ফ্রান্সের ইতিহাসে সবচেয়ে কনিষ্ঠতম প্রেসিডেন্ট হিসেবে গত ১৪ মে আনুষ্ঠানিকভাবে দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন ইমানুয়েল মাকঁর। ৮ম প্রেসিডেন্ট হিসেবে তার এই দায়িত্বভার ফ্রান্স সহ ইউরোপীয় ইউনিয়নের জন্য বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। ভোট বিশেষজ্ঞরা এবারের ফ্রান্সের নির্বাচনে মাকরেঁর লড়াইকে বিশ্লেষণ করতে গিয়ে ‘বিশ্বায়ন বনাম জাতীয়তাবাদ, ভবিষ্যৎ বনাম অতীত, উদারতা বনাম রক্ষণশীলতা’ – এই আলোকে তুলে ধরতে চেয়েছেন। অনেক বিশেষজ্ঞ ইমানুয়েল মাকরেঁর ব্যক্তিত্ব, বিভিন্ন বিষয়ে তার উদার চিন্তা-ভাবনা আর তার কথাবার্তার প্রাজ্ঞতায় প্রাক্তন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার ছায়া খুঁজে পেয়েছেন।
আশ্চর্যের বিষয় হলো, ভোটের ময়দানে লড়াইয়ের কোনো পূর্ব অভিজ্ঞতাই ছিল না মাকরেঁর। তার নিজের হাতে গড়ে তোলা দলটির বয়স মাত্র এক বছর। দলের নামটিও বেশ বৈচিত্র্যময়, সময় উপযোগীও বটে। ‘অঁ মার্শ’ যার অর্থ ‘এগিয়ে চলা’। একটু একটু করে তার রাজনীতির পথে এগিয়ে চলা, মূল স্রোতের রাজনৈতিক দলগুলোকে পিছনে ফেলে দলের নামের মতো ‘এগিয়ে এসেছেন’ মাকরঁ। অনেকেই ভেবেছিলেন অতি দক্ষিণপন্থী নেত্রী মারিন ল্য পেনকে হারানো মাকরেঁর পক্ষে সম্ভব নয়। কিন্তু সুবক্তা, ধীর স্থির মাকরঁ ধীরে ধীরে এগিয়ে গেছেন তার গন্তব্যে। মারিন ল্য পেনকে অনেক অনেক পিছনে ফেলে নিশ্চিত করেছেন তার দলের জয়। কিভাবে শুরু হলো তার এই যাত্রা? একটু পিছনের দিকে ফিরে তাকানো যাক।
১৯৭৭ সালের ২১ ডিসেম্বর উত্তর ফ্রান্সের আমিয়েন্সে জন্মগ্রহণ করেন ইমানুয়েল মাকরঁ। চিকিৎসক মা-বাবার সন্তান মাকরঁ পড়াশোনায় ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী। পড়াশুনা ছাড়াও সাহিত্য, রাজনীতি আর থিয়েটার ছিল তার ভালো লাগার বিষয়। বাল্যকালে তার প্রাথমিক পড়াশোনা শুরু হয় স্থানীয় জেসুইট স্কুল লা প্রভিডেন্সে। প্যারিসের মর্যাদাপূর্ণ লাসি হেনরি (চতুর্থ) স্কুলে তিনি হাই স্কুলের পড়াশোনা সম্পন্ন করেন। এরপর ২০০৪ সালে এলিট ইকলা ন্যাশনাল ডি অ্যাফেয়ার্স থেকে স্নাতক এবং পরে লোক প্রশাসনে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন।
তারপর শুরু হয় তার চাকুরি জীবন। এ সময় মাকরঁ পরিদর্শক হিসেবে ফ্রান্সের অর্থ মন্ত্রণালয়ে যোগদান করেন। ২০০৭ সালে তিনি দ্বিপাক্ষিক অর্থনৈতিক উন্নয়ন সংক্রান্ত আত্তালি কমিশনে নিয়োগ পান। পরের বছর সরকারি চাকুরি ছেড়ে মাকরঁ রথশিল্ড অ্যান্ড কোং ইন ইনভেস্টমেন্ট ব্যাঙ্কিংয়ে উচ্চ বেতনে ম্যানেজিং ডাইরেক্টর পদে যোগদান করেন। অল্প কয়েক বছরের মধ্যেই কোটিপতি ব্যাঙ্ক-কর্মকর্তা হয়ে ওঠেন তিনি। মাকরেঁর উত্থানের মতোই চমকপ্রদ তাঁর ব্যক্তিগত জীবনও। মাত্র ১৭ বছর বয়সে নিজের চেয়ে ২৫ বছরের বড় এক হাই স্কুল শিক্ষিকা এবং তিন সন্তানের জননী ব্রিজিত ত্রনিওর গভীর প্রেমে পড়েন। ২০০৭ সালে সেই প্রেমের শুভ পরিণতি ঘটে।
মাকরঁ ২০০৬ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত সমাজবাদী পার্টির শুধুমাত্র একজন সাধারণ সদস্য ছিলেন। ২০১২ সালে ঘটে তার রাজনৈতিক উত্থান। এ সময় দলের ডেপুটি সেক্রেটারী জেনারেল হন। ঐ বছরেই সমাজবাদী পার্টির দলনেতা ফ্রাসোঁয়া ওলাঁদ ফ্রান্সের রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন।
ওলাঁদের মন্ত্রীসভায় অর্থমন্ত্রী মাকরঁ হিসেবে নিযুক্ত হন এবং ব্যবসা-বান্ধব পরিবেশ তৈরির জন্য কিছু আইনের সংশোধনের উদ্যোগ নেন। সরকারি ব্যয় কমানোর জন্য বড় ধরনের উদ্যোগ নেন তিনি। তবে সেই সময়ে তাকে নিয়ে বিতর্ক কিছু কম হয়নি বটে। উদারপন্থী কিছু সংস্কারের জেরে সরকারের অন্দরেই বিরাগভাজন হন তিনি।
২০১৫ সালের আগস্টে মন্ত্রী পদ থেকে ইস্তফা দেন মাকরঁ। পরবর্তীতে দল থেকে বের হয়ে কোনো দলের অন্তর্ভুক্ত না হয়েই রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে কাজ শুরু করেন। ২০১৬ সালের এপ্রিল মাসে গড়ে তোলেন নিজের দল ‘অঁ মার্শ’। নিজেকে তিনি ‘প্রতিষ্ঠান-বিরোধী’ হিসেবে তুলে ধরতে চেষ্টা করেন এবং এতে সফলও হন। দলের সদস্য সংখ্যা বলতে গেলে মাত্র দু’লক্ষ। তিনি বা তার দল— দুই-ই তাই ফরাসি জনতার কাছে বেশ তরতাজা।
মাত্র ৩৯ বছর বয়সে মাকরঁ তেমন কোনো বড় রাজনৈতিক দলের সমর্থন ছাড়াই উঠে এসেছেন রাজনীতির পাদপ্রদীপে। অনেকটা ধূমকেতুর মতোই তার উত্থান। অনেক রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞই ভেবেছিলেন, মাকরেঁর যেহেতু সে অর্থে কোনো অভিজ্ঞতা নেই, এমন একটা মানুষের উপরে কিছুতেই ফরাসি নাগরিকরা ভরসা করবেন না। কিন্তু ফ্রান্সের আমজনতা সেই ধারণাকে ভুল প্রমাণ করে দিয়েছে এবং তারা বুঝিয়ে দিয়েছেন, প্রতিষ্ঠিত কোনো রাজনৈতিক দল বা প্রার্থীর উপর তাদের কোনো আস্থা নেই।
রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবেন ঘোষণা দেয়ার পরেই তিনি তার নির্বাচনী কৌশলে নতুনত্ব আনার চেষ্টা করেন। তিনি দেশের মানুষের মনের কথা, হতাশার কথা অন্তর থেকেই বুঝতে পেরেছিলেন বলেই শুরু থেকে গুরুত্ব দিয়েছেন তৃণমূলকে। তার সাথে যুক্ত হয় মাকরেঁর রাজনৈতিক বিচক্ষণতা। মাকরেঁর রাজনৈতিক পরামর্শদাতা হিসেবে তার প্রচার শিবিরে যে তিন ফরাসি যুবককে তিনি নিয়োগ দেন, তারা সকলেই ওবামার প্রচার শিবিরে প্রথম কাজ করে হাত পাকিয়ে এসেছিলেন। তারাই ওবামার সেই প্রচার কৌশলই ফিরিয়ে আনেন মাকরেঁর জন্য। নির্বাচনের অনেক আগে থেকেই ভোটারদের দ্বারে দ্বারে গিয়ে কথা বলেছেন আমজনতার সাথে, শুনেছেন তাদের নানা প্রত্যাশার কথা। এগুলোর পাশাপাশি কিছু রাজনৈতিক ঘটনাও সহায়তা করেছে মাকরঁকে। ইমানুয়েল মাকরঁ নির্বাচনের শুরু থেকেই ইউরোপীয় ইউনিয়নে ফ্রান্সের থেকে যাওয়ার পক্ষে সাওয়াল করেন। উদার অর্থনীতির পক্ষে সবর্দা মুখর এই রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব।
কিন্তু তার প্রতিদ্বন্দ্বী ল্য পেন ছিলেন ‘একলা চলো’র পক্ষে৷ তার কথাবার্তা ছিল শুরু থেকেই নেতিবাচক। তিনি ছিলেন পদ্ধতি বিরোধী। ল্য পেনের লক্ষ্য ছিল, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের আদলে ‘ফ্রান্স সবার আগে’-এ নীতি প্রয়োগ করা। তিনি উগ্র জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী এবং অভিবাসী বিরোধী। ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) থেকে ফ্রান্সের বের হয়ে যাওয়ার পক্ষে ছিলেন পেন। তাই ল্য পেন প্রেসিডেন্ট পদে জিতে এলে অর্থনৈতিকভাবে কোণঠাসা ফ্রান্সে খুব ভাল কিছু করতে পারবেন না সে ব্যাপারে নিঃসন্দেহ ছিল অনেক রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞই।
গোড়া থেকে ‘জিতে যাবো’ মার্কা কোনো আত্মবিশ্বাস মাকরেঁর ছিল না যা শাপে বর হয়েছে তার জন্য। আরো একটি বিষয় খুব গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিনিয়ত তার তুলনা করা যেতে পারে প্রাক্তন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ওবামার সাথে। আবার ওবামার সরাসরি মাকরেঁর জন্য সরব হওয়া, সবকিছুই মাকরেঁর পক্ষে যায়। দ্বিতীয় দফায় প্রেসিডেন্ট হওয়ার পরে ফ্রান্সে তুমুল জনপ্রিয়তা পেয়েছিলেন ওবামা।
মাকরেঁর নির্বাচনী প্রচার ছিল বৈচিত্র্যময় ও উৎসবমুখর পরিবেশ। অপর দিকে ল্য পেনের সভা ছিল হাঙ্গামামুখর, বিশৃঙ্খলাপূর্ণ। মাকরঁ সবসময় জনগণের মাঝে আশার বাণী শুনিয়েছেন। সকলকে নিয়ে পথ চলা, উদার গণতন্ত্র চর্চা, জনকল্যাণ এবং পেনশন ব্যবস্থা সংস্কারের বিষয় ভোটারদের মনে আশার আলো সঞ্চার করেছেন। নির্বাচনী প্রচারাভিযানে মাকরঁ জনগণের মাঝে অঙ্গীকার করেন যে তিনি রাষ্ট্রীয় ব্যয় কমাবেন, শ্রম আইন শিথিল করবেন, বঞ্চিত এলাকাগুলোয় শিক্ষার সুযোগ বাড়াবেন এবং আত্মকর্মসংস্থানে যুক্ত মানুষের সুরক্ষায় নতুন ব্যবস্থা নেবেন।
২৩.৯% ভোট পেয়ে প্রথম রাউন্ড পার হয়ে যাওয়ার পর ল্য পেনের বিরুদ্ধে একজোট হওয়ার ডাক দেন ফ্রান্সের অধিকাংশ রাজনৈতিক দল। এমনকি মাকরেঁর হয়ে সওয়াল করেন বিদায়ী প্রেসিডেন্ট ফ্রাসোঁয়া ওলাঁদও। এরপরও অনেকেরই অভিমত, মাকরেঁর পাশে ছিল ভাগ্য আর রাজনৈতিক কৌশল দেখানোর ক্ষমতা। সবাই যে মাকরঁকে চেয়েই ভোট দিয়েছেন, এমনটাও নয়। অতি দক্ষিণপন্থী নেত্রী ল্য পেনকে আসতে দেওয়া যাবে না, এই কারণেও অনেকে মাকরঁকে বেছে নিয়েছেন। ফলে মাকরেঁর পক্ষে নির্বাচনী ময়দানে জেতা অনেক সহজ হয়ে যায়।
অতি-দক্ষিণ নেত্রীকে বিপুল ভোটে হারিয়ে (প্রায় ৬৫ শতাংশ ভোটে) মধ্যপন্থী রাজনীতির তরুণ মুখ ইমানুয়েল মাকরেঁর হাত ধরেই নতুন সম্ভাবনার দিকে এগিয়ে যাবে ফ্রান্স- এমনই বিশ্বাস ফ্রান্সের আপামর জনতার।
একলা পথ চলা নয়, বরং সংঘবদ্ধ ইউরোপীয় ইউনিয়নেই ভরসা রাখলেন ফ্রান্সের জনসাধারণ। জয়ের পরে মাকরেঁর তাই ঘোষণা: ‘‘সামনে থাকা কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে সব নারী-পুরুষকে একজোট করাই আমার দায়িত্ব। আমার সর্বশক্তি দিয়ে বিভাজন রুখব।’’
মাকরঁ কি পারবেন তার নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করতে? ফ্রান্স তথা আপামর ইউরোপবাসীর মনে যে আশার সঞ্চার হয়েছে তা পূরণ করতে? তার জন্য আমাদের আরো কিছুটা সময় অপেক্ষা করতে হবে। তবে তরুণ উদ্দীপ্ত জননেতা হিসেবে ইমানুয়েল মাকরঁ ফ্রান্সে নব জাগরণ আনবেন এই বিশ্বাস বিশ্ববাসীর।