপ্রথম ১৯৭৬ সালে ‘স্কাড’ মিশর হয়ে দেশটিতে পৌঁছায়। ১৯৮৪ সালের মধ্যে হাসং নামে নিজস্ব সংস্করণের ক্ষেপণাস্ত্র তৈরি করে তারা। সেগুলোর সর্বোচ্চ সীমা ছিল ১,০০০ কিলোমিটারের মধ্যে। এই ক্ষেপণাস্ত্রগুলো গতানুগতিক, রাসায়নিক ও সম্ভবত জৈবিক অস্ত্র বহন করতে পারে।
উত্তর কোরিয়ার ক্ষেপণাস্ত্রগুলো রাশিয়ার ‘স্কাড’ ক্ষেপণাস্ত্রের অনুকরণে তৈরি করা হলেও এগুলোতে আরো উন্নতি প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে। ধারণা করা হয়, তাদের কাছে ১,০০০ (এক হাজার) ব্যালিস্টিক মিসাইল আছে। যদিও এসবের বেশিরভাগই স্বল্প-পাল্লার, যার ব্যাপ্তি ৩০ মাইল থেকে ৩০০ মাইল পর্যন্ত। এগুলো দক্ষিণ কোরিয়াকে লক্ষ্য করে তৈরি করা হয়েছিল।
এরপর হাসং থেকে নোডং সংস্করণ তৈরি করা হয়, যা আগেরগুলোর চেয়ে উন্নত মানের এবং সীমা ১,৩০০ কিলোমিটার পর্যন্ত বৃদ্ধি পায়। ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ ২০১৬ সালের এপ্রিলে এক বিশ্লেষণে বলেছে, এটা প্রমাণিত যে, এই ক্ষেপণাস্ত্রগুলি দক্ষিণ কোরিয়া এবং জাপানের অধিকাংশ জায়গায় আঘাত হানতে সক্ষম।
মুসুদান ক্ষেপণাস্ত্র আরো বেশি সক্ষমতাসম্পন্ন। ২০১৬ সালে এগুলোর পরীক্ষা চালানো হয়েছিল। এটি কত দূর পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে তা নিয়ে মতপার্থক্য আছে। ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থা জানিয়েছে, মুসুদান ক্ষেপণাস্ত্র ২,৫০০ কিলোমিটার পর্যন্ত যেতে পারে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা সংস্থা বলেছে, এর সীমা আনুমানিক ৩,২০০ কিলোমিটার পর্যন্ত। কেউ কেউ বলছে, সম্ভবত ৪,০০০ কিলোমিটার পর্যন্তও যেতে পারে মুসুদান।
২০১৬ সালের আগস্টে পরীক্ষা চালানো হয় পুকগুকসং নামের ক্ষেপণাস্ত্র। উত্তর কোরিয়া জানিয়েছিল, এটি সাবমেরিন ভিত্তিক ‘ভূমি থেকে ভূমি, মধ্যম পাল্লা থেকে দূর পাল্লার ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র’।
গত দুই বছরে উত্তর কোরিয়ার সেনাবাহিনী ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা বৃদ্ধি করেছে। এর মধ্যে ৭,৪০০ মাইলের দূর পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্রেরও পরীক্ষা চালিয়েছে। যেগুলো ইংল্যান্ডের রাজধানী লন্ডন (উত্তর কোরিয়া থেকে ৫,৩৮০ মাইল দূরে), রাশিয়ার রাজধানী মস্কো, ভারতের রাজধানী দিল্লি ও অস্ট্রেলিয়ার রাজধানী ক্যানবেরাতে পৌঁছাতে সক্ষম। উত্তর কোরিয়ার সবেচেয়ে উন্নত ক্ষেপণাস্ত্রগুলো যুক্তরাষ্ট্রে পৌঁছাতে সক্ষম বলে ধারণা করা হয়। শুধুমাত্র ফ্লোরিডা উপদ্বীপ এর সীমার বাইরে রয়েছে।
২০১৬ সালেই হাসং-১০ নামের ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা চালায় উত্তর কোরিয়া, যেটি ২,৫০০ মাইল দূরে আঘাত হানতে পারে। বিশ্লেষকরা জানিয়েছেন, এটি ২,৭০০ পাউন্ড ওজনের একটি পারমাণবিক বোমা বহন করতে সক্ষম।
২০১৬ সালের অক্টোবরে হাসং-১৩ নামের আন্তঃমহাদেশীয় ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের পরীক্ষা চালানো হয়। পারমাণবিক বোমা বহনে সক্ষম এই ক্ষেপণাস্ত্র ৭,৪৫০ মাইল পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে।
সাম্প্রতিককালে উত্তর কোরিয়া নির্ভরযোগ্য দূর-পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র নির্মাণ করতে চাচ্ছে, যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যেকোনো প্রান্তে আঘাত হানতে পারবে। গত ৪ জুলাই পিয়ংইয়ং বলেছিল যে, দেশটি একটি আন্তঃমহাদেশীয় ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র (আইসিবিএম) এর প্রথম সফল পরীক্ষা চালিয়েছে।
হাসং-১৪ নামের এই ক্ষেপণাস্ত্র উচ্চতর বক্রপথে সফলভাবে পরীক্ষা চালানো হয়। দেশটির দাবি, এই ক্ষেপণাস্ত্র ‘বিশ্বের যেকোনো অংশে’ আঘাত হানতে সক্ষম। তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রাথমিক ধারণা, যতটা ভাবা হচ্ছে এটি তার চেয়ে ছোট। যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনী এটিকে মধ্যম পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র বলে বর্ণনা করেছে, কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বেশ কয়েকজন বিশেষজ্ঞ বলেছেন যে, ক্ষেপণাস্ত্রটি যুক্তরাষ্ট্রের আলাস্কা পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে।
এরপর ২৮ জুলাই আরো একটি ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা চালায় উত্তর কোরিয়া। এটি তাদের দ্বিতীয় এবং সর্বশেষ আইসিবিএম পরীক্ষা। এটি প্রায় ২,৩০০ মাইল উচ্চ-বক্রপথ অতিক্রম করে জাপানের সাগরে নির্দিষ্ট লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানে।
২০১২ সালে সেনাবাহিনীর কুচকাওয়াজের সময় পিয়ংইয়ং দু’ধরনের আইসিবিএম প্রদর্শন করেছে, যা কেএন -০৮ এবং কেএন -১৪ নামে পরিচিত। একটি বিশেষায়িত ট্রাকে করে বহন করা ও উৎক্ষেপণ করা সম্ভব তিন-ধাপ বিশিষ্ট কেএন-০৮ ক্ষেপণাস্ত্রটিকে, এটি ১১,৫০০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে পারবে বলে ধারণা করা হয়। কেএন-১৪ নামক দু’ধাপ বিশিষ্ট ক্ষেপণাস্ত্রের সম্ভাব্য সীমা ১০,০০০ কিলোমিটার। এখন পর্যন্ত এগুলোর কোনো পরীক্ষা চালানো হয়নি অথবা হাসং-১৪ এর সাথে এদের কোনো সম্পর্ক আছে কিনা, তাও স্পষ্ট নয়।
আন্তঃমহাদেশীয় ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র তৈরির কারণ
আন্তঃমহাদেশীয় ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র (আইসিবিএম) শক্তি প্রদর্শনের শেষ মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করা হয়। এগুলো পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে ভয়াবহ অস্ত্র ব্যবহারের সুযোগ করে দেয়। আইসিবিএম তৈরিতে অর্থ, সময় এবং শ্রম ব্যয় করার একমাত্র কারণ হচ্ছে, এগুলোর মাধ্যমে পারমাণবিক বোমা হামলা চালানো যায়।
স্নায়ু যুদ্ধের সময় রাশিয়া ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাদের ক্ষেপণাস্ত্র রক্ষা ও সরবরাহ করার বিভিন্ন উপায় খুঁজছিল। সে সময় তারা এগুলো ভূগর্ভে লুকিয়ে রেখেছিল এবং বিশাল ট্রাকে বা সাবমেরিনের মাধ্যমে বহন করত।
সব আইসিবিএম একইভাবে ডিজাইন করা হয়। সেগুলো সাধারণত কয়েকটি ধাপের রকেট, যা কঠিন বা তরল জ্বালানি দ্বারা চালিত হয় এবং পারমাণবিক অস্ত্র নিয়ে বায়ুমণ্ডল ভেদ করে মহাকাশে পৌঁছাতে পারে। তারপর পুনরায় বায়ুমণ্ডলে প্রবেশ করে এবং তার লক্ষ্যের উপরে বা সরাসরি লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হেনে বিস্ফোরিত হয়।
কিছু আন্তঃমহাদেশীয় ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের ‘স্বাধীনভাবে একাধিক লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে পারে এমন পুনরায় প্রবেশযোগ্য (রি-এন্ট্রি) অংশ বা যান’ রয়েছে। এগুলোতে একাধিক পারমাণবিক বোমা ও ফাঁদে ফেলার মতো বিভিন্ন অংশ থাকে। ফলে এই ক্ষেপণাস্ত্রগুলো প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে ফাঁকি দিতে পারে এবং একই সময় একাধিক লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে পারে।
উত্তর কোরিয়ার ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরোধে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা
উত্তর কোরিয়া থেকে উড়ে আসা ক্ষেপণাস্ত্রের গতিবিধি চিহ্নিত করা ও সেগুলোকে ধ্বংস করতে যুক্তরাষ্ট্রের এক স্তর বিশিষ্ট ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা আছে। এর আওতায় প্রশান্ত মহাসাগরীয় নৌবাহিনীর জাহাজের উপর এবং আলাস্কা ও ক্যালিফোর্নিয়ায় বৃহৎ স্থলভিত্তিক ক্ষেপণাস্ত্রবিধ্বংসী ইন্টারসেপ্টর বসানো হয়েছে।
তবে প্রায় এক দশক আগে চালু হওয়ার পর থেকেই বৃহৎ ইন্টারসেপ্টরগুলির কার্যকারিতা নিয়মিতভাবে প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। কারণ ১৮টি ইন্টারসেপ্টরের মধ্যে মাত্র অর্ধেকের পরীক্ষা সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছিল।
গত মে মাসের শেষের দিকে, মিসাইল ডিফেন্স এজেন্সি সফলভাবে একটি ইন্টারসেপ্টর পরীক্ষা করে, যা আইসিবিএম ক্ষেপণাস্ত্রকে লক্ষ্য করে দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরীয় ওয়াজালিন অ্যাটোল থেকে ছোঁড়া হয়েছিল।
টার্মিনাল হাই অ্যালটিটিউড এরিয়া ডিফেন্স (থাড) হচ্ছে এক ধরনের ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা, যা স্বল্প ও মধ্যম পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র ঠেকিয়ে দিতে তৈরি করা হয়েছে। গত এপ্রিলে প্রথমবারের মতো দক্ষিণ কোরিয়ায় থাড মোতায়েন করেছে যুক্তরাষ্ট্র। উত্তর কোরিয়ার ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিহত করার দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা হিসেবে এই ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। উত্তর কোরিয়ার দূর পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র থেকে রক্ষা পেতে প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপ গুয়ামেও থাড ব্যবস্থা মোতায়েন করেছে যুক্তরাষ্ট্র।
বিশেষজ্ঞদের ধারণা, উত্তর কোরিয়ার কাছে যে ক্ষেপণাস্ত্র আছে, তাতে তারা যুক্তরাষ্ট্রে হামলা চালাতে সক্ষম। যুক্তরাষ্ট্রের যে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাই থাকুক না কেন, উত্তর কোরিয়ার ক্ষেপণাস্ত্রের সবগুলোই যে ঠেকিয়ে দেয়া সম্ভব নয়, সেটা স্পষ্ট। ফলে আকাশ পথে ধেয়ে যাওয়া পারমাণবিক বোমাবাহী কোনো একটি ক্ষেপণাস্ত্র যুক্তরাষ্ট্রে বড় ধরনের বিপর্যয় ঘটাতে পারে।