Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

কিংডম অব আসগার্দিয়া: পৃথিবীর বাইরে প্রথম নভো রাষ্ট্রের উত্থান

আমি একজন বিজ্ঞানী এবং ব্যবসায়ী ছিলাম। কিন্তু এখন আমি একজন সমাজসেবক। প্রায় ২০ বছর ধরে রাশিয়ায় মহাকাশযান এবং মহাশূন্য সম্পর্কিত বিভিন্ন মিশন ও কারখানার সাথে সম্পৃক্ত ছিলাম। আসগার্দিয়ার প্রথম রাষ্ট্রপতি হিসেবে নির্বাচিত হওয়ার আগে আমি অস্ট্রিয়ায় ROOM নামক একটি স্পেস জার্নাল এবং এরোস্পেস ইন্টারন্যাশনাল রিসার্চ সেন্টার (AIRC) প্রতিষ্ঠা করেছি। এসব কাজের ফাঁকে আমি অনেক কিছু নিয়ে ভাবতাম। মাথায় নতুন নতুন চিন্তা আসতো। প্রায় দশ বছর আগে আমার মাথায় আসলো, যদি এমন একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা যায় যেটি হবে অন্যান্য সকল রাষ্ট্র থেকে আলাদা, তাহলে বেশ দারুণ হবে।

একটি নতুন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে প্রয়োজন হয় নিজস্ব ভূখণ্ডের। পৃথিবীর মাটিতে ভূখণ্ড লাভ করা একদম সহজ কাজ হবে না। এরপর ২০১৬ সালে কানাডার মন্ট্রিলে মহাকাশ আইন নিয়ে আয়োজিত একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনে সর্বপ্রথম আমার মাথায় আসে আসগার্দিয়ার কথা। আসগার্দিয়া হবে এমন একটি রাষ্ট্র যার ভূখণ্ড থাকবে মহাকাশে। অসম্ভব বলে উড়িয়ে দেওয়াও যাচ্ছিল না। কারণ, আমি জানি এটি সম্ভব। কেন অসম্ভব হবে? আমি পরবর্তীতে মহাকাশ আইন বিশেষজ্ঞদের সাথে আলোচনা করি এবং আমার প্রস্তাবনার পূর্ণাঙ্গ খসড়া তৈরি করে ফেলি।

ফিউচারিজম‘ ওয়েবসাইটের নেওয়া এক সাক্ষাৎকারে এমন কথা বলছিলেন ইতিহাসের সর্বপ্রথম মহাকাশ রাষ্ট্রের নির্মাতা রাষ্ট্রপতি ইগর আশুরবেইলি। ২০১৬ সালে তিনি আসগার্দিয়া নামক একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেন। জনসংখ্যার দৌড়ে পৃথিবীর ১৭১তম বৃহত্তম রাষ্ট্র আসগার্দিয়া। প্রায় ২ লক্ষ নাগরিকের সমন্বয়ে গঠিত এই রাষ্ট্রের আছে নিজস্ব সংবিধান। শুধু গড়ে উঠেনি একটি নিজস্ব নিবাসস্থল। কিন্তু রাষ্ট্রপতি আশুরবেইলির কাছে এটি কোনো সমস্যাই না। তিনি নিশ্চিত যে অদূর ভবিষ্যতেই নিজেদের আবাস গড়ে উঠবে।

নভো রাষ্ট্র আসগার্দিয়া এখনো শুধু স্বপ্ন; Source: Wall Street Journal

পটভূমি

আসগার্দিয়া পর্ব শুরুর আগে এর পেছনের ঘটনা সম্পর্কে জানা যাক। আসগার্দিয়া শব্দটি ‘আসগার্দ‘ শব্দ থেকে নেওয়া হয়েছে। বিখ্যাত মার্ভেল সিরিজের মাধ্যমে ইতোমধ্যে আমরা অনেকেই আসগার্দ সম্পর্কে জানতে পেরেছি। নর্স পুরাণ অনুসারে, আসগার্দ হচ্ছে মহাশূন্যে অবস্থিত একটি জগৎ যেখানে শুধু দেবতারা বাস করেন। সেই কল্প জগৎ থেকে অনুপ্রাণিত হয়েই নেওয়া হয় আসগার্দিয়া প্রকল্প। ২০১৬ সালে রুশ কম্পিউটার প্রকৌশলী ইগর আশুরবেইলি কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত হয় মহাকাশ রাষ্ট্র আসগার্দিয়া।

প্রাথমিকভাবে আসগার্দিয়ার একচ্ছত্র নেতা হিসেবে আবির্ভাব ঘটলেও গতবছর ২৫ জুন ভিয়েনার হফবার্গ প্রাসাদে একটি জমকালো অনুষ্ঠানে আসগার্দিয়ানরা তাকে রাষ্ট্রপতি হিসেবে নির্বাচিত করে। প্রতিষ্ঠার পর ধীরে ধীরে বড় হতে থাকা আসগার্দিয়ার বর্তমান নিবন্ধিত সদস্য সংখ্যা প্রায় ২ লাখেরও বেশি। এই রাষ্ট্রের রয়েছে নিজস্ব জাতীয় সঙ্গীত এবং সংবিধান।

রাষ্ট্রপতি ইগর আশুরবেইলি; Source: Youtube

রাষ্ট্রপতি আশুরবেইলি বেশ রহস্যে ঘেরা এক ব্যক্তিত্ব। ব্যক্তিজীবনে তিনি একজন কোটিপতি হিসেবে পরিচিত। কিন্তু তার সম্পদের পরিমাণ সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট তথ্য পাওয়া যায় না। আশুরবেকভ নামক এক আজারবাইজানি পরিবারের বংশধর ইগর আশুরবেইলি তার নিজস্ব প্রচেষ্টায় ব্যবসাক্ষেত্র এবং মহাকাশ শিল্পে নিজের স্থান করে নিয়েছেন। এর আগে তিনি অস্ত্র উৎপাদন ব্যবসার সাথেও জড়িত ছিলেন। এখানেই থেমে না গিয়ে নিজস্ব চিন্তাভাবনাকে বাস্তবায়িত করতে প্রতিষ্ঠা করেছেন এই বিস্ময়কর রাষ্ট্র আসগার্দিয়া। 

আসগার্দিয়ার মূলনীতি

আসগার্দিয়া মূলত তিনটি লক্ষ্যমাত্রার উপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত: মহাকাশের শান্তিপূর্ণ ব্যবহার নিশ্চিতকরণ, মহাকাশের দুর্যোগ থেকে পৃথিবীকে নিরাপদ রাখা এবং মহাকাশে সেনাবাহিনী বিহীন এবং বিজ্ঞানের জন্য উন্মুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করা। এই তিনটি লক্ষ্যমাত্রার বাইরেও আসগার্দিয়া চাঁদের বুকে নিজেদের বসবাসের উপযোগী পরিবেশ এবং ঘাঁটি নির্মাণের লক্ষ্য নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে। আসগার্দিয়ানরা বিশ্বাস করে, পৃথিবীর একমাত্র উপগ্রহে একটি আইনগত বৈধ অবকাঠামো প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে মহাশূন্যের আরো গভীরে অভিযান পরিচালনা করা সম্ভব হবে। প্রযুক্তিগত উন্নতি সাধনের মাধ্যমে মানব সভ্যতা এগিয়ে যাবে দ্রুত থেকে দ্রুততত গতিতে।

যারা পৃথিবীর ভৌগোলিক সীমারেখার গণ্ডিতে আবদ্ধ, তাদের সকলের জন্য মুক্তির বার্তা নিয়ে হাজির হয়েছে এই ভবিষ্যৎ নগরী, এমনটাই ঘোষণা দেয়া আছে আসগার্দিয়ার অফিসিয়াল ওয়েবসাইটে। 

মহাশূন্যে আসগার্দিয়ার স্যাটেলাইট; Source: Asgardia Space News

২০১৭ সালে মহাকাশের বুকে আসগার্দিয়ার প্রথম স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ করা হয়। আসগার্দিয়া সম্পর্কিত বিস্তারিত তথ্য এবং সংবিধানের গুরুত্বপূর্ণ নীতিমালার একটি সংকলন বহনকারী এই স্যাটেলাইটটি সগৌরবে পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করছে। আগামী দুই বছরের মাথায় তারা আরো কয়েকটি স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের পরিকল্পনা করছে। এক কথায় বলতে গেলে, পৃথিবীর ঝামেলা থেকে বেঁচে থাকতে এক ইউটোপিয়ার কল্পনা করছে আসগার্দিয়ানরা। 

আসগার্দিয়া সরকার এবং সংবিধান

কাল্পনিক নভোরাষ্ট্র আসগার্দিয়ার সংবিধান অনুযায়ী একটি পার্লামেন্টও গঠিত হয়েছে। প্রায় ১৪৬ জন সদস্যের সমন্বয়ে গঠিত এই পার্লামেন্ট আসগার্দিয়ার মূল লক্ষ্য বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যে কাজ করছে। আসগার্দিয়ার সাংবিধানিক নাম ‘কিংডম অব আসগার্দিয়া’। কিন্তু নামে কিংডম হলেও আসগার্দিয়ায় মূলত গণতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থা প্রচলিত। আসগার্দিয়া সরকার কর্তৃক প্রণীত সংবিধানটি অনেকটাই বর্তমান প্রেক্ষাপটের সাপেক্ষে অবাস্তব। প্রায় নয় হাজার শব্দ সমন্বয়ে রচিত এই সংবিধান থেকে উল্লেখযোগ্য কিছু ধারা তুলে ধরা হলো

  • আসগার্দিয়ার মূল্যবোধ মহাশূন্যে শান্তির বার্তা বহন করা এবং বিশ্বজগতে শান্তিপূর্ণ বসতি নিশ্চিত করা।
  • আসগার্দিয়ার সকল নাগরিক সমান। পৃথিবীর জন্মসূত্র, আবাস, নাগরিকত্ব, বর্ণ, জাতীয়তা, লিঙ্গ, ধর্ম, ভাষা, আর্থিক অবস্থা এবং ইতিহাস ভেদে তাদের মধ্যে কোনো বৈষম্য থাকবে না।
  • বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তির জগতে সর্বশ্রেষ্ঠ জাতি হিসেবে আসগার্দিয়া পরিচিত হবে।
  • মত প্রকাশের কারণে কোনো ধরনের দমন নিপীড়ন বরদাস্ত করা হবে না। কিন্তু আসগার্দিয়ার সম্মান রক্ষার্থে সহিংসতা ঘটাতে পারে এমন উস্কানীমূলক মন্তব্য প্রকাশ করা থেকে আসগার্দিয়ানরা বিরত থাকবে।
  • তথ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে সরকার নির্দিষ্ট নীতিমালা গ্রহণ করবেন।

তাছাড়া আসগার্দিয়ার রাষ্ট্রপতি নিজ ক্ষমতাবলে তার উত্তরসূরির নাম ঘোষণা করার পূর্ণ অধিকার রাখেন। এমনকি রাষ্ট্রের প্রধান বিচারপতি এবং অন্যান্য আইনী পদস্থ ব্যক্তিবর্গের নিয়োগের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতির সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত বলে গণ্য করা হবে। ২০১৮ সালের ২৪ জুন ভিয়েনায় অনুষ্ঠিত প্রথম অধিবেশনে ৪০টি দেশের মোট ১০০ জন সদস্য উপস্থিত ছিলেন।

সেখানে বেঁধে দেওয়া সময় ৮ ঘণ্টার স্থলে দীর্ঘ ১১ ঘণ্টা ধরে চলতে থাকা অধিবেশনে সকলে একবার করে বক্তব্য উপস্থাপনের সুযোগ পান। এমনকি ২০টি মহাগুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে নাকি ভোটাভুটিও হয়েছে! আসগার্দিয়ানদের এমন উৎসাহে অনেকেরই চোখ কপালে উঠেছে। এটি ফ্লাট আর্থ সোসাইটির মতো আরেকটি হাস্যকর সংস্থা হিসেবে আবির্ভূত হচ্ছে বলেও মনে করেন অনেকে।

ভিয়েনায় আসগার্দিয়া সম্মেলন; Source: The Conservative Cartel

নাগরিকত্ব প্রদান 

আসগার্দিয়ার নাগরিকত্ব পেতে হলে প্রথমেই আপনাকে আসগার্দিয়ার সংবিধান বইটি পড়তে হবে। এরপর যদি আপনি এই সংবিধানের ধারার সাথে একাত্মতা প্রকাশ করেন, তখন আপনি আসগার্দিয়ার নাগরিকত্ব লাভের জন্য মনোনীত হবেন। মাত্র কয়েক মিনিটের মাথায় একটি রাষ্ট্রের নাগরিকত্ব পাওয়ার দৌড়ে হয়তো কেউই আসগার্দিয়াকে পেছনে ফেলতে পারবে না। নাগরিকত্ব প্রদানের আগে আপনাকে একটি ফর্মে বেশ কিছু ব্যক্তিগত প্রশ্ন করা হবে। ফর্মে নিজের নাম, ঠিকানা, শিক্ষাগত যোগ্যতা এবং যোগাযোগের ঠিকানা প্রদানের পর আপনাকে নাগরিক হিসেবে গ্রহণ করা হবে। কিন্তু এখানেই সবকিছু শেষ নয়। নতুন নাগরিককে তার প্রথম দিনেই একটি সংক্ষিপ্ত IQ টেস্টের মুখোমুখি হতে হয়।

আসগার্দিয়া সংবিধান; Source: Twitter

আসগার্দিয়া কি ভুয়া?

আসগার্দিয়া নামক ইউটোপিয়া কতটা বাস্তবধর্মী তা নিয়ে বিতর্কের অবকাশ আছে। কিন্তু আসগার্দিয়ার পুরো প্রকল্পটি ভুয়া, এমন দাবিও উঠছে। এমন দাবি উঠার পেছনে মূল কারণ, IQ টেস্টের পর অনেক নাগরিককেই গড় বুদ্ধিমত্তা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। পরবর্তীতে তাদেরকে আরো একটি বিশেষ প্রকল্পে অংশগ্রহণ করতে নির্দেশ দেওয়া হয়, যার মাধ্যমে তাদের বুদ্ধিমত্তা সম্পর্কিত সমস্যার সমাধান হবে বলে আশ্বাস প্রদান করা হয়। আর এখানেই ঝামেলার শুরু হয়।

অনেকেরই ধারণা এর মাধ্যমে কোনো বিশেষ উদ্দেশ্য হাসিল করছে ব্যবসায়ী ইগর আশুরবেইলি। স্টপ ফেক নামক একটি ওয়েবসাইটে একদল ইউক্রেনিয়ান সাংবাদিক এর বিরুদ্ধে বেশ কিছু অভিযোগ তুলে ধরে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল, আসগার্দিয়া সরকার জোর করে এর নাগরিকদের নির্দিষ্ট স্টক কোম্পানিতে শেয়ার কিনতে বাধ্য করছে। অনেকের কাছেই এটি রুশ সরকারের কোনো ষড়যন্ত্র। কিন্তু এসব অভিযোগের কোনোটার পক্ষেই শক্ত প্রমাণ দিতে না পারায় এখন পর্যন্ত টিকে আছে আসগার্দিয়া।

ভবিষ্যতে মানুষ নভো রাষ্ট্র গড়ে তুলবে; Source: CNN

রাষ্ট্রপতি ইগর আশুরবেইলি তার উদ্বোধনী বক্তৃতায় আসগার্দিয়াকে মানবতার সুন্দরতম ভবিষ্যতের বাস্তব রূপ হিসেবে আখ্যায়িত করেছিলেন। তার নিকট আসগার্দিয়া হবে স্বর্গের শান্তিময় চারণভূমি, যেখানে ঘৃণা থাকবে না। থাকবে শুধু আনন্দ। শুনতে বেশ আশাব্যঞ্জক মনে হলেও বাস্তবতা অনেক দূর। আসগার্দিয়া কতদূর যাবে, সেটি ঠিকভাবে বলা সম্ভব নয়। তবে দূর ভবিষ্যতে মানুষ মহাকাশে নভো রাষ্ট্র গঠন করবে, এটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। 

ফিচার ইমেজ- Extreme Tech

Related Articles