Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

ভারতীয়দের গুরুভক্তির রহস্য

সম্প্রতি উত্তর ভারতে এক ধর্মীয় গুরুর ভক্তরা তুমুল তাণ্ডব চালিয়েছে। হরিয়ানা ও পাঞ্জাব রাজ্যের শহরগুলো তছনছ করেছে, রেলস্টেশনে আগুন দিয়েছে, গাড়ি ভাঙচুর করেছে, গণমাধ্যমের গাড়িও জ্বালিয়ে দিয়েছে, নিরাপত্তাবাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষ করেছে। আর সেই সংঘর্ষে ঝরে পড়েছে অনেকগুলো তাজা প্রাণ

যার জন্য এই মানুষগুলো এমন উন্মাদনা দেখিয়েছে, এভাবে জীবন দিয়েছে, সেই ধর্মীয় গুরু গুরমিত রাম রহিম সিং একজন ধর্ষক। নিজের আশ্রমে দুজন নারীকে ধর্ষণ করেছে এই ব্যক্তি। আদালত তাকে ধর্ষণের দায়ে দোষী সাব্যস্ত করেছেন ও ২০ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছেন

আদালতের রায় ঘোষণার পর রাম সিংয়ের ভক্তদের তাণ্ডব; source: MONEY SHARMA/AFP/GETTY IMAGES

রাম রহিম সিং একজন ধর্মীয় গুরু হিসেবে পরিচিত হলেও, আধ্যাত্মিক নেতা হওয়ার চেয়ে একজন চটকদার বিনোদনকারী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছিল সে। জীবনে ‘সংযম’ থাকতে হবে- এই কথা বলে নিজেকেই ঐশ্বর্যের সাগরে ভাসিয়ে রেখেছিল সে। ‘রকস্টার বাবা’ নামে পরিচিত রাম রহিম সিং বেশ কয়েকটি সিনেমায় অভিনয় করেছে। নিজের আশ্রম ডেরা সাচ্চা সৌদার সামনে কনসার্টের আয়োজন করে, সেখানে নিজেই প্রধান গায়কের ভূমিকাও পালন করেছে রাম সিং।

নিজে তিন সন্তানের জনক হলেও অনেক অনুসারীকে নপুংসক করিয়েছে রাম রহিম সিং। ‘ঈশ্বরের আরো কাছে যেতে’ নাকি সে তাদেরকে এটা করতে বলেছিল, এমনকি নিজেকে ঈশ্বরও দাবি করেছে সে।

রাজনীতিতেও প্রভাব খাটাতে চেয়েছিল সে। তার বিরুদ্ধে চোরাকারবারী ও মানুষ খুনেরও অভিযোগ আছে। তবুও তার অসংখ্য ভক্ত আছে। শুধু হরিয়ানা ও পাঞ্জাবেই তার অনুসারীর সংখ্যা পাঁচ লাখ। আর সারা বিশ্বজুড়ে তার ভক্ত সংখ্যা প্রায় ছয় কোটি।

রাম রহিম সিংয়ের মতো সারা ভারত জুড়ে এমন হাজারো ধর্মীয় গুরু আছে। এটা শুধু কোনো নির্দিষ্ট ধর্মের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। মুসলিমদের মধ্যেও অনেককে মহাপুরুষ ভাবা হয় সেখানে। তাদের মাজার তৈরি করা হয়। ভারতের এমন গুরুর নজির নতুন নয়। যত দূর ভারতের ইতিহাস সম্পর্কে জানা যায়, তত দূর গুরুদের অস্তিত্বের কথাও জানা যায়। গুরুদের মধ্যেও আবার ভাগ আছে। কেউ কেউ ধনীদের গুরু। কেউ আবার গরীবদের ও মধ্যবিত্ত লোকদের গুরু। মহাঋষি মহেষ যোগীর মতো অনেকে আবার ‘বৈশ্বিক’ গুরু।

শুধু সাধারণ মানুষই এসব গুরুদের ভক্ত নন। অসাধারণ ব্যক্তিরাও আছেন তাদের ভক্তের তালিকায়। রাজনীতিবিদ, চলচ্চিত্র ও ক্রিকেট জগতের তারকাদের সঙ্গে আমলারাও আছেন সে দলে। ভারতের ক্রিকেট তারকা শচীন টেন্ডুলকারও এক গুরুর ভক্ত ছিলেন। সেই গুরুর নাম সাই বাবা। ২০১১ সালে যখন সেই গুরু মারা যান, স্ত্রীকে নিয়ে তার শেষকৃত্যে হাজির হন শচীন।

সাই বাবার মৃত্যুর পর শচীন টেন্ডুলকার; source: দ্য হিন্দু

ভারতের সবেচেয়ে প্রভাবশালী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বিবেচিত ইন্ধিরা গান্ধীও এক গুরুর ভক্ত ছিলেন। যোগগুরু ধীরেন্দ্র ব্রহ্মচারীর কাছে উপদেশ নেওয়ার জন্য প্রায়ই যেতেন ইন্ধিরা। শুধু পুরুষ গুরু নয়, ভারতে অনেক নারী গুরুও আছেন। তাদের মধ্যে অন্যতম প্রভাবশালী হলেন মাতা অমৃতানন্দময়ী। আশীর্বাদ ও থেরাপি দেওয়ার জন্য লোকজনের সঙ্গে কোলাকুলি করার দিক থেকে বেশ নাম কামিয়েছেন এই নারী গুরু।

গুরুদের জন্য তার ভক্তদের মাঝে রয়েছে উন্মাদনা। পাঞ্জাবের গুরু আশুতোশ মহারাজের জন্য উদ্ভট উন্মাদনা দেখিয়েছে তার শিষ্যরা। এই গুরুকে মৃত ঘোষণা করার পর তার মরদেহ ভক্তরা ডিপ ফ্রিজে রেখে দিয়েছিল। তাদের বিশ্বাস, একদিন তিনি আবার সাধারণ জীবনে ফিরে এসে শিষ্যদের নেতৃত্ব দিবেন।

তবে রাম সিংয়ের মতো অন্য অনেক গুরুর বিরুদ্ধে বিভিন্ন গুরুতর অভিযোগ আছে। এখন প্রশ্ন হলো, এত কু-কীর্তি থাকার পরও মানুষ এমন গুরুদেরকে কেন ভক্তি করে? কেন ভারতের লোকজন তাদের শিষ্য হয়?

এক গুরুর সঙ্গে ভারতের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি; source: এপি

এই প্রশ্নের জবাবে অনেকে মনে করেন, মূলধারার রাজনীতি ও ধর্ম মানুষের মনের অনুভূতি বুঝতে ও সেই অনুযায়ী কাজ করতে ব্যর্থ হওয়ায় লাখ লাখ মানুষ রাম সিংদের মতো গুরুদের কাছে যায়। ধীরে ধীরে বৈষম্য বৃদ্ধি পাওয়া এই পৃথিবীতে সাধারণ মানুষগুলো মনে করেন যে, রাজনীতিবিদরা ও ধর্মপ্রচারকরা সাধারণ মানুষের প্রতি নজর দিচ্ছেন না, তখন পরিত্রাণ বা মুক্তির জন্য তারা গুরু বা আধ্যাত্মিক লোকদের কাছে যান।

সমাজবিজ্ঞানী শিব বিশ্বনাথ বলেছেন,

“রাম সিংদের মতো গুরুদের উত্থান আমাদেরকে একটি বিষয় স্পষ্ট করে দেয় যে, গতানুগতিক রাজনীতি ও ধর্ম লাখ লাখ মানুষের কাছে ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে। তাই তারা মান-মর্যাদার জন্য অগতানুগতিক ধর্মের আশ্রয় নিয়েছে।”

তিনি আরো বলেন,

“আধুনিক গণতান্ত্রিক বিশ্বের নানা প্রান্তে এমন অনেক গোষ্ঠীর উদ্ভব হয়েছে। তারা লাখ লাখ অনুসারীর মধ্যে অভিন্ন অবস্থান ও আচার অনুষ্ঠানের মাধ্যমে সমতা নিশ্চিত করেছে।”

ধর্ষণের দায়ে ২০ বছরের কারাদণ্ড প্রাপ্ত রাম রাহিম সিং; source: saintdrmsginsan.me

আর এজন্যই রাম সিংয়ের ভক্তরা একটি অভিন্ন পদবি ব্যবহার করে। গোত্র, বংশ বা সমাজে অবস্থানসূচক পদবি বাদ দিয়ে সবাই নিজেদের নামের শেষে ‘ইনসান’ (মানুষ) শব্দটি ব্যবহার করে। তাই অনেক দলিত শ্রেণীর ও সমাজের পিছিয়ে পড়া মানুষজন রাম সিংয়ের ভক্তের তালিকায় নাম লিখিয়েছে।

অন্যদিকে, দ্রুত নগরায়ণের দিকে যাওয়া ভারতের অনেক মানুষের মধ্যে অতি উচ্চাশা, হতাশা ও মানসিক দ্বন্দ্ব থাকায় মহৌষধ হিসেবে তারা গুরুদের কাছে যান। যে মানুষগুলো নিজেদের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত দেখেন, মানসিক শান্তি পেতে শেষ ভরসা হিসেবে তারা গুরুদের কাছে দলবেধে ছুঁটে বেড়ান।

তারা মনে করেন, গুরুরা তাদের জীবনে বড় কিছু এনে দিতে পারবে, জীবনে অলৌকিক কিছু ঘটবে, যার মাধ্যমে জীবনটা পরিবর্তিত হয়ে যাবে। মারাত্মক অসুস্থ রোগীকে গুরু ভালো করে দিতে পারবে বলেও অনেকে বিশ্বাস করেন।

গুজরাটের সবারকণ্ঠ জেলায় এক গুরু আছে, যার হাজার হাজার অসুস্থ ভক্ত আছে। তিনি সবাইকে অঙ্গীকার করেছেন যে, অলৌকিকভাবে রোগমুক্ত করে দেওয়া হবে, কিন্তু ভক্তদের অনেকেই মারা গেছে। তবুও এখনো অনেক রোগী ভক্ত তার উপর বিশ্বাস করে বসে আছে।

রাম রাহিম সিংয়ের শাস্তির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাচ্ছে তার ভক্তরা; source: বিবিসি

সমাজবিজ্ঞানী দীপঙ্কর গুপ্ত বলেছেন,

‘গুরুদেরকে সাধারণত মন্ত্রসাধক হিসেবে দেখা হয়, যারা অলৌকিকতা দেখানোর কথা বলে। মানুষ গুরুর কাছে যায় এই বিশ্বাসে যে তাদের ক্ষেত্রেও এমন অলৌকিক কিছু ঘটবে।’

ধর্মের বিষয় উল্লেখ করে এই সমাজবিজ্ঞানী আরো বলেন,

‘ধর্ম ছদ্মাবরণ ছাড়া কিছু না। ধর্মের জন্য মানুষ গুরুদের কাছে যান না।’

ফলে মন্ত্র আর অলৌকিকতার উপর মানুষের যত দিন বিশ্বাস আছে, তত দিন গুরুরাও থাকবে বলে ধারণা করা যায়।

এছাড়া গুরুরা বিভিন্ন ধরনের সামাজিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গেও জড়িত থাকেন। তাদের কারো কারো পরিচালিত হাসপাতাল আছে। রাম সিংয়ের ছিল ব্লাড ব্যাংক। এছাড়া বৃক্ষরোপণ অভিযান চালাতো সে। কোনো কোনো গুরুর বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান আছে। এসবের মাধ্যমে তারা মানুষের কাছে পৌঁছায় ও তাদেরকে ভক্তে পরিণত করে।

আধুনিকতার ছোঁয়ায় ভারতের কয়েকটি শহর আমরা যতই উন্নত দেখি না কেন, বিশাল এ দেশের অনেক স্থানের মানুষ এখনও কুসংস্কারমুক্ত হতে পারেননি। তারা আদিম সমাজের অনেক কিছুই ছাড়তে পারেননি। ফলে তারা কুসংস্কারের উপর ভিত্তি করে অনেক ভণ্ড গুরুদের ভক্তে পরিণত হচ্ছেন। আর তাদের সরলতাকে কাজে লাগিয়ে অনেক প্রতারক গুরু সেজে বসে আছে। রাজনীতিবিদরাও ভোটের কথা বিবেচনা করে তাদের বিপক্ষে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া থেকে বিরত থাকে। এমনকি তাদের অনেকে সরাসরি গুরুদের উপর অনেকে ভক্তি-শ্রদ্ধাও প্রকাশ করে।

ফিচার ইমেজ- TSERING TOPGYAL /THE ASSOCIATED PRESS

Related Articles