মে, ২০২৩; অন্যান্যদিনের মতোই শুরু হয়েছিল প্লাটোস ক্লজেট (Plato’s Closet) দোকানের নৈমিত্তিক কাজকর্ম। নর্থ ক্যারোলাইনার অ্যাশভিল শহরের এই সুপারস্টোরে প্রতিদিন প্রচুর লোক ঢুঁ মারেন। অলস দৃষ্টিতে তাদের আনাগোনা দেখছিলেন দোকানমালিক।
এক জুটির ওপর আটকে গেল তার চোখ। পনের বছরের এক কিশোরীর সাথে চল্লিশোর্ধ্ব এক মহিলা। মা-মেয়েই মনে হচ্ছে। কোনো অস্বাভাবিকতা নেই তাদের আচরণে। কিন্তু কেন যেন খচখচ করছে দোকানমালিকের মন। মেয়েটিকে কোথাও দেখেছেন মনে হচ্ছে। কিন্তু কোথায়? হঠাৎই চোখ বড় বড় হয়ে গেল তার। মনে পড়েছে! দেরি না করে ফোন তুললেন তিনি, খবর দিতে হবে পুলিশে!
কেইলা আনবেহান
নয় বছরের ফুটফুটে মেয়ে কেইলা আনবেহান (Kayla Unbehaun) থাকে ইলিনয়ের শিকাগোতে। বাবা রায়ান আইজারকা (Ryan Iserka) আর মা হেদার আনবেহানের বনিবনা নেই। তাই ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে। আদালতের তরফ থেকে রায়ানকে দেয়া হয়েছে মেয়ের সম্পূর্ণ ভার, হেদার কেবল দেখা করতে পারবেন, তা-ও আগে থেকে জানিয়ে যেতে হবে। মেয়েকে নিয়ে কোথাও যেতে হলে লাগবে বাবার অনুমতি।
২০১৭ সালের ৪ঠা জুলাই মেয়েকে হেদারের বাসায় নামিয়ে দিয়ে এলেন বাবা। পরদিন নিয়ে আসতে গিয়েই বাধল ঝামেলা। কেইলা আর তার মায়ের কোনো হদিস নেই! দ্রুত পুলিশকে জানানো হলো। প্রতিবেশীদের সাথে কথা বলে জানা গেল হেদার মেয়েকে নিয়ে গাড়িতে মালপত্র চাপিয়ে উইসকন্সিনের দিকে ক্যাম্পিং করতে গেছেন, অন্তত সেটাই সবাইকে বলেছেন তিনি। কিন্তু আসলে মেয়েকে নিয়ে পালিয়েছেন ভদ্রমহিলা।
রায়ান মেয়ের খোঁজে হন্যে হয়ে গেলেন। এজন্য অর্থ যোগাতে অনলাইনে সাহায্যের আবেদনও জানান তিনি। সেখানে উল্লেখ করেন ফোন বা সোশ্যাল মিডিয়া কোনোখানেই সক্রিয় নেই তার প্রাক্তন স্ত্রী, ফলে তাকে ট্রেসও করা যাচ্ছে না। পুলিশও তাকে খুঁজে পেতে ব্যর্থ হয়েছে।
কোনো সূত্র না থাকায় পুলিশের ফাইলে কেইলার কেস অনেকটা হিমাগারে চলে যায়। তবে রায়ান হাল ছাড়েননি। ফেসবুকে নিয়মিত মেয়েকে নিয়ে পোস্ট দিতে থাকেন। এই বছরের ৬ জানুয়ারি কেইলা জন্মদিনে তাকে শুভ জন্মদিন জানিয়ে অচিরেই আবার বাবা-মেয়ে এক হবেন বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।
নেটফ্লিক্স
কেইলাসহ হারিয়ে যাওয়া শিশুদের নিয়ে কাজ করে ন্যাশনাল সেন্টার ফর মিসিং অ্যান্ড এক্সপ্লোয়েটেড চিল্ড্রেন (এনসিএমইসি) নামে একটি সংস্থা। তারা বড় হবার সাথে সাথে কেইলার চেহারা কেমন হবে সেই ছবি তৈরি করে প্রযুক্তির সাহায্যে। সেটা তাদের সাইটে প্রচার করা হয়। নেটফ্লিক্সের একটি সিরিজেও কেইলার কথা উঠে আসে। আলাদা হয়ে যাওয়া বাবা বা মা অনেক সময় সন্তানের দায়িত্ব বিষয়ে আদালয়ের রায় মেনে নিতে পারেন না। তখন তিনি আদালতের নির্দেশের ব্যত্যয় ঘটিয়ে সন্তানকে নিয়ে পালিয়ে যাবার চেষ্টা করতে পারেন, আইনের পরিভাষায় এটি অপহরণ বলে বিবেচিত হয়।
এরকম অপহরণের ঘটনা নিয়ে তৈরি হয়েছিল নেটফ্লিক্সে প্রচারিত ‘আনসল্ভড মিস্ট্রিজ’ এর তৃতীয় ভলিউমের নবম এপিসোড ‘Abducted By A Parent’। মজার ব্যাপার হলো- এপিসোডের বিষয়বস্তু কেইলাকে নিয়ে নয়, কেবল শেষদিকে এরকম অপহৃত হওয়া কিছু শিশুর মধ্যে তার ছবিও দেখানো হয়, যেখানে প্রযুক্তি ব্যবহার করে সেই বয়সের চেহারা তৈরি করা হয়েছিল।
উদ্ধার
কেইলাকে নেটফ্লিক্সের সিরিজ থেকেই চিনতে পেরেছিলেন দোকানমালিক। তার ফোন পেয়ে পুলিশ এসে মাকে গ্রেফতার করে অপহরণের অভিযোগে। পরে আড়াই লাখ ডলারের বিনিময়ে জামিন হয় তার। কেইলাকে তুলে দেয়া হয় সোশ্যাল সার্ভিসের কাছে। তারা তাকে বাবার কাছে ফিরিয়ে দেয়ার প্রক্রিয়া আরম্ভ করেছে।
ঠিক কে মেয়েটির কথা পুলিশকে জানিয়েছিলেন তা নিয়ে অবশ্য কিছুটা ধোঁয়াশা আছে। দোকানমালিকের কথা বলা হলেও ভিন্ন কিছু সূত্র দাবী করছে দোকানে কাজ করা কেইলার এক সমবয়সী তাকে শনাক্ত করে। সেটা কেবল নেটফ্লিক্সের জোরে নয়, কেইলার যখন বাবার সাথে থাকত তখন নাকি তাদের পরিচয় ছিল।
যিনিই ফোন করে থাকুক না কেন, স্থানীয় পুলিশ অফিসার ডায়ানা লাভ্ল্যান্ড (Diana Loveland) তাদের সাধুবাদ জানিয়েছেন। তিনি অনুরোধ করেছেন অপহরণের ঘটনা যতো পুরনোই হোক না কেন, কেউ কোনো সূত্র পেলে সাথে সাথে যেন তাদের জানান।
রায়ান খবর পেয়ে ইতোমধ্যে সবাইকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন। সাথে সাথে কামনা করেছেন তাদের ব্যক্তিগত গোপনীয়তার প্রতি যেন সকলে শ্রদ্ধাশীল থাকে। তিনি মেয়ের সাথে হারিয়ে যাওয়া সময়টুকু উসুল করে নিতে চান, এবং তাদের পরিবারকে এ সময় যেন কেউ বিরক্ত না করে সেটা তার চাওয়া।
এনসিএমইসি-র কর্মকর্তা ক্যালাহান ওয়ালশের মতে, হারিয়ে যাওয়া মানুষদের খুঁজে বের করতে মিডিয়া গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। তাদের গল্প যত মানুষের কাছে পৌছবে, ততই কোনো না কোনো সূত্র পাবার সম্ভাবনা বাড়বে। নেটফ্লিক্সের এই ঘটনা একটা উদাহরণ মাত্র, ভবিষ্যতে হয়তো এমন আরো দেখতে পাবো আমরা।