টেবিলের উপর রাখা হালকা ল্যাপটপটি কতগুলো ধাপ পার হয়ে আজকের এই পর্যায়ে এসেছে, তা চট করে কি কল্পনায় আনা যায়? মনে হয় না। কারণ, প্রায় অর্ধশত বছরেরও আগে বিজ্ঞানীরা কম্পিউটার তৈরির কাজে হাত দেন। সেই বিজ্ঞানীরা যেমন আজকের দ্রুতগতি ও উচ্চক্ষমতা সম্পন্ন কম্পিউটার দেখে যেতে পারেননি, তেমনি আমাদেরও প্রয়োজন হয়নি পুরনো সেসব ধীর গতির কম্পিউটার ব্যবহারের। ফলে আমাদের অনেকেরই সুস্পষ্ট কোনো ধারণা নেই যে, কীভাবে ক্রম বিবর্তনের মধ্য দিয়ে কম্পিউটার আজকের অবস্থায় এলো। আর সে ধারণা পেতে বিজ্ঞান জাদুঘর এক দারুণ জায়গা।
শুধু কম্পিউটার নয়, বিজ্ঞানের বহু মৌলিক ব্যাপার সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা পেতে পারেন বিজ্ঞান জাদুঘরের নানা উপকরণ থেকে, গেলেই মনে হবে “ইশ! এই জিনিসটা আগে দেখলে ফিজিক্সের অমুক জিনিসটা বুঝতে ভুল হতো না!”
তরুণ প্রজন্মের মাঝে বিজ্ঞানকে জনপ্রিয় করা ও গবেষণায় উৎসাহিত করার উদ্দেশ্যে ১৯৬৬ সালে বিজ্ঞান জাদুঘর তৈরি করা হয়। শুরুর দিকে অস্থায়ীভাবে বিভিন্ন জায়গায় চালু করা হলেও ১৯৮১ সালে আগারগাঁওয়ে ৫ একর বিশাল জায়গায় নিজস্ব ভবনে নতুন করে চালু হয় ‘জাতীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি জাদুঘর’। জাদুঘরে বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয় প্রদর্শন করা, সারা দেশে সেমিনার আয়োজন ও বিজ্ঞানভিত্তিক প্রকাশনা- এই তিনটি কার্যক্রমের মাধ্যমে তখন থেকে কাজ করে চলেছে বিজ্ঞান জাদুঘর।
জাদুঘরে আছে মোট সাতটি গ্যালারি- ভৌতবিজ্ঞান, শিল্প-প্রযুক্তি, জীব বিজ্ঞান, তথ্য প্রযুক্তি, বিজ্ঞানের মজার বিষয়গুলো নিয়ে দুটি গ্যালারি এবং মহাকাশ বিজ্ঞান গ্যালারি। এছাড়াও জাদুঘরে প্রাঙ্গনে আছে সায়েন্স পার্ক, ছাদে শুক্র-শনিবার সন্ধ্যায় থাকে টেলিস্কোপে আকাশ পর্যবেক্ষণের আয়োজন ও লাইব্রেরি।
ভৌতবিজ্ঞান গ্যালারিতে দেখতে পাওয়া যাবে পদার্থবিজ্ঞানের সেসব মৌলিক বিষয়, যা আমরা স্কুল জীবনে শিখেছি। যেমন- চৌম্বক বলরেখা, ডপলার ইফেক্টে কীভাবে শব্দ তরঙ্গ জোরে থেকে ধীরে ধীরে আস্তে হয়, সিনেমাস্কোপ কীভাবে কাজ করে, নিউটনের বর্ণচক্র অর্থাৎ ‘বেনীআসহকলা’ এই সাতটি রং লাগানো চাকতি ঘোরালে কেন সেটি সাদা দেখায় ইত্যাদি। এগুলো সবই আমরা স্কুলে পড়েছি। কিন্তু পার্থক্য হলো, স্কুলে এগুলো হাতে-কলমে দেখানোর ব্যবস্থা ছিল না। তাই স্কুল পড়ুয়া ছোট ভাই-বোন থাকলে, ওরা শুধু দেখেই মজা পাবে না, কিছু শিখবেও।
শিল্প-প্রযুক্তি গ্যালারিতে ঢুকে প্রথমেই দেখতে পাবেন শত বছরের পুরনো বই ছাপানোর মেশিন। এই মেশিনে ধাতব অক্ষর পরপর সাজিয়ে বাক্য তৈরি করে নিয়ে তারপর কাগজে ছাপ দেয়া হতো। সেসময় এভাবেই বই ছাপানো হতো।
বিটিভিতে ব্যবহৃত প্রথম ক্যামেরাও রাখা আছে এই গ্যালারিতে। মজার বিষয় হলো, এই ক্যামেরাটিতে কোনো ‘রেকর্ডিং মেমরি’ ছিল না, অর্থাৎ অনুষ্ঠান আগে রেকর্ড করে নিয়ে পরে সম্প্রচারের সুবিধা ছিল না, অনুষ্ঠান শুধুমাত্র সরাসরি সম্প্রচার করা হতো। তাও আবার ক্যামেরায় হাতে করে হুইল ঘোরাতে হতো! যতক্ষণ ধরে হাতে করে হুইল ঘোরানো হবে, শুধু ততক্ষণই সম্প্রচার চলবে!
এই গ্যালারিতে আরো আছে আশির দশকের ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপ, পাতন যন্ত্র, পুরনো বিমানের পিস্টন ইঞ্জিন, জাহাজে ব্যবহৃত রাডার, কম্পাস, যোগাযোগের রেডিও ইত্যাদি। একটি কপিকল আছে, যেটা দর্শকরা ব্যবহার করে দেখতে পারে। বইয়ে কপিকল দিয়ে কীভাবে ভারী জিনিস তোলা হয়, তার তত্ত্ব হয়তো অনেকেই পড়েছে, কিন্তু এখানে কপিকল সরাসরি ব্যবহার করে সেটা নিজ চোখে দেখা যায়।
এই গ্যালারির আরেকটি আকর্ষণ হলো, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যে বিমানে চলাফেরা করতেন, সেটার ইঞ্জিন এখানে রাখা আছে। তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন বিমানটি উপহার দিয়েছিলো।
জীববিজ্ঞান গ্যালারি অনেকটা স্কুল-কলেজের জীববিজ্ঞানের ল্যাবের মতোই। অনেক মাছ, সরীসৃপ, বড় ডলফিন ইত্যাদি জারে সংরক্ষণ করে প্রদর্শন করা হচ্ছে। এছাড়াও আছে কিছু পাখির সংরক্ষিত দেহ। তবে এই গ্যালারির সবচেয়ে বড় আকর্ষণ হলো একটি বিশালাকৃতির তিমি মাছের কংকাল, যেটা প্রায় পুরো হলঘরটা জুড়েই আছে।
তথ্য-প্রযুক্তি গ্যালারি দেখে খুবই মজা পাবেন সকলে, কেননা একমাত্র এখানেই দেখা পাবেন পঞ্চাশ-ষাটের দশকের দিককার এনালগ কম্পিউটারের। একটি কম্পিউটার সেট পুরো হলঘর দখল করে বসে আছে!
শুরুতে আছে RA-770 মডেলের একটি এনালগ কম্পিউটার, ১৯৭৯ সালে এ দেশে আনা দ্বিতীয় প্রজন্মের কম্পিউটার। বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশন এটি তাদের পারমাণবিক চুল্লী নিয়ন্ত্রণে ব্যবহার করত। এনালগ কম্পিউটারে বাইনারি সংকেতের পরিবর্তে তাপ, চাপ, উত্তাপের জন্য সৃষ্ট বৈদ্যুতিক তরঙ্গকে ইনপুট হিসেবে গ্রহণ করত এটি।
ঠিক এর পরেই আছে বাংলাদেশের প্রথম কম্পিউটার! IBM 1620 system নামে দ্বিতীয় প্রজন্মের এই কম্পিউটারটি ১৯৬৪ সালে ঢাকা এটমিক এনার্জি কমিশনে আনা হয়। তৎকালীন সমগ্র পাকিস্তানের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়, সরকারি ও বেসরকারি উন্নয়ন ও গবেষণা সংস্থা এটি থেকে কম্পিউটেশন সুবিধা পেয়েছে।
এই কম্পিউটারটির অনেক অংশ; যেমন ‘সিপিউ’ যেটি কন্ট্রোল প্যানেল, কনসোল টাইপ রাইটার ও মেমরি নিয়ে গঠিত। প্রোগ্রাম লিখতে হতো একটি আলাদা ‘কার্ড পাঞ্চ মেশিন’ দিয়ে, যেটি দেখতে অনেকটা টাইপ রাইটারের মতো। প্রোগ্রাম লেখা হতো ৮০ কলাম বিশিষ্ট নন ম্যাগনেটিক উপাদানে তৈরি কার্ডে। এই কার্ড আবার আরেকটি বিশাল আকারের ‘কার্ড রিড পাঞ্চ’ এ ঢোকাতে হতো প্রোগ্রাম ইনপুট দিতে। এর সাথে যুক্ত আছে একটা ‘ডিস্ক ষ্টোরেজ ড্রাইভ’। ওয়াশিং মেশিনের মতো আকারের এই ড্রাইভে আছে ৬টি ডিস্ক, যার মেমরি মাত্র ১ মিলিয়ন বিট।
এরপরে আরো কিছু মডেলের কম্পিউটার দেখতে পাবেন; যেমন- Honeywell DPS-6, যেটি প্রযুক্তির ক্রম উন্নতির ফলে অনেকটাই ছোট আকারে বানানো সম্ভব হয়েছে। এরপর রয়েছে কয়েকটি উচ্চগতি প্রিন্টার, স্পুলটাইপ ম্যাগনেটিক টেপ পড়তে ও লিখতে পারে এমন ইউনিট।
আরো কয়েকটি মেইনফ্রেম কম্পিউটার আছে; যেমন- IBM 1401 এবং IBM 370, এর মধ্যে IBM 370 কম্পিউটারটি উল্লেখযোগ্য। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সেন্টারে (বর্তমান IICT) ১৯৭৯ সালে এই কম্পিউটারটি সংযোজন করা হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, শিক্ষক ও গবেষক ছাড়াও বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের তথ্য প্রক্রিয়াকরণের কাজে এই কম্পিউটারটি বহুলভাবে ব্যবহৃত হতো। প্রতিষ্ঠানগুলোর ভেতর রয়েছে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড, বাংলাদেশে সরকারি কর্ম কমিশন, জীবন বীমা কর্পোরেশন, আমেরিকান এক্সপ্রেস ব্যাংক, বাংলাদেশে ক্ষুদ্র কুটির শিল্প সংস্থা ইত্যাদি। কম্পিউটারটি ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত ব্যবহৃত হয়েছে।
মজার বিজ্ঞান গ্যালারিতে মূলত বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব ব্যবহার করে আনন্দদায়ক কিছু উপকরণ তৈরি করা হয়েছে। যেমন- বিভিন্ন ধরনের উত্তল-অবতল আয়না, যেগুলো অদ্ভুত রকমের প্রতিবিম্ব তৈরি করে, সান্দ্রতা ও অভিকর্ষের ফলে তৈরি বিভিন্ন তরলের আল্পনা, ছিন্ন মস্তক-আয়নায় প্রতিবিম্বের মাধ্যমে এমন এক ব্যবস্থা, যেন দেখলে মনে হবে প্লেটে রাখা আছে একটি কাটা মুণ্ডু, বৈদ্যুতিক চুম্বক ব্যবহার করে ভাসমান চাকতি, তিনটি পৃথক রঙের আলোক উৎসের মাধ্যমে তৈরী রঙিন ছায়া ইত্যাদি।
মহাকাশবিজ্ঞান গ্যালারিতে মহাকাশ সংক্রান্ত বিষয়াদি তুলে ধরা হয়েছে, এখানে আছে ফ্লাইট সিমুলেটর গেম, ভিআর সিমুলেটর গেম, প্লাজমা টিউব যেটাতে গ্যাসের মধ্য দিয়ে আলোকচ্ছটা দেখা যায়, স্পেস সিকনেস হলে কেমন অনুভূত হয় তার নমুনা। আরেকটি জিনিস দর্শকের ভালো লাগবে, সেটি হলো ‘টাচ দ্য ফ্রুট’। অবতল দর্পণের ফোকাসে কোনো বস্তু রাখলে তার বিম্ব দর্পণের সামনে পাওয়া যায়। দেখলে মনে হবে সামনে একটি ফল ভাসমান অবস্থায় আছে, কিন্তু স্পর্শ করতে গেলে দেখা যাবে সেটি ধরা যায় না, একটি বিম্ব মাত্র।
বিজ্ঞানের মৌলিক বিষয়গুলো ভালভাবে দেখতে, হাতে সময় নিয়ে ঘুরে আসতে পারেন বিজ্ঞান জাদুঘর। বিশেষ করে শিশুদের জন্যে জাদুঘরটি শিক্ষণীয় তো অবশ্যই, যথেষ্ট আনন্দদায়কও বটে।