ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন নিয়ে দুই ধরনের মতামত দিলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। একবার তিনি ইউরোপিয়ান ইউনিয়নকে বলছেন “বাণিজ্যের শত্রু”, অন্যদিকে কিছুদিন পর সেই ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের কাছেই যাচ্ছেন সন্ধি করতে, সাহায্য চাইতে এবং নিজ দেশের রপ্তানি বাণিজ্য নিয়ে ইউরোপের সাথে চুক্তি করতে।
ট্রাম্পের সাথে বোধহয় সব দেশের কোনো না কোনো সমস্যা আছেই। নতুন বছরের শুরু থেকেই চীনের সাথে তার দ্বৈরথ নিয়ে একটি চর্চা চলে আসছে। এখন নতুন করে যোগ হয়েছে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোর সাথে মনোমালিন্য। কিছুদিন আগেও ট্রাম্প ইউরোপ সম্পর্কে, সেখানকার বাণিজ্য সম্পর্কে, ইউরোপের বাণিজ্য নীতি সম্পর্কে নেতিবাচক মনোভাব প্রকাশ করতে ছাড়ছিলেন না। চীনের বিভিন্ন পণ্যের উপর নতুন করে ট্যারিফ প্রয়োগ করার মাধ্যমে তার নেতিবাচক মনোভাব কাজে প্রকাশ পেয়েছে। কিন্তু ইইউ এর ক্ষেত্রে কাজের থেকে সেটা কথায় বেশি প্রকাশ পাচ্ছিলো। সেই সময় ইউরোপিয়ান বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যম ট্রাম্পকে রীতিমতো উন্মাদ বলে সম্বোধন করেছে। বছরের মাঝামাঝিতে সংবাদমাধ্যমে এমন প্রচারণা শুরু হওয়ার পর অনেকের মনে হচ্ছিলো, এবার বোধহয় ট্রাম্পের নজর ইউরোপের দিকে। কিন্তু কিছুদিন যেতে না যেতেই ট্রাম্প তার সুর বদলে ফেলেছেন।
ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের সাথে ট্রাম্পের কী ধরনের সমস্যা হয়েছিলো সেটা নিয়ে আগে একটু আলোচনা করে নিই। গত মে মাসে এক সাক্ষাৎকারে ট্রাম্প ইউরোপ সম্বন্ধে বক্তব্য দেন এই বলে যে, বাণিজ্য করার জন্য ইউরোপ হচ্ছে একটি ভয়ংকর জায়গা। কিছুদিন আগে সিবিএস এর কাছে এক সাক্ষাৎকারে ইউরোপকে শত্রু বলে উল্লেখ করেন ট্রাম্প। যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপের মধ্যকার একটি বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের উদাহরণ হচ্ছে ন্যাটো। ট্রাম্পের অভিযোগ, এখন পর্যন্ত ২৮ সদস্য বিশিষ্ট এই ন্যাটোর ২৩টি দেশ তাদের বিল পরিশোধ করেনি। যুক্তরাষ্ট্র, গ্রিস, পোল্যান্ড, এস্তোনিয়া এবং যুক্তরাজ্য তাদের মোট জিডিপির কমপক্ষে দুই শতাংশ ন্যাটোর চুক্তি অনুযায়ী নিজেদের সামরিক বাহিনীতে ব্যয় করেছে। আর কোনো দেশ এখন পর্যন্ত এই চুক্তিতে নির্দেশিত নিয়ম পূরণ করতে পারেনি। ভ্লাদিমির পুতিনের সাথে সাক্ষাৎ করার আগে ট্রাম্প এই বক্তব্য দেন।
তবে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন কাউন্সিলের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড টাস্ক তার বিবৃতিতে বলেন, ট্রাম্প ভুয়া খবর চারদিকে ছড়াচ্ছেন এবং নিশ্চিত করছেন যে তার এই ধরনের অভিযোগের কোনো ভিত্তি নেই। টাস্ক এটাও বলেন যে, বন্ধু হয়ে যুক্তরাষ্ট্র যদি এই ধরনের অভিযোগ দায়ের করে, তাহলে তাদের শত্রুর কোনো প্রয়োজন নেই।
ট্রাম্পকে যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় শত্রু সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে তিনি রাশিয়া এবং চীনের নাম উল্লেখ করেন। কিন্তু সবার আগে উল্লেখ করেন ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের কথা। তার মতে, ইউরোপের কয়েকটি দেশ বাণিজ্যের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রকে ব্যবহার করছে। তিনি এ সময় জার্মানির কথাও উল্লেখ করেন। Nord Stream 2 হচ্ছে একটি পাইপলাইন, যেটা রাশিয়া থেকে শুরু হয়ে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে গ্যাস সরবরাহ করবে। এই পাইপলাইন নিয়ে রাশিয়ার সাথে যে জার্মানির একটি মৈত্রী সম্পর্ক স্থাপন হয়েছে, সেটা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের অনেক ক্ষোভ। তিনি সিবিএসের সাক্ষাৎকারে বলেন, জার্মানি মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার খরচ করছে রাশিয়ার কাছে। ট্রাম্পের মতে, জার্মানি সাদা পতাকা ওড়াচ্ছে। কোনো কারণে তারা রাশিয়ার কাছে নিজেদেরকে সমর্পণ করেছে। জার্মানির বিরুদ্ধে ন্যাটোর বিল পরিশোধ না করা নিয়েও অভিযোগ করেন ট্রাম্প। তিনি উল্লেখ করেন, “যেখানে ২ শতাংশ পরিশোধ করার কথা, সেখানে ১.৩ শতাংশ পরিশোধ করা হয়েছে।”
ফিনল্যান্ডের হেলসিঙ্কিতে পুতিনের সাথে ঐতিহাসিক আলোচনায় আসার আগে ট্রাম্প ইইউ সম্পর্কে আরও অনেক নেতিবাচক মন্তব্য করেছিলেন। যেমন- যুক্তরাষ্ট্র ইউরোপকে তাদের দেশে বাণিজ্য করতে আসতে দেবে না বা দিলেও কঠিন বাণিজ্য শর্ত জুড়ে দেয়া হবে। বিশেষ করে ব্রেক্সিটের থেরেসা মে যে বাণিজ্য আকল্প তৈরি করেছেন, সেটা যদি বজায় থাকে তাহলে যুক্তরাষ্ট্র ইউরোপকে বাণিজ্য করার সুযোগ দিবে না। এ সময় তিনি ইউরোপের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য নিয়েও প্রশ্ন তোলেন। তিনি বলেন, ইউরোপে আফ্রিকা এবং মধ্যপ্রাচ্য থেকে অভিবাসন শুরু হওয়ার কারণে তাদের চারিত্রিক গুণাগুণে অবনতি ঘটেছে।
ট্রাম্পের এ ধরনের উসকানিমূলক কথার ফল কী হবে সেটা সময়ই বলে দেবে। তবে দেখা যাচ্ছে, ইউরোপে যারা অভিবাসিত হয়ে আসছে তাদের প্রতিও ট্রাম্পের বিশেষ সহানুভূতি নেই। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের ইউরোপের সাথে ২০১৬ সালের নির্বাচনের সময় রাশিয়ার হ্যাকিং নিয়ে আরেকটি তুলকালাম কাণ্ড চলছে।
ইউরোপের বাণিজ্য নীতি নিয়ে ট্রাম্প বলেন, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন এই দিক দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে অনেক বেশি কঠোর। ইউরোপে যুক্তরাষ্ট্রের যারা কাজ করে তাদের ক্ষেত্রেও ইইউ যে কঠোর সেটা প্রকাশ করতেও ভোলেননি তিনি। ট্রাম্পের দাবি, ইইউ এর এমন আচরণের ফলে গত বছর যুক্তরাষ্ট্রে ১৫১ বিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য ঘাটতি দেখা দিয়েছে। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র যে ইউরোপের উপর উদার সেটাও তিনি উল্লেখ করেন। তিনি উদাহরণ দেন, চীনের উপর স্টিলের ক্ষেত্রে ২৫ শতাংশ এবং অ্যালুমিনিয়ামের ক্ষেত্রে ১০ শতাংশ বেশি যে ট্যারিফ যুক্তরাষ্ট্র প্রদান করেছিলো, সেটা থেকে ইউরোপীয়রা কিন্তু অব্যাহতি পেয়েছে। তাদের উপর এত বেশি কর আরোপ করা হয়নি।
অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র নিয়ে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের কিছু বিষয়ে ক্ষোভ থাকলেও তারা কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের মতো প্রকাশ্যে সেটা জাহির করছে না। যুক্তরাষ্ট্র যেমন ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করে কথা বলে, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন থেকে এমন আচরণ পাওয়া যায় না। ইইউ কিন্তু ফিলিস্তিন, সিরিয়া, লেবানন প্রভৃতি দেশে আর্থিক সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে। শুধু তা-ই না, ইইউ এর যেহেতু ন্যাটো চুক্তিতে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে মৈত্রী সম্পর্ক বজায় আছে, সেজন্য কিছু কিছু ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের সিদ্ধান্তকে তারা স্বাগত জানাচ্ছিল। এমনকি তাদের হয়ে সামান্য হলেও কথা বলছিলো। ইইউ-কে নিয়ে ট্রাম্প যে সমস্ত উক্তি করেছেন, সেগুলো ছিল পুরোটাই তার নিজস্ব।
এতকিছুর পরেও সেই ট্রাম্প আবার ইইউ এর কাছেই ফিরে এসেছেন। গত জুলাই মাসে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সাথে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট জিন-ক্লড জাঙ্কারের বৈঠক হয়। সেখানে যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের ভেতর যেসব বিষয়ে বিবাদ আছে সেসব নিয়ে আলোচনার পাশাপাশি দুই দেশের মধ্যকার বাণিজ্য সম্পর্ক যেন আবার আগের মতো হয় সেটা নিয়েও আলোচনা হয়েছে। ফলাফল হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র এবং ইইউ আবার একে অপরের সাথে বাণিজ্যের জন্য রাজি হয়েছে। ইইউ যুক্তরাষ্ট্র থেকে সয়াবিন, প্রাকৃতিক গ্যাস এবং আরও কিছু আন্তর্জাতিক বাণিজ্য পণ্য আমদানি করবে। এমনকি আন্তর্জাতিক বাণিজ্য নিয়মাবলী নতুন করে ঢেলে সাজাতে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে কাজ করবে ইইউ। অন্যদিকে চীন ইইউ-কে আগে থেকেই চাপ দিচ্ছিলো যেন তারা বাণিজ্য নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র বিষয়ে আরও কড়া হয় এবং চীনের পক্ষে কাজ করে।
কিন্তু ইইউ চীনের কথায় সায় দেয়নি। তারা যুক্তরাষ্ট্রের সাথে বাণিজ্য নিয়ে ইতিবাচক মনোভাব প্রকাশ করেছে। কিন্তু কিছু শর্ত না মেনে নিলে তারা এই বাণিজ্য করবে না সেটাও উল্লেখ করেছে। যেমন- ট্যারিফ অর্থাৎ আমদানি করা পণ্যদ্রব্যের উপর যদি বেশি কর আরোপ করা হয় তাহলে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে কোনো বাণিজ্য সম্পর্কে যাবে না ইইউ। এছাড়া দুই দেশের মধ্যে যে ‘জিরো ট্যারিফ’ এর ব্যাপারে কথোপকথন হয়েছে, সেদিকেও যুক্তরাষ্ট্রকে খেয়াল রাখতে হবে। এসব মেনে নিলেই কেবল যুক্তরাষ্ট্র থেকে সয়াবিন এবং তরল প্রাকৃতিক গ্যাস আমদানি করবে ইইউ। ইউরোপিয়ান ইউনিয়নকে নিজেদের বাণিজ্য নীতিকে পুনর্বিবেচনা করা নিয়েও কথা বলছে যুক্তরাষ্ট্র।
যেকোনো যুদ্ধ কখনও কারোর জন্য ভালো বার্তা বয়ে নিয়ে আসে না। শুধু একে অন্যকে দোষারোপ করা, গালাগালি দেয়া এবং একে অন্যকে ধ্বংস করার জন্য নিজেদের শক্তির অপব্যবহার- এই কয়টি বিষয় ছাড়া যুদ্ধের ফলে আর কিছুই হয় না। যুক্তরাষ্ট্রের সাথে চীন, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন, রাশিয়ার যে বাণিজ্য যুদ্ধ চলছে, সেটা কখনোই কাম্য নয়। কারণ এতে সব দেশেরই ক্ষতি হয়ে থাকে। বৈদেশিক মুদ্রা, দেশের চাকরির বাজার, জিনিসপত্রের দাম, আমদানি-রপ্তানি ঘাটতি ইত্যাদি বিষয়ে বিরূপ প্রভাব পড়ে। তাই অহেতুক বাণিজ্য যুদ্ধ করে নিজেদের সম্পর্কের মধ্যেকার ফাটল আর বাড়তে না দিয়ে সমঝোতায় আসা জরুরি। এতে সব দিক দিয়েই লাভবান হওয়া যায়।
তবে ইইউ এর প্রতি ট্রাম্পের হঠাৎ এমন বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণকে অনেকেই অন্যভাবে নিচ্ছেন। অনেকের ধারণা হচ্ছে, ট্রাম্পের উপর বিরাট যে একটা ঋণের বোঝা এসে পড়েছে, সেটা থেকে বের হতেই তিনি ইইউ এর সাথে বাণিজ্য করতে পুনরায় আগ্রহী হয়েছেন। এখন দেখার বিষয় হচ্ছে কতদিন এই সুসম্পর্ক বজায় থাকে।
ফিচার ইমেজ সোর্স: tja.eu