Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

হামিদ মীর: তিন তিনবার বিন লাদেনের সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন যে সাংবাদিক

অজস্র গল্পগাথা ছিল যাকে ঘিরে, যে আসামীকে গোটা দেড় যুগ ধরে আমেরিকা হন্য হয়ে খুঁজেছে, সেই ওসামা বিন লাদেনের একটিবার সাক্ষাৎ পাওয়া, সাংবাদিক হিসেবে যে কারো ক্ষেত্রেই নিঃসন্দেহে একটি রোমাঞ্চকর অধ্যায়। সে কাজটি অনেকটা অনায়াসে তিন-তিনটিবার করার দুর্লভ কৃতিত্ব রয়েছে পাকিস্তানি সাংবাদিক হামিদ মীরের। বিন লাদেনকে সাংবাদিক হিসেবে সম্ভবত তিনিই সবচেয়ে কাছ থেকে দেখেছেন এবং জানার সুযোগ পেয়েছেন। তার এই বিশেষ অভিজ্ঞতা নিয়েই আজকের লেখা।

সুযোগের এলো অতি নাটকীয়ভাবে

হামিদ মীরের ভাষ্যমতে, বিন লাদেনের সাক্ষাৎকার গ্রহণের দুয়ারটি খুলে গিয়েছিলো স্বয়ং বেনজির ভুট্টোর বদৌলতে। কীভাবে? উত্তরটিও বেশ চিত্তাকর্ষক। ১৯৯৫ সালের জুনে জাতিসংঘের পঞ্চাশতম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী হিসেবে প্রধানমন্ত্রী বেনজির ভুট্টোর আমেরিকা সফর কভার করতে সাংবাদিক হিসেবে গিয়েছিলেন মীর। সেখানে তিনি দেখেছিলেন আমেরিকান কূটনীতিক ও পাকিস্তান লবিস্ট রবিন এল রাফেল বেনজিরকে বুঝিয়ে চলেছেন, আফগান তালেবান কত ভালো আর তাদের সমর্থন করা কতটা প্রয়োজন!

রবিন এল রাফেল; Source: washingtonpost.com

এদিকে আফগান তালেবানের সমালোচনায় এসব দেখে হামিদ মীর চট করে লিখে ফেললেন কলাম। কলামটিতে তালেবানকে আমেরিকার আজ্ঞাবাহী বলে অভিহিত করেছিলেন তিনি। পাশাপাশি প্রগতিশীলতার বাহক বেনজিরকে উগ্র ধর্মান্ধ গোষ্ঠীর পক্ষ নেবার জন্য করেছিলেন ধিকৃত। রেডিও তেহরানের কল্যাণে সে কলাম ভালো কাটতিও পায়। এরপর বেনজিরপক্ষ বেশ রুষ্ট হয় তার প্রতি। বেনজিরের ব্যক্তিগত কর্মকর্তা নাসীরুল্লাহ বাবর চেষ্টা চালাতে থাকেন হামিদ মীরকে তালেবানের ব্যাপারে ইতিবাচক করতে। তিনি বোঝালেন-

দেখুন, উজবেকিস্তান থেকে আমরা পাকিস্তানে গ্যাস পাইপলাইন আনতে চাই। কিন্তু কাবুল হয়ে সেটিকে আসতে হবে, যা ভারত ও ইরানের মদদপুষ্ট এলাকা। তাই আফগান তালেবানকে আমাদের হাতে রাখতে হচ্ছে, কেননা পাইপলাইন পুলিশের ভূমিকাটা মূলত তাদেরই থাকবে। বিশ্বাস করুন, যতটা ভাবছেন, তারা ততটা খারাপ নয়!

তাতেও তুষ্ট হননি মীর। শেষে গোয়েন্দা কর্মকর্তা রেহমান মালিকই আগ বেড়ে হামিদ মীরের ‘সংশয়’ দূর করতে তালেবান নেতা মোল্লা ওমরের সাথে মীরের সাক্ষাতের ব্যবস্থা করে দেন।

মোল্লা ওমর খুলে দিলেন নতুন পথ

‘৯৬ এর শেষ দিকে হামিদ মীর কোয়েটা হয়ে আফগানিস্তানের কান্দাহার যান মোল্লা ওমরের সাথে সাক্ষাৎ করতে। মোল্লা ওমর শুরুতেই হামিদ মীরের বিগত কলামের প্রসঙ্গ টেনে বললেন, “কেন আমাদের বিরুদ্ধে এভাবে লিখছেন? খোদার কসম, আমরা আমেরিকার দালালি করছি না।” মীর বললেন, “রবিন রাফেল আপনাদের সমর্থনের কথা জানিয়েছেন।” ওমর বললেন, “এই রবিন নারী নাকি পুরুষ?” মীরের কাছে উত্তর শুনে কপাল চাপড়ে নাকি ওমর বলেছিলেন, “লা হাওলা ওয়ালা কুওয়াত্তা ইল্লা বিল্লাহ! একজন নারী আমাদের সমর্থন করছে!

এরপরই কোটি টাকার একটি গুমর তখনই স্থূলবুদ্ধিসম্পন্ন ওমর মীরের কাছে ফাঁস করেন।

“আচ্ছা, তুমি আমাদের আমেরিকার গুপ্তচর ভাবো? যদি তোমাকে আমেরিকার সবচেয়ে বড় শত্রুর সাথে দেখা করিয়ে দিতে পারি?”

মীর দ্বন্দ্বে পড়ে যান, কার কথা বলা হচ্ছে! এরপরই ওমর তাকে জানান,

“আমরা আমেরিকার দালাল হলে ওসামা বিন লাদেনকে এখানে আশ্রয় দিতাম বলে তোমার মনে হয়?”

মোল্লা ওমর; Source:bbc.com

আকাশ থেকেই যেন পড়লেন মীর, তার ধারণাতেও ছিলো না যে বিন লাদেন আফগানিস্তানে থাকতে পারেন। পরবর্তীতে মীরের সন্দেহ দূর করতে মোল্লা ওমরই কয়েকমাস পর ১৯৯৭ সালের মার্চে আফগানিস্তানের পূর্বাঞ্চলে লাদেন-মীরের আলাপের ব্যবস্থা করে দেন। মোল্লা ওমরের আলগা জিভের বদান্যতায় রহস্যের একটা বিরাট দরজা উন্মোচিত হলো।

অবশেষে…

১৯৯৩ সালে সোমালিয়াতে ৯৩ জন পাকিস্তানি সেনাসদস্যকে হত্যা করে আল-কায়েদা। প্রথম আলাপেই মীর বিন লাদেনকে সরাসরি এই হত্যাকাণ্ডের কারণ জিজ্ঞেস করেছিলেন। প্রশ্নটি যতই চটকসম্পন্ন হোক, গণমাধ্যমের ‘খোরাক’ হিসেবে বিন লাদেন তখনো ঠিক ততটা ‘বিগনেম’ হয়ে উঠতে পারেননি। মীরের ভাষ্যমতে, প্রথম সাক্ষাৎকারটি তাই হয়েছিলো একদম ‘ফ্লপ’।

প্রথম সাক্ষাৎ! Source:digitaljournal.com

এক বছর বাদে ১৯৯৮ সালে দ্বিতীয়বারের মতো মীর মুখোমুখি হন বিন লাদেনের। তার আগে অবশ্য তালেবানের হাতে গ্রেফতার হয়েছিলেন মীর, ঐ এলাকায় আল-কায়েদার হামলার দরুন ঘটনাক্রমে ছাড়াও পেয়ে যান তিনি। এবারে শুধু ঘন্টাখানেকের গৎবাঁধা প্রশ্নোত্তর পর্ব চললো না, বরং দু’জন একসাথে কাটালেন তিন তিনটি দিন! আড্ডার ছলে অজস্র কথা হলো দুজনের মাঝে। বিন লাদেন একবার হত্যাকাণ্ডকে বৈধতা দিতে চান, তো আরেকবার মীর তাকে পাল্টা যুক্তি দিয়ে ঘায়েল করতে চান। সব মিলিয়ে লেখার এত বেশি রসদ জমেছিলো যে, মীরের পক্ষে এক আর্টিকেলে পুরোটাকে জায়গা দেওয়া সম্ভব ছিলো না। বিন লাদেন নিজেই তখন তাকে পরামর্শ দিলেন বই লেখার! বিচক্ষণ মীর বললেন, “বই লিখলে বস্তুনিষ্ঠ বই-ই লিখবো।” বিন লাদেনও কম চতুর নন, ‘বস্তুনিষ্ঠতা’র মানে যে বইটিতে ব্যক্তি বিন লাদেনের কঠোর সমালোচনাও যুক্ত হওয়া, তা তিনি বুঝেছিলেন। আর বুঝেই মীরকে শর্ত দিলেন, বইটির খসড়া লিখে এনে তাকে দেখিয়ে তারপরে চূড়ান্ত করতে হবে; তবেই মিলবে ‘সমালোচনা’র লাইসেন্স!

মাসখানেকের ভেতর শর্তমাফিক বই শেষ করে মীর যখন আফগানিস্তানে যাবেন, তখনই আফগানিস্তানে শুরু হলো মার্কিন বাহিনীর প্রতিশোধমূলক রকেট হামলা। কীসের প্রতিশোধ? আগস্ট মাসে কেনিয়া ও তানজানিয়াতে আল-কায়েদার বোমা হামলার প্রতিশোধ! হলো না দেখা!

৯/১১ পরবর্তী প্রথম সাক্ষাৎকার!

তৃতীয় সাক্ষাৎ তাই পিছিয়ে এলো ২০০১ এর নভেম্বরে, তখনও আফগানিস্তান উত্তাল। উত্তাল সময়ে বিন লাদেন নিজেই ছিলেন অনেকটা দৌড়ের ওপর, তাই মীরকেও জানিয়ে দিয়েছিলেন যে সময় সেভাবে তেমন দিতে পারবেন না। তবু মীর গিয়েছিলেন, আল-কায়েদার ওপর হওয়া মার্কিন মুহূর্মুহু আক্রমণের শঙ্কা মাথায় নিয়েই গিয়েছিলেন। সাক্ষাৎকারের একপর্যায়ে যখন বোমা হামলা হলো আল-কায়েদার ঘাঁটিতে, বিন লাদেন একদিকে ছুটে পালালেন! অন্যদিকে বিন লাদেনের এক নিরাপত্তা কর্মীর সহায়তায় জীবন নিয়ে আরেকদিকে পালালেন মীর। তখন আল-কায়েদার শীর্ষ পর্যায় থেকে জানিয়ে দেওয়া হয়, বই প্রকাশের ক্ষেত্রে শর্তপূরণের বাধ্যবাধকতা আর বলবৎ রাখছেন না তারা।

মীরের ক্যামেরায় বিন লাদেন ও আল-কায়েদার তৎকালীন সেকেন্ড ইন কমান্ড আয়মান আল জাওয়াহিরি; Source: wikimedia commons

৯/১১ পরবর্তী প্রথম সাক্ষাৎকার হিসেবে হামিদ মীরের গ্রহণ করা সে সাক্ষাৎকারটির কাটতি বেড়ে যায় বহুগুণে। সেখানে বিন লাদেন দাবি করেন-

“যদি আমেরিকা আমাদের ওপর রাসায়নিক বা পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করে, তবে প্রতিশোধ নিতে আমরাও সেগুলোর ব্যবহারে পিছপা হবে না। সেগুলো আমাদের কাছেও আছে।”

৯/১১ পরবর্তী প্রথম গণমাধ্যম সাক্ষাৎকার হওয়ায় অবধারিতভাবেই টুইন টাওয়ার হামলায় আল-কায়েদার সংশ্লিষ্টতার প্রসঙ্গ এসেছে বারবার। হামিদ মীরের কাছে ঘটনার প্রত্যক্ষ দায় এড়িয়ে যেতে চাইলেও সরাসরি ‘না’-ও বলছিলেন না বিন লাদেন। প্রথম বা দ্বিতীয় সাক্ষাৎকারে ফিলিস্তিন ও আন্তর্জাতিক জিহাদের মতো স্পর্শকাতর জটিল ইস্যুতে কথা না বললেও শেষ সাক্ষাৎকারটিতে বলেছিলেন তিনি। ‘৯৭ এ বলেছিলেন চীন, ইরান, পাকিস্তান ও আফগানিস্তান নিয়ে আঞ্চলিক সংহতি প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনার কথা, আর ২০০১ এ এসে বললেন বৈশ্বিক লড়াইয়ের কথা।

মীরের চোখে…

কথাবার্তা তো অনেক বললেন, কাছ থেকে কেমন দেখলেন বিশ্বপরাশক্তি আমেরিকার ‘মোস্ট ওয়ান্টেড’ এই আসামীকে? হামিদ মীরের মতে, চলনে-বলনে বিন লাদেনের মধ্যে বেশ একটা ‘লেডি কিলার’ ধরনের ভাব ছিলো, বেশ চোস্ত-কেতাদুরস্ত যাকে বলে! ৯/১১ এর পর গণমাধ্যমে বা ভিডিও বার্তায় সামনে আসা বিন লাদেন একেবারেই কমিয়ে দিয়েছিলেন, এমনকি একটা সময় এই আপাত ‘নিষ্ক্রিয়তা’র দরুন গুজব উঠেছিলো যে তিনি মারা গেছেন। সেই বিন লাদেন ২০১১ সালের ২ মে যুক্তরাষ্ট্রের গোপন বাহিনীর আক্রমণে পাকিস্তানের অ্যাবোটাবাদে প্রাণ হারান। আল-কায়েদার জন্য একে কত বড় ক্ষতি বলে মনে করেন মীর? “নিঃসন্দেহে এটি অনেক বড় ক্ষতি। তিনি শুধু আফগানিস্তানেই নয়, ইরান, পাকিস্তান, উত্তর-পূর্ব আফ্রিকায় নেটওয়ার্কের বিস্তৃতি ঘটাচ্ছিলেন নীরবে।”

হামিদ মীর: সাংবাদিক বা ‘তারকা’

৫১ বছর বয়সী হামিদ মীর পাকিস্তানে সাংবাদিক হিসেবে বেশ নাম-ডাকসম্পন্ন। বৈশ্বিক অঙ্গনে তার পরিচিতি খানিকটা বিন লাদেন-কেন্দ্রিক হলেও পাকিস্তানে তিনি বিখ্যাত হয়েছেন জিও টিভির রাজনৈতিক টকশো ‘ক্যাপিটাল টক’-এর উপস্থাপক হিসেবে। দুর্নীতিগ্রস্ত ও অতি নাটকীয় রাজনীতির কারণে পাকিস্তানে রাজনৈতিক টকশোর টিআরপি এমনিতেও বেশি, সে কারণে অনেকটা চলচ্চিত্র তারকাদের মতো রাজনৈতিক টকশো উপস্থাপকেরাও ‘সুপার স্টার’, হামিদ মীর তেমনই একজন। তবে শোবিজ জগতের তারকাদের সাথে নিজেদের এমন তুলনা মোটেও পছন্দ নয় মীরের। পারভেজ মোশাররফ ও জারদারি সরকার আমলে তিনি দু’দফায় মাসখানেকের জন্য উপস্থাপক হিসেবে পাকিস্তানে নিষিদ্ধ হয়েছিলেন। দেড় যুগ হতে চললো, এখনো লাদেন নিয়ে বইটি প্রকাশিত কেন হচ্ছে না? উত্তরটা স্পষ্ট, একে তো পাকিস্তান স্বাধীন সাংবাদিকতার পক্ষে খুব একটা অনুকূল নয়। দ্বিতীয়ত, মীরের মতে, অধিকাংশ পাকিস্তানিই প্রস্তুত নয় লাদেন বা আল-কায়েদার সমালোচনা হজম করতে; কেননা তাদের মতে ৯/১১ কেবলই ইজরায়েল বা জায়নবাদীদের প্রোপাগান্ডা।

Source:geo.tv

২০১৩ সালে বাংলাদেশ সরকার মুক্তিযুদ্ধের বিদেশী বন্ধুদের পুরস্কৃত করেছিলো। সে তালিকায় ১৩ জন পাকিস্তানির মধ্যে ছিলেন হামিদ মীরের বাবা সাংবাদিক ওয়ারিস মীরও। বাবার পক্ষে শুধু পুরস্কার গ্রহণই নয়, হামিদ মীর পাকিস্তানের অল্প কিছু সাংবাদিকের অন্যতম ছিলেন, যারা একাত্তরের প্রশ্নে ঢাকার কাছে ইসলামাবাদের আনুষ্ঠানিক রাষ্ট্রীয় ক্ষমা চাওয়া উচিত বলে মনে করতেন। কিন্তু যুদ্ধাপরাধের বিচার ইস্যুতে পাকিস্তানের বেশ কিছু কূটনৈতিক অসদাচরণের কারণে বাংলাদেশ-পাকিস্তান কূটনীতিক সম্পর্ক অনেকটা ভেঙে পড়ে। এমন অবস্থায় ২০১৭ এর ২৭ এপ্রিল আকস্মিকভাবে হামিদ মীর বাংলাদেশ কর্তৃক প্রদানকৃত বাবার পুরস্কারটি ‘প্রতিবাদস্বরূপ’ ফিরিয়ে দেবার ঘোষণা দেন। ২০১৪ সালে চোরাগোপ্তা হামলায় ভাগ্যক্রমে বেঁচে যাওয়া এই সাংবাদিক ইন্টারন্যাশনাল ফ্রি প্রেস কর্তৃক ‘সেরা প্রাণবন্ত সাংবাদিক’র পুরস্কার লাভ করেন। সম্প্রতি গত নভেম্বরে এই সাংবাদিকের বিরুদ্ধে খালিদ খাজা নামক এই ব্যক্তিকে অপহরণের অভিযোগে মামলা দায়ের করেছে পুলিশ, যেটিকে মীর শুরু থেকেই রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত বলে আসছেন।

ফিচার ইমেজ: pakistanmediawatch.com

Related Articles