Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

মারা গেলে কী ঘটে আমাদের মস্তিষ্কে?

বহুকাল আগে থেকেই বিশ্বাস করা হতো, মারা যাওয়ার পর দেহের প্রতিটি  অঙ্গপ্রত্যঙ্গ, এমনকি মস্তিষ্কেরও মৃত্যু ঘটে। পৃথিবীতে এমন অনেক নজির রয়েছে যে ডাক্তার মৃত ঘোষণার পর রোগী জীবিত হয়ে উঠেছে। তেমনি রোগীদের কাছে প্রশ্ন করা হয়েছে তাদের সেই সময়কার অনুভূতি সম্পর্কে। বেশিরভাগই বলেছেন, তারা সুড়ঙ্গের শেষ প্রান্তে একটি আলোর উৎস দেখতে পেয়েছেন, বা নিজেকে আবিষ্কার করেছেন কোনো একটি মাঠে হেঁটে বেড়াতে বা আশেপাশে  আপনজনের খুব ভিড়। আবার অনেকেই বলেছেন, তাদের দেহ ভাসমান থাকার অনুভূতির কথা। কেউ কেউ এও বলেছেন যে ডাক্তার তাদেরকে বাঁচানোর জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করেছেন, তাও দেখেছেন তারা। এখন প্রশ্ন হলো, যদি মানুষ মারা গেলে দেহের প্রতিটি অঙ্গপ্রত্যঙ্গ মারা যায়, তাহলে কীভাবে স্মৃতিচারণ করছেন? এর একটিই সম্ভাব্য উত্তর হতে পারে- নিশ্চয়ই তার মস্তিষ্ক জীবিত ছিল। শুরু হলো গবেষণা।

বেশিরভাগই বলেছেন যে তারা একটি সুড়ঙ্গের শেষ প্রান্তে একটি আলোর উৎস দেখতে পেয়েছেন; source: uwec.edu

যত গবেষণা

বিজ্ঞানীগণ চেষ্টা চালাতে লাগলেন মৃত্যু পরবর্তী মস্তিষ্কের কার্যাবলী সম্পর্কিত তথ্য উদঘাটনে। ১৯৯০ সালে এক দল মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীর বাস্তব অভিজ্ঞতার আলোকে একটি মনোবৈজ্ঞানিক ভৌতিক সিনেমা ‘Flatliners’ মুক্তি পায়। এখানে মৃত্যু পরবর্তী জীবন সম্পর্কে আলোকপাত করতে গিয়ে মৃত্যুর ঠিক আগমুহূর্তের বর্ণনা আনা হয়েছে। সিনেমাতে দেখানো হয়, এক দল তরুণ ডাক্তার একটি ভয়ংকর পরীক্ষা চালায় যেখানে মৃত্যুর পরবর্তীতে কী হয় তা জানতে হৃদপিন্ডের কাজ বন্ধ করে দেয়। বিজ্ঞানীদের গবেষণার ফলাফলও অনেকটা এরকমই। বিজ্ঞানীরা দেখতে পান, মৃত ঘোষণার পরেও রোগীর মস্তিষ্ক সজাগ থাকে!

মৃত ঘোষণার পরেও রোগীর মস্তিষ্ক সজাগ থাকে! source: truthinsideyou.org

নিউরোলজিস্ট জিমো বোরজিগিন বলেন,

“যদি মৃত্যুর ঠিক ঐ মুহূর্তে সচেতনতা কাজ করে যা কিনা মস্তিষ্ক থেকে আসে, তাহলে তা মানুষের মতো অন্যান্য প্রাণীর ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হবে। মস্তিষ্কে রক্ত সরবরাহ বন্ধ হয়ে গেলেও যেসব স্নায়ু সচেতনতা নিয়ন্ত্রণ করে সেগুলোর প্রাণীদের মস্তিষ্কেও পাওয়া যাবে।”

নিউরোলজিস্ট জিমো এবং তার দল একটি অজ্ঞান করা ইঁদুরের হৃদক্রিয়া ৩০ সেকেন্ডের জন্য বন্ধ করে মস্তিষ্কের ক্রিয়া দেখতে চেষ্টা করেন। দেখা যায়, ঐ সময়ে মস্তিষ্কের কার্যাবলী হঠাৎ করেই বেড়ে যায় এবং সেটি মানুষের অতি সক্রিয় মস্তিষ্কের মতোই দেখায়। তাদের এই পর্যবেক্ষণ বিজ্ঞানে এক নতুন অধ্যায়ের সূত্রপাত ঘটায়। এই গবেষণা থেকে এই সিদ্ধান্তে আসা যায় যে, ‘ক্লিনিক্যালি ডেড’ বলতে সারা শরীরে রক্ত সরবরাহ বন্ধ হওয়াকে বোঝায়। মস্তিষ্ক তখনো এর কার্যাবলী চালিয়ে যায় এবং ধীরে ধীরে থেমে যায়।

গবেষকগণ আরও বলেন যে, “এই গবেষণার মাধ্যমে আরও জানা যায় হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে গেলে যখন মস্তিষ্কে অক্সিজেন বা অক্সিজেন এবং গ্লুকোজের সরবরাহ কমে যেতে থাকে, তখন মস্তিষ্ক আরও বেশি কার্যকর হয়ে ওঠে এবং সচেতনতা প্রক্রিয়া চলতে থাকে এখান থেকে।”

স্টোনি ব্রুক বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক স্যাম প্যারিনা সম্পূর্ণ মৃত্যু এবং মৃত্যুর পূর্বমুহূর্ত নিয়ে ২০১৪ সালে পৃথিবীর সর্ববৃহৎ গবেষণা পরিচালনা করেন। অস্ট্রেলিয়া, আমেরিকা এবং যুক্তরাজ্যের হৃদক্রিয়া বন্ধ হওয়া বা হার্ট অ্যাটাকের ১০১ জন রোগীর সাক্ষাৎকার নেন তিনি। তাদের মধ্য ৪৬% রোগীই তাদের মৃত্যুর সাথে লড়াই করে যাওয়া, একটি আলোর বিন্দু দেখা এবং ভয়ের অনুভূতির কথা স্মৃতিচারণ করতে পেরেছেন। প্যারিনা বলেন, “হৃদক্রিয়া বন্ধের তিন মিনিট পরেও আমাদের সচেতনতা কাজ করে।”

তবে এই গবেষকই পরবর্তীতে আবার বলেন যে, রোগীদের এই ধরনের ব্যাখ্যা খুব সম্ভবত তাদের বিভ্রম। এই বিভ্রমের উৎস হতে পারে শারীরিক যন্ত্রণা থেকে সৃষ্ট স্নায়বিক প্রতিক্রিয়া।

এমনও আরও বহু গবেষণা হয়েছে এবং হচ্ছে। যেমন ২০০১ সালে নেদারল্যান্ডের গবেষকগণ ৩৪৪ জন হার্ট অ্যাটাকের রোগীর মধ্যে ৪১ জনকে পেয়েছেন যারা হৃদক্রিয়া বন্ধের পরবর্তী সময়ের স্মৃতিচারণ করতে পেরেছেন। আবার ২০০৩ সালে একই রকম একটি গবেষণা করেছেন ভার্জিনিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকগণ।

আরও চাঞ্চল্যকর একটি গবেষণার ফলাফল

২০১৭ সালে কানাডিয়ান ইন্টেনসিভ কেয়ার ইউনিট চারজন রোগীর উপর গবেষণা চালিয়ে এক চাঞ্চল্যকর তথ্য উদঘাটন করেছেন। লাইফ-সাপোর্টে থাকা ৪ জন রোগীর লাইফ সাপোর্ট বন্ধের পর মস্তিষ্কের কার্যাবলী দেখা হয়েছে। একজন রোগীর ক্ষেত্রে দেখা গিয়েছে, তার মৃত্যুর ১০ মিনিট পরেও মস্তিষ্কে স্নায়বিক তরঙ্গ সৃষ্টি হয়েছে।

ডাক্তার রোগীকে মৃত ঘোষণা করার ১০ মিনিট পরেও স্নায়বিক তরঙ্গ কাজ করে, যা অনেকটা আমাদের ঘুমন্ত অবস্থার মতোই। তবে একেকজনের ক্ষেত্রে তা একেক রকম। গবেষণায় প্রত্যেক রোগীর ক্ষেত্রে মৃত্যুর আগে এবং পরে ইইজি (ইলেক্ট্রো-এনসেফালোগ্রাম) এর মাধ্যমে মস্তিষ্কের বৈদ্যুতিক কার্যাবলী পর্যবেক্ষণ করা হয়েছিল। ইইজি রিপোর্টে মৃত্যুর ৩০ মিনিট আগের এবং ৫ মিনিট পরের মধ্যে উল্লেখযোগ্য পার্থক্য দেখা গিয়েছে। তিনজন রোগীর ক্ষেত্রে না হলেও চতুর্থ রোগীর ক্ষেত্রে হৃদক্রিয়া বন্ধের ১০ মিনিট পরেও মস্তিষ্কের কার্যাবলী চালু ছিল। তবে এক্ষেত্রে আরও গভীর গবেষণা প্রয়োজন।

মৃত্যুর কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে প্রাপ্ত ইইজি রিপোর্ট; source: popsci.com

বিজ্ঞানীগণ এখন বলছেন, মৃত্যুপথে কী অভিজ্ঞতা হচ্ছে, সেই বিষয়টি জানার চেয়ে সেটির কী প্রভাব পড়ছে সেটি গুরুত্বপূর্ণ। কেননা, দেখা গিয়েছে যে মৃত্যু থেকে ফিরে আসা রোগীরা মৃত্যুকে আর তেমন ভয় পান না, প্রতিদিনকার যে উদ্বিগ্নতা, সেটিও স্তিমিত হয়ে পড়ে। এর পরিবর্তে তাদের ভেতরে অন্যের প্রতি নিঃশর্ত মনোযোগ কাজ করে।

সারকথা

হৃদস্পন্দন বন্ধ হয়ে যাওয়া মানে সম্পূর্ণ মৃত্যু নয়। পরিপাকতন্ত্র এবং শ্বসনতন্ত্রের কাজ বন্ধ হয়ে গেলেও হৃদস্পন্দন বন্ধের ১০ মিনিট পরে আমাদের মস্তিষ্ক কাজ করে। ধারণা করা হচ্ছে, দেহের এই অংশটির মৃত্যু ঘটে সবার শেষে। ধীরে ধীরে মস্তিষ্কে অক্সিজেন প্রবাহ বন্ধ হয়ে গেলে মস্তিষ্কের কোষগুলো মারা যেতে থাকে। মৃত ঘোষণার পরেও ২-২০ সেকেন্ড পর্যন্ত সচেতনতা কাজ করতে থাকে। এই সময় মস্তিষ্কে বৈদ্যুতিক তরঙ্গের চলাচল হঠাৎ করেই বেড়ে যায়, যা ইইজি রিপোর্ট থেকে জানা গিয়েছে। কারণ অক্সিজেন ছাড়াও মস্তিষ্কের সেরেব্রাল করটেক্স কাজ করতে পারে। যদিও এর কারণ জানা যায়নি।

হৃৎস্পন্দন বন্ধ হয়ে যাবার পরেও শরীরের ভেতর কিছুটা অক্সিজেন থেকে যায়। তাই লাইফ সাপোর্টে  থাকা রোগীর ক্ষেত্রে বুকে জোরে চাপ দেয়া বা পাম্প করা হয়, যেন দেহের ঐ অক্সিজেনটুকু দ্রুত মস্তিষ্কে পৌঁছে মস্তিষ্ককে সজাগ রাখে। যদি তা সম্ভব না হয় তাহলে ধীরে ধীরে মস্তিষ্কের কোষগুলো মরে যেতে শুরু করে। তবে শেষ পর্যন্ত মস্তিষ্কের একটি অংশ বেঁচে থাকে- স্মৃতিকেন্দ্র। এখানে বেঁচে থাকাকালীন যত সুখময় স্মৃতি, ভালবাসার মুহূর্ত, প্রিয়জনের সাথে কাটানো কিছু আনন্দময় সময় এমনই স্মৃতিগুলো জমা থাকে। তাই মৃত ব্যক্তিটি বা মারাত্মকভাবে আহত ব্যক্তির ক্ষেত্রেও স্মৃতিকেন্দ্র বন্ধ হবার আগমুহূর্তে প্রিয়জনের মুখগুলো, আনন্দের সময়গুলো মনে পড়তে থাকে। হয়তো মনে পড়ে আরও অনেক কিছু। অর্থাৎ মৃত্যুর সময় সকলকেই কিছু বিশেষ সময়ের মধ্য দিয়ে যেতে হয়, যার ব্যখ্যা এখনো কেউ দিতে পারেননি। হয়তো এখন পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্যগুলোর কোনোটির ব্যাখ্যাই সঠিক নয়!

লাইফ সাপোর্টে থাকা রোগীর ক্ষেত্রে বুকে জোরে চাপ দেয়া বা পাম্প করা হয় যেন দেহের ঐ অক্সিজেনটুকু দ্রুত মস্তিষ্কে পৌঁছে মস্তিষ্ককে সজাগ রাখে; source: nihr.ac.uk

মৃত্যুর ২ দিন পরেও দেহের প্রায় ২,০০০ জিন কাজ করে চলে, যা গবেষণায় পাওয়া গিয়েছে। এমন তথ্যও পাওয়া গিয়েছে যে, মৃত্যুর পরে দেহের কোষ থেকে খুবই দ্রুতগতিতে ক্যান্সার কোষের সৃষ্টি হচ্ছে। কিন্তু কেন? এ প্রশ্নের উত্তর এখনো জানা।

তাহলে কি পোস্টমর্টেম করার সময় খুব সাবধানে করা উচিত নয়? কতক্ষণ পর তাহলে করা উচিত? এসব জানতে প্রয়োজন আরও আরও গবেষণা।

ফিচার ইমেজ- younusalgohor.org

Related Articles