
বিশ্বের বিভিন্ন দেশের অধিবাসীদের মধ্যে নানা রীতিনীতি চালু রয়েছে। এগুলোর কিছু বেশ হাস্যকর, কিছু অস্বস্তিকর, আবার কয়েকটি বিদঘুটেও বটে। এসব নিয়ে বিশ্ববাসীদের মনে তেমন কোনো রেখাপাত হয় না। কিন্তু কয়েকটি দেশ, যারা নিজেদের সভ্য মনে করে, তাদের মধ্যে এমন কিছু রীতিনীতি চালু রয়েছে, যেগুলোকে এককথায় নৃশংসতার চরম রূপ হিসেবেই চিহ্নিত করা যায়। তেমনই এক রীতি প্রচলিত রয়েছে ডেনমার্কের ফ্যারো দ্বীপপুঞ্জে।
‘গ্রিনদাদ্রাপ’ নামে একটি বিশেষ রীতি ফ্যারো দ্বীপপুঞ্জের অধিবাসীরা প্রতি বছর পালন করে আসছে। এটি তাদের বেশ পুরনো উৎসব। ১৫৮৪ সাল থেকে চলে আসছে এই প্রথা। এর মূল বিষয় হচ্ছে নির্বিচারে তিমি শিকার। সেই প্রাচীনকাল থেকেই এই বিশেষ উৎসবে তারা তিমি শিকার করে ভোজ উৎসবের আয়োজন করে। কারণ একসময় এই তিমির মাংসই ছিল দ্বীপপুঞ্জের অধিবাসীদের খাদ্যের প্রধান উৎস। আর এই রীতি তারা অত্যন্ত মযার্দার সাথে উৎসবমুখর পরিবেশে পালন করে থাকে। সেজন্য প্রতি বছর বিপুল পরিমাণ তিমি শিকার করা হয়।

একটি প্রাচীন রীতির কারণে হত্যা করা হয় শত শত তিমি; Source: Sea Shepherd Global
কিছুদিন আগে ফ্যারো দ্বীপপুঞ্জে হয়ে গেলো এমনই এক উৎসব। জানা গেছে, এই উৎসব উপলক্ষে প্রায় দেড়শোর অধিক তিমি হত্যা করা হয়। সংবাদপত্র থেকে প্রাপ্ত তথ্যানুসারে, ১৫০-২০০ তিমির একটি ঝাঁক ফ্যারো দ্বীপপুঞ্জের পাশ দিয়ে অতিক্রমের সময় দ্বীপের আশপাশে থাকা মাছ ধরার জাহাজ ও ছোট ছোট নৌকার সাহায্যে ঝাঁকটিকে নদীর পাড়ের দিকে নিয়ে আসতে চেষ্টা করে দ্বীপের অধিবাসীরা। তারপরই তোরশভান বীচের কাছে সেসব তিমিকে নির্বিচারে হত্যা করা হয়।

মাছ ধরার জাহাজ ও ছোট ছোট নৌকার সাহায্যে তিমির ঝাঁককে নদীর পাড়ে নিয়ে আসার চেষ্টা; Source: Sea Shepherd Global
মাত্র আধঘন্টার মধ্যে এই হত্যাযজ্ঞ সম্পন্ন করা হয় অত্যন্ত নিষ্ঠুর প্রক্রিয়ায়। লোহার তৈরি হুকের সাহায্যে তিমিগুলোকে উপর্যুপরি আঘাত করা হয়। ধারালো অস্ত্র দিয়ে কেটে নেওয়া হয় প্রাণীগুলোর শিড়দাঁড়া। আর প্রচুর রক্তক্ষরণের ফলে এসব তিমি মৃত্যুমুখে পতিত হয়। দ্বীপের অধিবাসীরা ছাড়াও প্রায় কয়েকশ মানুষ এই পুরো ঘটনার নীরব সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন। কারো মুখ থেকে আসেনি কোনো প্রতিবাদের ভাষা। নিষ্পলক, নির্বাক দৃষ্টিতে পুরো ঘটনাটিই অবলোকন করে গেছেন সেই রীতি উপভোগ করতে আসা দর্শনার্থীরা। ঠিক অনুরূপ আরো একটি ঘটনা ঘটে ফ্যারো দ্বীপপুঞ্জের অন্য একটি সমুদ্রসৈকতে তার কিছুদিন পরেই। সেখানে নিষ্ঠুরভাবে মেরে ফেলা হয় আটটি সাদা ডলফিনকে।

তিমিদের হত্যার পূর্বে বেঁধে ফেলা হচ্ছে; Source: The Sun
এই রীতি উপলক্ষে প্রতি বছরেই এ ধরনের নির্মম হত্যাকান্ড ঘটে। ২০১৫ সালে প্রায় পাঁচশোর মতো তিমি ও ডলফিন শিকার করা হয়। এসব হত্যাকান্ডের পর দ্বীপবাসীরা তিমির মাংস ভোজনের সাথে সাথে মেতে ওঠে নানা আনন্দ উৎসবে।

লোহার হুক আর ধারালো অস্ত্রের সাহায্যে নির্বিচারে হত্যা করা হচ্ছে তিমি; Source: The Sun
পশুপ্রেমিকদের এক সংগঠন থেকে দাবি করা হয়, প্রতি বছর গ্রীষ্ম মৌসুমে হাজারের উপর তিমি নির্বিচারে হত্যা করা হয় এই রীতিকে কেন্দ্র করে। গ্রীষ্ম শুরু হলেই তিমিরা শীতল আবাসের জন্য স্থান পরিবর্তন করার উদ্দেশ্যে দল বেঁধে চলাফেরা করে। এ সময় দ্বীপবাসীরা ছোট ছোট নৌকা নিয়ে ওঁৎ পেতে থাকে। এরকম কোনো তিমির ঝাঁক দেখা গেলে তারা সেই ঝাঁকের চারদিক থেকে ঘিরে দিক পরিবর্তন করে দ্বীপের কাছাকাছি আসতে বাধ্য করে।

নদীর পাড়ে এনে তিমিদের হত্যার মধ্য দিয়ে দ্বীপবাসীদের এক অদ্ভুত রীতির পালন; Source: indiatimes.com
এ ধরনের হত্যাকান্ডের পক্ষে যুক্তি দিতে গিয়ে ফ্যারো দ্বীপপুঞ্জের একজন মুখপাত্র পল নোলসই গতবছর এক বিবৃতিতে বলেন,
“এই দ্বীপের প্রকৃতির একটি অংশ হচ্ছে এই তিমি। আর তিমির মাংস এখানকার অধিবাসীদের পুষ্টির চাহিদা মেটানোর একমাত্র উপাদান। দ্বীপের অধিবাসীরা তিমি সংরক্ষণের আন্তর্জাতিক আইন পুরোপুরি মেনে চলে এবং বিশ্বব্যাপী টেকসই উন্নতির স্বীকৃত নীতি যথাযথভাবে মেনে চলে। দ্বীপবাসী সেসব তিমিই হত্যা করে যারা প্রকৃতিতে যথেষ্ট পরিমাণে বিরাজমান। বিরল প্রজাতির কোনো তিমি হত্যা না করার বিষয়ে তারা যথেষ্ট সজাগ।”

তিমি নিধন দেখার জন্য দ্বীপবাসীদের ভিড়; Source: hindustantimes.com
ফ্যারো দ্বীপপুঞ্জের সমুদ্রের জল তিমির লাল রক্তে রক্তিম হয়ে উঠেছিল সেদিন, যেন রক্তের লাল রঙে সমুদ্র স্নান করছে। প্রথমে যে-ই দেখেছে, সে-ই অবাক হয়েছে। কিন্তু পরে সবাই ঘটনাটি জানার পর রীতিমতো শিউরে উঠেছেন। শুধুমাত্র এক রীতি পালনের স্বার্থে এতগুলো তিমির নির্মম পরিণতি বিশ্ববাসীকে রীতিমতো মর্মাহত করেছে, প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে সামাজিক মাধ্যমগুলোতে।

মৃত তিমির রক্তে লাল হয়ে ওঠা নদীর জল ; Source: Sea Shepherd Global
এই ঘটনায় চরম ক্রুদ্ধ হয়েছে পশুপ্রেমিক সংস্থাগুলোও। শুধুমাত্র রীতি পালনের স্বার্থে কেন এই বিপন্ন প্রাণীদের হত্যা করা হবে, তা নিয়ে ইতোমধ্যেই প্রশ্ন জেগেছে অনেকের মনে। এ ধরনের অমানবিক রীতির বিরুদ্ধে মানবিকবোধসম্পন্ন মানুষদের নিন্দার ভাষা কঠোর থেকে কঠোরতর হচ্ছে।

টুইটারে পশুপ্রেমীদের বিক্ষুব্ধ টুইট; Source: hindustantimes.com
এই ধরণের রীতি বন্ধের জন্য চালানো হচ্ছে ব্যাপক প্রচার প্রচারণা। ইউরোপভিত্তিক পশু সংরক্ষণ সমিতির পক্ষ থেকে প্রতি বছর গ্রীষ্মের শুরু থেকেই ব্যাপক প্রচারণা চালানো হয়। তাদের সংগঠনের লোকেরা নৌকায় সমুদ্র উপকূলে টহল দিয়ে দ্বীপবাসীদের নিরুৎসাহিত করার চেষ্টা করে। কিন্তু গেলো বছর তাদের কয়েকজনকে গ্রেপ্তার ও বেশ কয়েকটি নৌকা জব্দ করা হয়।

তিমির হত্যাকান্ড বন্ধের প্রতিবাদ জানায় গ্রেপ্তার করা হচ্ছে পশু সংরক্ষণ সমিতিরএকজন কর্মীকে; Source: Sea Shepherd Global
যুক্তরাজ্য ভিত্তিক এক পশুপ্রেমিক সংস্থা ‘পেটা’র পক্ষ থেক এই ঘটনার তীব্র নিন্দা জানানো হয়েছে। তাদের ওয়েবসাইটে দেয়া এক বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়,
“ফ্যারো দ্বীপপুঞ্জ ডেনমার্কের অন্তর্গত একটি দ্বীপ। ডেনমার্কের সব আইন এই দ্বীপের জন্য প্রযোজ্য হলেও রীতিনীতির দোহাই দিয়ে কিছু আইন দ্বীপটির জন্য শিথিল রাখা হয়েছে; যেমন- তিমি হত্যা। তিমি হত্যা ডেনমার্কে নিষিদ্ধ হলেও এই দ্বীপের পুরনো এক রীতির কারণে তিমি হত্যা আইনটি এখানকার দ্বীপবাসীদের জন্য প্রযোজ্য হয় না। তার ফলে বছরের পর বছর এখানে প্রাচীন এক রীতির বলি হচ্ছে হাজার হাজার বিভিন্ন প্রজাতির তিমি ও ডলফিন।”
![]()
তিমিদের মেরে ফেলার পর নদীর পাড়ে ফেলে রাখা হয়েছে মাংস সংগ্রহের উদ্দেশ্যে; Source: Sea Shepherd Global
এই রীতি ও তিমি হত্যা বন্ধে ‘পেটা’ সংগঠন হতে তীব্র প্রতিবাদ জানানো হয়। সে প্রতিবাদ লিপিতে উল্লেখ করা হয়, প্রত্যেকটি প্রাণীকে অত্যন্ত নির্মম প্রক্রিয়ায় হত্যা করা হয়েছে। অথচ তিমি এবং ডলফিনরা মানুষের মতোই বুদ্ধিমান। মানুষ যেমন তার দুঃখ-কষ্টে শরীর ও মনে প্রচন্ড যন্ত্রণা অনুভব করে, তারাও অনুরূপ যন্ত্রণা অনুভব করে।
সামনের দিনগুলোতে চমৎকার এ প্রাণীগুলোকে দ্বীপবাসীদের এ রীতির শিকার হতে হবে, নাকি পশুপ্রেমিকদের দাবি জয়যুক্ত হবে সেটা সময়ই বলে দেবে। তবে তাদের এ কাজগুলো যে একটু একটু করে তিমির বিলুপ্তিকে ত্বরান্বিত করছে, সেটা বোধহয় বলার অপেক্ষা রাখে না।