আপনি কার্টুন দেখেন কেন? নিশ্চয়ই মনের খোরাক যোগানো ও বিনোদনের জন্য? কিন্তু কার্টুন যদি কিছু অপ্রীতিকর বা প্রীতিকর ভবিষ্যতের কথা হাসতে খেলতেই বলে দেয়, তাহলে কেমন লাগবে? বিশ্বাস করতে পারবেন কি? হ্যাঁ, বিশ্বাস করা একটু কঠিন হবে। কিন্তু, এমনটা হতেই পারে। যারা দ্য সিম্পসন্স কার্টুন দেখেন, আশা করছি, তারা বুঝতেই পেরেছেন এমন অদ্ভুত কথা বলছি।
সিচ্যুয়েশনাল কমেডি এই কার্টুনের স্রষ্টা ম্যাট গ্রোনিং ও তার দল এতটাই দূরদর্শী যে, হরহামেশাই মানুষকে হাসাতে হাসাতে কার্টুনের মাধ্যমে বলে দেন কিছু সুদূর ভবিষ্যতের কথা। এ পর্যন্ত দ্য সিম্পসন্সের ৩০টি সিজন বের হয়েছে। এই সিজনগুলোর প্রতিটাতে না হলেও কিছু কিছু সিজনের একাধিক পর্বের গল্প একসময় বাস্তব ঘটনা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। চলুন, প্রথম থেকে শুরু করা যাক।
সিজন ০২
১। ত্রিচোখী মাছ (পর্ব ০৪)
এ পর্বে দেখানো হয়, স্থানীয় পত্রিকায় হেডলাইন এসেছে, “পাওয়ার প্ল্যান্টের মাধ্যমে তৈরি হওয়া এক নদীতে ব্লিঙ্কি নামে একটি ত্রিচোখী মাছ পেয়েছে বুর্ট।”
পর্বটির সম্প্রচার হয় ১৯৯০ সালে। প্রায় ২১ বছর পর, ২০১১ সালে আর্জেন্টিনার একটি নদীতে ধরা পড়ে তিন চোখ বিশিষ্ট একটি ওলফ ফিশ। মাছটি যে নদীতে ধরা পড়ে, সেটিও নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্ল্যান্টের মাধ্যমে তৈরি হওয়া একটি নদী।
২। মাইলেকেঞ্জেলোর ‘অশ্লীল’ ভাস্কর্য (পর্ব ০৯)
১৯৯০ সালে সম্প্রচারিত এ পর্বে দেখানো হয়, ইতালির বিশিষ্ট শিল্পী মাইকেলেঞ্জেলোর তৈরি ডেভিডের প্রথাগত অর্থে ‘অশালীন’ ভাস্কর্য স্থানীয় জাদুঘরে প্রদর্শনের বিরূদ্ধে স্প্রিংফিল্ডিয়ানরা প্রতিবাদ জানায়। দ্য সিম্পসন্সের জগতটির নাম স্প্রিংফিল্ড। আর এখানকার অধিবাসীকে বলা হয় স্প্রিংফিল্ডিয়ান।
২০১৬ সালে এমনই ঘটনা ঘটতে দেখা যায় রাশিয়াতে। রাশিয়ানরা আন্দোলন করেন সেইন্ট পিটার্সবার্গের প্রাণকেন্দ্রে মাইলেকেলেঞ্জেলোর তৈরি ‘ডেভিড’ ভাস্কর্যটিকে পোশাক পরানোর জন্য। বলা বাহুল্য, মাইকেলেঞ্জেলো রেঁনেসা যুগের বেশ নামকরা একজন চিত্রশিল্পী ছিলেন যিনি বিব্লিক্যাল হিরো ডেভিডের (ইসলাম ধর্মানুসারীদের নবী দাউদ (আঃ)) নগ্ন চিত্রকর্ম তৈরি করেছিলেন। এটি রাশিয়ায় স্থাপন করা হলে রাশিয়ানরা একে মূল্যবোধের অবক্ষয় মনে করে এবং দাবি করে যেন ভাস্কর্যের লজ্জাস্থান ঢেকে দেওয়া হয়।
৩। দ্য বীটলসের চিঠি (পর্ব ১৮)
সিজন ০২ এর এই পর্বটি সম্প্রচার হয় ১৯৯১ সালে। এখানে দেখানো হয়, দ্য বীটলস ব্যান্ডের রিংগো স্টার উচ্ছ্বসিতভাবে এক দশক পর ভক্তের কাছ থেকে পাওয়া একটি ইমেইলের উত্তর দিচ্ছেন।
এসেক্সে বসবাসরত বীটলসের দু’জন ভক্ত একটি চিঠি আর রেকর্ডিং পাঠিয়েছিলেন লন্ডনের এক থিয়েটারে বাজানোর জন্য। ৫০ বছর পর, ২০১৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে পল ম্যাককার্টনি (বীটলসের একজন গায়ক) তাদের এই চিঠি ও রেকর্ডিংয়ের উত্তর দেন। ম্যাককার্টনি রেকর্ডিংটি পেয়েছেন কাকতালীয়ভাবে। একটি ঐতিহাসিক গাড়ি নিলাম করা হয়েছিল যেটি তিনি কেনেন। এই গাড়িতেই মেলে ১৯৬৩ সালে পাঠানো তার ভক্তদের এই রেকর্ডিং।
সিজন ০৫
৪। ‘সিগফ্রিড এন্ড রই’-এর উপর বাঘের আক্রমণ (পর্ব ১০)
এই পর্বটি ‘স্প্রিংফিল্ড’ বা ‘হাও আই লার্নড টু স্টপ ওরিং অ্যান্ড লাভ লিগালাইজড গ্যাম্বলিং’ নামে পরিচিত। এ পর্বে দেখানো হয়, একজন জাদুকর একটি ক্যাসিনোতে সাদা বেঙ্গল টাইগারকে নিয়ে খেলা দেখাচ্ছেন। হঠাৎ বাঘটি হিংস্র হয়ে যায় এবং জাদুকরকে আঘাত করে। পর্বটি সম্প্রচারিত হয় ১৯৯৩ সালে।
২০১৩ সালে ‘সিগফ্রিড এন্ড রই’ জাদুদল জাদু দেখানোর সময় তাদের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সাদা বেঙ্গল টাইগার, মন্টেকর হঠাৎ আক্রমণ করে রই হর্নের উপর। প্রাণে বেঁচে গেলেও গুরুতর আহত হন তিনি।
৫। ঘোড়ার মাংসের স্ক্যান্ডাল (পর্ব ১৯)
১৯৯৪ সালে সম্প্রচারিত পর্বটিতে দেখা যায়, স্প্রিংফিল্ড এলিমেন্টারিতে লাঞ্চলেডি ডরিস ভিন্ন ভিন্ন প্রজাতির ঘোড়ার বাতিলকৃত বিভিন্ন অংশ দিয়ে তৈরী খাবার তার শিক্ষার্থীদের খাওয়ান।
বর্তমানে খাবারে ভেজালের ঘটনা তো হরহামেশাই ঘটে থাকে। এই ক’ বছর আগে প্যারিসে ৪ জনকে আটক করা হয়েছে গরুর মাংস বলে ঘোড়ার মাংস বিক্রির জন্য।
সিজন ০৬
৬। অটোকারেক্ট (পর্ব ০৮)
১৯৯৪ সালে আইফোনের অটোকারেক্ট ফিচার নিয়েও আছে দ্য সিম্পসন্সের একটা পর্ব। যার নাম ‘লিসা অন আইস’। এখানে দেখানো হয় কিয়ার্নি বন্ধু ডোলফকে বলে তার পারসোনাল ডিজিট্যাল অ্যাসিস্ট্যান্টে ‘বিট আপ মার্টিন’ লিখতে। কিন্তু অটোকারেকশনের কারণে সেটি হয়ে যায় ‘ইট আপ মার্থা’। ফলে, তারা শত্রু মাটিনকে গণধোলাই দিতে পারেনি।
২০০৭ সালে আইফোনে অটোকারেক্ট অপশন যোগ হয়। এবং আমরা সবাই জানি, এই সফটওয়্যারটা মাঝে মাঝে খুবই বিরক্তিকর হয়ে দাঁড়ায়।
৭। উন্নত প্রযুক্তি (পর্ব ১৯)
স্মার্টওয়াচ, ভিডিও কল এবং কর্পোরেট রোবটের ব্যবহারের ধারণাও সর্বপ্রথম ম্যাট গ্রোনিং-এর দ্য সিম্পসন্সই দিয়েছে। কয়েকভাগে বিভক্ত ‘লিসা’স ওয়েডিং’ পর্বটি সম্প্রচারিত হয় ১৯৯৫ সালে। এ পর্বে এক জ্যোতিষী বলেন, “২০১০ সালে পৃথিবীতে ভালো কিছু পরিবর্তন আসবে। আমরা প্রযুক্তিনির্ভর হবো।” তিনি এটাও বলেন, “এ সময় গাছপালার অভাববোধ করবে মানুষ।” এবং এই পর্ব সম্প্রচারের প্রায় ২০ বছর পর, এখন আমাদের জীবনটা অনেকটা এমন হয়ে গেছে।
কয়েক বছর আগে আইফোন প্রথম স্মার্টওয়াচ নিয়ে আসে এবং এখন এই ঘড়ির ব্যবহার বর্তমানে বহুল প্রচলিত। শুধু তা-ই নয় , এখন ভিডিও কল ছাড়া অল্প দূরের মানুষের সাথেও যেন কথা বলে মন ভরে না। তাই কথা বলার সাথে সাথে মানুষটিকে দেখাতেও আমরা বেশ অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি। এবার আসি, কর্পোরেট রবোটের কথা।
সিম্পসন্সে দেখানো হয়, মানুষের পরিবর্তে লাইব্রেরিয়ানের দায়িত্ব পালন করছে সিম্পসন্স জগতের রোবটরা।
যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব এবারিসবিথের শিক্ষার্থীরা গ্রোনিং-এর এই কল্পনাকে সর্বপ্রথম বাস্তবে রূপ দেয়। পরবর্তীতে বিভিন্ন গবেষণাগারেও রোবটের ব্যবহার পরিলক্ষিত হয়।
৮। দ্য শার্ড আবিষ্কার (পর্ব ১৯)
এই ভবিষ্যদ্বাণীও ‘লিসা’স ওয়েডিং পার্ট ২’ পর্বে হয়। লিসা লন্ডনের বেড়াতে গিয়ে টাওয়ার ব্রিজের পেছনে একটা গগনচুম্বী দালান দেখে, যেটি পরবর্তী সময়ে ২০০৯ সালে তৈরি হওয়া বিশ্বের সবচেয়ে বড় দালান দ্য শার্ডের মতো দেখাচ্ছিল।
দ্য শার্ড পশ্চিম ইউরোপের সবচেয়ে উঁচু দালান। ৮৪ তালা বিশিষ্ট এই ভবনটি নির্মাণ করেন রেঞ্জো পিয়ানো নামের এক স্থপতি। লিসার দেখা গগনচুম্বী দালানটার শীর্ষভাগ ছিল সূঁচালো এবং দ্য শার্ডের শীর্ষভাগও তেমনটাই।
পর্বটির লিংক সংযুক্ত করা হলো। চাইলে চার সেকেন্ডের (২.২৭ মিনিট থেকে ২.৩০ মিনিট) এই অংশটুকু দেখে নিতে পারেন।
সিজন ০৮
০৯। হিগস বোসন কণা (পর্ব ০১)
১৯৯৮ সালে ‘দ্য উইজার্ড অব এভারগ্রিন ট্যারেস’ পর্বে হোমার সিম্পসন্স একটি জটিল সমীকরণ আবিষ্কার করেন। যেটি ২০১৩ সালে ব্যবহার করে হিগস বোসন কণা বা ঈশ্বর কণার অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়। ১৯৬৪ সালে হিগস এবং কয়েকজন পদার্থবিদ মৌলিক কণার ভর নিয়ে গবেষণা করেন। এ গবেষণার ফলাফল আসে, একটি কণা আছে যা সকল মৌলিক কণার ভর বলে দিবে। এই কণার নাম দেওয়া হয় হিগস বোসন কণা।
ধারণা করা হয়, দ্য সিম্পসন্সের লেখক দলটি অংকে বেশ পারদর্শী। একারণেই তারা এই সমীকরণটি সমাধান করতে পেরেছিল।
সিজন ১০
১০। ডিজনির টুয়েন্টিএথ সেঞ্চুরি ফক্স (20th Century Fox) কেনা (পর্ব ০৫)
১৯৯৮ সালে সম্প্রচার হয় দ্য সিম্পসন্সের ‘হোয়েন ইউ ডিশ আপুন অ্যা স্টার’ পর্বটি। এখানে দেখানো হয়, ডিজনি টুয়েন্টিএথ সেঞ্চুরি কোম্পানিটি ফক্স কোম্পানি কিনে নিচ্ছে।
আশ্চর্যজনক হলেও সত্য যে, ২০১৭ সালের ১৪ ডিসেম্বর ৫২.৪ বিলিয়ন ডলারের বিনিময়ে ডিজনি টুয়েন্টি-ফার্স্ট সেঞ্চুরি কোম্পানিটা ফক্স কিনে নেয়।
সিজন ১১
১১। ডোনাল্ড ট্রাম্পের ক্ষমতায়ন
পর্বটির নাম ‘বুর্ট টু দা ফিউচার’। একদিন বুর্ট স্বপ্নে দেখে, লিসা ডোনাল্ড ট্রাম্পের বংশধর হিসেবে উত্তরাধিকারসূত্রে আমেরিকার রাষ্ট্রপতি হয়েছে। লিসার ক্ষমতায়নে ফলে আমেরিকায় করুণ দুর্দশা নেমে এসেছে, কারণ সে মোটেও ভালো শাসক ছিল না। পর্বটি সম্প্রচারিত হয়েছিল ২০১০ সালে এবং ট্রাম্প নির্বাচনে জয়লাভ করেন ২০১৬ সালে।
সিজন ২০
১২। ত্রুটিপূর্ণ ভোটিং মেশিন (পর্ব ০৪)
২০০৮ সালের এই পর্বে দেখানো হয়, আমেরিকার জেনারেল ইলেকশনে দ্য সিম্পসন্স ক্যারেক্টার হোমার বারাক ওবামাকে ভোট দিতে চায়, কিন্তু ত্রুটিপূর্ণ ভোটিং মেশিনের কারণে তার ভোট বদলে যায়।
২০১২ সালে আমেরিকার ভোট চলাকালে এ ধরনের ত্রুটির কারণে পেনসিল্ভেনিয়ার এক ভোটিং মেশিন অপসারণ করা হয়।
সিজন ২১
১৩। অলিম্পিকের কারলিং খেলায় আমেরিকার সুইডেনকে হারানো (পর্ব ১২)
২০১০ সালে সম্প্রচার পায় ‘বয় মিট কার্ল’ পর্ব। এখানে দেখানো হয় মাজ এবং হোমার সিম্পসন্স ভ্যাঙ্কুভার অলিম্পিকের কারলিং খেলায় সুইডেনকে হারিয়ে আমেরিকার ঝুলিতে স্বর্ণপদক এনে দেয়।
২০১৮ সালের অলিম্পিকে বিশ্বকে অবাক করে সবার প্রিয় এবং একচেটিয়াভাবে চ্যাম্পিয়ন হয়ে আসা সুইডেন কারলিং দলকে হারিয়ে স্বর্ণপদক নেয় আমেরিকা দল।
সিজন ২২
১৪। নোবেল পুরস্কার বিজয়ী (পর্ব ০১)
২০১০ সালে দ্য সিম্পসন্সের ‘এলিমেন্টারি স্কুল মিউজিক্যাল’ পর্বে দেখানো হয়, স্প্রিংফিল্ডিয়ানরা ‘নোবেল পুরস্কার কারা পাবেন?’ এ বিষয়ে বেশ মতবিরোধ করে। এই দ্বন্দ্বকালে মার্টিন ধারণা করে, জগদীশ ভগবতী অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কার পাবেন। দ্য সিম্পসন্সের সেই পর্বে জগদীশ ভগবতীকে নোবেল পুরস্কার নিতে দেখা যায়।
২০১৬ সালে এমআইটির প্রফেসর জগদীশ ভগবতী অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কার অর্জন করে দ্য সিম্পসন্সের এই পর্বটিকেই সত্য প্রমাণিত করেন।
সিজন ২৯
১৫। গেম অভ থ্রোন্সের ড্যানেরিস টারগারিয়ানের প্লট টুইস্ট (পর্ব ০১)
গেম অভ থ্রোন্সের সিজন ০৮, পর্ব ০৫-এ সবাইকে অবাক করে ড্যানেরিস ড্রাগন ফায়ার দিয়ে কিংস ল্যান্ডিং জ্বালিয়ে দেয়। যদিও দর্শকরা এটা বিশ্বাসই করতে পারছিলেন না যে, ঘণ্টা বাজার পরেও ড্যানি যুদ্ধ থামাবেন না বরং ধ্বংস করে দিবেন সবাইকে। কিন্তু ২০১৭ সালে ম্যাট তা ইতোমধ্যেই ভেবে ফেলেছিলেন। এবং ‘দ্য সার্ফসন’ পর্বে সেটি দেখিয়েও-ছিলেন।
এছাড়াও ‘দ্য সিম্পসন্স’ কার্টুনে আরও কিছু ঘটনা দেখানো হয়, যা পরবর্তী সময়ে বাস্তবে রূপ নেয়। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে- ২০০৭ সালে প্রকাশিত ‘দ্য সিম্পসন্স’ মুভি, যেখানে নাসার স্পাইং স্ক্যান্ডালের কথা বলা হয়েছে, স্ক্যান্ডালটি ঘটে ২০১৩ সালে। ২০১২ সালে সম্প্রচারিত হওয়া সিজন ২৩ এর ২২ নং পর্বটি, যেখানে লেডি গাগার হাফটাইম শো নিয়ে বলা হয়েছে এবং ২০১৫ সালে প্রকাশ পাওয়া ফিফার দুর্নীতি নিয়ে ২০১৪ সালে সম্প্রচারিত হয় সিজন ২৫ এর ১৬তম পর্ব।