৭১১ সাল; জলদস্যুদের দ্বারা এক মুসলিম নারী নির্যাতিতা হয়ে ইরাকের গভর্নর হাজ্জাজ বিন ইউসূফের নিকট এক মর্মস্পর্শী পত্র লিখলেন। নির্যাতিতা ঐ নারীর পত্র হাতে পাওয়ার পর হাজ্জাজ বিন ইউসূফ সিন্ধুর রাজা দাহিরের নিকট অভিযোগ জানালেন। জলদস্যুদের উপর তার কোনো প্রভাব নেই, কাজেই এক্ষেত্রে তার কিছুই করার নেই- এমন একটি পত্র রাজা দাহির হাজ্জাজ বিন ইউসূফকে লিখে পাঠালেন। হাজ্জাজ বিন ইউসূফ এই পত্রটি পেয়েই ভারতবর্ষে অভিযান চালানোর সিদ্ধান্ত নেন।
প্রথমে দুটি অভিযান ব্যর্থ হলেও তাঁর নিজ ভাতিজা মুহাম্মদ বিন কাশিম ভারত অভিযান চালিয়ে সফল হন। ৭১২ সালে মাত্র ১৭ বছর বয়সে মুহাম্মদ বিন কাশিম সিন্ধু দখল করে নেন। এর পর থেকে পরবর্তী প্রায় তিন শতাব্দী ধরে মুসলিম সাম্রাজ্যের সাথে উত্তর ভারতের রাজপুত রাজ্যগুলোর যুদ্ধ লেগেই থাকতো, যার ফলে ধীরে ধীরে উত্তর ভারতে মুসলিম সুলতানি শাসন প্রতিষ্ঠা পায়। এদিকে আরব বিশ্বের সাথে বাণিজ্যের সুবাদে তারও বহু আগে দক্ষিণ ভারতের উপকূলীয় অঞ্চলগুলোতে আরবদের বসবাস শুরু হতে থাকে। হযরত মুহাম্মদ (সা) এর মাধ্যমে পুনরায় ইসলাম প্রচার শুরু হলে এসব আরবদের অধিকাংশই ইসলাম গ্রহণ করেন। পরবর্তীতে এসব আরব মুসলিমদের দ্বারা দক্ষিণ ভারতে বাহমানি সালতানাত আর দাক্ষিনাত্য সালতানাত প্রতিষ্ঠা লাভ করে।
এদিকে ত্রয়োদশ শতাব্দীর দিকে তুর্কীরা সাবেক রাজপুত ভূখন্ডগুলোকে কেন্দ্র করে প্রতিষ্ঠা করেন দিল্লী সালতানাত। একে একে মামলুক দাস বংশ, খিলজী রাজবংশ, তুঘলক আর লোদি বংশের ধারাবাহিকতায় মুঘল রাজবংশের হাতে ভারতের শাসন ক্ষমতা এসে পৌঁছায়।
১১৯১ সালে ত্বরাইনের প্রথম যুদ্ধে রাজপুত বীর পৃথ্বিরাজ চৌহানের কাছে শোচনীয় পরাজয় আর ১১৯২ সালে ত্বরাইনের দ্বিতীয় যুদ্ধে পৃথ্বিরাজ চৌহানকে পরাজিত করে মুহাম্মদ ঘুরী ভারতের উপর নিজ আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেন। ১২০৬ সালে নিঃসন্তান অবস্থায় মৃত্যুবরণ করলে মুহাম্মদ ঘুরীর সাম্রাজ্য তাঁর বিশ্বস্ত সব সেনাপতির মাঝে ভাগ হয়ে যায়। দিল্লীর শাসনভার লাভ করেন কুতুবউদ্দীন আইবেক নামক এক তুর্কী মামলুক সেনাপতি। তিনিই ভারতের দিল্লী সালতানাতের দাস বংশের প্রতিষ্ঠাতা। ১২০৬ থেকে ১২১০ সাল পর্যন্ত তিনি দিল্লী শাসন করেছিলেন। ১২১০ সালে পোলো খেলার সময় ঘোড়ার পিঠ থেকে পড়ে তিনি মারা যান।
কুতুবউদ্দীন আইবেকের কোনো পুত্রসন্তান না থাকায় আরাম শাহ সিংহাসনে বসেন। কুতুবউদ্দীন আইবেকের সাথে আরাম শাহর কী সম্পর্ক ছিলো তা স্পষ্ট না। তবে মুঘল সম্রাট আকবরের রাজসভার ঐতিহাসিক আবুল ফজল বলেছেন, আরাম শাহ ছিলেন কুতুবউদ্দীন আইবেকের ভাই। আরাম শাহ সিংহাসনে বসে অবশ্য স্বস্তি পাননি। সে সময় দিল্লীর রাজসভার অভিজাত প্রায় ৪০ জন সদস্য নিয়ে গঠিত একটি কাউন্সিল ছিলো, যাদের একত্রে বলা হত ‘চিহালগানি’। এই চিহালগানি আরাম শাহের সিংহাসনে আরোহণের পর তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র শুরু করে। বেশিরভাগ ঐতিহাসিকই একমত হয়েছেন যে, কুতুবউদ্দীন আইবেকের মৃত্যুর পর দিল্লীর আশেপাশে যোগ্য কেউ না থাকায় আরাম শাহকেই সিংহাসনে বসানো হয়। কিন্তু শীঘ্রই আরাম শাহ রাজ্য চালনায় তাঁর অযোগ্যতা প্রদর্শন করতে থাকেন। আর তাই চিহালগানি আরাম শাহের পরিবর্তে বাদাউনের গভর্নর শামসুদ্দীন ইলতুৎমিশকে সিংহাসনে বসাতে চাইলো। ইলতুৎমিশ সানন্দে এই প্রস্তাব গ্রহণ করে দিল্লী অধিকার করলেন।
ব্যক্তিগত জীবনে ইলতুৎমিশ বেশ সাহসী আর যোগ্য শাসক ছিলেন। ১২১১ থেকে ১২৩৬ সাল পর্যন্ত তিনি দিল্লী শাসন করেছিলেন। এ সময় তাকে বেশ কিছু বিদ্রোহের মুখে পড়তে হয়েছিলো, তিনি দক্ষতার সাথে সেসব প্রতিহত করেন। এমনকি কুখ্যাত মোঙ্গল বাহিনীর সাথেও তাকে কয়েকবার লড়াই করতে হয়েছিলো। শাসনক্ষমতার শেষদিকে এসে ইলতুৎমিশ তাঁর উত্তরাধিকারী নিয়ে বেশ চিন্তায় পড়ে যান। তাঁর পরে সিংহাসনে বসার মতো একমাত্র যোগ্য ছিলেন তাঁর বড় পুত্র। কিন্তু তিনি মারা যাওয়ায় ইলতুৎমিশকে বিকল্প উপায় ভাবতে হচ্ছিলো। এক্ষেত্রে তাঁর সামনে তাঁর কন্যা সুলতানা রাজিয়া ছাড়া আর কেউ ছিলো না। কারন তাঁর অন্যান্য ছোট পুত্রের কেউই রাজ্য চালনার জন্য উপযুক্ত ছিলো না। সুলতান ইলতুৎমিশ তাই তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর কন্যা রাজিয়াকে উত্তরাধিকারী মনোনীত করে যান।
রাজিয়া সুলতানা জন্মগ্রহণ করেন ১২০৫ সালে। প্রচন্ড মেধাবী, পরিশ্রমী আর বুদ্ধিমতী রাজিয়ার ছোটবেলা থেকেই রাজনীতির প্রতি প্রবল আগ্রহ ছিলো। যুদ্ধের প্রতিও ছিলো তার প্রচন্ড নেশা। পিতা ইলতুৎমিশ নিজ হাতে তাকে যুদ্ধের বিভিন্ন কৌশল শিখিয়েছিলেন, সাথে রাজনীতিও। রাজনীতি আর যুদ্ধবিদ্যা নিয়ে ব্যস্ত থাকায় অবস্থা এমন হয়েছিলো যে হেরেমের সাথে তার তেমন কোনো যোগাযোগই ছিলো না। হেরেমের রীতিনীতিও তেমন একটা জানতেন না! সে যা-ই হোক, ইলতুৎমিশ তার উত্তরাধিকারী হিসেবে কন্যা রাজিয়াকে মনোনীত করে যান। কিন্তু তাঁর মৃত্যুর পর একজন নারীর শাসন মেনে নিতে অস্বীকৃতি জানান দরবারের অভিজাতরা। আর তাই ইলতুৎমিশের মৃত্যুর পর তারা ইলতুৎমিশের ছোট পুত্র রাজিয়ার সৎ ভাই রোকনউদ্দীন ফিরোজকে ক্ষমতায় বসান।
রোকনউদ্দীন ফিরোজ ছিলেন চরম অযোগ্য একজন শাসক। ক্ষমতার স্বাদ পেয়েই তিনি ভোগ-বিলাসে ব্যস্ত হয়ে গেলেন, রাজ্য চালনার চেয়ে গায়িকা আর নর্তকীদের সাথে সময় কাটাতেই তিনি বেশি পছন্দ করতেন। আর রাজ্য চালাতে লাগলেন তার মা তুরকান খাতুন। ফলে যা হবার তা-ই হলো। অযোগ্য শাসক রোকনউদ্দীন আর তার অনভিজ্ঞ মা তুরকান খাতুনেরর জন্য গোটা রাজ্যে বিশৃঙ্খলা নেমে এলো। ১২৩৬ সালের ৯ নভেম্বর ৪০ জন অভিজাতদের কাউন্সিল চিহালগানি রোকনউদ্দীন ফিরোজকে ক্ষমতা থেকে অপসারণ করে রোকনউদ্দীন আর তার মাকে হত্যা করে। রাজ্যের সিংহাসন তখন শূন্য। সুলতানা রাজিয়া এই সুযোগের অপেক্ষাতেই ছিলেন। তিনি দিল্লীর জনগণের সহায়তায় সিংহাসনে আরোহণ করেন। অন্য কোনো উপায় না থাকায় চিহালগানিও তাকে সে সময়ের জন্য সমর্থন করতে বাধ্য হয়।
নারী হিসেবে যেন কেউ তাকে অবজ্ঞার দৃষ্টিতে না দেখে, সেজন্য সুলতানা রাজিয়া সিংহাসনে বসতেন পুরুষদের অনুকরণে আলখাল্লা পরে, মাথায় পরতেন পাগড়ি। তিনি তাকে ‘সুলতানা’ সম্বোধন করাটাও পছন্দ করতেন না। কারন, তাঁর মতে ‘সুলতানা’ হচ্ছে ‘সুলতান’ অর্থাৎ শাসকের স্ত্রীর উপাধি। তিনি তো আর শাসকের স্ত্রী না, বরং তিনিই স্বয়ং শাসক। ক্ষমতায় বসে রাজিয়া তাঁর পিতার রাজত্বকাল থেকে চলমান কিছু সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করতে লাগলেন। এছাড়াও তিনি বেশ ভালোই বুঝতে পেরেছিলেন চিহালগানি তাকে প্রতিটি পদে পদে বাধা দেবে, তাঁর বিরুদ্ধাচরণ করবে। আর তাই সিংহাসনে বসেই তিনি সভাসদদের কাউন্সিল চিহালগানির ক্ষমতার হ্রাস করার চেষ্টা করেন, যার ফলে তিনি চিহালগানির রোষের মুখে পড়ে যান। তাছাড়া দরবারের অনেক অভিজাত আমিরই একজন মহিলার শাসনে থাকতে পছন্দ করছিলো না, যার ফলে ভেতরে-বাইরে সব জায়গাতেই অসন্তোষ দানা বাঁধছিল।
সুলতানা রাজিয়া তার ব্যক্তিগত উপদেষ্টা হিসেবে আবিসিনীয় সিদি জামাল উদ্দীন ইয়াকুতকে নিয়োগ দেন। ইয়াকুতকে তিনি খুব বিশ্বাস করতেন। রাজিয়ার সাথে তার পরিচয় কীভাবে হলো, সে ব্যাপারে স্পষ্ট কোনো দলিল নেই। তবে প্রথমে সুলতানা রাজিয়া সিদি ইয়াকুতকে রাজকীয় আস্তাবলের প্রধান হিসেবে নিযুক্ত করেছিলেন। ইয়াকুতের প্রতি রাজিয়ার এই প্রবল বিশ্বাস দেখে অনেকেই ঈর্ষান্বিত হয়। আবিসিনীয় হওয়ায় ইয়াকুতের তুলনায় দরকারের অনেকেই নিজেদের বঞ্চিত ভাবতে শুরু করেছিলো। প্রতিহিংসার বশবর্তী হয়ে তারা রাজিয়ার সাথে ইয়াকুতের অবৈধ প্রণয় আছে বলে গুজবও রটিয়ে দেয়।
শীঘ্রই গোটা রাজ্যে বিশৃঙ্খলা দেখা দিতে শুরু করে। চারদিক থেকে বিদ্রোহের খবর আসতে থাকে। প্রথমেই বিদ্রোহ করেন লাহোরের গভর্নর। অবশ্য রাজিয়া এই বিদ্রোহ শক্ত হাতে দমন করতে সক্ষম হয়েছিলেন। অন্যদিকে সে সময় বাথিন্দার গভর্নর ছিলেন মালিক ইখতিয়ারুদ্দীন আলতুনিয়া। তিনি রাজিয়ার ছোটবেলার খেলার সাথী ছিলেন। মনে মনে তিনি রাজিয়াকে পছন্দও করতেন। কিন্তু রাজিয়ার সম্পর্কে এই গুজব শুনে তিনিও রেগে রাজিয়ার কর্তৃত্ব অস্বীকার করে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। দিল্লীর কর্তৃত্বাধীন অন্যান্য অঞ্চলগুলোর বিদ্রোহ ঘোষণা করে দিল্লীর কাজীর শরণাপন্ন হন। দিল্লীর কাজী সুলতানা রাজিয়াকে পদচ্যুত করেন। চিহালগানি আলতুনিয়াকে তাঁর স্থলাভিষিক্ত করেন। কিছুদিনের জন্য রাজিয়া পর্দার আড়ালে চলে যান। অবশ্য তিনি সুযোগের আশায় ছিলেন। শীঘ্রই তিনি সুযোগ পেয়েও যান। আলতুনিয়ার বিরুদ্ধে তিনি যুদ্ধ ঘোষণা করেন। কিন্তু যুদ্ধে পরাজিত হন। যুদ্ধে সিদি জামাল উদ্দীন ইয়াকুত নিহত হন এবং সুলতানা রাজিয়া বন্দী হন। মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচতে সুলতানা রাজিয়া আলতুনিয়াকে বিয়ে করতে সম্মত হন। তবে এক্ষেত্রে কিছুটা সংশয় থেকে যায়। একজন বীর শুধুমাত্র তাঁর জীবন রক্ষার জন্য শত্রুর সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হবেন না। এই বিয়ের মাধ্যমে রাজিয়ার মূল লক্ষ্য ছিলো দিল্লী অধিকার করা। কারণ ইতোমধ্যেই ১২৩৬ সালের এপ্রিলের দিকে চিহালগানি আলতুনিয়াকে পদচ্যুত করে রাজিয়ার ভাই মুয়িজুদ্দীন বাহরাম শাহকে মসনদে বসায়। রাজিয়া যে শুধুমাত্র জীবন রক্ষার জন্য আলতুনিয়াকে বিয়ে করেননি, তা সহজেই বোঝা যায়। কারণ শীঘ্রই তিনি আলতুনিয়াকে দিল্লী আক্রমণের জন্য প্ররোচনা দিয়ে সফল হন।
প্রয়োজনীয় সেনাবাহিনী গঠন করে ১২৪০ সালে আলতুনিয়া আর রাজিয়ার সম্মিলিত শক্তি মুয়িজুদ্দীনকে আক্রমণ করে। এ সময় রাজিয়ার অনুগত দিল্লীর কিছু আমির দিল্লী ত্যাগ করে রাজিয়ার সাথে যোগদান করে, কিন্তু যুদ্ধ শুরু হলে তারাই আবার পালিয়ে যায়। এমনকি আলতুনিয়ার কিছু ঘনিষ্ঠ আমিরও তাদের অনুসরণ করে পালিয়ে যায়। ফলে যুদ্ধে রাজিয়া আর আলতুনিয়া উভয়েই চরমভাবে পরাজিত হন। পরাজিত হয়ে রাজিয়া ভারতের উত্তর দিকে পালিয়ে যান। সেখানে আবারো সংগঠিত হয়ে ভারতের হরিয়ানা রাজ্যের কাইঠালে দিল্লীর সেনাবাহিনীর মুখোমুখি হন। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত এবারও পরাজিত হন। যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালিয়ে ক্লান্ত আর ক্ষুধার্ত অবস্থায় রাজিয়া এক কৃষকের বাড়িতে আশ্রয় নেন। খাওয়া-দাওয়ার পর তিনি ঘুমালে কৃষক তার শরীরে রাজকীয় পোশাক দেখতে পায়। পোষাকে প্রচুর রত্ন লাগানো ছিলো। কৃষক সহজেই বুঝে যায় তাঁর সামনে ঘুমিয়ে থাকা নারী সাধারণ কেউ নন। কৃষকটি ধন-সম্পদের লোভে পড়ে ঘুমন্ত রাজিয়াকে হত্যা করে এবং রত্ন নিয়ে পালিয়ে যায়। পরবর্তীতে এসব রাজকীয় রত্ন বাজারে বিক্রি করতে গেলে সে ধরা পড়ে। আর একইসাথে চূড়ান্তভাবে পতন ঘটে ভারতীয় উপমহাদেশের প্রথম নারী শাসক সম্রাজ্ঞী রাজিয়া সুলতানার।
অবশ্য রাজিয়া সুলতানার মৃত্যু সম্পর্কিত আরো বেশ কয়েকটি ঘটনা নিয়ে বিতর্ক আছে। একটি সূত্র মতে, ১২৪০ সালের ১৩ অক্টোবর রাজিয়া আর আলতুনিয়া দিল্লীর সেনাবাহিনীর হাতে ধরা পড়েন, ১৪ অক্টোবর তাদের হত্যা করা হয়। অন্য সূত্রমতে, ১২৪০ সালে সংঘটিত যুদ্ধে পরাজিত হয়ে ফেরার পথে বনে দস্যুদের আক্রমণে তিনি মারা যান। আবার কোনো কোনো সূত্রমতে, যুদ্ধে তাঁর স্বামী আলতুনিয়া নিহত হলে তিনি নিহত স্বামীর পাশে অবস্থান নেন। আর এ সময় হঠাৎ একটি তীর তাঁকে বিদ্ধ করলে তিনি নিহত হন। তবে অধিকাংশ ঐতিহাসিক রাজিয়ার মৃত্যু সংক্রান্ত প্রথম ঘটনাটিকেই সত্য বলে স্বীকার করেছেন। এক্ষেত্রে একটি ব্যাপার উল্লেখযোগ্য, দিল্লীর বাহিনীর সাথে প্রথম যুদ্ধে পরাজয়ের পর পালিয়ে যাওয়ার সময় তাঁর সাথে তাঁর স্বামী আলতুনিয়া ছিলেন না। এর একটি মানেই দাঁড়ায়, তাদের বিয়েটি পুরোপুরো রাজনৈতিক ছিলো। রাজিয়ার একমাত্র লক্ষ্য ছিলো দিল্লী পুনরুদ্ধার করা। আলতুনিয়ার মৃত্যু কীভাবে ঘটলো, সে সম্পর্কেও কিছুটা ধোঁয়াশা আছে। তবে ধারণা করা হয়, দিল্লীর বাহিনীর কাছে রাজিয়া আর আলতুনিয়ার সম্মিলিত বাহিনী পরাজিত হলে পলায়নের সময় আলতুনিয়া ধরা পড়েন ও তাদের হাতে পড়ে নিহত হন।
শাসক হিসেবে কেমন ছিলেন রাজিয়া? এ প্রশ্নের উত্তরে দ্বিধাহীনভাবে বলা যায়, তিনি একাধারে একজন দক্ষ প্রশাসক আর সেনাপতি হিসেবে নিজের গুরুত্ব তুলে ধরতে পেয়েছিলেন। তিনি ছিলেন মেধাবী, বুদ্ধিমতী, রূপবতী এবং পরিশ্রমী। পিতা ইলতুৎমিশ যখন যুদ্ধের জন্য রাজধানী ত্যাগ করতেন, তখন মূলত রাজ্য পরিচালনা করতেন তাঁর কন্যা এই রাজিয়াই। সত্যিকার অর্থে রাজপরিবারে সেই সময় রাজিয়ার চেয়ে যোগ্য আর দক্ষ কেউ ছিলেন না। তিনি যুদ্ধক্ষেত্রেও নিজের সাহসিকতা প্রদর্শন করতে পেরেছিলেন। যুদ্ধক্ষেত্রে হাতির পিঠে চড়ে একেবারে সামনে থেকে তিনি যুদ্ধের নেতৃত্ব দিতেন।
রাজিয়া সুলতানা সবক্ষেত্রে বেশ উদার ছিলেন, বিশেষত ধর্মের ক্ষেত্রে। মুসলিম আর হিন্দুদের মাঝে তিনি কোনো ভেদাভেদ করতেন না। সবাইকে সমানভাবে সুযোগ-সুবিধা দিতেন। প্রশাসনে তিনি স্থানীয় লোকদের থেকে বেছে বেছে যোগ্যদের নিয়োগ দিতেন। তবে তিনি সবচেয়ে বেশি কাজ করেছেন শিক্ষাখাত নিয়ে। সে সময় তিনি সরকারী পৃষ্ঠপোষকতায় বিভিন্ন স্কুল, কলেজ আর গবেষণাগার প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, যা সে সময়ের বিবেচনায় কল্পনাই করা যেতো না। প্রজাদের সাথেও বেশ ঘনিষ্ঠ ছিলেন তিনি, যার প্রমাণ মেলে দিল্লীর জনগণের সহায়তায় তাঁর সিংহাসনে আরোহণের ঘটনা থেকে। তিনি সবসময় তাঁর প্রজাদের সুখ-দুঃখে তাদের পাশে থাকার চেষ্টা করতেন। তবে তাদের দুর্ভাগ্য, রাজিয়ার শাসনকাল স্থায়ী হয়েছিলো মাত্র অল্প কয়েকটি বছর।
যা-ই হোক, সুলতানা রাজিয়ার মৃত্যুর পর ১২৪২ সালে চিহালগানির অন্তর্দ্বন্দ্বে পরে মুয়িজুদ্দীন বাহরাম নিহত হন। এরপর আলাউদ্দীন মাসুদ সিংহাসনে বসেন। তিনিও চিহালগানির হাতের পুতুল ছাড়া কিছু ছিলেন না। ১২৪৬ সালে তারা ইলতুৎমিশের আরেক পুত্র নাসিরুদ্দীন মাহমুদকে মসনদে বসায়। তিনি অবশ্য বেশ কিছুদিন শাসন করতে পেরেছিলেন। তাঁর শাসনক্ষমতা ১২৪৬ সাল থেকে ১২৬৬ সাল পর্যন্ত ছিলো। নাসিরুদ্দীন মাহমুদ সুলতান হিসেবে বেশ জনপ্রিয় ছিলেন। অত্যন্ত ধার্মিক এ সুলতান গরীব-দুঃখীদের অকাতরে দান করতেন। তাঁর শাসনামলের অধিকাংশ সময়ই তিনি ধর্মকর্মে ব্যস্ত থাকতেন। আর গিয়াসউদ্দীন বলবন নামে তাঁর অনুগত এক সহকারী রাজ্য পরিচালনা করতেন। নাসিরুদ্দীন মাহমুদের পর এই গিয়াসউদ্দীন বলবনই সিংহাসনে বসেন। তিনি আগেই বুঝতে পেরেছিলেন, স্বাভাবিকভাবে রাজ্য পরিচালনার মূল অন্তরায় হচ্ছে এই কুটিল চিহালগানি। আর তাই তিনি তাদের প্রভাব থেকে নিজেকে মুক্ত করতে চিহালগানি ভেঙে দিয়ে স্বাধীনভাবে শাসন করতে শুরু করেন। আর এভাবেই অবশেষে পতন ঘটে প্রতিটি পদে পদে রাজিয়া সুলতানার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রকারী চিহালগানির।
১২৩৬ সাল থেকে ১২৪০ সাল পর্যন্ত মোট চার অথবা সাড়ে চার বছর রাজিয়া ভারতবর্ষ শাসন করেছিলেন। ভারতবর্ষের সমৃদ্ধ ইতিহাসের ভিড়ে এই সময়টুকুর কথা হয়তো তেমন আলোচনাতেই আসতো না। কিন্তু সম্রাজ্ঞী রাজিয়া সুলতানা নিজ যোগ্যতাবলেই এই সময়টুকুকে গুরুত্বপূর্ণ করে তুলতে পেরেছিলেন। ভারতবর্ষের প্রথম নারী সুলতান হিসেবে অবশ্যই তিনি নিজেকে ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করছেন। কারণ একজন নারী হিসেবে তিনি যে সময় সিংহাসনে বসেছিলেন, সে সময় তা কল্পনাও করা যেতো না। ইসলাম ও ভারতবর্ষের ইতিহাসে যে কয়জন নারী খুব বেশি আলোচিত হন, রাজিয়া সুলতানা তাঁদের মধ্যে অন্যতম, যিনি শুধুমাত্র নিজ যোগ্যতাবলে ভারতবর্ষের পরাক্রমশালী সব রাজা, মহারাজা, বাদশাহ আর সম্রাটদের পাশে নিজের অবস্থান গড়ে নিতে পেরেছিলেন। আর তাই ভারতবর্ষের শাসকদের তালিকায় আজও তাঁর নামটি নক্ষত্রের মতই জ্বলজ্বল করছে।
সহায়ক বইসমূহ:
১। মোগল সাম্রাজ্যের সোনালী অধ্যায়- সাহাদত হোসেন খান (আফসার ব্রাদার্স)
২। ভারতবর্ষের ইতিহাস- আন্তোনভা, বোনগার্দ-লেভিন, কতোভস্কি (প্রগতি প্রকাশন)