রাতের আকাশের উজ্জ্বল নক্ষত্ররাজির দিকে তাকিয়ে আমাদের মনে কখনো না কখনো এই প্রশ্ন অবশ্যই জেগেছে যে কতকাল ধরে তারা এভাবে জ্বলজ্বল চোখে তাকিয়ে আছে আমাদের দিকে? কিভাবেই বা তারা এই আকাশে এলো? এত তারকারাজির মধ্যে হঠাৎ একজন নিভে গেলে সেটাও কি আমাদের দৃষ্টিতে ধরা পড়ে?
এরকম নানা প্রশ্ন আমাদের মনে উঁকি দেয় এসব উজ্জ্বল তারকাদের দেখে। মজার ব্যাপার হলো এরা জড় বস্তু হওয়ার পরেও এদের জন্ম হয়, বার্ধক্য আসে এবং একসময় এরা মৃত্যুবরণও করে। অবাক হওয়ার মতই কথা বটে কিন্তু সত্য। নক্ষত্রের জন্ম-মৃত্যু নিয়েই এই লেখা। চলুন জানা যাক সে সম্বন্ধে।
যেভাবে জন্ম নেয় একটি নক্ষত্র শিশু
মহাকাশে যদিও বিভিন্ন বস্তু বিদ্যমান, কিন্তু এই বস্তুগুলো মহাকাশে ঠিক সমানভাবে বিন্যস্ত নয়। মহাশূন্যের ফাঁকে ফাঁকে অবস্থান করে বিভিন্ন প্রকার গ্যাসীয় (সাধারণত হাইড্রোজেন গ্যাসই বেশি পাওয়া যায়) বা ধূলিমেঘ অঞ্চল। এসব গ্যাসীয় বা ধূলিমেঘের অঞ্চলকে বলে আন্তঃনাক্ষত্রিক মাধ্যম বা ইন্টারেস্টেলার মিডিয়াম। এই অঞ্চলসমূহ এদের পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের তুলনায় কিছুটা বেশি ঘনত্বের হয়ে থাকে। সাধারণত ধূলিমেঘের নিজস্ব অভিকর্ষ বলের প্রভাবে এর ভেতরকার ধূলিকণাসমূহের গতিশক্তির ভারসাম্য বজায় থাকে। এখন যখন ধূলিমেঘের এই ভারসাম্য কোনো কারণে বিঘ্নিত হয় (যেমন পার্শ্ববর্তী কোনো সুপারনোভার প্রভাবে) তখন এসব ভারসাম্যহীন ধূলিমেঘ অঞ্চল আরো ঘন ও সংকুচিত হতে থাকে।
এভাবে ঘন থেকে ঘনতর হতে হতে গ্যাস বা ধূলিমেঘ একসময় একটি নির্দিষ্ট ভর যাকে বলা হয় ক্রান্তি ভর (ক্রিটিক্যাল ম্যাস) অর্জন করে তখন মেঘের ঘনতর অংশগুলো অভিকর্ষ বলের প্রভাবে আরো সংকুচিত হতে থাকে। এই সংকোচন এমন একটি পর্যায়ে পৌঁছায় যখন মেঘের ঘনতর অংশগুলো একে অপরের থেকে আলাদা হয়ে যায় এবং আরো ঘন অঞ্চল গঠন করে। এই প্রক্রিয়া চলে প্রায় কয়েক মিলিয়ন বছর ধরে।
যখন ধূলিমেঘ আরো সংকুচিত ও ঘনীভূত হতে থাকে তখন একদিকে এদের আকৃতি গোলাকের ন্যায় হতে শুরু করে। এ অবস্থায় এদের প্রোটোস্টার বলা হয়ে থাকে। অন্যদিকে মহাকর্ষ বলের প্রভাবে এদের সংকোচনের প্রভাবে এদের ভেতরকার তাপমাত্রা বাড়তে থাকে যা প্রায় ২০ মিলিয়ন ডিগ্রি ফারেনহাইট পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে। এই তাপমাত্রায় মেঘের মধ্যে উপস্থিত হাইড্রোজেন গ্যাসের দহন শুরু এবং এই দহনের ফলে শুরু হয় হাইড্রোজেনের কয়েক দফা নিউক্লিয়ার ফিউশন বিক্রিয়া। এই বিক্রিয়ার ফলে শেষ পর্যন্ত হাইড্রোজেন থেকে হিলিয়াম উৎপাদিত। এভাবেই জন্মগ্রহণ করে একটি শিশু নক্ষত্র, যা আস্তে আস্তে বৃদ্ধ হতে থাকে এবং এক সময় মৃত্যুও বরণ করে।
জ্যোতির্বিজ্ঞানীগণের ধারণামতে সাধারণত সর্পিলাকার গ্যালাক্সির বাহুর অভ্যন্তরেই নতুন নক্ষত্রদের জন্ম হয়ে থাকে, কারণ এখানেই থাকে ঘনীভূত গ্যাসীয় বা ধূলিকণার মেঘ। কখনো কখনো একই আণবিক মেঘ থেকে একসাথে অনেকগুলো নক্ষত্র জন্মগ্রহণ করতে পারে। তখন এদের একসাথে বলা হয় স্টার ক্লাস্টার বা তারকাদল। সাধারণত নক্ষত্রসমূহের দুই ধরনের ক্লাস্টার পাওয়া যায়। প্রথমটিকে বলে ওপেন ক্লাস্টার যেখানে কয়েকশত অপেক্ষাকৃত তরুণ, একটু বেশি উত্তপ্ত এবং একে অপরের থেকে খানিকটা দূরত্ব বজায়কারী নক্ষত্রদের দেখা মেলে। দ্বিতীয় ক্লাস্টারটিকে বলা হয় গ্লোবিউলার ক্লাস্টার, যেখানে অপেক্ষাকৃত বয়স্ক এবং একে অপরের কাছাকাছি অবস্থিত কয়েক হাজার নক্ষত্র অবস্থান করে।
বিজ্ঞানীরা মনে করেন যে আমাদের সূর্য ও সৌরজগৎ প্রায় একই সময়ে সৌর নীহারিকার মাঝে জন্ম নিয়েছে এবং একই নীহারিকাতে অদ্যাবধি অবস্থান করছে। সূর্যের জন্মও হয়েছে নক্ষত্রদের জন্মের সাধারণ সূত্র ধরে। অর্থাৎ গ্যাসীয় বা ধূলিমেঘের সংকোচন এবং এরপর ইন্টারস্টেলার মাধ্যমের ভেঙ্গে পড়ার ফলে জন্ম নিয়েছে সূর্য।
নক্ষত্রদের উজ্জ্বলতার পরিমাপ: হার্টজপ্রং-রাসেল ডায়াগ্রাম
সূর্য বাদে বাকি সব নক্ষত্র সাধারণত পৃথিবী অর্থাৎ সৌরজগৎ থেকে অনেক দূরে অবস্থান করে। যেমন ধরা যাক, প্রক্সিমা সেন্টারি নামক নক্ষত্রটি। এটি পৃথিবী থেকে প্রায় ৪.২ আলোকবর্ষ দূরে অবস্থিত। ফলে বাস্তবে আমরা পৃথিবীতে বসে যদি প্রক্সিমাতে কী হচ্ছে দেখার চেষ্টা করি তাহলে আসলে দেখবো যে ৪.২ আলোকবর্ষ আগে সেখানে কী হচ্ছিলো সেই ঘটনা। ফলে এই মুহূর্তে সেখানে কী হচ্ছে সেটা দেখা অসম্ভব। মূলত জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা দুটি জিনিসই দেখে থাকেন এক্ষেত্রে; প্রথমটি হচ্ছে নক্ষত্রের লুমিনোসিটি বা উজ্জ্বলতা এবং এদের পৃষ্ঠের বর্ণ।
নক্ষত্রের উজ্জ্বলতা পরিমাপের কথা যখন আসে তখন এদের উজ্জ্বলতা পরিমাপের একটি স্কেলেরও দরকার পড়ে। সেক্ষেত্রে বিজ্ঞানীগণ এদের উজ্জ্বলতার পরিমাপকে বাস্তব মান দিয়ে প্রকাশ করে থাকেন অর্থাৎ কোনো আপেক্ষিক মান এক্ষেত্রে গ্রহণযোগ্য নয়। সূর্যের বর্তমান উজ্জ্বলতাকে আদর্শমান ধরেই এই স্কেল তৈরী করা হয়েছে। অর্থাৎ যদি কোনো নক্ষত্রের উজ্জ্বলতা হয় ১ তাহলে এর অর্থ হচ্ছে সেটি সূর্যের বর্তমান উজ্জ্বলতার সমান উজ্জ্বলতা ধারণ করছে।
অন্যদিকে নক্ষত্রদের পৃষ্ঠের বর্ণ নির্ভর করে এদের পৃষ্ঠের তাপমাত্রার উপর। সাধারণত অপেক্ষাকৃত বেশী তাপমাত্রায় এদের বর্ণ থাকে নীল বা নীলাভ ধরনের। সময়ের সাথে সাথে এদের তাপমাত্রা কমতে থাকে এবং অপেক্ষাকৃত শীতল নক্ষত্রের পৃষ্ঠবর্ণ লাল বা লালাভ হয়ে থাকে।
দুজন জ্যোতির্বিজ্ঞানী হার্টজপ্রং এবং রাসেল নক্ষত্রের এই উজ্জ্বলতা এবং এদের পৃষ্ঠের বর্ণ পরিবর্তনের মান সম্বলিত একটি দ্বিমাত্রিক ডায়াগ্রাম তৈরী করেন, যা তাদের নামানুসারে হার্টজপ্রং-রাসেল ডায়াগ্রাম নামে পরিচিত। এই ডায়াগ্রামে নক্ষত্র থেকে প্রয়োজনীয় তাপমাত্রার মান বসিয়ে তাপমাত্রার বিপরীতে এদের লুমিনোসিটি কেমন হবে বা এটি এখন কোন অবস্থায় আছে সে সম্পর্কে ধারণা পাওয়া সম্ভব।
মজার ব্যাপার হলো, এই ডায়াগ্রামে নক্ষত্রের অবস্থান সমভাবে বিন্যস্ত নয়। অর্থাৎ একটি অনিয়মিত প্যাটার্ন পাওয়া যায় যেখানে অধিকাংশ নক্ষত্রই অবস্থান করে ডায়াগ্রামের উপরে বামদিক হতে নিচের ডানদিক পর্যন্ত। উপরের বামদিক নির্দেশ করে যে নক্ষত্র এখন তরুণ, বৃহদাকার, অপেক্ষাকৃত অধিক উত্তপ্ত, অধিক উজ্জ্বল ও নীলাভ এবং যখন সেটা নিচে ডানদিকে অবস্থান করে তখন নির্দেশ করে যে এটির তাপমাত্রা অপেক্ষাকৃত শীতল, আকৃতিতে ছোট, অনুজ্জ্বল ও বর্ণ লালাভ ধরনের। উপরে ডানদিকে অবস্থান করে যেসব নক্ষত্র তাদের উজ্জ্বলতা অধিক, বৃহদাকার এবং লাল বর্ণের হয়ে থাকে। তবে এদের তাপমাত্রা থাকে কম। এ ধরনের নক্ষত্রদের বলা হয় রেড জায়ান্ট (লোহিত দানব)। অন্যদিকে নিচে বামদিকে থাকে শ্বেত বামন বা হোয়াইট ডোয়ার্ফ নামক অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্রাকৃতির উত্তপ্ত ও নীলাভ বর্ণের নক্ষত্র।
নক্ষত্রের জীবনকাল এবং বার্ধক্য
সদ্য জন্ম নেয়া নক্ষত্রের ক্ষেত্রে সাধারণত এর জীবনকালের প্রায় ৯০ শতাংশ সময়ই এদের আকৃতি, উজ্জ্বলতা এবং পৃষ্ঠের তাপমাত্রা প্রায় একই রকম থাকে। এই সময়ে নক্ষত্রসমূহ হাইড্রোস্ট্যাটিক সাম্যাবস্থায় থাকে। অর্থাৎ বলা যায় যে হার্টজপ্রং-রাসেল ডায়াগ্রামে এদের অবস্থান পরিবর্তন হয় না। এই পর্যায়ে নক্ষত্রকে বলা হয় মূল অনুক্রম নক্ষত্র বা মেইন সিকোয়েন্স স্টার। আমাদের সূর্য এর একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ। এরা হার্টজপ্রং-রাসেল ডায়াগ্রামের উপরে বামদিক হতে নিচের ডানদিকের মধ্যবর্তী প্যাটার্নে অবস্থান করে। এই অবস্থায় এরা দীর্ঘকাল অবস্থান করে। কিন্তু এই সময়কাল সকল নক্ষত্রের জন্য এক নয়।
মেইন সিকোয়েন্স স্টার, যেমন আমাদের সূর্য এদের জীবনকালে হাইড্রোজেন থেকে নিউক্লিয়ার ফিউশনের মাধ্যমে হিলিয়াম উৎপাদন করে। এদের জীবনকাল নির্ভর করে এদের আকৃতি ও ভরের উপর। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, অপেক্ষাকৃত বৃহদাকার নক্ষত্রগুলো এদের জ্বালানি খুব দ্রুত দহন করার প্রবণতা প্রদর্শন করে এবং এতে করে এরা তত তাড়াতাড়ি বার্ধক্যে প্রবেশ করে। অন্যদিকে অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্রাকার নক্ষত্রগুলোর এত দ্রুত জ্বালানি দহনের প্রয়োজন পড়ে না। ফলে এরা দীর্ঘকাল যাবৎ টিকে থাকে।
রেড জায়ান্ট
নক্ষত্রের বর্তমান অবস্থা জানা যায় এদের ভেতর কোন প্রকারের জ্বালানি কী পরিমাণ আছে তার উপর। যেমন মেইন সিকোয়েন্স স্টার হাইড্রোজেন গ্যাস ধারণ করে এবং দহন করে। যখন হাইড্রোজেন গ্যাস পুড়তে থাকে অর্থাৎ আস্তে আস্তে নিঃশেষ হতে থাকে তখন নক্ষত্র খুবই কম পরিমাণ শক্তি উৎপাদন করতে পারে। ফলে এই শক্তি নক্ষত্রের ভার বহন করতে অপ্রতুলতা প্রদর্শন করে এবং নক্ষত্রের মজ্জা বা কোর আস্তে আস্তে সংকুচিত হতে শুরু করে। এতে করে আবারও এদের ভেতরকার তাপমাত্রা ও কোরের ঘনত্ব বৃদ্ধি পেতে থাকে। আর সেই সাথে বৃদ্ধি পায় এদের লুমিনোসিটি।
এই বিপুল পরিমাণ তাপ নির্গমণের পর নক্ষত্রের ব্যাসার্ধ এদের মূল ব্যাসার্ধ থেকে প্রায় ১০০ হতে ১,০০০ গুণ পর্যন্ত বৃদ্ধি পায়। এখন যেহেতু এই অতিরিক্ত তাপের জন্য অধিক জ্বালানি পুড়ে নিঃশেষ হয়ে গেছে সেহেতু এদের জ্বালানি একদিকে হ্রাস পায় সেই সাথে পৃষ্ঠের তাপমাত্রা প্রায় অর্ধেকই হ্রাস পায়। ফলে নক্ষত্র তখন লাল বর্ণ ধারণ করে। মূলত বৃহদাকার ও লাল বর্ণের এই অবস্থাকেই বলা হয় লোহিত দানব বা রেড জায়ান্ট। হার্টজপ্রং-রাসেল ডায়াগ্রামে এদের অবস্থান উপরে ডানদিকে।
নক্ষত্রের বার্ধক্যের শুরু হয় মূলত যখন এরা আস্তে আস্তে লাল বর্ণ ধারণ করতে শুরু করে অর্থাৎ রেড জায়ান্ট তৈরীর প্রক্রিয়া শুরু হয়। আমাদের সূর্য এখন প্রায় এর মাঝ বয়সে অবস্থান করছে এবং ধারণা করা হচ্ছে যে আগামী পাঁচ মিলিয়ন বছর পরে এটি রেড জায়ান্ট-এ পরিণত হবে এবং পৃথিবী ও এর পরিবেশকে ভস্মীভূত করে ফেলবে।
শ্বেত বামন: ক্ষুদ্রাকার নক্ষত্রের শেষ পরিণতি
রেড জায়ান্ট পর্যায়ের শেষে অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্রাকার (সূর্যের ভরের থেকে প্রায় আট গুণ কম ভরবিশিষ্ট নক্ষত্র) নক্ষত্রের ক্ষেত্রে প্রায় সব হাইড্রোজেন গ্যাস নিঃশেষ হয়ে যায়। অন্যদিকে তাপমাত্রা বৃদ্ধির সংকল্পে এদের সংকোচনও সম্ভব হয়। তখন এর নিউক্লিয়ার ফিউশন বিক্রিয়া চালিয়ে রাখার জন্য আর জ্বালানি বা তাপ কিছুই অবশিষ্ট থাকে না। যেহেতু এদের নিউক্লিয়ার বিক্রিয়া স্তিমিত হয়ে যায় সেহেতু এদের বহিঃস্তর তখন আর স্থিতিশীল থাকে না এবং নক্ষত্রসমূহের উৎপাদিত নাক্ষত্রিক বায়ুর প্রভাবে এই স্তর উড়ে শূন্যে মিলিয়ে যায়।
পৃথিবী থেকে যখন এই ঘটনা দেখা যায় তখন মনে হয় যে নক্ষত্র হতে বৃহৎ রঙিন মেঘ যেন খুব দ্রুত উড়ে যাচ্ছে। পেছনে ফেলে যাচ্ছে শুধুই নক্ষত্রের কোর। এই রঙিন মেঘকে তখন বলা হয় প্লানেটারি নেবুলা। হেলিক্স নেবুলা এক্ষেত্রে প্লানেটারি নেবুলার একটি উপযুক্ত উদাহরণ। তবে প্লানেটারি নেবুলার সাথে প্লানেট বা গ্রহ সম্পর্কিত কোনো যোগসূত্র নেই। যখন এই রঙিন মেঘ নক্ষত্রের মজ্জা হতে উড়ে যেতে থাকে তখন পুরো ব্যাপারটিকে অনেকটা গ্রহের মতো দেখায়। সেই থেকে এর এমন নামকরণ।
প্লানেটারি নেবুলা বা নক্ষত্রের বহিঃস্তর উড়ে যাওয়ার পর নক্ষত্রের যে কোর অবশিষ্ট থাকে সেটি ক্ষুদ্র হলেও এর ঘনত্ব তখনও অধিক এবং সেই সাথে তাপমাত্রা থাকে অধিক। ক্ষুদ্রাকার এবং ধূসর-সাদাটে বর্ণের এই কোরকেই বলা হয় শ্বেত বামন। তারা এতটাই ঘনীভূত থাকে যে এই নক্ষত্র কোরের এক চা চামচ পরিমাণ পদার্থের ভর হবে পৃথিবীর একটি প্রমাণাকৃতির হাতির ভরের সমান। এরা মূলত হার্টজপ্রং-রাসেল ডায়াগ্রামের নিচে বামদিকে অবস্থান করে।
ক্ষুদ্রাকার নক্ষত্রের ক্ষেত্রে এই শ্বেত বামন কোর গঠিত হয় মূলত কার্বন এবং সেই সাথে সামান্য পরিমাণ অক্সিজেন নিয়ে। অন্যদিকে একটু বৃহৎ আকৃতির কোরে থাকে নিয়ন। আগেই বলা হয়েছে যে নিউক্লিয় বিক্রিয়া চালানোর জন্য এই কোরে আর কোনো জ্বালানি অবশিষ্ট থাকে না। ধীরে ধীরে এর তাপমাত্রা কমে যেতে থাকে এবং একসময় এদের উজ্জ্বলতা একদম কমে যায়। এই অবস্থাকে বলা হয় ধূসর বামন বা ব্রাউন ডর্ফ। আমাদের সূর্যের মৃত্যু হবে খুব সম্ভবত এই উপায়ে।
সুপারনোভা: বৃহদাকার নক্ষত্রের শেষ পরিণতি
ক্ষুদ্রাকার নক্ষত্রের শেষ পরিণতির কথা যেহেতু বলা হয়েছে সেহেতু প্রশ্ন থেকেই যায় যে তাহলে বৃহদাকার নক্ষত্রের ক্ষেত্রে পরিশেষে কি হবে?
বৃহদাকার নক্ষত্র বলতে আমরা বোঝাবো সেসব নক্ষত্রদের, যাদের ভর সূর্যের ভরের থেকে প্রায় আট গুণ বেশি। বৃহদাকার নক্ষত্রগুলো ঠিক ক্ষুদ্রাকারগুলোর মতো এভাবে নীরবে ধীরে ধীরে মৃত্যু বরণ করে না। এদের মৃত্যু নির্দেশিত হয় এক প্রকাণ্ড স্বতঃস্ফূর্ত বিস্ফোরণের ফলে। বিস্ফোরণের প্রথম সেকেন্ডে এর উজ্জ্বলতা এতটা বেশি হয় যা প্রায় অসংখ্য নক্ষত্র সমন্বিত গ্যালাক্সির উজ্জ্বলতার সমান। এ ধরনের নাক্ষত্রিক বিস্ফোরণকে বলে টাইপ-২ (Type-II) সুপারনোভা। টাইপ-১ সুপারনোভা গঠিত হয় মূলত শ্বেত বামনের বিস্ফোরণের ফলে।
মূল নক্ষত্রের ভরের উপর নির্ভর করে সুপারনোভা বিস্ফোরণের ফলে নক্ষত্রের কোরের দুই ধরনের অবস্থা পাওয়া যেতে পারে। তুলনামূলক ক্ষুদ্র নক্ষত্রের ক্ষেত্রে কোরটি নিউট্রন স্টারে পরিণত হতে পারে। কিন্তু যদি নক্ষত্রের কোরের ভর সূর্যের ভরের ২.৫ গুণ বেশি হয় তবে এদের দ্বারা ব্ল্যাক হোল তৈরী হওয়া সম্ভব।
বিস্ফোরণের পরে ছিটকে পড়া কণাসমূহ আবার নতুন কোনো গ্যাসীয় মণ্ডলে প্রবেশ করে এবং সেখানকার হাইড্রোজেনের সাথে মিশে গিয়ে আবার নতুন কোনো নক্ষত্রের জন্মদানের অবদান রাখে। আমাদের সূর্যও একই উপায়ে তৈরী হয়েছে। সূর্যের অভ্যন্তরে এরকম কণা রয়েছে যা অগণিত নক্ষত্র বিস্ফোরণের ধ্বংসাবশেষের নমুনা প্রদর্শন করে।
নিউট্রন স্টার
যখন সুপারনোভা বিস্ফোরণ হয় তখন বিধ্বস্ত নক্ষত্রের কোরের পদার্থসমূহ সংকুচিত হতে থাকে। অধিক সংকোচনের ফলে প্রোটন ও ইলেকট্রন একে অপরের সাথে মিলে তৈরী করে নিউট্রন। কিন্তু এই নিউট্রন তৈরী একটি বিশেষ সীমায় সীমাবদ্ধ। অর্থাৎ এই সীমার পর আর নিউট্রন তৈরী হয় না এবং এরপরই তৈরী হয় নিউট্রন স্টার। এরা এতই ঘনীভূত যে এদের কোরের এক চা চামচ পরিমাণ পদার্থের ভর হবে গিজার পিরামিডের ভরের ২০ গুণ প্রায়। খুব সম্ভবত মানুষের জানামতে এটাই সবথেকে ঘনতর বস্তুর উদাহরণ।
কতিপয় নিউট্রন স্টার কয়েক মিলিসেকেন্ড থেকে কয়েক সেকেন্ডের ব্যবধানে খুব দ্রুতগতিতে ঘুরতে থাকে। এই ঘূর্ণনের সময়ে এরা রেডিও তরঙ্গ তৈরী করে যা নির্দিষ্ট স্পন্দন বা পালস সমৃদ্ধ। এই কারণে এদের বলা হয় পালসার। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য পালসার নক্ষত্রের অবস্থান পাওয়া যায় ক্রাব নেবুলার কেন্দ্রীয় অঞ্চলে। এরা প্রতি সেকেন্ডে প্রায় ৩০ বার পর্যন্ত ঘোরে।
ব্ল্যাক হোল
ব্ল্যাক হোল তৈরীর ক্ষেত্রে নক্ষত্রের কোরকে অবশ্যই সূর্যের ভরের ২.৫ গুণ বেশি ভরের হতে হবে। এই বিশাল ভরের কারণে এর অভিকর্ষ বলও হয় অত্যদিক। এর ফলে যখন সুপারনোভা বিস্ফোরণ ঘটে তখন নিউট্রনসমূহের ভেতরকার রিপালসন বা বিকর্ষণ বল এদের ধ্বংস হওয়া থেকে ঠেকাতে অক্ষম হয়। এদের কোর ক্রমাগত ঘনীভূত হতেই থাকে যতক্ষণ না সেটি ব্ল্যাক হোলে পরিণত হয়।
ব্ল্যাক হোল বা কৃষ্ণ গহ্বর মহাকাশের সেই সব অংশ যেখানে এদের অভিকর্ষ বা মহাকর্ষ বল এবং এদের ঘনত্ব এত অধিক থাকে যে আলো পর্যন্ত সেখান থেকে বেরিয়ে আসতে পারে না। সমস্ত বস্তু এক জায়গায় এভাবে একত্রে ঘনীভূত হয়ে থাকার কারণে এদের ‘সিঙ্গুলারিটি’-ও বলা হয়।
এভাবেই মহাকাশে গ্যাসীয় মেঘের সংকোচনের ফলে শিশু নক্ষত্রদের জন্ম হয় এবং ধীরে ধীরে তারা মৃত্যুর দিকে এগিয়ে চলে। কেউ উজ্জ্বলতা হারিয়ে শ্বেত বামনে পরিণত হয়, কেউ পরিণত হয় নিউট্রন স্টারে, আবার অনেকের শেষ পরিণতি হয় ব্ল্যাক হোল সৃষ্টির মাধ্যমে।
আমাদের আকাশে আমরা যেসব নক্ষত্রকে দেখতে পাই তারা তাদের জীবনের বিভিন্ন পর্যায় পার করছে। কেউ হয়তো সদ্য জন্মলাভ করেছে, কেউ বা ধীরে ধীরে এগিয়ে চলেছে শেষ পরিণতির দিকে। আবার অনেক আলোকবর্ষ দূরের নক্ষত্র থেকে এখনো হয়তো আলোকরশ্মি আমাদের পৃথিবীতে এসে পৌঁছায় নি। কোনোটি আবার মৃত এখন। অবস্থা যা-ই হোক, আকাশের এই নক্ষত্ররাজি সবসময়ই পৃথিবীর মানুষের কাছে হয়ে থাকবে এক বিস্ময়।
ফিচার ইমেজ: anu.edu.au