
ডুইট আইসেনহাওয়ার, বার্নার্ড মন্টগোমারি, শার্ল দ্য গল, এরউইন রোমেল– দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সম্পর্কে যাঁদের ধারণা রয়েছে, তাদের কাছে এই নামগুলো অতি পরিচিত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সবচেয়ে সফল সমরনায়ক কে– এই প্রশ্নের উত্তরে পশ্চিমা বিশ্ব তো বটেই, সমগ্র বিশ্বেরই অধিকাংশ মানুষ সম্ভবত এই নামগুলোরই কোনো একটি বলবে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে যে সমরবিদ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় সবচেয়ে বেশি সাফল্য অর্জন করেছিলেন, তিনি এদের মধ্যে কেউ নন। তিনি হলেন মার্শাল অফ দ্য সোভিয়েত ইউনিয়ন গিওর্গি কনস্তান্তিনোভিচ ঝুকভ!
মার্শাল ঝুকভ ছিলেন সেই সমরনায়ক, যিনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় দুর্ধর্ষ জার্মান ভের্মাখটের (Wermacht) অগ্রযাত্রা প্রথমবারের মতো রুখে দিতে সমর্থ হয়েছিলেন। তিনিই প্রথম বিশ্ববাসীকে দেখিয়েছিলেন যে, দুর্ধর্ষ নাৎসি জার্মান সশস্ত্রবাহিনীকে পরাজিত করা সম্ভব। তিনিই ১৯৪১ সালের সেপ্টেম্বরে জার্মানদের নিকট নিশ্চিত পতন থেকে লেনিনগ্রাদকে রক্ষা করেছিলেন। তিনিই ১৯৪১ সালের ডিসেম্বরে জার্মান বিদ্যুৎগতির আক্রমণ থেকে মস্কোকে রক্ষা করেছিলেন। তার পরিকল্পনাতেই বিশ্ববিখ্যাত স্তালিনগ্রাদের যুদ্ধে জার্মান সমরযন্ত্র পরাস্ত হয়েছিল। তিনিই কুরস্কে সংঘটিত বিশ্বের সর্ববৃহৎ ট্যাঙ্ক যুদ্ধে জার্মানদের আক্রমণ ক্ষমতাকে ধ্বংস করে দিয়েছিলেন। এবং সবশেষে তার নেতৃত্বেই সোভিয়েত সৈন্যরা ১৯৪৫ সালের এপ্রিলে বার্লিন দখল করে নিয়েছিল, আর তার কাছেই আত্মসমর্পণ করেছিল দুর্ধর্ষ নাৎসি জার্মানি।
জন্ম, শৈশব এবং কৈশোর
এক অতি সাধারণ কৃষক পরিবার থেকে উঠে এসেছিলেন তিনি। সেখান থেকে পরিণত হয়েছিলেন মানব ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ সমরনায়কদের মধ্যে অন্যতম একজনে। তিনিই একমাত্র রুশ সেনানায়ক, যার ছবি বিখ্যাত টাইম ম্যাগাজিনের প্রচ্ছদে ছাপা হয়েছিল। স্নায়ুযুদ্ধের প্রাথমিক পর্যায়ে তার নেতৃত্বেই সোভিয়েত ইউনিয়নের সামরিক কৌশল প্রণীত হয়েছিল। অদম্য ইচ্ছাশক্তি এবং ইস্পাত-দৃঢ় মনোবলের অধিকারী ঝুকভকে রুশ ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ সমরবিদ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। সোভিয়েত ইউনিয়নে তার সম্মান ছিল আকাশছোঁয়া, অথচ তার সমসাময়িক আইসেনহাওয়ার, মন্টগোমারি, রোমেল বা দ্য গলের মতো তিনি কখনোই বহির্বিশ্বে ব্যাপক পরিচিতি অর্জন করেননি।
১৮৯৬ সালের ১ ডিসেম্বর তদানীন্তন রুশ সাম্রাজ্যের কালুগা গভর্নর–শাসিত প্রদেশের স্ত্রেলকোভকা গ্রামে (বর্তমানে রাশিয়ার কালুগা প্রদেশের ঝুকভ শহর) একটি কৃষক পরিবারে ঝুকভের জন্ম। ঝুকভ শব্দটি এসেছে রুশ শব্দ ‘ঝুক’ থেকে, যেটির অর্থ ‘গুবরে-পোকা’। অবশ্য রুশ কথ্য ভাষায় ঝুক শব্দটি দিয়ে কিছুটা দুর্বৃত্ত প্রকৃতির লোককে বুঝানো হয়। ঝুকভের পরিবারটি ছিল জাতিগতভাবে রুশ এবং ধর্মগতভাবে রুশ অর্থোডক্স খ্রিস্টান। ঝুকভের বাবা কনস্তান্তিন ঝুকভ ছিলেন একজন মুচি আর মা উস্তিনিয়া ঝুকোভা ছিলেন একজন কৃষি শ্রমিক। ঝুকভ ছিলেন বাবা-মায়ের দ্বিতীয় সন্তান। তার বড় বোন মারিয়া ছিলেন তার দুই বছরে বড়, কিন্তু তার ছোট ভাই আলেক্সেই শিশুকালেই মৃত্যুবরণ করে।

ঝুকভের পরিবারের ছিল অত্যন্ত দরিদ্র এবং খুবই কষ্টের মধ্যে তারা দিনাতিপাত করত। ঝুকভের বাবা-মা তাকে একদিকে যেমন খুবই ভালোবাসতেন, অন্যদিকে তেমনি কড়া শাসনে রাখতেন। ছোটবেলা থেকেই ঝুকভ ছিলেন জেদি প্রকৃতির এবং এজন্য তাকে তার বাবার হাতে বহু উত্তম-মধ্যম পেতে হয়েছে। কিন্তু শৈশবের অভিজ্ঞতা নিয়ে ঝুকভের কোনো ক্ষোভ ছিল না। পরবর্তী জীবনে তিনি বলতেন, “কঠিন জীবন হচ্ছে জীবনের শ্রেষ্ঠ শিক্ষাঙ্গন!”
ঝুকভের বাবা-মা তাদের দারিদ্রতা সত্ত্বেও ছেলেকে পড়াশোনা করাতে আগ্রহী ছিলেন। এজন্য ১৯০৩ সালে ৭ বছর বয়সে ঝুকভকে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি করানো হয়। প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্ত হওয়ার পর ১৯০৮ সালে ১২ বছর বয়সী ঝুকভকে মস্কোয় তার মামার কাছে প্রেরণ করা হয়। ঝুকভের মামা মিখাইল মস্কোয় পশমের ব্যবসা করতেন এবং ঝুকভ তার দোকানে শিক্ষানবিশ হিসেবে কাজ করতে শুরু করেন। সেখানে তাকে দৈনিক ১২ ঘণ্টা কাজ করতে হতো।
কিন্তু কঠোর পরিশ্রমের মধ্যেও ঝুকভ পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন এবং এ উদ্দেশ্যে একটি নৈশ বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। তিনি এবং তার মামাতো ভাই আলেক্সান্দর মিলে রুশ ভাষা, গণিত, ভূগোল এবং জনপ্রিয় বিজ্ঞাবের বই পড়তেন। আলেক্সান্দরকে ব্যবসার কাজে বেশ কয়েকবার জার্মানির লাইপজিগে যেতে হয়েছিল এবং এর ফলে তিনি জার্মান ভাষা রপ্ত করেছিলেন। তার কাছে ঝুকভ জার্মান ভাষা শিখতে শুরু করেন। তার পরবর্তী জীবনে তার জার্মান ভাষার জ্ঞান ব্যাপক কাজে এসেছিল।
কৈশোরকাল থেকেই ঝুকভের মূল বৈশিষ্ট্য ছিল তার সুশৃঙ্খল জীবনধারা এবং এজন্য তিনি ব্যবসার কাজে দ্রুত উন্নতি করতে থাকেন। ১৯১৪ সাল নাগাদ তিনি একজন প্রশিক্ষিত পশম ব্যবসায়ীতে পরিণত হন। সেসময় তিনি বেশ ভালো আয় করছিলেন এবং তার অধীনে তখন তিনজন কমবয়সী ছেলে কাজ করছিল। পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকলে ঝুকভ হয়তো একজন সফল পশম ব্যবসায়ী হিসেবেই জীবন কাটিয়ে দিতে পারতেন, কিন্তু ইতোমধ্যে শুরু হয়ে যায় প্রথম বিশ্বযুদ্ধ।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ: রুশ সেনাবাহিনীর এনসিও

১৯১৪ সালের ২৮ জুন অস্ট্রিয়া–হাঙ্গেরির অন্তর্গত বসনিয়া–হার্জেগোভিনার সারায়েভোয় গাভ্রিলো প্রিন্সিপ নামক একজন সার্ব উগ্র জাতীয়তাবাদী অস্ট্রো–হাঙ্গেরীয় যুবরাজ আর্চডিউক ফ্রাঞ্জ ফার্ডিন্যান্ড ও তার স্ত্রীকে খুন করে। অস্ট্রিয়া–হাঙ্গেরির সঙ্গে সার্বিয়ার আগে থেকেই তীব্র বিরোধ চলে আসছিল এবং এই হত্যাকাণ্ডের জন্য অস্ট্রিয়া–হাঙ্গেরি সার্বিয়াকে দায়ী করে। সার্বিয়া একটি অস্ট্রো–হাঙ্গেরীয় চরমপত্র প্রত্যাখ্যান করার পর ১৯১৪ সালের ২৮ জুলাই অস্ট্রিয়া–হাঙ্গেরি সার্বিয়ার ওপর আক্রমণ চালায়। স্লাভিক জাতিভুক্ত সার্বিয়া ছিল রাশিয়ার মিত্র, সুতরাং সার্বিয়ার প্রতি সমর্থন জানানোর উদ্দেশ্যে রাশিয়া অস্ট্রিয়া–হাঙ্গেরির সীমান্তে সৈন্য সমাবেশ শুরু করে।
অস্ট্রিয়া–হাঙ্গেরির মিত্র জার্মানি রাশিয়াকে সৈন্য সমাবেশ বন্ধ করার জন্য চরমপত্র প্রদান করে এবং রাশিয়া এটি উপেক্ষা করায় ১ আগস্ট জার্মানি রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। রুশ–জার্মান যুদ্ধে ফ্রান্স নিরপেক্ষ থাকবে কিনা, জার্মানির এই প্রশ্নের কোনো জবাব না পাওয়ায় ৩ আগস্ট জার্মানি রাশিয়ার মিত্র ফ্রান্সের বিরুদ্ধেও যুদ্ধ ঘোষণা করে। জার্মানি কর্তৃক বেলজিয়ামের নিরপেক্ষতা লঙ্ঘনের কারণে ৪ আগস্ট ব্রিটেন জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। ৬ আগস্ট অস্ট্রিয়া–হাঙ্গেরি রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। এভাবে শুরু হয়ে যায় প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। পরবর্তীতে জাপান, ইতালি, রুমানিয়া, গ্রিস, চীন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও আরো কয়েকটি রাষ্ট্র রাশিয়া, ফ্রান্স ও ব্রিটেনের পক্ষে যোগ দেয়, অন্যদিকে ওসমানীয় সাম্রাজ্য ও বুলগেরিয়া যোগ দেয় জার্মানি ও অস্ট্রিয়া–হাঙ্গেরির পক্ষে।

রুশদের দৃষ্টিকোণ থেকে, এই যুদ্ধ ছিল রাশিয়া ও সার্বিয়ার বিরুদ্ধে জার্মানি ও অস্ট্রিয়া–হাঙ্গেরির অন্যায় আগ্রাসনের ফল এবং রাশিয়ার জাতীয় প্রতিরক্ষা যুদ্ধ। ফলে যুদ্ধ শুরুর পর রুশদের মধ্যে তীব্র দেশপ্রেম জাগ্রত হয় এবং লক্ষ লক্ষ রুশ নাগরিক স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে রুশ সেনাবাহিনীতে যোগদান করে। ঝুকভের মামাতো ভাই আলেক্সান্দর ছিলেন তাদের মধ্যে একজন। তিনি যুদ্ধ শুরুর পরপরই স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে রুশ সেনাবাহিনীতে যোগ দেন এবং ঝুকভকেও তার পথ অনুসরণ করার জন্য উৎসাহ দেন। ঝুকভ প্রথমে এ ব্যাপারে উৎসাহ দেখান, কিন্তু পরবর্তীতে তার সেনাবাহিনীতে যোগদানের ডাক আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করার সিদ্ধান্ত নেন। উল্লেখ্য, রুশ সশস্ত্রবাহিনী ছিল ‘কনস্ক্রিপশন’ (conscription) ভিত্তিক এবং একটি নির্দিষ্ট বয়সে পৌঁছানোর পর প্রতিটি রুশ যুবককেই সশস্ত্রবাহিনীতে যোগদানের জন্য ডাকা হতো।
১৯১৫ সালের গ্রীষ্মকালে ঝুকভের সেনাবাহিনীতে যোগদানের জন্য ডাক পড়ে। তার মামা মিখাইল নিজের ছেলের সেনাবাহিনীতে যোগদান নিয়ে সন্তুষ্ট ছিলেন না এবং তিনি ভাগ্নেকে স্বাস্থ্যগত কারণ দেখিয়ে সেনাবাহিনীতে যোগদান এড়িয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেন। কিন্তু ঝুকভ মন্তব্য করেন যে, মাতৃভূমির প্রতি তার কর্তব্য রয়েছে এবং সেটি তাকে পালন করতে হবে। ১৯১৫ সালের আগস্টে তিনি কালুগায় রুশ সামরিক কেন্দ্রে উপস্থিত হন এবং সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। তাকে ৫ম অতিরিক্ত অশ্বারোহী রেজিমেন্টের অন্তর্ভুক্ত করা হয় এবং সেপ্টেম্বরে তার রেজিমেন্টটিকে খারকভে (বর্তমান ইউক্রেনের অন্তর্ভুক্ত) অবস্থিত ১০ম অশ্বারোহী ডিভিশনে যোগদানের জন্য প্রেরণ করা হয়।

খারকভে ঝুকভ প্রথম সামরিক প্রশিক্ষণ লাভ করেন এবং ১৯১৬ সালের বসন্তকাল নাগাদ তার প্রশিক্ষণ সম্পূর্ণ হয়। কিন্তু এরপর তাকে নন–কমিশন্ড অফিসার (এনসিও) হিসেবে অতিরিক্ত প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয় এবং তিনি একজন এনসিওতে পরিণত হন। এ সময় চলছিল রুশ সশস্ত্রবাহিনীর ব্রুসিলভ আক্রমণাভিযান (Brusilov Offensive)। রুশ জেনারেল আলেক্সেই ব্রুসিলভের নেতৃত্বাধীন এই অভিযানটি ছিল প্রথম বিশ্বযুদ্ধে রাশিয়ার সবচেয়ে সফল অভিযান এবং ইতিহাসের সবচেয়ে রক্তক্ষয়ী সামরিক অভিযানগুলোর মধ্যে একটি। এই অভিযানের ফলে রুশ সৈন্যরা ভোলিনিয়া ও বুকোভিনার প্রায় সম্পূর্ণ অংশ এবং গ্যালিসিয়ার অংশবিশেষ দখল করে নেয়। অভিযানে ৬২,১৫৫ জন রুশ সৈন্য নিহত, ৩,৭৬,৯১০ জন রুশ সৈন্য আহত/অসুস্থ এবং ৩৮,৯০২ জন রুশ সৈন্য নিখোঁজ/বন্দি হয়। অন্যদিকে, এই অভিযানে প্রায় ১২ লক্ষ অস্ট্রো–হাঙ্গেরীয়, প্রায় সাড়ে ৩ লক্ষ জার্মান ও প্রায় ১২,০০০ ওসমানীয় সৈন্য হতাহত বা বন্দি হয়।
ব্রুসিলভ আক্রমণাভিযান চলাকালে ১৯১৬ সালের আগস্টে ঝুকভ ও তার ইউনিটকে বেসারাবিয়া গভর্নর–শাসিত প্রদেশে (বর্তমান মলদোভার অন্তর্ভুক্ত) দনেস্তর নদী বরাবর মোতায়েন করা হয়। এবার ঝুকভ প্রথমবারের মতো সত্যিকার যুদ্ধের অভিজ্ঞতা অর্জন করেন। যুদ্ধক্ষেত্রে পৌঁছানোর আগেই পথিমধ্যে শত্রুপক্ষের একটি রিকনিস্যান্স (reconnaissance) বিমান ঝুকভের ইউনিটের ওপর বোমাবর্ষণ করে। এর ফলে একজন সৈন্য নিহত হয় এবং ৫টি ঘোড়া আহত হয়।
যুদ্ধক্ষেত্রে পৌঁছানোর কিছুদিনের মধ্যেই ঝুকভ একজন জার্মান অফিসারকে বন্দি করতে সক্ষম হন এবং এই কৃতিত্বের জন্য তাকে ‘ক্রস অফ সেইন্ট জর্জ’ পদক প্রদান করা হয়। এ সময় ঝুকভ গোয়েন্দা কার্যক্রমের প্রতি খুবই আগ্রহী হয়ে উঠেন এবং এক্ষেত্রে তার জার্মান ভাষার জ্ঞান কাজে আসে। শত্রুপক্ষের সৈন্য ও অফিসারদের বন্দি করা তার একটি বিশেষত্বে পরিণত হয়।
১৯১৬ সালের অক্টোবরে অনুরূপ একটি টহল দেয়ার সময় তার ঘোড়াটি একটি মাইন বিস্ফোরণের ফলে নিহত হয় এবং তার দুই সঙ্গী গুরুতরভাবে আহত হয়। ঝুকভ নিজে শেল–শকড হয়ে যান এবং তাকে চিকিৎসার জন্য খারকভের একটি হাসপাতালে প্রেরণ করা হয়। আহত হওয়ার কারণে তাকে দ্বিতীয়বারের মতো একটি ‘ক্রস অফ সেইন্ট জর্জ’ পদক প্রদান করা হয়। সুস্থ হওয়ার পর তার ইউনিটে ফিরে যান। এ সময় তার ইউনিট খারকভ থেকে প্রায় ৮০ মাইল দক্ষিণ–পূর্বে লাগেরি নামক স্থানে অবস্থান করছিল।

রুশ বিপ্লব: রাজনীতির প্রথম পাঠ
ইতোমধ্যে রাশিয়ার রাজনৈতিক পরিস্থিতি খুবই টালমাটাল হয়ে পড়ছিল। যুদ্ধে রাশিয়া প্রচুর ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছিল, পশ্চিম রাশিয়ার অংশবিশেষ শত্রুদের করতলগত হয়েছিল এবং যুদ্ধের কারণে জনসাধারণের অর্থনৈতিক দুর্ভোগ বৃদ্ধি পাচ্ছিল। ১৯১৫ সালে রুশ সম্রাট দ্বিতীয় নিকোলাই নিজে রুশ সশস্ত্রবাহিনীর সর্বাধিনায়কের পদ গ্রহণ করেছিলেন এবং এজন্য যুদ্ধে রাশিয়ার পরাজয়গুলোর জন্য তাকেই দায়ী করা হচ্ছিল। এমতাবস্থায় ১৯১৭ সালের মার্চে রাজধানী পেত্রোগ্রাদে (বর্তমান রাশিয়ার সেইন্ট পিটার্সবার্গ) সংঘটিত একটি বিপ্লব/অভ্যুত্থানের ফলে রোমানভ রাজবংশ ক্ষমতাচ্যুত হয় এবং উদারপন্থী, গণতন্ত্রী ও সমাজতন্ত্রীদের সমন্বয়ে গঠিত একটি অস্থায়ী সরকার রাশিয়ার শাসনক্ষমতা গ্রহণ করে।
কিন্তু অস্থায়ী সরকারের হাতে রাশিয়ার একচ্ছত্র কর্তৃত্ব ছিল না। এ সময় ‘শ্রমিক, কৃষক ও সৈনিকদের সোভিয়েত’ নামক জনসাধারণের ভোটে নির্বাচিত পরিষদগুলো স্থানীয় পর্যায়ে শাসনক্ষমতার অধিকারী হয়ে ওঠে এবং এর ফলে রাশিয়ায় ‘দ্বৈত ক্ষমতা’ বিরাজ করতে থাকে। উল্লেখ্য, রুশ ভাষায় ‘সোভিয়েত’ শব্দটির অর্থ সভা বা পরিষদ।
অস্থায়ী সরকার বিভিন্ন বৈপ্লবিক সংস্কার কর্মসূচি গ্রহণ করে এবং এগুলোর মধ্যে একটি ছিল রুশ সশস্ত্রবাহিনীর গণতন্ত্রায়ন। রুশ সেনাবাহিনীর প্রতিটি ইউনিটে কমিটি নির্বাচনের প্রথা প্রবর্তিত হয় এবং এই কমিটি স্থানীয় সোভিয়েতগুলোতে তাদের প্রতিনিধি প্রেরণের সুযোগ লাভ করে। ঝুকভ যে অশ্বারোহী স্কোয়াড্রনের অংশ ছিলেন, তাকে সেই স্কোয়াড্রনের কমিটির সভাপতি নির্বাচিত করা হয় এবং রেজিমেন্টাল সোভিয়েতে স্কোয়াড্রনটির প্রতিনিধি হিসেবে নিযুক্ত করা হয়। এ সময় ঝুকভের নির্দিষ্ট কোনো রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি ছিল না। একজন ভালো এনসিও হিসেবে তার মর্যাদা ও জনপ্রিয়তার কারণে তিনি এই পদে নির্বাচিত হয়েছিলেন। কিন্তু তিনি এ পর্যায়ে এসে বলশেভিক মতবাদের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়তে শুরু করেন।
এ সময় রাশিয়া জুড়ে গড়ে ওঠা সোভিয়েতগুলোতে ভ্লাদিমির লেনিনের নেতৃত্বাধীন মার্ক্সবাদী বলশেভিকরা ক্রমশ প্রাধান্য বিস্তার করতে থাকে এবং অস্থায়ী সরকারের সঙ্গে তাদের ক্ষমতার দ্বন্দ্ব শুরু হয়। অবশেষে ১৯১৭ সালের নভেম্বরে বলশেভিকরা একটি বিপ্লব/অভ্যুত্থানের মাধ্যমে অস্থায়ী সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করে এবং রাশিয়ার শাসনক্ষমতা দখল করে নেয়। কিন্তু ঝুকভ যে রেজিমেন্টাল সোভিয়েতের সদস্য ছিলেন, সেটির কর্তৃত্ব চলে গিয়েছিল ইউক্রেনীয় জাতীয়তাবাদীদের হাতে, যারা ছিল তীব্র বিপ্লববিরোধী। তারা ঝুকভের ইউনিটকে বাতিল করে দেয় ও তাকে বন্দি করার চেষ্টা করে। এর ফলে ঝুকভকে কয়েক সপ্তাহ পালিয়ে বেড়াতে হয় এবং এরপর তিনি তার নিজ গ্রাম স্ত্রেলকোভকায় ফিরে আসেন।
রুশ গৃহযুদ্ধ: লাল ফৌজে যোগদান

বলশেভিকরা ক্ষমতা লাভের পর রুশ সাম্রাজ্যের সশস্ত্রবাহিনীকে বিলুপ্ত করে এবং তাদের বিপ্লবকে রক্ষা করার জন্য একটি নতুন সশস্ত্রবাহিনী গড়ে তোলে। এভাবে ১৯১৮ সালের জানুয়ারিতে গঠিত হয় বিখ্যাত ‘লাল ফৌজ’ (Red Army)। ঝুকভ নতুন এই বাহিনীতে যোগ দিতে ইচ্ছুক ছিলেন, কিন্তু এ সময় তিনি টাইফুস রোগে আক্রান্ত হন এবং প্রায় ছয় মাস অসুস্থতায় ভোগেন। ১৯১৮ সালের সেপ্টেম্বরে ঝুকভের সমবয়সী সৈন্যদের লাল ফৌজে যোগদানের জন্য ডেকে পাঠানো হয়। এ সময় রাশিয়া জুড়ে বলশেভিক/লাল রুশদের সঙ্গে বলশেভিকবিরোধী/শ্বেত রুশদের গৃহযুদ্ধ শুরু হয়ে গিয়েছিল এবং এজন্য অনেকেই এই ডাককে উপেক্ষা করে। কিন্তু ঝুকভ তার সামরিক জীবনে ফিরে যেতে ইচ্ছুক ছিলেন এবং তার রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি ততদিনে পুরোপুরি বলশেভিক হয়ে উঠেছিল। ফলে ১৯১৮ সালের ১ অক্টোবর ঝুকভ লাল ফৌজে যোগদান করেন এবং তাকে ১ম মস্কো অশ্বারোহী ডিভিশনের অন্তর্গত ৪র্থ রেজিমেন্টের অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
১৯১৯ সালের মার্চে ঝুকভ কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যপদ প্রার্থী হন। সেসময় যে কেউ চাইলেই কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য হতে পারত না। প্রথমে তাদেরকে সদস্যপদের জন্য আবেদন করতে হতো এবং এরপর একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত কমিউনিস্ট আদর্শের প্রতি তাদের নিষ্ঠা পর্যবেক্ষণ করা হতো। এরপরই কেবল তাদেরকে পার্টির সদস্যপদ প্রদান করা হতো। ফলে ১৯২০ সালের মে মাসের আগে ঝুকভ কমিউনিস্ট পার্টির পূর্ণ সদস্যপদ লাভ করেননি।
অ্যাডমিরাল কোলচাকের বিরুদ্ধে লড়াই: প্রণয় এবং পদোন্নতি
এদিকে ১৯১৯ সালের মে মাসে ঝুকভের ডিভিশনকে দক্ষিণ উরাল অঞ্চলে প্রেরণ করা হয়। এ সময় প্রাক্তন রুশ নৌবাহিনীর অ্যাডমিরাল আলেক্সান্দর কোলচাক সাইবেরিয়ায় বলশেভিক সরকারের বিপরীতে একটি বিকল্প সরকার প্রতিষ্ঠা করেছিলেন এবং নিজেকে রাশিয়ার ‘সর্বোচ্চ শাসক’ ঘোষণা করেছিলেন। তার সরকারকে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের মিত্রশক্তি সমর্থন করছিল। কোলচাকের শ্বেত ফৌজের (White Army) বিরুদ্ধে যুদ্ধ ছিল লাল ফৌজের সদস্য হিসেবে ঝুকভের প্রথম লড়াই। জুনে ঝুকভের ইউনিট ৮০০ কসাক অশ্বারোহীর সঙ্গে এক ভয়াবহ যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। ঝুকভের নিজের ভাষ্যমতে, এটি ছিল তার জীবনের সবচেয়ে তীব্র লড়াইগুলোর একটি।

এই লড়াইয়ের পর ১৯১৯ সালের সেপ্টেম্বরে ঝুকভের ইউনিটকে জারিৎসিনে (বর্তমানে রাশিয়ার ভোলগোগ্রাদ) প্রেরণ করা হয় এবং সেখানে তিনি শ্বেত ফৌজের বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি খণ্ডযুদ্ধে অংশ নেন। অক্টোবরের শেষদিকে সংঘটিত এক হাতাহাতি লড়াইয়ের সময় একটি গ্রেনেড বিস্ফোরণের ফলে ঝুকভ আহত হন এবং তাকে সারাতভের একটি ফিল্ড হাসপাতালে প্রেরণ করা হয়। এখানে অবস্থানকালে ঝুকভ মারিয়া ভলখোভা নাম্নী এক স্কুলছাত্রীর সঙ্গে প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন। কিন্তু মাসখানেকের মধ্যেই ভলখোভাকে পলতাভায় (বর্তমানে ইউক্রেনের অন্তর্ভুক্ত) নিজের বাড়িতে ফিরে যেতে হয় এবং এর ফলে এই সম্পর্কের অবসান ঘটে। এর কিছুদিনের মধ্যে ঝুকভকেও পুরোপুরি সুস্থ হয়ে ওঠার জন্য স্ত্রেলকোভকায় তার গ্রামের বাড়ি পাঠিয়ে দেয়া হয়।
গ্রামে থাকা অবস্থায় ঝুকভ আবার টাইফুস রোগে আক্রান্ত হন, কিন্তু পুরোপুরি সুস্থ হওয়ার আগেই ১৯২০ সালের ২০ জানুয়ারি লাল ফৌজে ফিরে যান। তাকে ৩য় অতিরিক্ত অশ্বারোহী ডিভিশনের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এর মাস দুয়েকের মধ্যেই তাকে রিয়াজানে ‘লাল কমান্ডারদের অশ্বারোহী কোর্স’ করার জন্য প্রেরণ করা হয়। ১৫ মার্চ তিনি এই কোর্সে ভর্তি হন এবং প্রস্তুতিমূলক পরীক্ষাগুলোয় অত্যন্ত ভালো ফলাফল করেন। এরপর তাকে অশ্বারোহী যুদ্ধবিগ্রহের বিশেষ রণকৌশলের ওপর প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। আগস্টে এই কোর্স সমাপ্ত হয়। এই কোর্স গ্রহণের মধ্য দিয়ে ঝুকভ লাল ফৌজের একজন কমান্ডার হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেন। উল্লেখ্য, এ সময় লাল ফৌজে কোনো র্যাঙ্ক ছিল না এবং অফিসার পদমর্যাদার সদস্যদের ‘কমান্ডার’ হিসেবে অভিহিত করা হতো।
ব্যারন ভ্রাঙ্গেলের বিরুদ্ধে লড়াই: পরিণয় এবং উত্থানের সূচনা
কোর্স শেষ হলে ঝুকভ এবং তার সঙ্গের আরো প্রায় ১০০ ক্যাডেটকে ২য় মস্কো রাইফেল ব্রিগেডের অন্তর্ভুক্ত করা হয় এবং উত্তর ককেশাসের ক্রাস্নোদার অঞ্চলে প্রেরণ করা হয়। এখানে লাল ফৌজ ব্যারন পিওতর ভ্রাঙ্গেলের নেতৃত্বাধীন শ্বেত ফৌজের বিরুদ্ধে যুদ্ধরত ছিল। উল্লেখ্য, প্রাক্তন রুশ সেনাবাহিনীর লেফটেন্যান্ট জেনারেল ভ্রাঙ্গেল ছিলেন ‘দক্ষিণ রাশিয়ার সশস্ত্রবাহিনী’র সর্বাধিনায়ক এবং তার মূল ঘাঁটি ছিল ক্রিমিয়ায়।
ক্রাস্নোদারে ভ্রাঙ্গেলের শ্বেত ফৌজের সঙ্গে কয়েকটি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সংঘাতে অংশগ্রহণের পর ঝুকভকে ১৪তম পৃথক অশ্বারোহী ব্রিগেডের অন্তর্ভুক্ত ১ম অশ্বারোহী রেজিমেন্টে বদলি করা হয়। তার ইউনিট নভোঝেরেলিয়েভস্কায়ায় ভ্রাঙ্গেলের সৈন্যদলের অবশিষ্টাংশকে নির্মূল করার কাজে নিয়োজিত ছিল। ১৯২০ সালের অক্টোবরে ঝুকভকে প্লাটুন কমান্ডার নিযুক্ত করা হয় এবং কিছুদিনের মধ্যেই তাকে স্কোয়াড্রন কমান্ডার নিযুক্ত করা হয়। একইসময়ে তার সঙ্গে আলেক্সান্দ্রা দিয়েভনা নাম্নী এক গ্রাম্য স্কুলশিক্ষিকার পরিচয় হয় এবং তারা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। সেসময় ঝুকভের বয়স ২৪ বছর।
২৪ বছর বয়সের মধ্যে ঝুকভ একজন উঠতি পশম ব্যবসায়ী থেকে একজন সুদক্ষ সৈনিকে পরিণত হন এবং রাশিয়ার ভাগ্যনির্ধারণী দুইটি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। পাঁচ বছরের ব্যবধানে সাহসী, সুশৃঙ্খল ও রণনিপুণ ঝুকভ রুশ সেনাবাহিনীর একজন এনসিও থেকে লাল ফৌজের একজন স্কোয়াড্রন কমান্ডারে পরিণত হন। এর মধ্য দিয়ে তার উত্থান শুরু হয়, যেটি তাকে যথাসময়ে পৌঁছে দেয় সামরিক কৃতিত্বের চরম শিখরে।
(এরপর দেখুন ২য় পর্বে)