মধ্যযুগে মুসলিম মনীষীদের জ্ঞান বিজ্ঞান চর্চার যুগে যত পণ্ডিত জন্মেছেন তাদের অধিকাংশের সম্বন্ধেই খুব কম তথ্য আমরা পাই। তবে তাদের মধ্যে একজন ব্যাতিক্রম রয়েছেন, যার জীবনী বিশদভাবে ইতিহাসে জায়গা পেয়েছে। তিনি চৌদ্দ শতকের একজন মুসলিম ইতিহাসবেত্তা, সমাজবিজ্ঞানী, অর্থনীতিবিদ এবং সর্বোপরি একজন দার্শনিক। তাকে আধুনিক ইতিহাস রচনা, সমাজবিজ্ঞান এবং অর্থনীতির অন্যতম একজন জনক বলা হয়। ‘মুকাদ্দিমাহ’ নামের যে অমর বইটি তিনি রচনা করছিলেন সে মধ্যযুগে বসে, তা আজও সমান প্রাসঙ্গিক এবং গুরুত্বপূর্ণ। এই মহান জ্ঞানী পণ্ডিত ও দার্শনিকের নাম আবু জায়েদ আবদুর রহমান বিন মুহাম্মদ বিন খালদুন আল হাদরামি। তাকে আমরা সংক্ষেপে ইবনে খালদুন বলেই চিনি।
১৩৩২ সালের ২৭ মে, আরবী ৭৩২ হিজরির প্রথম রমজান, ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যপূর্ণ পবিত্র এক দিনে তিউনিসের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন ইবনে খালদুন। সে সমাজের প্রচলিত রীতি অনুযায়ী পবিত্র কুরআন শিক্ষা দিয়েই তার শৈশবকালীন শিক্ষা শুরু হয় তার ঘরেই। তার বাবা ছিলেন একজন ইসলাম ধর্ম বিষয়ক পণ্ডিত, যিনি ছেলেকে কুরআন, হাদিস, আইন, বক্তৃতা, ব্যাকরণ, দর্শন আর সাহিত্য শিক্ষা দেন। দ্রুতই তিনি কুরআনের হাফেজ হয়ে ওঠেন। অন্যদিকে ইসলামিক ক্লাসিক জ্ঞানচর্চাও চলছিল পুরোদমে। ১৯ বছরের মধ্যেই তিনি ইসলামি শরীয়াহ, হাদিস আর ফিকহ শাস্ত্রে পারদর্শী হয়ে ওঠেন। অন্যদিকে প্রখ্যাত দার্শনিক ও গণিতবিদ আল আবিলির পরিচর্যায় গণিত, দর্শন আর যুক্তিশাস্ত্রেও পারদর্শী হয়ে ওঠেন ইবনে খালদুন। তবে খালদুনের জীবনে পরিবর্তন আসে অপ্রত্যাশিতভাবে। ১৩৪৯ সালের শুরুতেই পুরো তিউনিস জুড়ে মহামারী আকারে ছড়িয়ে পরে প্লেগ। আর তখনই প্রথমবারের মতো রাজনৈতিক অঙ্গনে পা রাখেন ইবনে খালদুন।
তখনো পর্যন্ত ইবনে খালদুনের রাজনৈতিক জ্ঞান ছিল সীমাবদ্ধ। সরকার এবং রাষ্ট্র কীভাবে পরিচালিত হয়, সে সম্পর্কে তার খুব একটা ধারণা ছিল না। প্রথমবারের মতো তিনি এই সুযোগ পান, যখন তিউনিসের তৎকালীন শাসক ইবনে তাফ্রাকিন সুলতান আবু ইশাককে বন্দী করেন। খালদুনকে বন্দী সুলতানের সীলমোহর বাহক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। পরের বছর অর্থাৎ ১৩৫২ সালে কনস্টান্টিনের আমির আবু জিয়াদ তিউনিস আক্রমণ করেন। তিউনিস পরাজিত হয় এবং তাফ্রাকিন বন্দী হন। ইবনে খালদুন তখন আবাতে পালিয়ে যান। মাঝে কিছু সময় আলজেরিয়াতে উদ্দেশ্যহীন যাযাবর জীবন কাটানোর পর বিসক্রাতে স্থায়ী হন। এ সময় মরক্কোর নতুন সুলতান আবু ইনাম আলজেরিয়া অভিযানে যান। এই খবর পেয়ে ইবনে খালদুন লেমসেন ভ্রমণে যান, যেখানে সুলতান অবস্থান করছিলেন এবং সুলতানের সাথে দেখা করেন। সুলতান খালদুনকে নিজের গৃহধাক্ষ্যের সাথে আলজেরিয়ার বুগিতে প্রেরণ করেন সেখানকার শাসককে নতি স্বীকার করাতে।
সুলতান আবু ইনাম মরক্কোর তৎকালীন রাজধানী ফেজে ফিরে গিয়ে ইবনে খালদুনকে তার রাজদরবারের ‘উলামা’ সভায় যোগ দেওয়ার প্রস্তাব করেন। খালদুন এতে রাজি হয়ে ফেজে চলে আসেন। কিন্তু এখানে এসে তিনি সেই আগের সীলমোহর বাহকের কাজ পান, যাতে তিনি সন্তষ্ট হতে পারেননি। তবু চাকরি তিনি ছেড়ে দেননি। বরং চাকরিতে মনোযোগ না দিয়ে নতুন করে জ্ঞান চর্চায় মনোনিবেশ করেন। এ সময় মরক্কোতে সমগ্র আফ্রিকা, আন্দালুসিয়া এবং ইউরোপের পণ্ডিতদের আনাগোনা ছিল। খালদুন তাদের সান্নিধ্যে আসার সুযোগ পান। কিন্তু চাকরি করতে গিয়ে তার পরিচয় হয়ে যায় তারই বংশের একজন দূর সম্পর্কের আত্মীয় আবু আবদুল্লাহর সাথে, যিনি জেলে বন্দী ছিলেন। আর এখানেই একটি ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে বসেন খালদুন। তিনি আবদুল্লাহর সাথে মিলে সুলতান আবু ইনানকে ক্ষমতাচ্যুত করার ফন্দী আঁটেন। তবে শীঘ্রই ধরা পড়েন এবং বন্দী হন। তবে তার সৌভাগ্যই বটে, দয়ালু সুলতান তাকে মাত্র দুই বছরের কারাদণ্ড সাজা দিয়েছিলেন। আরো অবাক করা ব্যাপার হচ্ছে এই যে, জেল থেকে ছাড়া পাবার পর ইবনে খালদুন রাজদরবারে তার পূর্বতন চাকরি ফিরে পান! অবশ্য তিনি ছাড়া পাবার কিছুদিন আগেই সুলতান আবু ইনান মারা গিয়েছিলেন।
আবু ইনানের পর মরক্কোর সুলতান হয়েছিলেন আবু ওয়াজির, যিনি খালদুনকে মুক্তির পর চাকরিতে পুনর্বহাল করেছিলেন। কিন্তু রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের হাওয়া বইতে থাকা মরক্কোতে খালদুন আরো একবার নিজের ভাগ্যকে পরীক্ষা করেন। তিনি সুলতান আবু সলিম এর সাথে মিলে আবু ওয়াজিরের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হলেন। সুলতান আবু সলিম তাকে ‘আমিন আল সির’ বা গোপনীয়তার রক্ষক খেতাব দিলেন। কিন্তু এই পরিকল্পনা ভেস্তে যায় কিছুদিনের মধ্যেই যখন আবু সলিমের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ সংঘটিত হয় এবং সলিম ক্ষমতাচ্যুত হন। এই বিদ্রোহের পেছনে কলকাঠি আবার আবু ওয়াজির নেড়েছিলেন। এদিকে ষড়যন্ত্রের কথা আর কারো নিকট প্রকাশ পেলো না। ওয়াজির খালদুনকে পদোন্নতি দিয়ে আরো উচ্চ পদে বসালেও খালদুন গৃহাধ্যক্ষের পদের জন্য আবেদন জানান। সম্ভবত ওয়াজিরের সন্দেহের তীর খালদুনের দিকে ছিল বলে তিনি সে আবেদন নাকচ করে দেন। এতে ইবনে খালদুন মনঃক্ষুণ্ণ হয়ে পদত্যাগ করেন এবং ফেজ ত্যাগ করে আন্দালুসিয়ান যাবার অনুমতি প্রার্থনা করেন।
এদিকে গ্রানাডার শাসক সুলতান মুহাম্মদ বিন আহমার তার ছোট ভাইয়ের বিদ্রোহে ক্ষমতাচ্যুত হন। তিনি মুকুট পুনর্দখলের অভিপ্রায়ে ক্যাস্টিলের রাজা পেদ্রোর সাথে যোগাযোগ করেন। তাতে কাজ না হলে সুলতান মুহাম্মদ ওয়াজির উমারের নিকট সাহায্যের আবেদন করেন। ওয়াজির তাতে সাড়া দিয়ে সুলতান মুহাম্মদের পরিবারকে দেখাশোনার দায়িত্ব দেন ইবনে খালদুনকে। এই সূত্রে সুলতানের সাথে খালদুনের সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে। ১৩৬১ সালে সুলতান মুহাম্মদ গ্রানাডায় নিজের সিংহাসন পুনরুদ্ধার করতে সক্ষম হন এবং ইবনে খালদুনকে রাজদূত হবার আমন্ত্রণ জানান। খালদুন সে প্রস্তাবে সাড়া দিলেও অল্প কিছুদিন দায়িত্ব পালন করেই আবু আবদুল্লাহর বুগি দখলের সংবাদে গ্রানাডা ত্যাগ করেন। তিনি যখন বুগিতে পৌঁছান উচ্চাভিলাষী জীবন যাপনের স্বপ্ন নিয়ে, তখন তার বয়স ছিল ৩২। তার উচ্চাকাঙ্ক্ষা প্রাথমিকভাবে সফল হয়েছিল। তবে বুগিতে নতুন করে বিদ্রোহে সুলতানকে হত্যা করা হলে তিনি বুগি ছেড়ে বিসক্রা চলে যান। এরপর বেশ কয়েক বছর এখানে সেখানে বাসস্থান পরিবর্তন এবং সুবিধামতো রাজনৈতিক শক্তির সমর্থন করে যাচ্ছিলেন ইবনে খালদুন। অবশেষে ১৩৭৭ খ্রিস্টাব্দে কনস্টান্টিনের একেবারে দক্ষিণে, সালামা নামক এক নির্জন অঞ্চলে গিয়ে কিছুটা স্থির হন খালদুন।
সালামায় বসবাসকালে খালদুন ইতিহাস রচনায় মনোনিবেশ করেন। কিন্তু এর জন্য তার যে প্রয়োজনীয় রেফারেন্স প্রয়োজন ছিল, তা সেখানে সহজলভ্য ছিল না। তাই কৈশোরে জন্মস্থান ত্যাগ করার ২৫ বছর পর আবার তিউনিসে পা রাখেন ইবনে খালদুন। সেখান থেকে প্রয়োজনীয় তথ্য ও বই সংগ্রহ করে পুনরায় সালামা ফিরে আসেন খালদুন। এ সময় তিনি মুকাদ্দিমার লেখা চালানোর পাশাপাশি আরো বেশ কিছু বিখ্যাত বই লেখেন। তার জ্ঞানচর্চার কথা ছড়িয়ে পড়ে পুরো আরব জুড়ে। তাকে আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তৃতা দেওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়। সেখানে বক্তৃতা দিতে গিয়ে তিনি কায়রোর সুলতান আল জাহির বারকাকের সাথে সাক্ষাৎ করেন, যিনি খালদুনকে কামিলিয়া বিদ্যালয়ে শিক্ষকতায় নিয়োগ করেন। কিন্তু এ সময় তার জীবনের সবচেয়ে দুঃসহ দুর্ঘটনাটি ঘটে। আরব সাগরে একটি জাহাজ ডুবে যায়, যে জাহাজে ভ্রমণরত ছিল ইবনে খালদুনের পুরো পরিবার।
শোকে মুহ্যমান ইবনে খালদুন শোক কাটিয়ে উঠতে হজ্ব পালনের জন্য মক্কার উদ্দেশে যাত্রা করেন। হজ্ব থেকে ফিরে কায়রোর একটি সুফি খানাকায় যোগ দেন খালদুন। এ সময় তিনি পুরোদমে শিক্ষকতা এবং এবং জ্ঞানচর্চা অব্যহত রাখেন। তার রাষ্ট্রের উত্থান ও পতন বিষয়ক অমর আসাবিয়াহ তত্ত্ব এ সময়ের লেখা। তবে মিশরের সুলতান ফারাজের সাথে উজবেক সুলতান তৈমুর লংয়ের দ্বন্দ্বের জের ধরে খালদুনকে রাজ প্রতিনিধি করে উজবেকিস্তান প্রেরণ করেন সুলতান। ইবনে খালদুনের কূটনৈতিক দক্ষতায় এই সফর সফল হয় এবং খালদুন তৈমুর লংকে প্রভাবিত করতে সক্ষম হন। তিনি তৈমুর লংয়ের সাথে ছয়টি দ্বিপাক্ষিক চুক্তি সাক্ষর করেন, যেগুলো কায়রো এবং দামেস্ক, উভয় অঞ্চলের মানুষের জন্য উপকারী ছিল। এই কূটনৈতিক মিশন থেকে ফিরে ভ্রমণ সংক্রান্ত সকল কাজ থেকে অব্যাহতি নেন ইবনে খালদুন। কায়রোতেই রাজদরবারের দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি নিভৃতে জ্ঞানচর্চা চালিয়ে যান তিনি। ১৪০৬ সালের ১৭ মার্চ কায়রোতে মৃত্যুবরণ করেন এই মহান দার্শনিক। দিনটি ছিল রমযান মাসের ২৬ তারিখ। কায়রোর আবু নাসর নামক একটি সূফী কবরাস্থানে তাকে দাফন করা হয়।
ইবনে খালদুনের আত্মজীবনী অনুযায়ী তার কাজকে দুটি ভাগে ভাগ করায় যায়। ঐতিহাসিক দর্শন এবং ইসলামিক দর্শন। ধর্মীয় গ্রন্থের মধ্যে তার ফিকহ শাস্ত্রের উপর লেখা ‘লুবাব আল মাহসুল’ সম্পূর্ণ অক্ষত পাওয়া যায়। তবে তৈমুর লংকে নিয়ে লেখা ঐতিহাসিক গ্রন্থটি হারিয়ে গেছে কালের গর্ভে। তার শ্রেষ্ঠ গ্রন্থ হচ্ছে ‘আল-মুকাদ্দিমা’, যা তিনটি খণ্ডে বিভক্ত। প্রথম খণ্ডটি পরিচিতি পর্ব, দ্বিতীয় খণ্ডে রয়েছে সার্বজনীন ইতিহাস আর তৃতীয় খণ্ডটি ‘মাগরিব এর ইতিহাস’। শেষ খণ্ডটি মূলত তার আমৃত্যু ভ্রমণের অভিজ্ঞতার উপর ভিত্তি করে লেখা। অন্যদিকে বইয়ের শেষে একটি বাড়তি অংশ, ‘লেখকের আত্মজীবনী’কে অনেকে এই বইয়ের অংশ বলে মনে করেন না।
বইয়ের ভূমিকা খণ্ডে রয়েছে মোট ছয়টি অংশ। যথা-
- মানব সমাজ- জাতিতত্ত্ব এবং নৃতত্ত্ব
- গ্রামীণ সভ্যতা
- সরকার ও রাষ্ট্রের ধরণ
- শহুরে সভ্যতা
- অর্থনীতি
- বিজ্ঞান এবং মানবতা
এই ছয়টি অংশের অধিকাংশ তথ্যই অত্যন্ত চমৎকার যুক্তি তর্কের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত করেছেন খালদুন। তথাপি তার বৈচিত্র্যময় রাজনৈতিক জীবনের অভিজ্ঞতার আলোকে রাষ্ট্র, সমাজ ব্যবস্থা ও সরকারের প্রতিরূপ তিনি অত্যন্ত বাস্তবসম্মত উপায়ে বিশ্লেষণ করেছেন। সভ্যতার বিকাশ সম্পর্কে তার আলোচনা খুবই সময়োপযোগী। অর্থনীতি সম্পর্কে খালদুনের স্বচ্ছ ধারণা ছিল। তিনি বাজারদরের উপর যোগান এবং চাহিদার বিপরীতমুখী প্রভাব সম্পর্কে বিস্তর আলোচনা করেন। অন্যদিকে অর্থের প্রবাহ, এক দেশ থেকে অন্যদেশে মুদ্রার বিনিময় ইত্যাদি বিষয় কীভাবে বাজার অস্থিতিশীল করতে পারে সে ব্যাপারেও আলোচনা করেন তিনি।
ইবনে খালদুনকে আধুনিক সামাজিক বিজ্ঞানের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা বলা হয়ে থাকে। কেননা তিনিই প্রথম ব্যক্তি যিনি সামাজিক বিজ্ঞানের একেবারে নতুন একটি ধারা, ‘সাংস্কৃতিক বিজ্ঞান’ এর সূচনা করেন। অন্যদিকে মানব সমাজের উন্নয়নের জন্য সামাজিক বিজ্ঞানের প্রয়োজনীয়তা এবং এর সীমা নির্ধারণে রয়েছে তার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। আবার ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে তিনি অভূতপূর্ব দৃঢ়তা দেখিয়েছিলেন। মধ্যযুগীয় ইতিহাস লেখকদের মধ্যে হাতে গোনা কয়েকজনই কেবল ইতিহাস লেখাকে নির্ভুল করার জন্য এর উৎসের উপর জোর দিয়েছিলেন। ইবনে খালদুন তাদের মধ্যে একেবারে উপরের দিকেই থাকবেন। ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে উৎস ও রেফারেন্স সন্তোষজনক না হলে তিনি সেগুলো উপেক্ষা করে যেতেন।
মানব সমাজের প্রয়োজনীয়তাকে খাদ্য এবং নিরাপত্তা, এই দুটি বিষয় দিয়ে ব্যাখ্যা করেন ইবনে খালদুন। তার মতে, সমাজ গঠন করে সেখানে কেউ ব্যক্তিগতভাবে জীবনধারণ করতে পারে না। সমাজের উন্নয়নের জন্য শ্রমবণ্টনের অপরিহার্যতাও উল্লেখ করেন ইবনে খালদুন। আবার তার মতে, রাষ্ট্রের উদ্ভব হয় মানুষের স্বভাবজাত আক্রমণাত্মক প্রকৃতি থেকে সমাজকে নিরাপদ করতে। একদিকে যেমন সমাজ ছাড়া রাষ্ট্র কল্পনা করা যায় না, অন্যদিকে রাষ্ট্রহীন সমাজের অস্তিত্ব টিকতে পারে না। এসব বিষয় আলোচনা করতে গিয়ে খালদুন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের অবতারণা করেন। সেটি হচ্ছে রাজনৈতিক ও সমাজ কেন্দ্রিক ইতিহাস লিখতে গিয়ে ঐতিহাসিকগণের বস্তুনিষ্ঠতার অভাব। তিনি দেখিয়েছেন, কীভাবে ইতিহাস রচনায় তারা ভুল ব্যাখ্যা করেন, কখনোবা ভুল প্রসঙ্গে ভুল উদাহরণ প্রয়োগ করেন, অতিরঞ্জন করেন, আবার নিজের বিশ্বাস থেকে ইতিহাস রচনা করেন কিংবা তথ্যসূত্রের যাচাই করেন না।
ইবনে খালদুন একটি সমাজকে একটি জৈব অবয়ব আকারে কল্পনা করেছেন, যা প্রতিটি সমাজের ক্ষেত্রেই মোটামুটি একই রকম। ইতিহাস থেকে সংগৃহীত তথ্য, নিজের বাস্তব অভিজ্ঞতা আর ধর্মীয় বিশ্বাস, এই সব কিছু মিলিয়ে তিনি তার এই মতামত দিয়েছেন। তার মতে, সকল সমাজের মৌলিক কাঠামোর মধ্যেই রয়েছে একটি অন্তর্নিহিত মিল, যা মানুষের সহজাত প্রকৃতির মতোই। যে কারণে তার সমাজ কাঠামোর আলোচনা প্রতিফলিত হয়েছে আফ্রিকার যাযাবর কিংবা আরবের বেদুইন আর তুরস্কের কুর্দিদের মধ্যেও।
ইবনে খালদুনের মতে, ইতিহাস সর্বদা পরিবর্তনশীল, যা ঘটে দুই শ্রেণীর মানুষের হাত ধরে। এক হলো যারা যাযাবর, আরেক হচ্ছে সমাজবদ্ধ বা দলবদ্ধ জনসমষ্টি। আর এই দুই শ্রেণীর মাঝে রয়েছে কৃষক শ্রেণী। এদের মধ্যে যাযাবররা হচ্ছে স্বভাবে সবচেয়ে উগ্র এবং অসভ্য, যাদের সভ্যতার সাথে সর্বদাই একপ্রকার প্রতিকূল সম্পর্ক রয়েছে। তবে এদের একটি গুণ হচ্ছে নৈতিকভাবে এরা কলুষতামুক্ত এবং অতিমাত্রায় স্বাধীনতাপ্রিয় এবং স্বনির্ভর। অন্যদিকে স্থির দলবদ্ধ জনগোষ্ঠীর হাত ধরে জগতের যাবতীয় পরিবর্তন, উন্নয়ন এবং একই সাথে ধ্বংস সাধন হয়। এরা একদিকে যেমন জ্ঞান বিজ্ঞানে পৃথিবীকে প্রতিনিয়ত অধিক বসবাসযোগ্য করে তোলে, মুদ্রার অপর পিঠে এরাই আবার অর্থের মোহে দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে অন্যায়ে জড়িয়ে পড়ে আর পৃথিবীর ক্ষতি করে। এসব আলোচনা করতে গিয়েই খালদুন তার বিখ্যাত ‘আসাবিয়া’ তত্ত্বের অবতারণা করেন। এই আসাবিয়া মানে হচ্ছে ‘দলগত সংহতি’ কিংবা ‘সামাজিক সংহতি’। তার মতে যাযাবরদের মধ্যে আসাবিয়া কম কাজ করে বলেই তারা যাযাবর। আসাবিয়া তথা সামাজিক সংহতি থেকেই মানুষ দলীয়ভাবে বসবাসের চিন্তা করতে শেখে।
ইবনে খালদুন একটি রাষ্ট্রের উত্থান-পতনের মূল বিষয় হিসেবে আসাবিয়ার কথা উল্লেখ করেন। প্রথমত আসাবিয়া থেকে একটি সমাজ এবং একটি রাষ্ট্র গড়ে ওঠে। শাসকগণ সে সমাজ প্রাথমিকভাবে প্রজাদের তথা সাধারণ জনগণের চাহিদা অনুযায়ী পরিচালনা করে। কিন্তু ধীরে ধীরে তারা ক্ষমতালোভী হয়ে ওঠেন এবং প্রজাদের দমিয়ে রাখতে অধিক সৈন্য নিয়োগ দেন। তারা আমলাতান্ত্রিক জটিলতা বৃদ্ধির মাধ্যমে একপ্রকার জাল তৈরি করেন, যে জালে অধিকাংশ সাধারণ মানুষ আটকে থাকে। সাধারণের চেয়ে তার সামরিক বাহিনীর জন্য অধিক ব্যয় করে এবং এর ফলে বাজারে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পায়। সামরিক খরচ বহন করতে সরকার করের পরিমাণ বৃদ্ধি করে আর এতে করে বিনিয়োগ নিরুৎসাহিত হয়, উৎপাদন ব্যহত হয়। ধীরে ধীরে সরকার একা হয়ে যায় এবং যে জনগণ তাদের ক্ষমতায় এনেছিল তাদের সাথেই সরকারের দূরত্ব সৃষ্টি হয়। এ অবস্থায় শাসক গোষ্ঠী কখনোবা ধর্মকে ব্যবহার করে পুনরায় জনপ্রিয়তা অর্জন করতে পারে কিন্তু তা দীর্ঘস্থায়ী হয় না। একসময় শাসকগোষ্ঠী ক্ষমতাচ্যুত হয় এবং আসাবিয়া ভেঙে নতুনরূপে গড়ে ওঠে। আবার নতুন শাসকগোষ্ঠী ক্ষমতায় আসে এবং আগের চক্রটির পুনরাবৃত্তি হয়। ইবনে খালদুনের এই দর্শন অসাধারণ নয় কি পাঠক? আজ থেকে ৭০০ বছর পূর্বে তিনি যে রাজনৈতিক দর্শন দিয়ে গেছেন তা আজকের সমাজেও প্রবলভাবে বিদ্যমান!
ইবনে খালদুনের বৈজ্ঞানিক দর্শন কিছুটা ইমাম গাজ্জালির মতোই ছিল। তিনি বিজ্ঞানকে দুটি ভাগে বিভক্ত করেন। ধর্মীয় বিজ্ঞান এবং অধর্মীয় বিজ্ঞান। অধর্মীয় বিজ্ঞানকে আবার দু’ভাগে ভাগ করেন। একটি হচ্ছে প্রয়োজনীয় এবং অন্যটি অপ্রয়োজনীয়। মূলত অতিপ্রাকৃত ব্যাপারগুলোর সাথে সম্পর্কিত বিজ্ঞানকেই তিনি অপ্রয়োজনীয় বলেছেন যেমন, জাদু, আলকেমি বা অপরসায়ন এবং জ্যোতির্বিজ্ঞান। তার দর্শনের মূল মতাদর্শ ছিল, ধর্ম আর বিজ্ঞান একসূত্রে গাঁথা। অতীন্দ্রিয়বাদকে তিনি ফিকহশাস্ত্রের আওতায় এনে আলোচনা করেছেন। তার মতে, মানুষের জ্ঞান চর্চা অবশ্যই করতে হবে এই জ্ঞান প্রাত্যহিক জীবনে কাজে লাগাতে হবে। কিন্তু বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা অবশ্যই একটি নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে রাখা উচিৎ। এমন পর্যায়ে যাওয়া উচিৎ নয় যেখানে মানুষের বুদ্ধি যথেষ্ট নয়। তার নিকট সে পর্যায়গুলো হচ্ছে সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্ব, তার একত্ব, মৃত্যু পরবর্তী জীবন, ধর্মীয় ভবিষ্যদ্বাণী ইত্যাদি। মানুষ বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা করবে কিন্তু অবশ্যই এসব বিষয়কে বাদ রেখে।
আজ থেকে প্রায় ৭০০ বছর পূর্বে ইবনে খালদুন এমন দর্শন দিয়ে গেছেন, যা আজও পৃথিবীর পূর্বে-পশ্চিমে সর্বত্র সমানভাবে বিরাজমান। কতটা প্রজ্ঞা প্রয়োজন হয় এরকম চিন্তা করার জন্য? একজন দার্শনিক ইবনে খালদুন তাই চিরন্তন আদর্শ হয়ে থাকবেন, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।