গতির কারণে যদি আমার মৃত্যু হয়, কেঁদো না। কারণ আমি হাসিমুখেই মরব।
কারো সবচেয়ে শখের বিষয়ই যখন হয়ে দাড়ায় তার অকালমৃত্যুর কারণ, তখন সেটাকে ট্রাজেডি ছাড়া আর অন্য কিছু দিয়ে সংজ্ঞায়িত করা যায় না। সেরকমই এক গল্প নিয়ে হাজির হয়েছি আজ আপনাদের সামনে, যে গল্পের নায়ক পল ওয়াকার।
সিনেমাপ্রেমী সবার কাছেই বেশ পরিচিত একটি নাম পল ওয়াকার। হলিউডে টিকে থাকার জন্য যে ব্যাপারগুলো একজন অভিনেতার মধ্যে থাকতে হয়, যেমন- সোনালি চুল, নীল চোখ, আকর্ষণীয় চেহারা আর অভিনয় দক্ষতা; এর সবই ছিল তার। একজন সুদর্শন অভিনেতা হিসেবে চাইলেই তিনি চেহারার মাধুর্য দিয়েই হলিউডের উজ্জ্বল তারকা হয়ে থাকতে পারতেন দীর্ঘ সময়ের জন্য। তবে গতানুগতিক এই ধারা মেনে নেওয়ার বান্দা ছিলেন না পল। অন্যান্য গ্ল্যামার বয়দের মতো সারাক্ষণ পার্টি আর নাইটক্লাব নিয়েও পড়ে থাকতেন না তিনি। তার মনোভাব ছিল উল্টো,
“লোকে বলে পার্টি বা নাইটক্লাবে যাওয়াটা খুব খারাপ কিছু না। আমি তাদেরকে বলি, ‘রিভার ফিনিক্সকে দেখুন, একবার এসবে আটকে গেলেন তো হেরে গেলেন’, হলিউড আবর্জনা ছাড়া আর কিচ্ছু না।”
তিনি মেতে থাকতেন অভিনয়, কার রেসিং আর তারই তৈরি করা ‘রিচ আউট ওয়ার্ল্ডওয়াইড’ সংস্থা নিয়ে।
মার্কিন এই অভিনেতা জন্মগ্রহণ করেন ১৯৭৩ সালের ১২ সেপ্টেম্বর, ফ্যাশন মডেল এবং অভিনেত্রী শেরিল ওয়াকারের গর্ভে। মায়ের জনপ্রিয়তার কারণে মাত্র দু’বছর বয়সেই বিজ্ঞাপনের মডেল হয়ে তিনি পা রাখেন শো-বিজনেসের জগতে। সত্তরের দশকের মাঝামাঝি সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের চ্যানেলে প্রচার হওয়া প্যাম্পার ব্র্যান্ডের ডায়াপারের বিজ্ঞাপনে শিশুটি ছিলেন পল ওয়াকার। পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে তিনি ছিলেন সবার বড়। শৈশব থেকেই পল মায়ের মতো সুদর্শন আর আত্মবিশ্বাসী ছিলেন, যার ফলে, মাত্র ১৩ বছর বয়সেই সিনেমায় অভিনয় করার সুযোগ পেয়ে যান। ১৯৮৫ সালে মুক্তি পাওয়া ‘মনস্টার ইন ইউর ক্লোজেট’ সিনেমার মধ্য দিয়ে সেলুলয়েড জগতে তার বিচরণ শুরু হয়। এরপর বেশ কিছু ধারাবাহিক নাটকে তিনি হাজির হন অতিথি শিল্পী হিসেবে।
খুব অল্প বয়সে শো-বিজনেসে পদচারণা শুরু করলেও জনপ্রিয়তা পেতে খানিকটা সময় লেগেছিল তার। বেশ কিছু ধারাবাহিক নাটকে তিনি হাজির হন অতিথি শিল্পী হিসেবে। সেখানে অভিনয় করার পাশাপাশি কিছু সিনেমায় পার্শ্ব চরিত্রে কাজ করার পর ১৯৯৯ সালে মুক্তি পাওয়া ‘ভার্সিটি ব্লু’ ও ‘শি ইজ অল দ্যাট’ সিনেমাগুলোর মাধ্যমে দর্শকদের নজরে আসেন পল। তবে সেটা ছিল মাত্র শুরু। ২০০১ সালে নির্মিত ‘দ্য ফাস্ট এন্ড ফিউরিয়াস’ সিনেমায় অভিনয় করে নিজের জনপ্রিয়তার পাল্লা ভারী করেন পল। বিশেষ করে তরুণ দর্শকদের মাঝে তিনি হয়ে উঠেন দারুণ জনপ্রিয়।। ‘ফাস্ট এন্ড ফিউরিয়াস’ সিরিজের প্রথম এই সিনেমাটি বক্স অফিসে আয় করে নিয়েছিল প্রায় ২০০ মিলিয়ন ডলারের মতো। সেই সুবাদে সিরিজের নতুন সিনেমা হাজির হয় দু’বছর পর, এবারে সিনেমার মূল নায়ক পল ওয়াকার। পলের দুর্দান্ত পারফর্মেন্সের ফলে আগের পর্বের তারকা অভিনেতা ভিন ডিজেল ছাড়াই সিনেমাটি বক্স অফিসে ঝড় তুলতে সক্ষম হয়।
সেভাবে সমালোচকদের প্রশংসা না পেলেও ৭৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বাজেটে নির্মিত সেই সিনেমাটি আয় করে প্রায় ২৪০ মিলিয়ন ডলার। তারপর থেকে পল অ্যাকশনধর্মী সিনেমায় অভিনয় করা শুরু করেন। তবে নিয়মিত বাণিজ্যিকধর্মী সিনেমায় কাজ করলেও ২০০৬ সালে ক্লিন্ট ইস্টউড পরিচালিত ‘ফ্ল্যাগস অব আওয়ার ফাদার’ এর মাধ্যমে অভিনেতা হিসেবে নিজের দক্ষতার পরিসর দেখিয়ে দেন তিনি। তবে তার ‘রোল অফ লাইফটাইম’ ছিল সেই ব্রায়ান ও’কনর। ২০০৬ সালে পল ওয়াকার এবং ভিন ডিজেলদের কাউকে মূল চরিত্রে না রেখে তৃতীয় সিনেমা মুক্তির পর, ২০০৯ সালে সিরিজের চতুর্থ সিনেমা ‘দ্য ফাস্ট এন্ড ফিউরিয়াস’ এর মাধ্যমে এই মানিকজোড়কে আবার ফিরিয়ে নিয়ে আসে স্টুডিও। কারণ সবকিছুর পরেও ওয়াকার আর ভিন ডিজেলের মধ্যকার কেমিস্ট্রি ছিল এই সিরিজের প্রাণ। তাই সেই জুটির সাথে সিরিজের আগের সিনেমার কিছু চরিত্র মিলিয়ে নতুন করে ফিরে আসে ‘দ্য ফাস্ট এন্ড ফিউরিয়াস’।
নতুন উদ্যমে শুরু হয় ব্রায়ান আর টরেটোর পথচলা। ২০১১ সালে সিরিজের পঞ্চম সিনেমা ‘ফাস্ট ফাইভ’ এ তাদের সাথে যোগ দেন ‘দ্য রক’খ্যাত ডোয়াইন জনসন। সেই সিনেমাটি সাধারণ দর্শকদের পাশাপাশি সমালোচকদের কাছেও প্রশংসা পায় এবং আয় করে নেয় প্রায় ৬২৭ মিলিয়ন ডলার। এরপর থেকে ভালোই চলছিল সবকিছু। ২০১৩ সালে আসে সিরিজের ষষ্ঠ সিনেমা ‘ফিউরিয়াস সিক্স’, ফাস্ট ফাইভের মতো সমালোচকদের সুনজরে না আসলেও এটি ঝড় তুলে বক্স অফিসে। শুরু হয়ে যায় সপ্তম সিনেমার কাজ। কিন্তু ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস! সেই সিনেমার শুটিং শেষ হওয়ার কিছুদিন আগে এক সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান পল ওয়াকার।
দিনটি ছিল ২০১৩ সালের ৩০ নভেম্বর। দুর্দশাগ্রস্ত মানুষের জন্য তার নিজেরই তৈরি ‘রিচ আউট ওয়ার্ল্ডওয়াইড’ সংস্থার আয়োজিত চ্যারিটি প্রোগ্রাম থেকে ফেরার পথে মারাত্মক দুর্ঘটনার কবলে পড়েন পল আর তার বন্ধু ও অর্থ উপদেষ্টা রজার রোডাস। তবে সেদিন তার পোরশের প্যাসেঞ্জার সিটে ছিল পল। প্রায় একশো মাইল গতিতে চলতে থাকা সেই গাড়িটির চালক হঠাৎ করে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেললে, সেটি দক্ষিণ-পূর্ব দিকে চলতে শুরু করে এবং গাড়ির প্যাসেঞ্জার সাইড রাস্তার পাশের আইল্যান্ডের গাছের সাথে প্রচণ্ড জোরে ধাক্কা মারলে বিকট বিস্ফোরণের পর গাড়িটিতে আগুন ধরে যায়। সেই আগুনেই অকালে প্রাণ হারান পল আর তার বন্ধু। বিস্ফোরণের কারণে তাদের শরীর এতটাই ক্ষত-বিক্ষত ছিল যে, তাদেরকে আলাদাভাবে শনাক্ত করতে কষ্ট হয়েছিল। পুলিশের তদন্ত থেকে জানা যায়, গাড়িতে কোনো যান্ত্রিক ত্রুটি ছিল না। তাছাড়া অ্যালকোহল জাতীয় পানীয় কিংবা ড্রাগের চিহ্নও পাওয়া যায়নি তাদের মৃতদেহে।
সিনেমা ছাড়াও বাস্তব জীবনে গাড়ির রেসিংয়ের প্রতি ব্যাপক আগ্রহ ছিল পল ওয়াকারের। বেশ দক্ষভাবে গাড়ি চালাতে পারতেন বলে শুটিংয়ের সময় নিজের স্টান্টগুলো প্রায়ই নিজে নিতেন তিনি। তাছাড়া বিভিন্ন চ্যারিটি ফান্ডের জন্য আয়োজিত কার রেসিং ইভেন্টেও যোগ দিতেন মাঝে মধ্যে। আর তার এই শখের ব্যাপারটিই হয়ে দাঁড়াল তার অকালমৃত্যুর কারণ। পরিবার-পরিজন এবং বিশ্বজুড়ে অগণিত ভক্তদের চোখের জলে ভাসিয়ে তিনি চলে গেলেন না ফেরার দেশে। তার মৃত্যুর পর সিরিজের সপ্তম সিনেমার পরিচালককে ব্যবহার করতে হয়েছিল মোট চারজন বডি ডাবল, এর মধ্যে দুজন ছিলেন পলের আপন দুই ভাই কডি এবং ক্যালেব ওয়াকার। তার মৃত্যুর চার মাস পর মুক্তি পায় সিনেমাটি। এছাড়াও মুক্তি পায় তার অভিনীত আরও দুটি সিনেমা ‘আওয়ারস’ এবং ‘ব্রিক ম্যানশন’।
পল ওয়াকার সম্পর্কে জানা-অজানা কিছু তথ্য
- তার বাবার নাম ছিল তৃতীয় পল উইলিয়াম ওয়াকার। একজন নিকাশী ঠিকাদার এবং দুই বার করে গোল্ডেন গ্লাভস জেতা প্রাক্তন মুষ্টিযোদ্ধা ছিলেন তিনি।
- তার পরদাদা উইলিয়াম বিলি ওয়াকার ছিলেন একজন আইরিশ মুষ্টিযোদ্ধা। তার পূর্বপুরুষরা মূলত ব্রিটিশ ছিলেন, সাথে কিছুটা জার্মান, সুইস এবং আইরিশ।
- তার শৈশব কেটেছে লস এঞ্জেলেসের সান ফার্নান্ডো ভ্যালিতে এবং সেখানকার গ্রামীণ খ্রিস্টান স্কুলে তিনি পড়াশোনা করেন।
- উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষার পর তিনি দক্ষিণ ক্যালিফোর্নিয়ার বিভিন্ন কমিউনিটি কলেজে পড়াশোনা করেন, তার মেজর ছিল মেরিন বায়োলজি। পরে ‘ইন টু দ্য ব্লু’ সিনেমার পর মেরিন বায়োলজির প্রতি টান আবার মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে তার এবং ২০০৬ সালে তিনি ফ্লোরিডার ‘বিলফিশ ফাউন্ডেশন’ এর পরিচালনা পরিষদে যোগদান করেন।
- তিনি ‘স্টার ওয়ার্স’ সিরিজের প্রিক্যুয়েলের অ্যানাকিন স্কাইওয়াকার চরিত্রের জন্য অডিশন দিয়েছিলেন, কিন্তু চরিত্রের সাথে তার বয়সের পার্থক্যের জন্য তাকে নেওয়া হয়নি। এই চরিত্রে অভিনয় করবেন, সেটা সবময়ই চাইতেন তিনি।
- ‘ডনি ব্রাস্কো’ সিনেমা দেখে আন্ডারকভার পুলিশের চরিত্রে অভিনয় করার প্রবল ইচ্ছে হয় তার। সেই কারণেই মূলত ‘দ্য ফাস্ট এন্ড ফিউরিয়াস’ সিনেমায় অভিনয় করতে রাজি হন তিনি।
- ২০০৩ সালে ‘সোয়াট’ সিনেমার মূল চরিত্রটি তাকে অফার করা হলে, তিনি সেই অফার ফিরিয়ে দেন। পরে সেই চরিত্রে অভিনয় করেন কলিন ফেরেল।
- পল স্ট্রিট রেসিং পছন্দ করতেন এবং ‘ফাস্ট এন্ড ফিউরিয়াস’ সিরিজে ব্যবহার করা গাড়িগুলো তিনি নিজে নির্বাচন করেছিলেন।
- সিরিজের দ্বিতীয় সিনেমায় তার ব্যবহৃত নিশান স্কাইলাইন আর৩৪ গাড়িটি ছিল তার নিজের।
- ২০০৫ সালে মুক্তি পাওয়া ‘ফ্যান্টাস্টিক ফোর’ সিনেমার জনি স্ট্রোম চরিত্রের জন্যে প্রথমে তাকে ঠিক করা হলেও, পরে সেটি চলে যায় অভিনেতা ক্রিস ইভানসের কাছে।
- ২০১৫ সালে নির্মিত ‘হিটম্যান: এজেন্ট ৪৭’ সিনেমাতে পল ওয়াকারের অভিনয় করার কথা ছিল, কিন্তু সিনেমার শুটিং শুরুর আগেই তিনি মারা যাওয়ার কারণে তার জায়গায় অভিনয় করেন রূপার্ট ফ্রেন্ড।
- মারা যাওয়ার মাত্র সাতদিন আগে ২০১৩ সালের থ্যাংকসগিভিং এর সময় ভিন ডিজেলের সাথে শেষ সাক্ষাৎ হয় পলের। সেদিন পলের বাড়ি থেকে ফেরার সময় ভিন ডিজেল তাকে জড়িয়ে ধরে বলেছিলেন “আমি যদি আজকে মারা যাই, তুমি সবাইকে জানিয়ে দিও আমি তোমার কেমন ভাই ছিলাম।” পল ওয়াকারের মৃত্যুর দুই বছর পর তার প্রতি সম্মান দেখিয়ে ভিন ডিজেল নিজের নবজাত কন্যার নাম রাখেন ‘পলিন’।
- প্রাক্তন প্রেমিকা রেবেকা সতেরসের সাথে তার একজন কন্যা সন্তান রয়েছে, তার নাম মেডো এবং তার গডফাদার ভিন ডিজেল। বর্তমানে পলের মা মেডোর দেখাশোনা করেন।
- মারা যাওয়ার আগে পলের সম্পর্ক ছিল জেসমিন পিলচার্ড গসনেলের সাথে। তাদের সম্পর্কে যখন সূচনা হয়, তখন জেসমিনের বয়স ছিল মাত্র ষোল বছর এবং তিনি যখন মারা যান তখন তার বয়স ছিল তেইশ।
বি: দ্র: সিনেমা কীভাবে নির্মাণ করা হয় সে সম্বন্ধে খুটিনাটি জানতে চাইলে দেখতে পারেন এই বইটি (কেমন করে সিনেমা তৈরি হয়)।