“একবার স্বপ্নে দেখলাম এমন একটি ছক যেখানে সকল মৌল যথাযথভাবে শ্রেণীবদ্ধ করা হয়েছে। ঘুম ভাঙতেই আমি সাথে সাথে এ ব্যাপারটি একটি কাগজে লিখে ফেলি।”
অদ্ভুত লাগছে ব্যাপারটি? অবিশ্বাস্য ঠেকছে কি? বিশ্বাস না হলেও কিছু করার নেই। উক্তিটি পড়ে আপনি যা ভাবছেন, তা সম্পূর্ণ সঠিক। কেননা ‘পিরিয়ডিক টেবিল’ বা পর্যায় সারণীর আবিষ্কারক দিমিত্রি মেন্ডেলিভ নিজে এ কথা বলেছেন। রসায়নের গতিপথ পাল্টে দেয়া এক বৈপ্লবিক আবিষ্কার পর্যায় সারণী। আর এমন গুরুত্বপূর্ণ এক আবিষ্কারই কিনা একটি স্বপ্নের ফল! তবে বলতেই হয়, মেন্ডেলিভ খুবই ভাগ্যবান একজন মানুষ। কারণ স্বপ্নটি তার সারাদিনের চিন্তার ফল হয়েই যে এসেছিলো!
রসায়নের প্রতি আজন্ম আগ্রহী দিমিত্রি ইভানোভিচ মেন্ডেলিভ ১৮৩৪ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি সাইবেরিয়ার রাশিয়ান অঙ্গরাজ্য ভারখাইন রেমজিয়ানে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা ইভান এবং মা মারিয়ার ঘরে মেন্ডেলিভ জন্মগ্রহণ করেন একাদশ সন্তান হিসেবে! এ ব্যাপারে যেমন মতান্তর রয়েছে, তেমনি বিতর্ক রয়েছে তার পরিবারের মোট সদস্য সংখ্যা নিয়েও। তবে সব বিতর্ক থেকে একটি বিষয়ে অন্তত নিশ্চিত হওয়া যায় যে, মেন্ডেলিভের ভাই-বোন কম করে হলেও ১৫ জন ছিলেন!
মেন্ডেলিভের বাবা সেন্ট পিটার্সবার্গের একটি ‘টিচার্স ট্রেনিং ইনস্টিটিউট’ এর একজন শিক্ষক ছিলেন। মেন্ডেলিভও পরবর্তীতে সে স্কুলে শিক্ষকতার ট্রেনিং নিয়েছেন। এ সময় তিনি তার রসায়ন বিজ্ঞানে জ্ঞান ও দক্ষতা বৃদ্ধি করেন। তিনি ট্রেনিংয়ের পর অবসরে নিয়মিত গবেষণাগারে সময় কাটাতেন। আর তার এই আগ্রহ এবং ট্রেনিংয়ে ভালো ফলাফল তাকে এনে দিয়েছিল ইউরোপে গবেষণার সুযোগ, যা আক্ষরিক অর্থেই তার জীবন বদলে দিয়েছিল।
মেন্ডেলিভের শৈশব খুব একটা আর্থিক সচ্ছলতায় কাটেনি। তার বয়স যখন তের বছর, তখন তার বাবা মারা যান। বিশাল সংসার চালাতে স্বামীর গ্লাস ফ্যাক্টরি পুনরায় চালু করেন মেরি। তবে তিন বছরের মাথায় সে ফ্যাক্টরিতে এক ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড ঘটে এবং ফ্যাক্টরিটি সম্পূর্ণ পুড়ে যায়। মেন্ডেলিভের বয়স যখন ষোল বছর, তখন তার পরিবার তৎকালীন রাশিয়ার রাজধানী সেন্ট পিটার্সবার্গে চলে আসে। আর এখানে এসে কিছুটা ভাগ্যের সহায়তা পান মেন্ডেলিভ। বাবার পরিচয়ে পিটার্সবার্গ টিচার্স ট্রেনিং ইনস্টিটিউটে সুযোগ পেয়ে যান।
পারিবারিক দুঃখ-দারিদ্র্যের মাঝে বড় হওয়া মেন্ডেলিভ ছিলেন খিটখিটে স্বভাবের। কৈশোরের সে খিটখিটে মেজাজ টিকে ছিল উচ্চশিক্ষা পর্যন্তও। অল্পতেই রেগে যাওয়া এবং যার তার সাথে খারাপ ব্যবহার করা যেন ছিল তার নিত্য অভ্যাস। একে তো বাবার পরিচয়ে সুযোগ পেয়েছেন, তার উপর মেন্ডেলিভের খিটখিটে স্বভাব মোটেও ভালো লাগেনি তার কয়েকজন শিক্ষকের। কিন্তু পরীক্ষার ফলাফল দিয়ে তিনি নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করে দেন। সবাইকে তাক লাগিয়ে, পরীক্ষার সময় টিউবারকুলোসিসে ভোগা মেন্ডেলিভ প্রথম স্থান অধিকার করেন! শুধু তা-ই নয়, ১৮৫৬ সালে তিনি সেন্ট পিটার্সবার্গ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স ডিগ্রি লাভ করেন এবং সেখানেও তার ফলাফল ছিল অত্যন্ত ভালো।
স্কলারশিপ নিয়ে ইউরোপে গবেষণা করতে গিয়ে বেশিরভাগ সময়ই জার্মানির হাইডেলবার্গে কাটিয়েছেন মেন্ডেলিভ। কয়েক মাস হলেও তার জীবনের অনেক গুরুত্বপূর্ণ সময় কাটান তিনি হাইডেলবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখানে তিনি বিখ্যাত রসায়নবিদ রবার্ট বুনসেনের সাহচর্যে কাজ করেন। ১৮৬০ সালে বুনসেন ও তার বন্ধু কিরশফ রাসায়নিক স্পেক্ট্রোস্কপি ব্যবহার করে নতুন মৌল সিজিয়াম আবিষ্কার করেন। আর এই নতুন পদ্ধতি উদ্ভাবনের গবেষণায় প্রত্যক্ষভাবে কাজ করে ব্যাপক অভিজ্ঞতা লাভ করেন মেন্ডেলিভ।
“একই তাপমাত্রা ও চাপে সমআয়তনের সকল গ্যাসে সমান সংখ্যক অণু থাকে”
১৮৬০ সালে জার্মানির কার্লশ্রুহে রসায়ন বিজ্ঞানকে মানসম্মত করতে এবং পারমাণবিক ভর সঠিকভাবে নির্ণয়ের পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা করতে একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। সে সম্মেলনে অ্যামেদিও অ্যাভোগেড্রোর উপরের বিখ্যাত নীতিটি বিশ্লেষণ করা হয়। এই নীতি মেন্ডেলিভকে অভিভূত করে। সম্মেলনে পারমাণবিক ভর নির্ণয়ের যে সকল পদ্ধতি আলোচনা করা হয় সেগুলো খুব মনোযোগ সহকারে আত্মস্থ করেন তিনি। ধারণা করা হয়, রাসায়নিক ভরের উপর ভিত্তি করে তার তৈরি করা পর্যায় সারণীর উপর এই সম্মেলনের ব্যাপক প্রভাব ছিল।
জার্মানি গিয়ে মেন্ডেলিভ একদিকে যেমন অনেক কিছু জেনেছেন, অন্যদিকে নিজ দেশ রাশিয়ায় রসায়নের অনগ্রসরতা অনুধাবন করেছেন। এই অনুধাবন থেকে রসায়নে রাশিয়ান বিজ্ঞানীদের আরো এগিয়ে নেয়ার প্রত্যয় নিয়ে ১৮৬১ সালে তিনি সেন্ট পিটার্সবার্গ ফিরে আসেন। আর এই প্রত্যয় থেকেই তার দুর্বার গতিতে সামনে এগিয়ে চলা শুরু হয়। তিনি মাত্র ৬১ দিনে অবিশ্বাস্য দক্ষতায় ‘অরগানিক কেমিস্ট্রি’ বা ‘জৈব রসায়ন’ নামক একটি বই রচনা করেন। বইটি রাশিয়ায় ‘ডমিডভ’ নামক সম্মানজনক পুরস্কার লাভ করে। আর এই বইটিই দিমিত্রি মেন্ডেলিভকে রাশিয়ায় রসায়নবিদদের মধ্যে প্রথম সারিতে আসন তৈরি করে দেয়।
সেন্ট পিটার্সবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে রসায়নের শিক্ষক হিসেবে যোগ দেয়ার পর নিজের প্রতিভা এবং আকর্ষণীয় বক্তৃতার কল্যাণে দ্রুতই শিক্ষার্থীদের মাঝে অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন মেন্ডেলিভ। বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেয়ার পাঁচ বছরের মাথায় ৩৩ বছর বয়সী মেন্ডেলিভ পিটার্সবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের চেয়ারম্যান পদে উন্নীত হন। এমন প্রভাবশালী এবং সম্মানজনক অবস্থানে গিয়ে দেশে রসায়নকে আরো উপরে নিয়ে যাবার স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন মেন্ডেলিভ। ১৮৬৯ সালে তিনি লিখে ফেললেন আরো একটি পাঠ্যপুস্তক ‘প্রিন্সিপালস অব কেমিস্ট্রি’ যা ইংরেজি, জার্মান, ফ্রেঞ্চ সহ একাধিক ভাষায় অনূদিত হয়।
রসায়ন পড়ে থাকলে আপনার অবশ্যই জানা আছে যে, রসায়ন বিজ্ঞানের প্রাণ হচ্ছে মৌলিক পদার্থগুলো এবং পর্যায় সারণী। মেন্ডেলিভের সময় মৌলিক পদার্থ অনেকগুলোই আবিষ্কৃত হয়েছিল, কিন্তু ছিল না পর্যায় সারণী। আর রসায়ন তখনো পর্যন্ত কেবল সামান্য কিছু পর্যবেক্ষণ এবং আবিষ্কারের জোড়াতালিই ছিল। এই অবস্থা থেকে উত্তরণের উপায় ভাবতে লাগলেন মেন্ডেলিভ। তিনি রসায়নের প্রাণ তথা মৌলগুলোকে যৌক্তিক উপায়ে ছকবদ্ধ করার উপায় ভাবতে লাগলেন।
আবার ফিরে আসবো মেন্ডেলিভের স্বপ্নে। মৌলগুলোকে সাজানোর জন্য মেন্ডেলিভ একটা উপায় বের করলেন। তিনি তখনকার সময় পর্যন্ত আবিষ্কৃত মোট ৬৫টি মৌলের প্রতিটির নাম, রাসায়নিক ধর্ম এবং পারমাণবিক ভর ৬৫টি ভিন্ন কার্ডে (তাসের কার্ড) লিখলেন। তারপর সেগুলো বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে সাজানোর চেষ্টা করলেন। তিনি লক্ষ্য করলেন, পারমাণবিক ভর এই ছকের জন্য বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। কারণ ভর বৃদ্ধি পাবার সাথে সাথে মৌলের অনুরূপ বৈশিষ্ট্যের পুনরাবৃত্তি হয়। তবে এই পর্যন্ত গিয়েও ছকের জন্য কোনো নির্দিষ্ট নমুনা কল্পনা করতে পারছিলেন না মেন্ডেলিভ। খুব বড় কিছু একটা আবিষ্কারের কাছাকাছি এসে গেছেন, এমন ভাবতে ভাবতে খাতায় একটার পর একটা নমুনা ছক এঁকে যাচ্ছিলেন। আর তখনই আশীর্বাদ হয়ে এলো তার ঘুম!
ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়লেন মেন্ডেলিভ এবং স্বপ্নে দেখলেন কিছু একটা। ঘুম ভাঙতেই অনুভব করলেন তার অবচেতন মন আসলে একটি বাস্তবসম্মত সারণীর নমুনা দাঁড় করিয়ে ফেলেছে যা তিনি স্বপ্নে দেখেছেন! তিনি বসে পড়লেন পর্যায় সারণি তৈরি করতে। মাত্র দু’সপ্তাহের ব্যবধানে মেন্ডেলিভ তৈরি করে ফেললেন পর্যায় সারণী। ১৮৬৯ সালে তিনি প্রকাশ করলেন ‘দ্য রিলেশন বিটুইন দ্য প্রোপার্টিজ অ্যান্ড অ্যাটমিক ওয়েইট অব দ্য এলিমেন্টস’ নামক একটি গবেষণাপত্র, যা রসায়নের জগতে আলোড়ন তুললো। আর মেন্ডেলিভ হয়ে গেলেন ইতিহাসের পাতায় অমর।
মেন্ডেলিভের আগেও আসলে আরো কয়েকজন পর্যায় সারণি প্রস্তুত করেছিলেন। কিন্তু তারা সফল হতে পারেননি বলেই আজ পর্যায় সারণীর আবিষ্কর্তা হিসেবে আমরা মেন্ডেলিভের নাম জানি। রসায়নবিদ লোথার মেয়ার ১৮৬৪ সালেই একটি পর্যায় সারণি দাঁড় করিয়েছিলেন, তবে তিনি ১৮৭০ সালের আগে তা প্রকাশ করেননি। অন্যদিকে জন নিউল্যান্ড তার নিজের তৈরি পর্যায় সারণি প্রকাশ করেছিলেন ১৮৬৫ সালে যেখানে তিনি উল্লেখ করেছিলেন, “সারণির যেকোনো মৌল তার থেকে অষ্টম (আগে বা পরে) মৌলের ধর্মের পুনরাবৃত্তি করবে।” কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে তার কাজ চরমভাবে অবহেলিত হয়েছিল। সবশেষ মেন্ডেলিভ হাঁটলেন ভিন্ন পথে। তিনি সারণিতে মৌলগুলো কোন প্যাটার্নে থাকবে তার একটি যৌক্তিক নমুনা দাঁড় করালেন। এছাড়াও তিনি নিচের দুটি ভবিষ্যদ্বাণী করলেন।
- যে কয়টি মৌলের ধর্ম তার পর্যায় সারণির পারমাণবিক ভর অনুযায়ী মিলছে না তাদের পারমাণবিক ভর ভুলভাবে নির্ণীত হয়েছে।
- মেন্ডেলিভ আরো নতুন আটটি মৌলের অস্তিত্ব এবং ধর্ম সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করেন।
প্রথমে নিউল্যান্ডের মতো তার কাজেও কেউ খুব একটা গুরুত্ব দেয়নি। কিন্তু তার ভবিষ্যদ্বাণীগুলো রসায়নবিদরা বিবেচনায় আনেন। আর তাতেই সব ধারণা উল্টে যায়। দেখা গেল যে বাস্তবিকভাবেই কিছু মৌলের পারমাণবিক ভর ভুলভাবে নির্ণয় করা হয়েছিল! ব্যস, আর কী লাগে মেন্ডেলিভের পর্যায় সারণিকে সঠিক বলে ধরে নিতে! পরবর্তীকালে তার ভবিষ্যদ্বাণী করা মৌলগুলো আবিষ্কৃত হলে তার খ্যাতি আরো বেড়ে যায়। ১৯০৫ সালে তিনি ব্রিটিশ রয়্যাল সোসাইটির সর্বোচ্চ সম্মান ‘কুপলি মেডেল’এ ভূষিত হন। একই বছর তিনি ‘সুইডিশ অ্যাকাডেমি অব সায়েন্টিস্ট’ এর সদস্যপদ লাভ করেন। পর্যায় সারণির ১০১ তম মৌল ‘মেন্ডেলিভিয়াম’ এর নামকরণ করা হয় তার সম্মানে।
গুণী রসায়নবিদ দিমিত্রি ইভানোভিচ মেন্ডেলিভ ১৯০৭ সালে ইনফ্লুয়েঞ্জায় আক্রান্ত হয়ে সেন্ট পিটার্সবার্গে মারা যান। দিনটি ছিল ২ ফেব্রুয়ারী, তার ৭৩ তম জন্মদিনের ঠিক ছয়দিন আগে। বিশ্বজুড়ে রসায়নবিদগণ তথা রসায়ন বিজ্ঞান এই মহান বিজ্ঞানীর কাছে ঋণী থাকবে চিরকাল।